উপন্যাস       :         প্রেমাতাল
লেখিকা        :         মৌরি মরিয়ম
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল    :         
রচনাকাল     :         ১০ নভেম্বর, ২০২২ ইং

লেখিকা মৌরি মরিয়মের “প্রেমাতাল” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে লেখা শুরু করেছেন।
প্রেমাতাল || মৌরি মরিয়ম
প্রেমাতাল || মৌরি মরিয়ম Ebook



৩৯ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

প্রেমাতাল || মৌরি মরিয়ম (পর্ব - ৪০)

সকাল সকাল গাড়ি ছুটে চলেছে গোয়াইনঘাটের পথে। শহর ছেড়েছে অনেকক্ষণ। গোয়াইনঘাট থেকে নৌকায় করে যাবে বিছনাকান্দি। মুগ্ধ ড্রাইভ করতে করতে বলল,

-"একটা সুপুরুষ ছেলের সাথে কিস করতে করতে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে আমি আগে জানতাম না। তাও আবার দাঁড়ানো অবস্থায়!"

তিতির মন খারাপ করে বলল,

-"আর কত পচাবে?"

-"আজীবন পচাব, আজীবন খোঁটা দিব। কি করে পারলা ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়তে? আর তারপর এত ডাকলাম উঠলেই না।"

-"কখনোই এত ডাকোনি। হয়তো একটা ডাক দিয়েছো, আমি উঠিনি তাই আর ডাকোনি।"

-"আজ্ঞে না ম্যাম, আমি আপনাকে কম হলেও / বার ডেকেছি।"

-"ইশ না।"

-"এখন এই কথা বললে একটা গাড্ডা দিব মাথার মধ্যে।"

-"সরি।"

-"এখন সরি বলে কি হবে? রাত থাকবো তার মধ্যে একটা চলেই গেল।"

-"আমি কি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি বলো?"

-"কি জানি!"

-"মানে কি? তুমি ভাবছো আমি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি?"

তিতিরের অপরাধবোধ দেখে মুগ্ধর খুব মজা লাগছিল। ওকে আরো তাতানোর জন্য বলল,

-"হতেও পারে।"

-"নাহ, বিশ্বাস করো। কখন ঘুমিয়েছি টেরই পাইনি।"

-"ভাল করেছ।"

-"আমি সত্যি সরি। আমাকে মাফ করে দাও।"

মুগ্ধ অভিমানী কন্ঠে বলল,

-"এখন এগুলো বলে লাভ নেই। সারারাত আমার একা একা অনেক কষ্ট হয়েছে। ঘুমই আসছিল না। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি।"

তিতির নিজের কান ধরে বলল,

-"এই দেখো কান ধরছি। এবার তো মাফ করো।"

মুগ্ধ ভাব ধরে বলল,

-"ঠিকাছে ঠিকাছে। কান ধরতে হবে না।"

-"আমি আজ রাতে এক মিনিটের জন্য ঘুমাবো না।"

-"এহ, জোকস অফ দ্যা ইয়ার।"

-"সত্যি।"

মুগ্ধ এবার হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-"তোহ, সারারাত জেগে কি করবে?"

তিতির এবার লজ্জা পেল। কিন্তু ওর কথার অর্থ না বোঝার ভান করে বলল,

-"কি আর করবো? যা করি তাই করবো! ওই মানে গল্পগুজব আর কি! আর ঘুমালে তুমি ঘুমানোর পর ঘুমাবো।"

মুগ্ধ এতক্ষণ পর হেসে দিল। তিতিরের বুকের ভার নেমে গেল। বুঝতে পারলো মুগ্ধ আসলে রাগ করেনি দুষ্টুমি করছিল। কিন্তু রাগ করার মতই একটা ঘটনা ঘটেছে। গতরাতে কিস করতে করতেই কি করে যে ঘুমিয়ে পড়লো। ইশ এত সফটলি আদর করছিল মুগ্ধ, আরামেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। দোষ কি তাহলে ওর? তিতির যখন এসব ভাবছিল মুগ্ধ তখন বলল,

-"দেখা যাবে বাসর রাতেও তুমি নাক ডেকে ঘুমাবে। আর আমি বসে বসে মশা মারবো।"

একথায় তিতির চমকে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও খেয়াল হলো, যেখানে ওদের বিয়েই হবে না সেখানে এসব কি নিয়ে ভাবছে মুগ্ধ! দুজনেই চুপ হয়ে গেল। কেউ এই বিষয়ে আর কোন কথা বলল না।

দুপাশে জমি মাঝখানে রাস্তা। জমির কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারনে পানি উঠে গেছে। হঠাৎ গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"কি হলো?"

-"তরমুজ খাব।"

তিতিরের নজরে পড়লো রাস্তা দিয়ে একটা তরমুজের ভ্যান যাচ্ছে। মুগ্ধ নেমে দুটো তরমুজ কিনে আনলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,

-"তোমার না তরমুজ প্রিয়?"

-"হুম। তোমারও তো প্রিয়।"

-"সেজন্যই নিলাম।"

-"হ্যা কিন্তু কেটে আনলে না কেন? কাটবো কি করে?"

-"তরমুজ আবার কাটা লাগে নাকি?"

-"তো খাব কি করে?"

-"যখন খাব তখনই দেখো।"

কিছুদূর গিয়ে মুগ্ধ একটা কালভারটের সামনে গাড়ি থামালো। তারপর তিতিরকে বললো,

-"নামো।"

তিতির নামলো। মুগ্ধ একটা তরমুজ নিয়ে নামলো। তারপর কালভারটের পাথুরে ফুটপাতের সাথে বারি দিতেই তরমুজটা ফেটে গেল। আরেকবার বারি দিতেই তরমুজটা ভেঙে কয়েকটা অসমান টুকরা হয়ে গেল। তিতির হেসে দিল।

তিতির পড়ে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার আর শার্ট। মুগ্ধ পড়ে ছিল হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা যখন ভাঙা তরমুজ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিল লোকজন যেতে যেতে হা করে দেখছিল। তিতির বলল,

-"উম্মম্মম্মম্ম, তরমুজটা অন্নেক মিষ্টি।"

-"হুম। কালো তরমুজগুলো মিষ্টিই হয়।"

-"এই, দেখো এরকমভাবে তরমুজ খেয়ে আমার হাতমুখ পুরো মেখে গেছে।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,

-"হাসছো কেন?"

-"এমনি।"

-"এমনি না, এমন দুষ্টুমার্কা হাসি তুমি তখনই দাও যখন তোমার মাথায় কোনো দুষ্টুমি ঘুরতে থাকে।"

মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করেই বলল,

-"আচ্ছ, তারাতারি খেয়ে শেষ করো। রওনা হতে হবে।"

-"বলো না কেন হাসলে?"

-"পরে বলছি বাবা। একটু পরে বলি?"

-"আচ্ছা।"

তরমুজ খাওয়া শেষ হতেই আবার দুজনে গাড়িতে উঠলো। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিল। তিতির বলল,

-"ইশ তরমুজের রস লেগে মুখ, গাল আর হাতগুলো কেমন আঠা আঠা মিষ্টি মিষ্টি হয়ে আছে! তোমারও এমন হয়েছে?"

-"কই না তো। দেখো তুমি।"

-"আসলেই তোমার এরকম হলো না কেন?"

-"আমি কি তোমার মত হালুম হুলুম করে খেয়েছি নাকি?"

-"ইশ, আমি বলে হালুম হুলুম করে খেয়েছি? তুমি এটা বলতে পারলে?"

মুগ্ধ হাসতে লাগলো। তিতির বলল,

-"আচ্ছা যাও আমি হালুম হুলুম করেই খেয়েছি। খুশি? এবার আমার ব্যাগ থেকে একটু পানিটা বের করে দাও। হাতমুখ ধোব।"

গাড়ি থামালো মুগ্ধ। বলল,

-"দেখি কেমন মিষ্টি মিষ্টি হয়েছে?"

একথা বলেই মুগ্ধ আচমকা তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। তারপর বলল,

-"তোমার ঠোঁট এম্নিতেই অনেক মিষ্টি। তরমুজের রস তার কাছে তুচ্ছ।"

তিতির লজ্জা পেয়ে লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,

-"এটা করবো ভেবেই তখন হেসেছিলাম।"

তিতির আর কিছু বলল না।

গোয়াইনঘাট থেকে ওরা একটা নৌকা নিল। সাথে জুটে গেল ছোট্ট একটা গাইড। বয়স ১৩/১৪ হবে। নৌকা চলতে শুরু করতেই মুগ্ধ তার সাথে আর মাঝির সাথে গল্প জুড়ে দিল। তিতির খেয়াল করলো নদীর চারপাশটা বড্ড সুন্দর। সবুজ আর সবুজ। নদীর পানিটাও কি সুন্দর। দূরের পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুগ্ধ মাঝিকে বলল,

-"মামা, আগে পান্থুমাই চলো। ওদিকটা ঘুরে বিছনাকান্দি যাবা।"

মাঝি মাথা নাড়লো।

দূর থেকেই প্রথমবার যখন পান্থুমাই ঝরনা দেখতে পেল তিতির দুইহাত নিজের গালে রেখে চিৎকার করে উঠলো,

-"ওয়াও, এটা কি দেখতে পাচ্ছি আমি?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"এটাই পান্থুমাই ঝরনা।"

-"এত সুন্দর কিভাবে? উফফফ।"

নৌকা আরো যত কাছে যেতে লাগলো ঝরনার পানি পড়ার শব্দ আরো কাছে আসতে লাগলো। বিশাল বিশাল সবুজ গাছে ভরা দুই পাহাড়ের মাঝখানে সুন্দরী ললনার মত কোমর বাঁকিয়ে আছে পান্থুমাই। একসময় নৌকাটা থামিয়ে দিল মাঝি। তিতির বলল,

-"মামা, থামালেন কেন এখন? যান না। আমি ওই ঝরনার নিচটায় যাব।"

মাঝি কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,

-"প্রথমত, ওই ঝরনার নিচে গেলে স্রোত নৌকা উলটে দেবে। দ্বিতীয়ত, ওই ঝরনাটা ইন্ডিয়াতে।"

-"মানে কি এত সুন্দর একটা ঝরনা কিনা ইন্ডিয়াতে? অথচ এত কাছে! ধ্যাত শুধু দেখতেই পারলাম। ছুতে পারলাম না।"

-"হুম, যদিও ঝরনাটা আমাদের দেশে না কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা তাও ঝরনাটা দেখতে পারি। অথচ ওটা ইন্ডিয়াতে হওয়া স্বত্তেও ইন্ডিয়ানরা দেখতে পারে না। দেখতে হলে ওদের ভিসা নিয়ে এপাড়ে আসতে হবে। নাহলে ওই ব্রিজটা দিয়ে কোথাও যেতে হবে।"

তিতির ব্রিজটা দেখলো। একদম ঝরনার সামনে দিয়ে একটা ব্রিজ এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলে গেছে। তারপর বলল।

-"ওদের ঝরনা ওরা কেন দেখতে পারবে না?"

-"কারন ঝরনাটা একদম সীমান্তে, এবং পুরোটাই আমাদের দেশে মুখ করা।"

-"ইয়েস! একদম ঠিক হয়েছে।"

এতক্ষণে ঝরনার কাছে যেতে না পারার আফসোস কাটলো তিতিরের।

মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে চলল বিছনাকান্দির পথে। নদীটি মোটেও গভীর না। কাছাকাছি যেতেই নৌকা এক যায়গায় আটকে গেল। যায়গাটা বোধহয় একটু উঁচু। গাইড রাজু আর মুগ্ধ নামলো নৌকায় ধাক্কা দিয়ে যায়গাটা পার করার জন্য। নামতেই দেখলো ওখানে হাটু সমান পানি। তিতির মুগ্ধকে বলল,

-"আমিও নামবো।"

মুগ্ধ বলল,

-"নামবে? নামো।"

তিতিরও নেমে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই পানি ছিটকে এসে খানিকটা ভিজিয়ে দিল ওদেরকে। তিতিরের খুব আনন্দ হলো। হাসতে লাগলো, ওকে এভাবে হাসতে দেখে মুগ্ধরও ভাল লাগলো। নৌকা যখন আবার একা একা চলতে শুরু করলো মুগ্ধ বলল,

-"এবার ওঠো তিতির।"

-"না আমি উঠবো না। নৌকা ধরে ধরে পানির মধ্যে হাটবো।"

মাঝি বলল,

-"আপু সামনে তো অনেক পানি। হাটতে পারবেন না ওখানে।"

মুগ্ধ কথা না বাড়িয়ে তিতিরকে কোলে উঠিয়ে নৌকায় তুলে দিল। তারপর নিজেও উঠলো। তিতির রাগী রাগী মুখ করে মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়লো। তবে সেলিব্রেটিদের মত হাত দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে নয় শুধুই ঠোঁটের ইশারায়। তারপর তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিল।

এই যায়গাটায় নদী থেকে পাথর উঠানো হয়। পাথর উঠিয়ে নদীর পারে একের পর এক রেখে রেখে পাথরের পিরামিড বানিয়ে ফেলেছে কতগুলো।

তিতির সেই পাথরের পিরামিড গুলোই দেখছিল। আর দেখছিল বিছনাকান্দির পাহাড়। না পৌঁছালেও পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দুপাশে পাহাড়, মাঝখানে ফাঁকা। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো দুপাশের পাহাড় একদম সমান উচ্চতার। আল্লাহ বুঝি গজফিতা দিয়ে মেপে মেপে বানিয়েছেন। তিতির ভেবেছিল দূর থেকে পাহাড়গুলোকে নীল মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছে পাহড়গুলো আসলেই নীল রঙের। পাহাড়ের নীচের দিকটা গাঢ় নীল, উপরটা হালকা নীল। মুগ্ধ বলল,

-"তিতির, এদিকে তাকাও.. পানিটা দেখো।"

তিতির তাকাতেই দেখতে পেল পানিটা স্পষ্ট দুই রঙের। একপাশে নদীর পানি যেমন হয় হালকা সবুজ ভাব, আরেকপাশে স্বচ্ছ নীল পানি। পানির নিচের বালু, ছোট ছোট মাছ, শৈবাল সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিতির এক্সাইটমেন্টে মুগ্ধর হাত চেপে ধরে বলল,

-"এটা কি করে সম্ভব?"

-"সবই আল্লাহর সৃষ্টি।"

-"উফফ এত সুন্দর পানি।"

তিতির নীলপানি গুলো হাতে করে উঠালো। হাতের মধ্যেও পানিগুলো নীলই দেখালো। তিতির মুগ্ধকে বলল,

-"দেখো, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আকাশের রিফ্লেকশান বুঝি। কিন্তু পানিগুলো আসলেই নীল।"

-"নীলই তো। এখানে সবই নীল। এখনি বুঝবে না। পৌঁছে নিই তখন বুঝতে পারবে।"

বিছনাকান্দি পৌঁছেই তিতিরের চোখে নীলের নেশা ধরে গেল। আকাশ নীল, পাহাড় নীল, পানি নীল। নীলের যে কতরকম শেড হতে পারে তা বিছনাকান্দি এলেই দেখা যাবে। ওরা নৌকা থেকে যেখানে নেমেছে তার একটু সামনে থেকেই পাথর শুরু। ছোট বড় অসংখ্য পাথর। সামনেই ভারতীয় সীমান্ত, ওপাশে শিলং। শিলং থেকে বয়ে আসা নদীটিই সেই নীল পানির উৎস। অজস্র পাথরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটি। এখানে নদীতে হাটুসমান পানি। তার নিচে পাথর। যেখানে ওরা নৌকা থেকে নেমেছে সেখানে গিয়ে নদী গভীর হয়েছে। নীল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল তিতির! নিজের অবচেতন মনেই একটার পর একটা পাথর লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে নেমে যাচ্ছিল পানিতে। মুগ্ধ মাঝির ফোন নাম্বার নিচ্ছিল যাওয়ার সময় যোগাযোগ করার জন্য। নাম্বার নিয়ে তাকাতেই দেখে তিতির অনকদূর নেমে গেছে। মুগ্ধ দৌড়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে গিয়ে গিয়ে ভেজা পিচ্ছিল পাথরে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলল। রেগে গিয়ে বলল,

-"তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি তো আল্লাহর রহমতে কম না, তাহলে মাঝে মাঝে এমন গাধামি কেন করো?"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"আমি কি করলাম?"

-"আমি ফোন নাম্বারটা নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না? একা একা নামছিলে কেন? সাহস ভাল কিন্তু এত সাহস তো ভাল না।"

-"ইশ, সরি। তুমি যে আসছিলে না খেয়ালই করিনি। আমি তো ভেবেছি তুমি সাথেই আছো।"

-"খেয়াল করবেনা কেন?"

-"আরে এত সৌন্দর্য দেখে আমার তো মাথাই ঠিক নেই, পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাগ করোনা প্লিজ।"

-"ড্যাম ইওর রাগ। জানো পাথরগুলো কতটা পিচ্ছিল? পিছলে পড়ে গেলে শুধু ব্যাথাই পাবে তা না স্রোতের সাথে ভেসে হারিয়ে যাবে নদীর মধ্যে।"

-"আমি তো সাঁতার জানি।"

-"হেহ! সাঁতার জানে। স্রোতের ভয়াবহতার ব্যাপারে কোন আইডিয়া আছে?"

তিতির প্রায় কান্না করে দিচ্ছিল। চোখে পানি ছিল না কিন্তু গলাটা কেঁপে উঠলো যখন বলল,

-"সরি আর এরকম করবো না।"

মুগ্ধর বুকটাও সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। বলল,

-"আরে আরে কাঁদছ নাকি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই একটু কড়া কথা বলে ফেলেছি।"

তিতির সামলে নিল। বলল,

-"না, ঠিকাছে।"

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তারপর পানির মধ্যে নামতে নামতে বলল,

-"বকেছি তো পরে বেশি আদর করে পুষিয়ে দেব। মন খারাপ করোনা প্লিজ। তুমি যদি পা পিছলে পড়ে যেতে? ব্যাথা পেতে না বলো? পাথরের সাথে ঘষা খেয়ে তোমার এই সুন্দর সুন্দর পা গুলো ছিলে যেত না?"

-"তুমি আমার পা দেখেছো কিভাবে?"

-"কেন তুমি যখন যখন থ্রি-কোয়ার্টার পড়েছো তখন তখনই তো দেখেছি।"

-"যখন যখন বলতে? আমি তো ট্যুরে যাওয়া ছাড়া পড়িনা।"

-"ওইতো, নাফাখুম ট্রিপে দেখেছি। আজ দেখেছি।"

-"মানে কি? এখন নাহয় বুঝলাম দেখেছো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড, তাকাতেই পারো! কিন্তু নাফাখুম ট্রিপে তো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না, তখন কেন দেখেছো?"

মুগ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

-"না মানে, এত সুন্দর জিনিস দেখে কি চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় বলো? তাছাড়া আমি ততদিনে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। আকর্ষণ টা একটু বেশিই ছিল। তোমার সবকিছুতে নজর দিতাম।"

তিতির চোখ বড় বড় করে বলল,

-"সবকিছু বলতে?"

ততক্ষণে ওরা পানিতে নেমে গিয়েছে। তিতিরকে পানির নিচে পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,

-"না না, নেগেটিভলি নিও না। মানে আমি তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। একদিন তোমার পেটও দেখে ফেলেছিলাম।"

তিতিরের চোখগুলো এবার বেড়িয়ে আসতে চাইলো। বলল,

-"নাফাখুম ট্রিপে?"

-"হুম।"

-"কিভাবে?"

-"ওইযে যেদিন আমরা রেমাক্রি পৌঁছেছিলাম তুমি গোসল করে বাইরে এসে কাপড় মেলে দিচ্ছিলে তখন তোমার টপসটা উঠে গিয়ে পেট বের হয়ে গিয়েছিল।"

-"তার মানে তো এক্সিডেন্টলি বের হয়ে গেছিল। আর তুমি কিনা হা করে দেখছিলে?"

-"না বাবা, আমি একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।"

-"কে জানে!"

-"কিন্তু তারপর অনেকদিন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠতো সেই দৃশ্য, উফফফ!"

তিতির ওর বুকে একটা কিল দিয়ে বলল,

-"যাহ, অসভ্য একটা।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আচ্ছা শোনো না, যখন তোমাকে কোলে তুলে হাটছিলাম তখন আশেপাশের মানুষগুলো তাকিয়ে ছিল।"

-"হুম, খেয়াল করেছি আমি। দেখুক গিয়ে।"

-"তুমি খুব এনজয় করো না? মানুষ যখন হা করে দেখে আমাদের?"

-"করি তো। খুব প্রাউড ফিল করি আমি।"

মুগ্ধ হাসলো।

কথা বলতে বলতেই মুগ্ধ পানিতে শুয়ে পড়লো। কিন্তু একটা হাত দিয়ে তিতিরকে ধরে রেখেছিল। তিতির বলল,

-"এই এত স্রোতের মধ্যে তুমি শুয়ে পড়লে যে? আমার ভয় লাগছে।"

মুগ্ধর পুরো শরীর পানির নিচে। মাথাটা পানি থেকে উঠিয়ে বলল,

-"কিছু হবে না, প্রটেকশন আছে। ওই দেখো পা একটা পাথরে আটকে রেখেছি।"

-"প্লিজ ওঠো তুমি। আমার ভয় করছে কারন, আমার বসে থাকতেই প্রব্লেম হচ্ছে। তুমি ধরে না রাখলে স্রোতের তোরে কবেই ভেসে যেতাম।"

-"তুমি আমাকে নিয়ে নাফাখুমের মত ভয়ঙ্কর যায়গায়ও ভয় পাওনি আর এখানে ভয় পাচ্ছো?"

-"ওখানে তো সেফটি বেল্ট ছিল।"

-"এখানেও পা ঠেকানো ওই পাথরটা সেফটি।"

-"উফ তিতির তুমি না!"

উঠে বসলো মুগ্ধ। তারপর বলল,

-"আমি তোমাকে ধরে রেখেছি, তুমি একটু শোও।"

-"এত মানুষের মধ্যে আমি শোবো?"

-"এত মানুষ কোথায় পেলে? বিছনাকান্দিতে অনেক মানুষ হয়। এখন তো মানুষ নেই বললেই চলে।"

-"তবু, যেকয়জন আছে তারা আমার অপরিচিত।"

-"বাপরে, বিছনাকান্দির বিছনায় না শুয়ে গেলে অনেক বড় কিছু মিস করবে। কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে নেই বাবা। একা থাকলে হয়তো তাকাতো, কিন্তু এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আছে সাথে। ওরা তো বুঝে তাকালে চোখ গেলে দেব।"

তিতির একটা হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লো পানির মধ্যে। মুগ্ধ হাত ধরে থেকে বলল,

-"পুরো শরীর পানির নিচে ডুবিয়ে দাও। শুধু মাথাটা পাথরটার উপরে রাখো তাহলে কানে পানি যাবেনা।"

তিতির তাই করলো। মুগ্ধ বলল,

-"আরে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? চোখ বন্ধ করে রাখো।"

তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ আবার বলল,

-"হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দাও পাখির মত তাতে পানির মধ্যে শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারবে।"

তিতির তাই করলো। তারপর মুগ্ধ ওকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিতেই তিতির তাকিয়ে বলল,

-"আমি পারবো ব্যালেন্স রাখতে কিন্তু তুমি ধরে থাকো ভাল লাগে।"

-"না তিতির। কিছু কিছু জিনিস ফিল করতে একা হওয়া প্রয়োজন। এখানে কোন মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে ফিল করা যায় এমন কিছু ফিল করাতাম তোমাকে। যেহেতু মানুষজন আছে তাই একটা কথাও না বলে যেভাবে বললাম ওভাবেই থাকো কিছুক্ষণ। আমি পাশেই আছি।"

তিতির আর কথা বলল না। মুগ্ধ যেভাবে বলল সেভাবেই শুয়ে রইলো। কোনো অজানা পাহাড়ের অজানা ঝরনার গা বেয়ে নেমে আসা হিমশীতল পানি তিতিরের সারা অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এভাবে ছোঁয়ার জন্য আবার শাস্তি দেবে না তো মুগ্ধ? একথা ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠলো তিতির। আস্তে আস্তে টের পেল নদীর কলকল ধ্ধনিতে মুখরিত চারপাশ। শব্দটা যেন ওর বুকের ভেতর হচ্ছে, আসলে তা তো না। কিন্তু শব্দটা পানির মধ্যে আর স্রোতের পানিগুলো কানের এত কাছে যে অন্য কোনো শব্দ আর কানে আসছে না। শব্দটা আস্তে আস্তে কেমন যেন করুন শোনালো। কিন্তু এত অসাধারণ যে কোনো ওস্তাদের বাজানো সানতুর, সেতার বা সারদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হলো না। কখন যে তিতিরের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে মিশে গেল সে পিয়াইন নদীর নীল জলে তা কেউ জানলো না।

একসময় মুগ্ধ বলল,

-"এবার চোখ দুটো খুলে আকাশের দিকে তাকাও।"

তিতির তাকাতেই অন্যরকম এক অনুভূতি রইলো। একটু আগের সব অনুভূতি তো রইলোউ সাথে আরো যোগ হলো খোলা নীল আকাশের সৌন্দর্য। এবার মনে হতে লাগলো এমন কোনো অচেনা জগতে আছে যেখানে একই সাথে পাখির মত আকাশে ওড়া যায় আবার জলকন্যার মত পানিতে সাঁতারও কাটা যায়।

কয়েক ঘন্টা পানিতে থাকার পর যখন ওরা পানি থেকে উঠলো হঠাৎই বৃষ্টি নামলো, ব্যাপক বৃষ্টি। তিতির চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছিল। কিন্তু মুগ্ধর প্রচন্ড ক্ষুদা লেগেছে। দুপুর পেড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে, সেই সকালে খেয়ে বেড়িয়েছে। পথে আসতে আসতে হাবিজাবি খেয়েছে,

-"তিতির, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে একটা জিনিস।"

তিতির চোখ খুলে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"কি?"

-"ভাত খেয়ে পানিতে নামা উচিৎ ছিল। স্রোত ছিল যে অনেক, স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে পানিতে থাকায় এনার্জি শেষ।"

-"আহারে! তো খেয়েই নামতে।"

-"খেয়াল ছিল না, তাছাড়া তখন তো আর ক্ষিদেও ছিল না।"

-"ও।"

-"তোমার ক্ষিদে পায়নি?"

-"বুঝতে পারছি না। আসলে আমি এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছি না।"

-"স্বাভাবিক, প্রথমবার এমনই হয়। কিন্তু আমার তো ভাত খাওয়ার জন্য জানটা বের হয়ে যাচ্ছে।"

-"ইশ।"

ততক্ষণে মাঝি আর রাজু ওদের দেখতে পেয়ে চলে এসেছে। তিতির ওদের জিজ্ঞেস করলো,

-"ওই দোকানটাতে ভাত পাওয়া যায়?"

রাজু বলল,

-"না আফু, চিপস, কেক, বিস্কুট আছে।"

মুগ্ধ বলল

-"ভাত হাদারপাড় ছাড়া পাওয়া যাবে না না?"

-"না।"

তিতির বললো,

-"হাদারপাড় গিয়ে খাই তাহলে।"

মুগ্ধ বলল,

-"আমার লাশ যাবে তাহলে। কারন, ওইটা অনেক দূর।"

-"ধুর, তোমার যত আজেবাজে কথা।"

তিতির দোকানে চলে গেল।"

মুগ্ধ বলল,

-"আরে আরে, কোথায় যাও?"

-"তোমার লাশ হওয়া ফেরাতে।"

দোকানে গিয়ে বলল,

-"ভাই, এখানে ভাত পাওয়া যাবে?"

দোকানদার বলল,

-"না।"

-"চাল পাওয়া যাবে?"

মুগ্ধ ততক্ষণে দোকানের সামনে চলে এল। বলল,

-"আরে পাগল এটা কি চালের দোকান?"

দোকানদার বলল,

-"এইখানে চাল নাই।"

তিতির বলল,

-"প্লিজ কিছু চাল বিক্রি করুন, যেভাবেই হোক। আমার স্বামী ক্ষুধার জালায় মারা যাচ্ছে।"

তিতিরের কথায় মাঝি আর রাজু হেসে দিল। মুগ্ধ আর দোকানদার হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,

-"প্লিজ ভাত নাহলে চাল কিছু একটার ব্যবস্থা করুন।"

দোকানদার কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,

-"এই আমার ক্ষিদে নেই, চলো। অযথা বিরক্ত করছো ওনাকে, থাকলে তো দিতোই।"

মুগ্ধ জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল তিতিরকে। পেছন থেকে দোকানদার ডাকলো,

-" ভাই দাঁড়ান।"

ওরা দাঁড়ালো। দোকানদার বলল,

-"আমার বউ খুদের ভাত পাডাইছিল। আমি আর আমার ভাই খাওয়ার পরও আছে। খাইবেন?"

তিতিরের মুখে বিশ্ব জয় করার হাসি ফুটে উঠলো। মুগ্ধ কিছু বলার আগেই লাফিয়ে পড়ে বলল,

-"হ্যা খাবে, খুদের ভাত তো ওর খুব প্রিয়।"

মুগ্ধর মনে পড়ছে না খুদের ভাত কবে ওর প্রিয় ছিল।

দোকানদার উঁচু উঁচু করে বেড়ে একপ্লেট খুদের ভাত দিতেই তিতির মুগ্ধর হাতে দিয়ে বলল,

-"এই নাও খাও।"

আরেকপ্লেট যখন দিতে নিল, তিতির বলল,

-"না না আর লাগবে না। আমি খাব না। ওর জন্যই চাইছিলাম।"

মুগ্ধ এখনো খাওয়া শুরু করছেনা দেখে দোকানের দাওয়ায় বসে তিতির হাত ধুয়ে নিজেই খাইয়ে দিল। মুখে দিয়ে মুগ্ধর মনে হলো অমৃত খাচ্ছে। শুধু ক্ষুদার জন্য না। রান্নাটাও ছিল চমৎকার। বোম্বাই মরিচ দিয়ে রান্না করেছে বোধয়। ঘ্রাণেই অর্ধেক পেট ভরে গেল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা শরীরে বিয়ে না করা বউ কিংবা বউয়ের থেকেও বেশি এমন মানুষটার হাতে তারই ভালবাসা দিয়ে জোগাড় করা খাবার খেতে খেতে মুগ্ধর বুকের ভেতর আবেগের তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মেয়ে হলে হয়তো এতক্ষণে কেঁদেই ফেলতো। নাইবা পেল ওকে সারাজীবনের সহধর্মিণী হিসেবে, যা পেয়েছে ওর কাছ থেকে এমনকি এখনো পাচ্ছে তা অনেকে ভালবেসে সার্থক হয়ে বিয়ে করা বউয়ের কাছ থেকেও এর একশোভাগের এক ভাগ পায়না। মুগ্ধ বলল,

-"শুধু আমাকে দিচ্ছো কেন? এতটা কি আমি একা খেতে পারবো?"

-"হ্যা পারবে।"

-"না পারবো না, তুমিও খাও। আর এটা অনেক টেস্টি। না খেলে মিস করবে।"

-"উফ তুমি খাও তো।"

-"তুমি না খেলে আমিও খাব না।

অগত্যা তিতিরও খেল মুগ্ধর সাথে। খাওয়া শেষ হতেই তিতির দোকানদারকে বলল,

-"ভাই আপনার নাম কি?"

-"সুরুজ আলী।"

-"সুরুজ ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার এই ঋণ কোনদিনও শোধ করতে পারবো না। আপনি জানেন না আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন।"

সুরুজ আলী কোন অজানা কারনে লজ্জা পেল। বলল,

-"না না আপা কি যে বলেন।"

মুগ্ধ বলল,

-"সুরুজ ভাই, আমি জানি আপনি এটা বিক্রি করেন না। আপনার স্ত্রী যত্ন করে আপনার জন্য রান্না করে পাঠিয়েছে। তবু আমরা ক্ষুদার সময় খেয়েছি। আপনি যদি দামটা রাখেন আমি খুব খুশি হব।"

সুরুজ আলী বলল,

-"না না, ভাইজান আমি টাকা রাখতে পারমু না। এটা তো আমার ব্যবসার জিনিস না। আর বাড়তিই ছিল।"

-"তবু ভাই, রাখেন। আর লজ্জা দিয়েন না। এমনিতেই আমার বউ অনেক লজ্জায় ফেলেছে।"

সুরুজ আলী টাকা রাখতে চাচ্ছিল না। মুগ্ধ জোর করে তার হাতের মুঠোও টাকা গুঁজে দিল। তিতির বলল,

-"সুরুজ ভাই, আজ থেকে আপনি আমার ভাই। আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আপনার বাড়িতে বেড়াতে আসব। ভাবীকে বলবেন এরকম খুদের ভাত রান্না করতে। এটা পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবার।"

সুরুজ আলী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। লোকটি বোধহয় খুব আবেগী। কারন, তিতিরের কথায় তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বলল,

-"অবশ্যই আসবেন আপা।"

নৌকার কাছে যেতে যেতে তিতির বলল,

-"আমি তোমাকে লজ্জায় ফেলেছি না?"

মুগ্ধ একহাতে ওকে বুকে ধরে হাটতে হাটতে বলল,

-"এত ভালবাসিস কেন রে পাগলী?"

তিতির আহ্লাদে আটখান হয়ে গেল। মুগ্ধ আবার বলল,

-"আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবে, না?"

-"যেটা বাস্তবে কখনো হবার নয় সেটা যদি কল্পনাতে ভেবে সুখ পাওয়া যায় তাতে দোষের কি?"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। তিতির চোখ বন্ধ করে তা সাদরে গ্রহন করলো। তারপর বলল,

-"আচ্ছা, তখন যে বলেছিলে মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে উপভোগ করা যায় এমন কিছু করতে। সেটা কি?"

-"তোমাকে একবার আমার বুকে, আরেকবার পিঠে নিয়ে সাঁতার কাটতাম।"

-"সিরিয়াসলি?"

-"হ্যা।"

-"পারবে তুমি?"

-"কেন পারবো না? তোমার ওজন কত ৫০?"

-"না, ৪৮।"

-"আর আমার ৮০, ভরসা হয়না? তাছাড়া পিউকে পিঠে নিয়ে সাঁতরাতে পারলে তোমাকে নিতে পারবো না? তোমরা তো অলমোস্ট সেম। ওর ওজন হয়তো তোমার থেকে সামান্য বেশি।"

-"তাহলে প্লিজ চলো... এখন তো মানুষজন একদম নেই বললেই চলে।"

মুগ্ধ হাসতে লাগলো।

বৃষ্টি, ব্যাপক বৃষ্টি! ঝুমবৃষ্টি... নদীর নীল পানিতে বৃষ্টির ইয়া বড় বড় ফোঁটা পড়ছে, আর শামুকের শেপ তৈরি হচ্ছে পানিতে। তার মধ্যে উলটা সাঁতার দিচ্ছে মুগ্ধ। মুগ্ধর বুকের উপর ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে তিতির। যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিল মুগ্ধ ততটা হচ্ছে না। কারন, তিতিরও পা দিয়ে সাঁতরাচ্ছে মুগ্ধর বুকের উপর শুয়ে। দুজনই একসাথে পা দিয়ে পানিগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে সাঁতার কাটছে আর পাগলের মত হাসছে। হাসির শব্দ ফাঁকা যায়গায় বার বার বাজছে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন মিলিয়ে যাচ্ছে তখন বড্ড করুণ শোনাচ্ছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা ওদের। ওরা আজ ভাসছে। আজ ওরা মানুষ নয়। ওরা জলমানব আর জলমানবী।

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৪১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা মৌরি মরিয়ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হবে। 

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন