গল্প                    :         নয় নাম্বার প্লাটফর্ম

গল্পকার             :         শাহাদাত রাসএল

গল্পগ্রন্থ              :         জীবন এক সুস্বাদু হেমলক

প্রকাশকাল        :       


ইউনিফর্ম ।। শাহাদাত রাসএল
ইউনিফর্ম ।। শাহাদাত রাসএল

ইউনিফর্ম ।। শাহাদাত রাসএল


তার পুরো নাম শেখ আব্দুর রহমান। যদিও রহমান মিয়া নামেই সবাই চেনে। একমাত্র তার মা'ই তাকে আব্দুর নামে ডাকতেন। এই কথাটা এখন আর রহমান মিয়ার মনে পড়েনা। কেননা রহমান মিয়ার মা মারা গেছেন আজকে থেকে ঠিক এক কুড়ি চার বছর আগে। আজ তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। দিনে দিনে রহমান মিয়ার বয়সও এখন তিন কুড়ির কাছাকাছি প্রায়। আজকে নামাজের সময় মায়ের জন্য বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছে রহমান মিয়া। অবশ্য মৃত বাবা মায়ের জন্য এর বেশি কিছু করার সামর্থ্য নেই রহমান মিয়ার। ইনকাম যা হয় তা নেহাত মন্দ না। কিন্তু নাতি সবুজের পেছনেই চলে যায় ইনকামের বড় অংশ। মেয়ের ঘরের নাতি। মেয়ে ফাহিমাকে বেশ আয়োজন করেই বিয়ে দিয়েছিলো রহমান মিয়া। পাত্রকে নগদ ত্রিশ হাজার টাকার সাথে ঘর সাজিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সাজানো ঘর রেখে বিয়ের দুই বছরের মাথায় আট মাসের ছেলে সবুজকে নিয়ে বাপের কাছে এসে উঠলো ফাহিমামেয়ে জামাই আরেকটা বিয়ে করে নারায়ণগঞ্জের দিকে থাকে বলে জেনেছে রহমান মিয়া। তারপর থেকে ফাহিমা আর সবুজ রহমান মিয়ার কাছেই আছে। এখন সবুজের বয়স আট বছর। মেয়ে চলে আসায় রহমান মিয়ার একটা লাভ হয়েছে যে সংসারটা আবার গোছানো একটা চেহারা পেয়েছে। স্ত্রী শামসুন্নাহার ধনুষ্টংকারে মারা যাবার পর থেকে ঘরটা ঠিক ঘরের মতো লাগতো না রহমান মিয়ার। অফিসের ডিউটি শেষ করে রহমান মিয়া চলে যেতো কাশেমের সিএনজি গ্যারেজে। গ্যারেজের পেছনের দিকে বসতো রহমান মিয়াদের তাসের আসর। তাস পিটিয়ে যখন ঘুমে চোখ লেগে আসতো তখন বিসমিল্লাহ হোটেলে ভাত খেয়ে ঘরে ফিরে সোজা ঘুম। রহমান মিয়ার কাছে ঘর বলতে ছিলো কেবল একটা ঘুমানোর জায়গা। কিন্তু ফাহিমা আসার পর থেকে ঘরটার প্রতি আগের টানটা আবার ফিরে এসেছে। আর নাতি সবুজও দাদা অন্তপ্রান। কিন্তু ছয়মাস বয়সে নিউমোনিয়ার ভুল চিকিৎসায় একটা পা বাঁকা হয়ে গেছে সবুজের৷ ডান পা'টা টেনে টেনে হাটে সবুজ। রহমান মিয়া সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা এখনো জারি রেখেছে একদিন সবুজের পা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে এই আশায়। 
তাই ইচ্ছে থাকার পরেও এবার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ পড়াতে পারেনি রহমান মিয়া। টাকা যে পকেটে একেবারেই নেই তেমন না। কিন্তু যা টাকা আছে তা দিয়ে পরশুদিনই সবুজের ইনজেকশন কিনতে হবে। তাই ও টাকায় হাত দিতে চায়নি রহমান মিয়া। 
        আসরের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হতে হতেই নামাজের টুপিটা মাথা থেকে খুলে সিকিউরিটি গার্ডের ক্যাপটা মাথায় পড়ে নেয় রহমান মিয়া। 
জমজম প্রোপার্টিস লিমিটেডের সিকিউরিটি ইনচার্জ রহমান মিয়া। চাকরি করার বয়স পেড়ুলেও নিজের সততা আর পরিশ্রমী মানসিকতার জন্য সিকিউরিটি সার্ভিসে এখনো তার চাকরিটা টিকে আছে সুনামের সাথেই। আগে একটা অফিসে পিয়নের চাকরি করতো। সেখান থেকে চাকরি চলে যাবার পর এই সিকিউরিটি সার্ভিসে জয়েন করেছে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর চাকরি করার পর সাধারণ সিকিউরিটি গার্ড থেকে পদন্নোতি পেয়ে গত বছর সিকিউরিটি ইনচার্জ হয়েছে। সিকিউরিটি ইনচার্জ হবার ব্যাপারটা রহমান মিয়ার কাছে খুব সম্মানের আর গর্বের। আগে সাদামাটা একটা ইউনিফর্ম পড়ে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে ডিউটি করতোএখনকার ইউনিফর্মটার কাধের উপর একটা মেডেল লাগানো আছে। আর ডিউটিকালিন বসার জন্য একটা নিজস্ব টেবিল আছে। এই প্রোপার্টিস প্রজেক্টে বর্তমানে আটাশজন সিকিউরিটি গার্ড কর্মরত আছে। আর এই আটাশ জনের প্রধান হচ্ছেন রহমান মিয়া। এই বিষয়টাই রহমান মিয়ার আনন্দের কারণ। মাঝেমাঝে ফাহিমা বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে প্রজেক্টে আসে। সাথে আসে সবুজও। রহমান মিয়ার পদোন্নতিটা ফাহিমাকেও গর্বিত করে। দুপুরে খাবার নিয়ে এলে অন্য সিকিউরিটি গার্ডরা ফাহিমাকে কিছুটা সমীহ করে। এটা ফাহিমার ভালো লাগে।

 
মসজিদ থেকে হাটতে হাটতে বড় রাস্তাটা পাড় হয়ে প্রোজেক্টের গেইটের দিকে হেঁটে আসে সে। রহমান মিয়াকে দূর থেকে আসতে দেখেই মেইন গেইটে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড বাদল একটু আড়ালে সরে যায়। তারপর হাতের সিগারেটে দ্রুত দুইটা টান দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর গেইটের সামনে এসে গেইট খুলে দেয় আর রহমান মিয়া টিনের চালা দেয়া তার বসার টেবিলে গিয়ে বসে। বাদল আর সাত্তার মেইন গেইটে ডিউটি করে। আর এরা যে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট খায় এটা রহমান মিয়া জানে। তাকে দেখলে ওরা সিগারেট লুকিয়ে ফেলে, কখনো রহমান মিয়ার সামনে সিগারেট জ্বালায় না এটা রহমান মিয়াকে তৃপ্তি দেয়। মুরব্বীদের সামনে এটুকু আদব মেনে চলা উচিত। 
বসে থাকতে থাকতে রহমান মিয়া অনেক কিছু ভাবে। ভাবতে ভাবতে বয়সী শরীরে ক্লান্তি নামে। আজকাল রহমান মিয়া আগের মতো দীর্ঘসময় কিছু ভাবতে পারেনা। ক্লান্তি লাগে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। শরীরের সাথে মনের এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। ইদানিং প্রেসারটাও যখন তখন ঝামেলা করছে। যদিও কখনো প্রেসারে জন্য ডাক্তারের কাছে যাবার পক্ষে না রহমান মিয়া। তার কথা শরীরের নাম মহাশয় যাহা সওয়াবে তাহাই সয়। বুকের ভেতরটা ধরফর করে। রহমান মিয়া টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে।
এমন সময় গেইটের কাছে গাড়ির হর্ন বাজে। টেবিল থেকে মাথা তুলে গেইটের দিকে তাকায় রহমান মিয়া। সত্তার দৌড়ে গিয়ে গেইট খুলে দেয়। একটা বালুর ট্রাক ভেতরে ঢোকে। সারাদিন প্রজেক্টের মালামাল আসতেই আছে। রহমান মিয়া বসে থেকেই হাক দেয়
        সাত্তার বালিগুলা কই রাখবো গিয়া দেখাইয়া দেও। দেইখো চলাচলের রাস্তায় যাতে বালু না ফেলে
        জ্বি ভাই যাইতাছি
সাত্তার ট্রাকের পেছনে উঠে যায়। ট্রাক ভেতরে চলে যায়। প্রজেক্টের আয়তন প্রায় এককিলোমিটার এলাকা নিয়ে। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় এপার্টমেন্ট প্রজেক্ট এটা। রহমান মিয়া একটা টালি খাতা বের করে এক ট্রাক বালুর হিসেবটা লিখে রাখে। তারপর আবার টেবিলে মাথা রাখে। 
টেবিলে মাথা রেখে কতোটা সময় কেটেছে সেটা বলতে পারবেনা রহমান মিয়া। 
প্রজেক্টের এজিএম হারুন সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার ডাকে রহমান মিয়ার ঘুম ভাঙে। তো হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ড্রাইভারের চোখে মুখে বিরক্তি 
        রহমান মিয়া এইডা কি ঘুমানোর সময়? স্যার গাড়িতে বসে আছে। হর্নের পর হর্ন দিতাছি কারো খবর নাই 
রহমান মিয়া একবার গেইটের দিকে তাকায় বাদল বা সত্তার কেউই গেইটে নেই৷ রহমান মিয়া দেরি না করে ছুটে গিয়ে গেইট খুলে দেয়। গেইট খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে হারুন সাহেবকে স্যালুট দেয়। ড্রাইভার গিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রজেক্টের ভেতর ঢুকে। গাড়ি যখন রহমান মিয়াকে ক্রস করে তখন জানালায় মাথা বের করে ধমক লাগায় হারুন সাহেব

 যাও আবার গিয়ে ঘুমাও যতোসব ইউজলেস গর্দভ...

রহমান মিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। হারুন সাহেবের গাড়ি চলে যবার পরেও অনেকটা সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রহমান মিয়া। এতো বছরের চাকরি জীবনে কাজে অবহেলার জন্য কখনো এভাবে অপমান হতে হয়নি তাকে। বাদল এসে সামনে দাঁড়াতেই বাদলের মুখের দিকে তাকায় রহমান মিয়া। একটা জোর ধমক দেবার জন্য মুখ খুলেও আবার মুখটা বন্ধ করে নেয় সে। তারপর ঘুরে আস্তে আস্তে পা ফেলে নিজের চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে বাদল নিচুস্বরে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চেষ্টা করে

এতো জোরে পেশাব লাগলো যে না গিয়া পারলাম না... সাত্তার সেইযে ট্রাকের লগে গেছে আর খবর নাই

রহমান মিয়া কোন উত্তর দেয়না।    

 

কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে আজিজ মিয়ার চায়ের দোকানে রোজ একবার ঢু দেয়। এককাপ চা খেয়ে তারপর বাড়ি যায়। আজকেও এসে আজিজ মিয়ার দোকানে বসে

আজিজ ভাই একটা চা দেও

কি হইলো মিয়া ? মনমরা লাগতাছে মনে হয় ?

না ক্লান্ত লাগে

হুম বড় পোষ্টে কাম করলে তো কামের খাটনিও বেশি

কথাটা শুনে একটু হাসিমুখেই আজিজ মিয়ার দিকে তাকায় রহমান মিয়া। বড় পোষ্টের কথাটা রহমান মিয়াকে তৃপ্তি দেয়।

হ ঠিকই কইছো। দেও চা দেও

রহমান মিয়ার মনের গুমোট ভাবটা কেটে যায়।

 

বিছানার উপর সবুজ বসে স্কুলের পড়া পড়ছে। পাশেই বসে আছে রহমান মিয়া। মাঝেমাঝে নাতিকে পড়ার ভুল শুধরে দিচ্ছে।

আচ্ছা নানা কও তো বড় হইয়া আমি হমু ?

        কি হইবি ? ডাক্তার নইলে ইঞ্জিনিয়ার

        না নানা আমি তোমার মতো গার্ড হমু

        আরেহ না তুই বড় অফিসার হবি

এমন সময় ঘরে এসে ঢোকে ফাহিমা। ছেলের কথা শুনে একটা ধমক দেয়

        সারাদিন আছে নানার মতো হইবো নানার মতো হইবো...

        মা দেখছো নানার ইউনিফর্মডা কি সোন্দর। মেডেল লাগাইন্না

সবুজের কথা শুনে রহমান মিয়া একবার আলনার পাশে ঝুলিয়ে রাখা ইউনিফর্মটার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোনে একফালি হাসি রোদের মতো আলো ফেলে

        ওই মেডেলডাই আমার এতো বছরের পরিশ্রমের পুরষ্কার রে নানা । তুইও বড় হইয়া এমন অনেক মেডেল পাবি। খালি সৎ থাইকা নিজের কাম কইরা যাইতে হইবো

        আব্বা হইছে এহন খাইতে বহো। কতক্ষন পরে আবার সবুজে না খাইয়া ঘুমাইয়া যাইবো

রহমান মিয়া সবুজকে বুকে জড়িয়ে ধরে

        চল নানা খাইয়া নিই হেরপর আবার গল্প করমু

 

 

সকাল বেলা প্রজেক্ট অফিসে যাচ্ছিলো রহমান মিয়া। বাইপাস সড়কের কাছাকাছি আসতেই অপরদিক থেকে দৌড়ে আসে সাত্তার

        রহমান ভাই জলদি আসো একটা ঝামেলা হইয়া গেছে

        কি হইছে ?

        গত রাইতে প্রোজেক্টের তিননাম্বার গেইট গোডাউন থিকা সিমেন্ট চুরি হইছে

        কি কস !

ম্যানেজার আইসা সকালে দেখছে । আমি শিফট চেঞ্জ কইরা ইউনিফর্ম রুমে গেছি পরে আমারে ডাইকা নিয়া কইলো। এখনি আর্জেন্ট মিটিং ডাকছে

        চল

 

 

এজিএম হারুন সাহেব বসে আছে একটা চেয়ারেপাশেই ম্যানেজার বসে আছে আরেকটা চেয়ারে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রহমান মিয়া। রহমান মিয়ার একটু পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সাত্তার বাদল সহ আরো জনা পনেরো সিকিউরিটি গার্ড। এতো সময় হারুন সাহেব আর ম্যানেজার মিলে যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়েছে সকল সিকিউরিটি গার্ডকে। সবাইকে শোনালেও সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে প্রধান লক্ষ্য ছিলো রহমান মিয়া। মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া প্রতিবাদের আর কোন ভাষা মাথায় আসলো না রহমান মিয়ার। রহমান মিয়ার চোখটা জ্বালা করে ওঠে। এমন সময় হারুন  সাহেব ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে

        এদেরকে বকা দিয়ে তো লাভ নেই। সিকিউরিটি ইনচার্জ যাকে বানিয়েছেন সেই তো সারাদিন ঘুমিয়ে থাকে। গতকাল আমি নিজেই দেখেছি। এসব বুড়া মানুষ দিয়ে কি কাজ হয় নাকি। যতোসব অকাজের ঢেঁকি

        জি স্যার দেখছি কি করা যায়

ম্যানেজারের কথা শুনে হারুন সাহেব যেনো কিছুটা বিরক্তই হলো

        আপনাকে আর দেখতে হবেনা। রহমান মিয়াকে ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ইয়াং কাউকে দিন

রহমান মিয়া নত মাথাটাকে সোজা করে হারুন সাহেবের দিকে তাকায়

        স্যার এইবারের মতো মাফ করে দেন। সামনে আর...

        কোন কথা শুনতে চাইনা

রহমান মিয়ার আকুতি খুব একটা ধোপে টেকেনা। সেদিনই তার গায়ে থেকে খুলে নেয়া হয় সিকিউরিটি ইনচার্জের মেডেল বসানো ইউনিফর্ম। আবার গায়ে চড়ে সাধারণ নিরাপত্তারক্ষীর ইউনিফর্ম । ড্রেস রুম থেকে বেড়িয়ে আসার সময় রহমান মিয়া অনেকটা নির্বাকভাবে কয়েক মুহুর্ত সিকিউরিটি ইনচার্জের ইউনিফর্মটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

পরদিন থেকেই নতুন সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেয় অল্প বয়সী জুনায়েদ। অভিজ্ঞতা না থাকলেও জুনায়েদের চোটপাট খুব। সাধারণ নিরাপত্তারক্ষীরা সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকে। একদিন তো রাগের মাথায় জুনায়েদ রহমান মিয়াকে মুখের উপর বলে দিলো

        ‘চাচা মিয়া আপনার মতো অকর্মা বুইড়াকে কাজে না রেখে একটা কুকুর পাললেও আরো ভালো সিকিউরিটি দিতো। আপনাকে বেতন দেয়াটাই কোম্পানির লস’ 

 

ফাহিমা বা সবুজ কেউই এখনো জানেনা রহমান মিয়ার পদপতনের কথা। বাড়ি ফিরলে সবুজ প্রায় দিনই নানাকে মেডেলওয়ালা ইউনিফর্মের কথা জিজ্ঞাস করেরহমান মিয়া ঘরের স্লিংয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়

        ওই মেডেলওয়ালা ইউনিফর্মটা পুরান হইয়া গেছে তো হের লাইগা কোম্পানি ফেরত নিয়া নিছে। কয়দিন পরেই আবার মেডেলওয়ালা নতুন ইউনিফর্ম দিবো

 

নাতিকে মিথ্যে বলে সান্তনা দিলেও নিজেকে সান্তনা দেবার মতো কোন মিথ্যে খুঁজে পায়না রহমান মিয়া। আজিজ মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় একদিন আজিজ মিয়া প্রশ্ন করেছিলো রহমান মিয়ার ইউনিফর্ম নিয়ে। তারপর থেকে ঘুরতি পথে প্রোজেক্টে গেলেও আজিজ মিয়ার দোকানকে এড়িয়ে যায় রহমান মিয়া। ইউনিফর্ম বিষয়ক প্রশ্নগুলো তার এতো বছরের একনিষ্ঠ দায়িত্বপালনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। রহমান মিয়ার কাছে সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

প্রায় একমাস পরে একদিন  সকালে ঘুম থেকে উঠে ফাহিমা বাবাকে বিছানায় দেখতে পায়না। এতো ভোরে রহমান মিয়া কখনো ঘুম থেকে ওঠেনা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফাহিমা ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে বাসি থালাবাসন ধুয়ে চা বানিয়ে তারপর রহমান মিয়াকে ডেকে তোলে। আজকে আচমকা বাবাকে বিছানায় না দেখে চমকে ওঠে ফাহিমা। কদিন ধরে রহমান মিয়া একটু থমথমে মেজাজে ছিলো। কথা কম বলতো। কাজ থেকে ফিরে সবুজের সাথেও খুব একটা কথা বলতোনা । ব্যাপারটা আগেই চোখে পড়েছে ফাহিমার। এই ভাবনাটাই ফাহিমাকে আরো চিন্তিত করে তোলে। সবুজকে ঘুম থেকে তুলে দ্রুত হাতমুখ ধুতে কলতলার দিকে নিয়ে যায়। 

 

রহমান মিয়াকে প্রথম দেখতে পায় আজিজ মিয়া। আজিজ মিয়া তখন সবে দোকান খুলবে বলে দোকানের সামনে এসেছে। এমন সময় কোথা থেকে জানি দৌড়ে আসে রহমান মিয়া। এসেই হ হো করে হাসতে থাকে

        দেখছো মিয়া এইযে আমার মেডেলওয়ালা ইউনিফর্ম। হেদিন তো খুব জিগাইলা ইউনিফর্ম কই। এহন জিগাও। এইযে দেহো আমার ইউনিফর্ম আমারই আছে। অনেকবছর কাজ কইরা এইডা আমার পুরষ্কার... হেহেহে

আজিজ মিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রহমান মিয়া আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। আজিজ মিয়া রহমান মিয়ার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনা।

তারপরই রহমান মিয়াকে দেখা যায় প্রোজেক্টের গেইটে। সিকিউরিটিতে থাকা বাদল আর সত্তারকে ইউনিফর্ম দেখিয়ে চিৎকার করে ওঠে রহমান মিয়া

        কি রে বাদল দেখছস এইযে আমার ইউনিফর্ম। আমি সিকিউরিটি ইনচার্জ ছিলাম, আমিই থাকমু। আমার এতো বছরের কাজের এই পুরষ্কার আমি কাউকে দিমুনা...

সিকিউরিটি ইনচার্জ জুনায়েদ রেস্ট রুমে ঘুমাচ্ছিলো। বাহিরে চিৎকার শুনে দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। এসেই রহমান মিয়ার হম্বিতম্বি আর গায়ের সিকিউরিটি ইনচার্জের পোশাক দেখে একবার চোখ কচলে নেয়। তারপর এগিয়ে গিয়ে সত্তারকে প্রশ্ন করে

        সত্তার ঘটনা কি ? রহমান মিয়া চিল্লায় কেন ? আর তার গায়ে আমার ড্রেস কেন ?

        ভাই আজকে ভোরে ফজরের আযানের সময় প্রোজেক্টে আসছিলো রহমান ভাই। তারপর কখন রেস্টরুম থেকে আপনের ড্রেস নিয়া বের হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। এখন এসে বলতেছে সেই নাকি সিকিউরিটি ইনচার্জ

        ধরো ওরে বেটা চোর কোথাকার

বাদল আর সত্তার দৌড়ে গিয়ে রহমান মিয়ার দুই হাত চেপে ধরে। জুনায়েদ রহমান মিয়াকে বলে শরীর থেকে সিকিউরিটি ইনচার্জের ইউনিফর্ম খুলে দিতে। কিন্তু বারবার রহমান মিয়া দাবী করে

        এই ইউনিফর্ম আমার। আমিই সিকিউরিটি ইনচার্জ। আমার ইউনিফর্ম আমার আমার ইজ্জত। আমার ইউনিফর্মে হাত লাগাইলে হাত ভাইঙ্গা দিমু

বাদল আর সত্তারও বারবার রহমান মিয়াকে বোঝায়। কিছুতেই কাজ হয়না। জুনায়েদের নির্দেশে রহমান মিয়াকে ধরে নিয়ে স্টোররুমে আটকে রাখা হয়।

 

ম্যানেজার প্রোজেক্টে আসতে আসতে সকাল নয়টার মতো বাজে। তারপর ম্যানেজারের রুমে উপস্থিত করা হয় রহমান মিয়াকেআগেই আদ্যপান্ত ঘটনা জানানো হয়েছে ম্যানেজারকে। ম্যানেজারের রুমে রহমান মিয়াকে নিয়ে এলেও সে চিৎকার করে বলতে থাকে

        এই ইউনিফর্ম আমার ইজ্জত। এই মেডেল আমার পুরষ্কার। এইগুলা আমি কাউকে দিমুনা

ম্যানেজার রহমান মিয়াকে বোঝায় জুনায়েদের ইউনিফর্ম তাকে ফেরত দিয়ে জুনায়েদের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য। রহমান মিয়া কারো কথাই কানে তোলেনা।

ম্যানেজার এসে রহমান মিয়ার শরীর থেকে ইউনিফর্ম খুলে নেবার জন্য ইউনিফর্মের বোতামে হাত রাখতেই শরীরের সর্বো শক্তি প্রয়োগ করে ম্যানেজারের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রহমান মিয়া

        এইডা আমার ইউনিফর্ম। এই ইউনিফর্মে হাত লাগাইলে হাত ভাইঙ্গা দিমু

ম্যানেজার কল্পনাও করতে পারেনি যে তার সাথে এমন কিছু ঘটতে পারে। জুনায়েদকে চোখের ইশারায় একপাশে ডেকে নেয় ম্যানেজার। ম্যানেজারের সাথে ফিসফিস করে কিছু কথা বলে রুমের বাহিরে চলে যায় জুনায়েদ। কিছুক্ষণ পরেই জুনায়েদ ফিরে আসে শিল্পাঞ্চল পুলিশের দুজন কনস্টেবল আর একজন এসআই সহ।

রহমান মিয়ার নামে অভিযোগ রাতের অন্ধকারে স্টোররুম ভেঙ্গে চুরির। পুলিশ এসে রহমান মিয়াকে বলে ইউনিফর্ম খুলে দেবার জন্য। রহমান মিয়া খুব অবাক চোখে রুমের প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে তাকায়

        এই বাদল তুমি কও এইডা আমার ইউনিফর্ম না ? এতোদিন একলগে আমরা চাকরী করলাম তুমি পুলিশকে বইলা দেও আমি চোর না, আমি তোমাগো সিকিউরিটি ইনচার্জ...

বাদল কোন কথা বলেনা। একজন পুলিশ কনস্টেবল এগিয়ে এসে হাতে রাখা রুলার দিয়ে রহমান মিয়ার হাঁটুতে বাড়ি মারতেই ‘বাবাগো’ বলে হাঁটু চেপে ধরে বসে পড়ে রহমান মিয়া। বয়সী চোখে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে।  তারপরের রুলারের আঘাতগুলোতে আর চিৎকার দেয়ার ক্ষমতা থাকেনা রহমান মিয়ার। একজন মানুষ কতক্ষণ আর চিৎকার করতে পারে। সেই সকাল থেকে চিৎকার করছে রহমান মিয়া। শরীর থেকে ইউনিফর্মটা খুলে নিয়ে হাতদুটো পেছনে বেঁধে পুলিশ যখন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে রহমান মিয়াকে থানায় নিয়ে যাবার জন্য প্রোজেক্টের গেইট দিয়ে বের হয়, ঠিক সেই সময়েই গেইটের কাছে এসে দাঁড়ায় ফাহিমা, আর ফাহিমার হাত ধরে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দাঁড়ায় সবুজ। ফাহিমা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রহমান মিয়ার দিকে। একজন কনস্টবল গালি দিয়ে ওঠে

শুয়ারেরবাচ্চা আবার ঘাড় ত্যারামি করে। ইউনিফর্ম চুরি করার শিক্ষা তোকে দেয়া হবে। থানায় চল

সবুজ প্রথমে রহমান মিয়াকে দেখে চিনতে পারেনি। নানার এই চেহারা ও কখনো দেখেনি। ফাহিমা সবুজকে বাঁ হাত দিয়ে  নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে। আর ডান হাত দিয়ে ঢেকে রাখে সবুজের দুইচোখ

 রহমান মিয়ার ঠোঁটের কোনা দিয়ে একটা চিকন রক্তের রেখা। রহমান মিয়ার চোখ আধখোলা নতমুখী। রহমান মিয়া বিড়বিড় করছে

        এই ইউনিফর্ম আমার ইজ্জত... 



গল্পটি শাহাদাত রাসএল'র "জীবন এক সুস্বাদু হেমলক" গল্পগ্রন্থ ‍থেকে সংগৃহিত


লেখক সংক্ষেপ:

কবিয়াল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন