উপন্যাস        :        দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা        :         তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
Bangla Golpo দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা

২৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ২৭)


(ক)

নিশীথের বাপ-দাদা বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০টার মতোন বেজে গেলো। আসমা বেগম খাবার না খেয়ে উনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি নিশীথকেও না খাইয়ে রেখেছিলেন সবাই একসাথে খাওয়ার জন্য! তো, আয়মান তালুকদার তথা নিশীথের বাবা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই আসমা বেগম স্বামীর নিকট গিয়ে বললেন,
-বলছিলাম, খাবার টেবিলে দেবো? রাত তো অনেক হয়ে গেছে!
-আমরা খেয়ে এসেছি বাহিরে থেকে।
আয়মান সাহেব জবাব দিলেন। আসমা কিছুটা অবাক হলেন। বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে তবে তাকে জানালোনা কেন? উনি বিস্ময় না ঢেকেই প্রশ্ন করলেন,
-আপনারা খেয়ে আসবেন আমায় ফোন দিয়ে জানালেন না কেন? আমি তো আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম!
-ওহ প্লিজ, আসমা। বাবা ডায়াবেটিস এর পেশেন্ট, ইনসুলিন করেই সময়মতো তাকে খেতে হয়। এটা কি তুমি জানোনা? ওখানে যখন দেখছিলাম আমাদের আসতে টাইম লাগবে তখনি ডিনার সেড়ে ফেলেছি। এটা আবার ফোন দিয়ে বলার কি আছে? এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার!
বিরক্তির সহিত জবাব দিলেন আয়মান সাহেব। উনার কথা শুনে আসমা বেগমের মুখটা ছোট হয়ে এলো। যার জন্য করলেন চুরি, সে-ই বললো চোর!
অতএব, আর কথা না বাড়িয়ে নিশীথকে খে'তে ডাকার উদ্দেশ্যে তিনি রুম ত্যাগ করছিলেন৷ এমন সময় পেছন থেকে আয়মান সাহেব বললেন,
-তোমার ছেলে কখন বাড়ি ফিরেছে? মা একা ছিলো বাসায়, আজকে অন্তত জলদি ফেরার কথা যদি আমি ভুল না হই!
-৮ টার দিকে এসেছে।
ছোট্ট করে জবাব দিলেন আসমা। আয়মান সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে কথা শুনালেন,
-মায়ের জন্য ঠিকই ৮টায় ফেরা যায়। অথচ বাপ বাসায় থাকলে তো ঘুমোনোর আগে ছাড়া বাড়ির ত্রিসীমানায় পাওয়া যায়না লাটসাহেবকে!
বরাবরের ন্যায় এ কথাটাও আসমা হজম করে নিলেন। নিশীথকে ডাকার পর সে আসতে বেশিক্ষণ লাগালোনা। সে পারতপক্ষে অন্য ধান্ধায় আছে, তাই জলদি ডিনার সেড়ে একবারে রুমে চলে যাবে। তাই ও মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ডাইনিং টেবিলে আসে। মা-কে একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি একা বসে আছো কেন, মা? বাকিরা কই? দাদু খেয়েছে?
-আব্বার খাওয়ার টাইম পার হয়ে যাচ্ছিলো তাই উনারা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন।
-সেকি? তাহলে আমরা এতক্ষণ ওয়েট করলাম কেন? আমি আরও ভাবলাম খেতে বসে দাদুর খোজখবর নিবো এখন দেখছি এই কাহিনি। ওরা তোমায় একটা ফোন দিয়ে জানালেই তো পারতো। আজব!
-বাদ দে! তুই খেয়ে নে চুপচাপ।
-তুমি খাবেনা?
-ক্ষিধে নেই। তোকে খেতে বললাম না? খাওয়ার সময় এত কথা বলছিস কেন?
ছেলেকে ধমকে উঠেন আসমা বেগম। নিশীথ কিছু বলতে গিয়েও বলেনা, নিরবে বুঝে যায় মায়ের অভিমান। বাবা-মায়ের মধ্যে চলা মনমালিন্য নিঃসন্দেহে একজন সন্তানের জন্য ভীষণ কষ্টের। নিশীথের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলোনা। বরং, অন্তরে পুষে রাখা জন্মদাতার প্রতি চাপা ক্ষো'ভ আরও খানিকটা বৃদ্ধি পেলো। ও চুপচাপ মায়ের মুখের কাছে খাবারের নলা ধরলো উনি খাবেন সে আশায়, কিন্তু আজ বোধহয় আসমা বেগমের অভিমান একটু বেশিই। তাকে কঠোর হতে দেখা গেলো। ছেলের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ওর নিকটই ফিরিয়ে দিলেন। হতাশাময় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশীথ কোনোমতে খাওয়া শেষ করলো। নিজ রুমে যাওয়ার আগে দাদুর কাছে গিয়ে উনার খোজখবর নিতে ভুললোনা!
________________
দোলা ব্যাপক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কারণ, মা সত্যি সত্যি নিশীথের সাথে দেখা করতে চাইছে। দোলা প্রথমে ভেবেছিলো উনি সৌজন্যতার জন্য এমনটা বললেন বোধহয়। কিন্তু পারভীন বেগম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,
-এসব বিষয়ে আমি ইয়ার্কি-ঠাট্টা করিনা। প্রত্যেকটা মানুষের উচিত উপকারির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সেখানে একি এলাকায় থেকেও যদি ছেলেটার সাথে একদিন কথা না বলি, বিষয়টা কত বাজে দেখায়! আর তোর তো কোনো আক্কেলই নাই দেখছি৷ কেন রে? একটাবার অন্তত মুখের কথা বলতে পারলিনা ওকে বাসায় আসার জন্য?
খানিকটা থেমে কিছু একটা ভেবে বললেন,
-আচ্ছা, বাজার আছেই বাসায়। শিমুল অনেকদিন ধরে পোলাও খাওয়ার বায়না করছিলো, কালকে তো রান্না করবোই। নিশীথকে কাল দুপুরেই ডাকিস। এক রান্নায় মিটে যাবে!
মায়ের এত পরিকল্পনা দেখে দোলা রোবটের ন্যায় চেয়ে থাকে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
-তুমি যদি জানতে তুমি কাকে বাসায় ডেকে আনতে চাইছো, তবে নিজেও এ কথা মুখে আনতেনা, মা!
পারভীন বেগম শুনতে না পেয়ে শুধালেন,
-কি বলছিস?
-ক,কই? কিছুই না!
-আচ্ছা, তাহলে ঘুমাতে যা! রাত হয়ে গেছে!
ব্যস! এরপর থেকেই নিজের রুমে এসে দোলা নিজের সাথে মনে মনে তর্ক করছে, কিভাবে নিশীথকে বাসায় আসতে বলবে এ বিষয়ে? দোলার মনে ভয় হচ্ছে। নিশীথ তো ঠোঁট'কাটা, স্ট্রেইটকাট কথা বলতে ভালোবাসে। বাসায় এসে যদি সুযোগবুঝে ও মা-কে প্রস্তাব দেয়? তবে কতটা লজ্জাজনক ব্যাপার হবে!
নিশীথের সাথে বিয়ের কথা ভাবতেই দোলার গাল গরম হতে লাগলো। তবে মেয়েটা বুঝলোনা আজ নিশীথের কথা মনে হতেই ও এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? ভ্রুযুগল কুচকে দোলা কাপাকাপা হাতে ফোন হাতে নিলো। বিকালে নিশীথের মেসেজের কোনো রিপ্লাই এখনো দেওয়া হয়নি। এখন রাত ১০.৩০ এর মতো বাজে! এ সময় মেসেজ দেওয়াটা ভালো দেখাবে কি? পরক্ষণেই ভাবলো, মেসেজ দেওয়া উচিত। সরাসরি না বল্লেও অন্তত ফোনে ধন্যবাদ জানানো উচিত ছেলেটাকে। মা ঠিকই বলেছে, ওর মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ কম। তাই নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাশে রেখে একবুক সাহস সঞ্চার করে দোলা টাইপ করলো। দুরুদুরু বুকে মেসেজ সেন্ড করে নিশীথের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলো!
____________________
দাদুর সাথে কথাবার্তা শেষে ভালো মেজাজে নিশীথ রুমে ফিরলো। দরজা লাগিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে বালিশের পাশ হতে ফোনটা হাতে নিতেই ওর অক্ষিদ্বয় বড় হয়ে এলো! মিনিট দশেক হবে দোলা মেসেজ দিয়েছে। ছোট্ট একটা বার্তায় "থ্যাংক ইউ আজকের জন্য" লিখে পাঠিয়েছে মেয়েটা। নিশীথ ইষত হাসলো। যাক! ওর দোলনচাঁপার একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে তবে! অতঃপর, মেসেজের জবাব হিসেবে আর কিছু লিখে না পাঠিয়ে ও সরাসরি কল দিলো।
দোলা মাত্রই ফোন রেখে শুয়ে পড়েছিলো। চোখ বুঝার সেকেন্ড খানেকের মাঝেই আচমকা ফোন বেজে উঠায় চমকে উঠে ও। এ সময় কে কল করছে ভাবতেই চোখে পড়লো নিশীথের নাম। ধরবে কিনা ভাবতে ভাবতে দোলা শেষমেশ ধরেই ফেললো কল। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো,
-কিসের জন্য থ্যাংকস দিলে?
-ওইতো আজকে হেল্প করলেন যে, সেজন্য।
-তোমার আমাকে কখনোই ধন্যবাদ দিতে হবেনা, দোলনচাঁপা। তোমার দিকে আসা সমস্ত বিপদ যেন আমায় আগে অতিক্রম করুক, এটাই আমি দোয়া করি সবসময়।
নিশীথের সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি দোলাকে বিমোহিত করে, ওর অন্তরে নাড়া দেয়। মেয়েটা খেয়াল করে, ওর গাল আবারো গরম হতে শুরু করেছে। দোলার মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবা বলতেন, "তোর উপর আসা সব বিপদকে আগে আমাকে অতিক্রম করতে হবে, দোলনচাঁপা"
বাবার এ কথা শুনে প্রতিবার দোলার চোখ জ্বলজ্বল করতো আর বাবাকে নিজের সুপারহিরো মনে হতো। সেই মানুষটা নেই আজ অনেক বছর হতে চললো। প্রতিদিন বাবার কথা মনে পড়লেও সচারচর কারও মাধ্যমে ওর বাবার কথা মনে পড়েনা। কিন্তু নিশীথের ক্ষেত্রে যেন এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
দোলা অস্বীকার করতে পারেনা এ ছেলেটার কথায়, ওর প্রতি নিশীথের আচরণে কিছু একটা আছে যা দোলাকে ওর বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেটা খুব কম মানুষই পেরেছে। বাবার মতো পরিপূর্ণভাবে ওকে "দোলনচাঁপা" ডাকাই হোক, কিংবা ওর প্রতি নিশীথের সুস্পষ্ট রক্ষণশীলতাই হোক না কেন। নিশীথের ব্যক্তিত্বে কিছু একটা তো আছে, যেটা দোলা চাইলেও হাজার চেষ্টা করে উপেক্ষা করতে পারেনা!
নিজ ভাবনায় বিভোর দোলা সম্ভ্রম ফিরে পায় ফোনের ওপাশ থেকে বেশ অনেকবার "হ্যালো, হ্যালো" শব্দ আসায়। সাড়া না পেয়ে নিশীথ ওকে ডেকেই চলেছে নিজের মতোন। দোলা ঠোঁট টিপে হাসে। প্রসঙ্গ পাল্টে সিরিয়াস ভাবে বলে,
-আপনাকে একটা দরকারি কথা বলার ছিলো
-শুনছি, বলো
-উম, মা আপনাকে বাসায় ডাকছে। কাল দুপুরে আসতে পারবেন ক..
-তুমি আন্টিকে আমার কথা বলে দিয়েছো? ওহ মাই গড! শাশুড়ী মা কি রাজি? কাল আমাদের বিয়ের কথা বলার জন্য...
-আল্লাহ! থামুন আপনি! কিসব ভাবছেন একা একাই?
নিশীথের কথায় লাগাম টেনে দোলা থামিয়ে দেয়। এই ছেলে দিবাস্বপ্ন দেখতে পটু। মিনিট খানেকের মাঝে কত কি না ভেবে নিলো একা একাই?
-এমন কিছুই নয়। মা এসব কিছুই জানেন না। ওনি স্রেফ আপনাকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছে। আর আমায় বলেছে আপনাকে জানাতে। যদি সময় হয়, কাল দুপুরে আমাদের বাসায় আসবেন। মা খুশি হবেন।
-আর তুমি? তুমি খুশি হবেনা, দোলনচাঁপা?
দোলা জবাব দিলোনা এবারো। নিশীথ জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, যা ফোনের এপাশ থেকে কর্ণগোচর হলো দোলার। ও হঠাৎ বললো,
-আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট ছিলো...
-তোমার মা-কে আমাদের ব্যাপারে কিছু না বলতে, তাই তো?
-জি। ঠিক বুঝেছেন। আশা করছি আমার অনুরোধের মান রাখবেন।
এবার নিশীথ জবাব দিলোনা। উলটো, খুট করে ফোন কেটে দিলো দোলার মুখের উপর! ও চমকালো, ছেলেটা কি খুব বেশি রেগে গেলো নাকি? কপাল কুচকে দোলা ভাবলো, এত রাগ কেন নিশীথের? কিন্তু ও আর ফিরতি কল করলোনা। মনে মনে ভাবলো, কাল আসুক আগে। তখন যা হবার দেখা যাবে!

(খ)
কথায় আছে, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। ঠিক তেমনি, দুশ্চরিত্র লোকেরাও সহজে ভালো হয়না। উদাহরণস্বরুপ, রাকিবের কথাই বলা যাক! গতকাল রাকিবের থেকে নিশীথের থেকে অপমানিত হওয়ার পর ওর মনে অনুশোচনাবোধ জন্মানো তো দূরের কথা, বরং দোলার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে বেড়ে গেলো! কোথায় সে নিজের পাপচিন্তার কথা বাদ দিয়ে শুধরে যাবে তা নয়, উল্টো সন্ধ্যেবেলা ও বাড়ি ফিরেই চোখমুখ কালো করবার অভিনয় করে মায়ের নিকট এগিয়ে গেলো।
শায়লা বেগম তখন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভিতে তার প্রিয় সিরিয়াল দেখছিলেন। এমন সময় ছেলেকে বাসায় আসতে দেখে তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
—কিরে, চলে আসলি? দোলার সাথে কথাবার্তা হলো?
মায়ের কথার জবাব না দিয়ে রাকিব থমথমে মুখে চেয়ে রয়। শায়লা বেগম ছেলের আঁধারে ঢাকা মুখপানে চেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। বুঝে যান কিছু একটা তো হয়েছে। তাই আপাতত পছন্দের সিরিয়াল দেখার মায়া ত্যাগ করে টিভি বন্ধ করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। রাকিবের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
---কি হয়েছে, বাবা? ভালো করে বল নয়তো বুঝবো কি করে? আর চেহারার এই হাল বানিয়েছিস কেন? ও আবারো রিজে'ক্ট করেছে তোকে?
---মা! তোমায় মানা করেছি না? তবু বারবার রিজে'ক্ট এর কথা মনে করিয়ে দাও কেন?
---আচ্ছা আর বলবোনা। কিন্তু ওই মেয়েটার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা! ফোনে এত শুনানোর পরেও ও তোকে মানা করার দুঃসাহস পাবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওর মা তো ঠিকি মাথা নত করে রাখে আমাদের সামনে। অথচ মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলোনা ঠিকমতো, চরম বেয়াদব হয়েছে একটা! আমার সোনার টুকরো ছেলেকে রিজেক্ট করে?
এরপর খানিকটা থেমে শায়লা একা একাই বিড়বিড়িয়ে বললেন,
---ও কি রিজেক্ট করবে তোকে? আরে আমরাই তো নেহাৎ ভালোমানুষি দেখিয়ে এত বড় বাড়ির মেয়েদের প্রস্তাব ছেড়ে ওর মতো মেয়েকে বিয়ে করাইতে চাইছিলাম! এখন ওদের আসল অবস্থান দেখাতে হবে। আমি এখনি পারভীনকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি আমরাই দোলাকে রিজেক্ট করলাম! আমার ছেলেকে অপমান করা হচ্ছে তাইনা? আমিও তবে দেখাবো এবার!
মায়ের কথাবার্তা শুনে রাকিব বাকা হাসে। মা ব্যাপক ক্ষে'পেছে৷ অর্থাৎ লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ের বাড়ি মারতে হবে। তাই ও আর সময় বিলম্ব না করে উদাসীন চেহারা বানিয়ে করুণ মুখে বললো,
---ও যে শুধু বেয়াদব তাই নয়, মা। মেয়েটা খুব খারাপ। উপর দিয়ে সহজ-সরল হওয়ার নাটক করে অথচ তলে তলে রা'স'লীলা করে বেড়ায়!
---মানে? কিসব বলছিস?
---আরেহ দোলার কথাই বলছি। ওকে দেখলে মনে হয়না কেমন ছিমছাম ছাপোষা মেয়ে? অথচ মাথাভর্তি চিকন বুদ্ধি! আমি গেলাম ওর সাথে বোঝাপড়া করে আমাদের সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য তাইনা? এটা কি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো?
শায়লা বেগম নেতিবাচক মাথা নাড়ান। এটা মোটেও খারাপ কিছু নয়, বরং রাকিব যখন বললো ও দোলাকে সত্যিই পছন্দ করে তখনই তিনি নিজ থেকে ওকে ফোন করে ছেলের সাথে একবার কথা বলতে পাঠিয়েছেন, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে নতুন একটা সুযোগ দেওয়ার চেস্টা করতেই তো এসব করা। অথচ এখন তার ছেলে এসব কি বলছে!
---কি হয়েছে ভালো করে বলতো, রাকিব। আমি কিন্তু তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা। দোলা আবার চালাকির কি করলো? কিছু হয়েছে কি রেস্টুরেন্টে?
মায়ের উদ্বিগ্নতায় রাকিব মনে মনে হাসে। যেভাবে ভেবেছিলো সবকিছু সেদিকেই যাচ্ছে। তাই আর দেরি না করে ও আগেকার ন্যায় বলতে লাগে,
---বলছি তোমাদের ভাইজি একা যায়নি ওখানে। বরং সাথে নিজের প্রেমিককেও নিয়ে গিয়েছিলো। সেই ছেলে তো আবার গু'ন্ডা টাইপের। এলাকার মাস্তা'ন বোধহয়, বুঝোনা? আমাকে থ্রে'ট দিলো দোলার থেকে দূরে থাকতে। ওর আশেপাশে আমায় দেখলেও নাকি আমায় জা'নে মে'রে ফেলবে!
ছেলের কথায় শায়লা বেগম বেশ অবাক হন। দোলার মতোন মেয়ের আবার প্রেমিকও আছে? তাও সে ছেলে নাকি গু'ন্ডা-মা'স্তান? সুতরাং, কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি তিনি ছেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
---কি বলছিস এসব! তুই সত্যি বলছিস তো?
রাকিব বিরক্ত হয়। এত কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথাগুলো বললো অথচ ওর নিজের মা কিনা ওকে বিশ্বাস না করে এখন এমন বেহুদা প্রশ্ন করছে?
---মিথ্যা বলবো কেন? তোমার কি আমার উপর বিশ্বাস নেই? নাকি দোলার বাহ্যিক সরল রুপ দেখে তুমিও ওকে অন্ধবিশ্বাস করো আর সবার মতোন?
---না, তা বলছিনা। তবে ওকে দেখে আসলেই মনে হয়না ও এরকম প্রেম-ট্রেম করতে পারে। তাও ওর মতো সাদাসিধা কোনো ছেলের কথা বললে না হয় মানতে পারতাম। কিন্তু ডাইরেক্ট গু'ন্ডার সাথে প্রেম করছে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে ক'ষ্ট হচ্ছে!
---থাক আর কষ্ট করে বিশ্বাস করতে হবেনা। তুমি না হয় সরাসরি প্রমাণ দেখেই বিশ্বাস করো! এই দ্যাখো, আমার গলায় হালকা লাল আং'গুলের ছাপ দেখছো? ওটা দোলার প্রেমিকের হাতের ছাপ! আমায় ওয়া'র্নিং দেওয়ার সময় গলা চে'পে ধরেছিলো!
শায়লা বেগম বিস্ময় চেপে ছেলের নিকট এগিয়ে আসেন। রাকিব শার্টের বোতাম খুলে গলার দিকে ফাকা করে, ড্রয়িংরুমের ঝলমলে আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর গলায় আংগুলের ছা'পগুলো। এবার শায়লার রাকিবের কথা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে কোনোপ্রকার অসুবিধা হয়না! বরং, নিজ ছেলের প্রতি দোলার এহেন আচরণ ওর প্রতি ঘৃণায় উনার অন্তর বি'ষিয়ে দিলো। শায়লা হিস'হিসিয়ে বললেন,
---যে মেয়েকে নিয়ে এত বড় বড় কথা ওদের মায়ের, সেই মেয়ে যে ওর আড়ালে এসব করে বেড়াচ্ছে তা কি পারভীন জানে? ওদিকে, তোর বাপের আজকেই সিলেট যাওয়া লাগলো! বাসায় থাকলে তো তাকেও শুনাতাম তার আদরের ভাতিজির কু'কর্ম। ওদের দুই ভাই-বোনের মুখটা দেখার মতো হতো!
রাকিব কুটিল হাসে। তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দেয়,
---জানলে কি আর অত গর্ব করতে পারতো? তার চেয়ে তুমি এক কাজ করো। বাবাকে পরে জানানো যাবে। তার চেয়ে তুমি বরং ফুপিকেই নিজ দায়িত্বে জানিয়ে দাও তার মেয়ের কীর্তিকালাপ সম্পর্কে!
রাকিবের কথায় শায়লা বেগম কিছু একটা ভাবলেন। উনার অন্তরে হিং'সা ও ক্রো'ধের আ'গুন জ্ব'লছে ক্রমশ। তিনি সহজে এই মা-মেয়েকে ছাড়ছেন না!
_____________________
পরদিন দুপুর। দোলার মা একে একে খাবার রেডি করছেন টেবিলে। দোলা রান্নায় সাহায্য করায় আপাতত ও গোসল সেড়ে এসে বসে আছে। কামিনি মায়ের সাহায্য করছে খাবার টেবিলে রাখায়। নিশীথকে তো আসতে বলেছে কিন্তু ও আদৌ আসবে কিনা দোলা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। বস্তুত, কাল রাতে যেভাবে রাগ করে ফোন কে'টে দিলো তাতে দোলার মন বিচলিত হয়ে আছে।
পুরো বাড়ি হরেক রকম ভোজনের সুবাসে মৌ মৌ করছে। এর মাঝে শিমুলও গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলো। ওর মাথায় এখনো টাওয়াল ঝুলছে। বুঝাই যাচ্ছে, খাবারের সুগন্ধেই ও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে এখানে। শিমুল চেয়ারে বসার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বললো,
---ওয়াও! কত্তদিন পর পোলাও। আজ অবশেষে পেটভরে খাবো!
কিন্তু ও চেয়ারে বসার আগেই ওকে বাধা দিলো কামিনি। টাওয়াল সরিয়ে ওর কান মলে দিয়ে বলল,
---তাই না? আজ পেটভরে খাবি আর অন্যদিন বোধহয় না খেয়ে থাকিস তুই?
---উফফ, আপু। কান ছাড়ো লাগছে! মা, দেখো তো!
শিমুল প্রতিবাদ করে উঠলো। পারভীন বেগম ছেলেমেয়ের খুনসুটি দেখে হাসলেন। দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
---তোরা থাম এখন। বাসায় মেহমান আসবে যেকোনো সময় আর তোরা কিনা ঝগড়া করছিস?
---মেহমান? শুধু নিশীথ ভাইয়াই তো আসবে!
শিমুল অবাক স্বরে শুধায়। পারভীন বেগম চোখ পাকিয়ে বলেন,
---তো ও কি মেহমান নয়? তুই আর তোর বোন না হয় চিনিস, আমাদের সাথে তো কোনোদিন দেখা হয়নি। সে হিসেবে তো ও মেহমানই হলো! আর নিশীথ আসার আগ পর্যন্ত কেউ খাবারের দিকে হাত বাড়াবিনা, মনে থাকে যেন!
শিমুল আর কথা বাড়ায় না। উদাস মুখে চুল মুছে বারান্দায় টাওয়াল নাড়তে চলে যায়। মূলত, সে বুঝতে পেরেছে নিশীথ না আসা অব্দি ওর কপালে খাবার জুটবেনা। এদিকে দোলার ফোনে টুং করে মেসেজ এলো। চকিত দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই ও দেখলো নিশীথ বার্তা পাঠিয়েছে।
"পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা হচ্ছে! তুমি রেডি তো?"
দোলার কি হলো ও জানেনা। আচমকা বক্ষপিঞ্জরে কাপন ধরলো, হার্টবিট বেড়ে গেলো মুহূর্তেই। কই! নিশীথের সাথে তো আগেও কত দেখা হয়েছে। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? এরই মাঝে শিমুল বারান্দা থেকে চলে এলো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
---নিশীথ ভাইকে মাত্রই নিচে দেখলাম, মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় আসবে!
পারভীন বেগম খুশি হলেন। মাথার কাপড় টেনে সোফায় বসে নিশীথের অপেক্ষা করতে লাগলেন। সকাল থেকেই শিমুলের মুখে ছেলেটার অনেক প্রশংসা শুনলেন তিনি। এদিকে দোলারও সাহায্য করেছে কালকে। ছেলেটাকে না দেখা অব্দি তিনিও শান্তি পাচ্ছিলেন না! এবার অপেক্ষা ঘুচলো তবে!
বাসার সকলে যখন নিশীথের জন্য অপেক্ষা করতে ব্যস্ত, এরই মাঝে কলিংবেল বেজে উঠলো জোরেশোরে। অর্থাৎ, অপেক্ষার প্রহর শেষ।
নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে নিশীথ এসে গেছে!

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন