উপন্যাস         :         শরম 
লেখিকা          :         তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ               :         শরম 
প্রকাশকাল      :       

জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। 

পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
শরম || তসলিমা নাসরিন
শরম || তসলিমা নাসরিন

২১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ২২)

- আপনি হিন্দু না?

সুরঞ্জনের প্রশ্নের জবাবে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শুধু না বোধক মাথা নাড়লো।

- ও শিট। সুরঞ্জনের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো রাগের বিরক্তির অপমানের একটা শব্দ।

সোবহান দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে। সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কথা বলা। মাথা নিচু করে থাকা ভালো স্বভাবের ছেলে সোবহান। সুরঞ্জনের তাকে না হলেও চলে। সোবহানেরও চলে। চলে কিন্তু চলে না। দুজন কী ভীষণরকম একা। এবং দুজনই দুজনের শ্রোতা। সুরঞ্জন তার বাবার মায়ের বোনের স্ত্রীর গল্প বলে। সোবহানের কাছে সব গল্পই করেছে, এমনকী তার মুসলমান বিদ্বেষী বন্ধুদের, কিন্তু কখনও জুলেখার কথা সে বলেনি সোবহানকে। কেন সোবহানকে বলতে তার বাধে, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে উত্তর যেটা পেয়েছে, সেটা হল সোবহান মাথা নিচু করে থাকা ছেলে, আর সুরঞ্জন মাথা উঁচু করে থাকা ছেলে। সুরঞ্জন মেজরিটি। সোবহান মাইনরিটি। জুলেখার সঙ্গে সুরঞ্জনের সম্পর্কের কথা জানা মানে সুরঞ্জনও সোবহানের কাতারে দাঁড়ালো এসে। মাইনরিটির সঙ্গে বন্ধুত্ব আর মাইনরিটির সঙ্গে প্রেম দুটো দু জিনিস। প্রেম মানে শুধু প্রেম নয়, অনেক কিছু। প্রেমের পরে বিয়ে, বিয়ের পরে সন্তান। যে সন্তানটি পিওর হিন্দু সন্তান নয়। মুসলমানের গর্ভের সন্তান মুসলমানই।


শোভনবাবুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুসলমান সোবহানকে আবিষ্কার করার পর সম্পর্ক আর রইলো না। শোভন আর সুরঞ্জন দুজনই জানতো সম্পর্কটা আর এগোবে না। ওই আবিষ্কারের ঘটনার পর আর কোনও দেখা সাক্ষাৎ নেই। কোনও খোঁজ খবর নেই। জীবন যার যার তার তার। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এভাবেই চলছিল। চলেও যেত এভাবেই। কিন্তু সুরঞ্জনই, সে নিজেই জানে না কী কারণে যোগাযোগ করলো প্রথম। সোবহানকে ছাড়া তার চলবে না। চালালেই চলতো। কিন্তু সুরঞ্জন আলসেমি করে চালালো না। সে একটা ঝুঁকি নিল। নিতান্তই হেঁয়ালির মতো একটা ঝুঁকি। যাদের সে জানে যে রক্তের মধ্যে বদমাইশি আর বিশ্বাসঘাতকতার বীজ, তাদের সঙ্গেই সে মেলামেশা শুরু করলো। নন্দননগর ঝিলের ধারে, রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠে, কমপিউটারের দোকানে সুরঞ্জনই সোবহানের সঙ্গে তখন অনর্থক গল্প করে কাটায়। মনে মেলে বলেই সম্ভবত। তাছাড়া আর কী! বন্ধুর তো তার আর অভাব ছিল না। সুরঞ্জনের তো অবশ্যই ভালো লাগে। সোবহানের কেমন লাগে তা সে কোনওদিনই সে বলেনি, প্রসঙ্গ এলে মুখে রহস্যময় একটা হাসি ফুটে ওঠে শুধু।

সুরঞ্জনের সঙ্গে সোবহানের মাখামাখিটা বেলঘরিয়ার বন্ধুদের পছন্দ হয়নি। সোবহানের ওপর যেদিন চড়াও হয় ওরা, সেদিন সুরঞ্জনের মাথা ঠিক ছিল না। সোবহানের কমপিউটারের দোকানে বসেছিল সে। অচিন্ত্য ঢুকে বললো, কী রে মুসলমানের সঙ্গে ভাব হচ্ছে নাকি বেশ? তা মালটা কোথায়?

সুরঞ্জন ঠাণ্ডা গলায় বললো, - বাজে কথা বলিস না।
- কিছু টাকা ফেলতে বল।
- মানে?
- মালটা তো হিন্দুদের দেশে বসে ভালো কামাচ্ছে। তা হাজার দশ ফেলতে বল আজ। নইলে..
- নইলে কী?
- নইলে রাজারহাটে নিয়ে গিয়ে কপালে একটা চুমু খাবো আদর করে। অচিন্ত্যের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

সুরঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। তার কথা বলতে ঘেন্না হয়। অচিন্ত্য এর দিন দশেক পর তার আরও কয়েকটা শিষ্য নিয়ে সকালবেলা সোবহানের ওপর চড়াও হয়। অচিন্ত্য ভেতরে ঢুকলো। শিষ্যরা অবস্থান নিল দোকানের দরজায়।

- চাঁদা দিন সোবহান সাব।
- কিসের চাঁদা?
- পুজোর।
- কী পুজো।
- কার্তিক পুজো।
- কার্তিক পুজো?
- হ্যাঁ, পাঁচ হাজার এক টাকা দিয়ে দিন। পুজোটা করে ফেলি।

সোবহান অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। পরে বললো, - দুর্গা পুজো, কালি পুজো, সরস্বতী পুজোয় আমি চাঁদা দিই। কার্তিক পুজোয় তো দাদা আমি পারবো না।
অচিন্ত্য হেসে বললো, - আপনাকে তো দিতেই হবে চাঁদাটা।
- অত টাকা আমার কাছে নেই।
- নেই বললেই তো হবে না।
- তাহলে?
- টাকাটা এখন, এই মুহূর্তে যে লাগবেই মিস্টার সোবহান।
- সোবহান ঢোক গিলছে। মাথা নিচু।


এবার জোরে একটা ঘুষি সোবহানের সামনে টেবিলের ওপর পড়লো। গ্লাস ভর্তি জল ছিল, ছিটকে পড়লো।

- এক হাজার দিলে চলবে?
- এক হাজার দিলে তো পুজোটাই হবে না।
- এই মুহূর্তে..

অচিন্ত্য সোবহানের শার্টের কলার মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে দেয়ালে চেপে ধরলো। সোবহান তার সহকারিকে কাছাকাছি কোনও একটি দোকান থেকে এক্ষুণি চার হাজার টাকা ধার আনার জন্য বললো। সহকারি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। কলার ছেড়ে অচিন্ত্য বসলো একটা চেয়ারে, সুরঞ্জনের মুখোমুখি। না সুরঞ্জন কোনও কথা বলেনি। তাকিয়েছিল বাইরে রাস্তার মানুষের দিকে, তাদের হেঁটে যাওয়া, সাইকেলে যাওয়া, যান বাহনে যাওয়ার দিকে। কেউ উত্তরে যায়, কেউ দক্ষিণে। সহকারি খুব দেরি করেনি। ঘেমে নেয়ে টাকাটা সোবহানের হাতে দিল। পকেট থেকে একহাজার এক টাকা বের করে ধারের চার হাজার মিলিয়ে অচিন্ত্যকে দিল। টাকাটা গুনে পকেটে ভরে, সোবহানের পেটে একটা শক্ত লাথি কষিয়ে শালা মুসলমানের বাচ্চা বলে মেঝেয় থুতু ফেলে চলে গেল। সুরঞ্জন পাথরের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে বেরিযে যায়। সোবহানের সঙ্গে কোনও কথা সে বলেনি। বেরিয়ে রাস্তায় সে অচিন্ত্যকে ধরে। পেছন থেকে পা পেচিয়ে টেনে ফেলে দেয় অচিন্ত্যকে। টাকাটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। বলে, - গুণ্ডামি করিস কার সাথে?

লাফ দিয়ে উঠে সুরঞ্জনের চোয়ালে ঘুসি দিয়ে বলে, - মুসলমানের সাথে।
সুরঞ্জন পাল্টা ঘুসি দিয়ে বলে, - না, তুই গুণ্ডামি আজকে আমার সাথে করেছিস।
অচিন্ত্য গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, - সুরঞ্জন, সাবধান, টাচ করবি না। তোর সাথে কিছু করিনি আমি। চাঁদা চাইতে গেছি, সে যদি তোর বন্ধু হয়, ইটস ইওর প্রবলেম, নট মাইন।


সুরঞ্জন বলে, - তুই পুজোর চাঁদা নিবি, নে, হিন্দুদের কাছ থেকে নে। মুসলমানকে প্রেশার দিবি কেন শুনি? ওদের ঈদের সময় তোর কাছ থেকে চাঁদা নেয়? কত টাকা চাঁদা দিয়েছিস এ পর্যন্ত? 
অচিন্ত্য জোরে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে, - এখনও ওদের সঙ্গ ছাড় সুরঞ্জন। তোর কি জানা হয়নি ওরা কী জিনিস? বাংলাদেশে ভুগে আসিসনি? ওরা ফেরোসাস। ওদের বিষদাঁত তোর এখনও দেখা হয়নি। যত ক্রাইম হয় দেশে, কারা করে জানিস না? চোখ বুজে থাকিস? ওরা এ দেশে থাকে, একটা কাপল বারো চৌদ্দটা করে বাচ্চা বানায়, দেশটায় কী হারে বাড়ছে মুসলমান দেখছিস না? ওরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, বোমা মেরে মেরে আমাদের সবাইকে মারবে। দেশটা দখল করে নেবে। দেখিস তুই। ওরা পাকিস্তানে চলে যায় না কেন? পাকিস্তান খেলায় জিতলে তোর ওই বন্ধু যায় না পাকিস্তানের পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে? যায়। আমাদের দেশে থেকে আমাদের ট্যাক্স না দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। যা, দেখ গিয়ে পাকিস্তানে তলে তলে বাড়িও বানাচ্ছে বোধহয়। সব টেররিস্টের জাত। ইচ্ছে করে লাশ ফেলে দিই শালাদের। 
অচিন্ত্য বলছে আর হাঁপাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে আর ঘামছে। ঘামছে। তার চোখ ফেটে আগুন আর জল দুইই বেরোচ্ছে। ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। তার মনে পড়তে থাকে অন্যকিছু। মনে পড়তে থাকে ঠিক এরকমই সব কথা। এমন কথা আগেও সে শুনেছে, শুনেছে বাংলাদেশে। হিন্দুবিরোধী কট্টরপন্থী মুসলমানেরা বলতো এভাবে, ওরা ভারতে চলে যায় না কেন? ভারত খেলায় জিতলে ওরা খুশি হয় মনে মনে। আমাদের দেশে থেকে আমাদের ট্যাক্স না দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। দেখ গিয়ে ভারতে তলে তলে বাড়িও বানাচ্ছে বোধহয়।

অচিন্ত্য একসময় নকশালপন্থী ছিল। এখন কোনও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নয়। কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, বজরং দলের কিছু ছেলের সঙ্গে কিছুদিন ঘুরেছিল। এরপর সিপিএমএর খাতায় নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু ওখান থেকে কারও জানা নেই কেন নাম কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অচিন্ত্য নিজের বিশ্বাসে নিজে চলে। কাউকে পরোয়া করে না। বিজেপির লোকদের সে গালি দিয়ে বলে, তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। অচিন্ত্যর গুণগ্রাহী কম নয়। সাধারণের মধ্যে তো আছেই, এমনকী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকেরাও অচিন্ত্যর শিষ্য হয়েছে স্বেচ্ছায়।


এই অচিন্ত্যর সঙ্গে, অচিন্ত্যই বলে দিয়েছে, যে, তেড়িবেড়ি করলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। সুরঞ্জন আর একটি কথা না বলে ফিরেছিল নিজের বাড়ি। আর বাড়ি থেকে সে বেরোয়নি। তার কেবল মনে পড়েছে অচিন্ত্যর কথাগুলো। কী বীভৎস ঘৃণা উপচে উঠছে। মুসলমান জাতটার প্রতি ঘৃণা। একই রকম হিন্দু ঘৃণা সে দেখেছে। হিন্দু মুসলমানে অমিল অনেক, কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের একটিই মিল, সে ঘৃণার মিল। কিন্তু সবাই তো নয়। সবাই কি? বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সুরঞ্জন। সুরঞ্জন কি? বারবার সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, সুরঞ্জন কি? সুরঞ্জন কি? আমি কি? আমি কি? ঘামতে থাকে সে। একবার উঠে জল খায়। আবার শোয়। এপাশ ওপাশ করে। ওঠে। পায়চারি করে। সিগারেট ধরায়। একটা শেষ হলে আরেকটা। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। চপ্পল পরে বেরিয়ে পড়ে, কোথাও না, এদিক ওদিক হেঁটে ফিরে আসে। বই মেলে ধরে চোখের সামনে। বন্ধ করে। উঠে চা করে। চা ঠাণ্ডা হতে থাকে। সিগারেট ধরায়। শোয় চিৎ হয়ে। আবার উপুড় হয়। বালিশ একটা বুকে চাপে। বুকে চাপা বালিশটায় আবার মুখ গুঁজে দেয়। একটা ঘুমের বড়ি খোঁজে বাড়িতে। পায় না। দরজা ভিজিয়ে রেখে বেরোয়। ফার্মেসিতে যায়। ঘুমের ওষুধ পাওয়া যাবে কি না জানতে চায়। যাবে না। ফিরে আসে। সিগারেট ধরায়। দ্রুত শ্বাস পড়তে থাকে তার। বুকে ব্যথা ব্যথা লাগে। স্নান করে। স্নান থেকে এসে সিগারেট ধরায়। পায়চারি করে। আবার চা করে খায়। ফোন বাজে। ফোন ধরে না। কিরণময়ী কথা বলতে আসে। বলে দেয়, বিরক্ত না করতে। শুয়ে পড়ে, এবার উপুড় হয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। সুরঞ্জন ওভাবেই শুয়ে থাকে। 

সিদ্ধান্তটা তখনই সে নিয়েছিল বেলঘরিয়া ছাড়ার। ধীরে ধীরে সে টের পায় তার ভেতরে কোথাও যেন ধস নামছে। পাল্টে যাচ্ছে ছবিগুলো। স্পষ্ট করে সে বুঝতে পারে না পাল্টে যাওয়া ছবিগুলো ঠিক কী রকম। তবে যখন সে হাঁটে রাস্তায়, দেখে বেশির ভাগ মানুষের আঙুলে আঙুলে কুসংস্কারের আংটি, কব্জিতে লাল সুতো, মন্দিরে মন্দিরে উপচে পড়া ভিড়, মোড়ে মোড়ে শনিপুজোর উন্মাদনা - না, এই কলকাতা তার স্বপ্নের কলকাতা নয়। ধর্মবিশ্বাস, সে যার সঙ্গেই মিশেছে, দেখেছে, আছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবারই আছে। আরএসএস, বজরং দল, বিজেপির দলের যাদের সঙ্গে মিশেছে, যেমন আছে ধর্মবিশ্বাস, কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম সদস্য কারও কিছু কম নয়। সবাই পুজো করে। ঠাকুর দেবতা মানে। সবচেয়ে অবাক হয়েছে সুরঞ্জন, এই দেখে যে, শিল্পী সাহিত্যিক, এমনকী পদার্থবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা পণ্ডিত ব্যক্তি যাকেই দেখেছে সে, সবাই ধর্মবিশ্বাসী। ঢাকায় কিন্তু শিল্পী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, টেকনোক্রেট, বিজ্ঞানী এদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস তুলনায় অনেক কম, প্রায় নেই বললেই চলে। অন্তত নিজে সে দেখেনি কাউকে। তার নিজের বাড়িতে সুধাময়কে কোনওদিনই সে দেখেনি ধর্ম বিশ্বাস করতে। নাস্তিক ছিলেন। ছেলে সুরঞ্জনও নাস্তিক হয়েছে ছোটবেলাতেই। কেবল কিরণময়ীর ছিল বিশ্বাস। মায়ার ছিল না, জন্মেছে কলকাতায় এসে। কলকাতায় এসে কিরণময়ীর বিশ্বাস আগের চেয়ে বেড়েছে কি না সুরঞ্জন জানে না, তবে লক্ষ্য করেছে ধর্মপালনের নানা রকম অনুষ্ঠানাদিতে কিরণময়ী আগের চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে জড়িয়েছেন। এগুলো কি কিছু ভুলে থাকার জন্য, সুধাময়কে, নিঃসঙ্গতাকে, দারিদ্রকে, ভাগ্যকে! নাকি সত্যিকার বিশ্বাস থেকেই কিরণময়ী বিপদতাড়িনী পুজো দিতে কালিঘাটে ভোর হওয়ার আগেই দৌড়ে যান, বাড়িতে রান্নাপুজোর আয়োজন করেন, আরও কী কী সব সুরঞ্জন নামও সব জানে না। আর সবার মতো হতে চাওয়ার তাগাদা? নাকি অন্য কিছু? কিরণময়ী শাড়ি কাপড় বিক্রি করে হাতে যে টাকা পান, সুরঞ্জনের বিশ্বাস বেশির ভাগই যায় কিরণময়ীর ঠাকুরদেবতার পেছনে।

- দিন বদলেছে, কী হবে এসব করে মা।
- লোকে করে কেন?
- লোকে করে, নির্বোধ বলে। সুরঞ্জন উত্তর দেয়।
- এত লোক নির্বোধ?
- হ্যাঁ, এত লোকই।


কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, - ভাবছিলাম এই দেশে আইসা তর বোধহয় মতিগতি পাল্টাইবো। ভগবানে বিশ্বাস করবি। 
- এত যে ভগবানকে ডাকো, তোমার ভগবান তোমাকে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছু কি দিয়েছে? সুরঞ্জন বলে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কিরণময়ী। সুরঞ্জনের এসব উদ্ভট কথার উত্তর তিনি দিতে চান না। ভাবে সে, কিরণময়ী এত ধর্মান্ধ কখনও ছিলেন না, মায়া তো ঠাকুর দেবতার দিকে যেতই না। আর সেই মায়া এত অদ্ভুতভাবে কালিভক্ত হয়ে পড়েছে যে সুরঞ্জন ঠিক কী করবে বুঝে পায় না। মায়াকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা সে করেছে। বলেছে, মুসলমানরা খারাপ, তার মানে এই নয় যে তোর হিন্দু হতে হবে। হিন্দু হবি হ, তাই বলে ধর্মান্ধ হওয়ার কী দরকার! এতে তোর কী লাভ শুনি। না। মায়ার মাথায় সুরঞ্জনের কোনও উপদেশবাণী প্রবেশ করে না। মায়া, সুরঞ্জন ভাবে, দিনকে দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিরণময়ীকে বরং ব্যঙ্গ বিদ্রুপ যেমন খুশি করতে পারে। বোঝানোর কাজটাও করে সে। কিন্তু এসবে দেখেছে সে কোনও কাজ হয় না। হবেই বা না কেন এত অন্ধ। চারদিকে তো অন্ধত্বরই জয়জয়কার। শুধু হাতে গোনা কিছু ছেলেমেয়েরা সুরঞ্জন দেখেছে ধর্ম এড়িয়ে চলে। পুজো আচ্চার ধারে কাছে ঘেষে না। ছেলেমেয়েরা হয় বিজ্ঞান ক্লাবে জড়িত, নয়তো সত্যিকারের কমিউনিস্ট। সুরঞ্জন একবার ভেবেছিল সিপিএমে যোগ দেবে। বেলঘরিয়ার অনেকে তাকে বলেওছিল। কিন্তু এখানকার সিপিএমএর নীতি আদর্শ কমিউনিজম থেকে এতটা দূরে চলে এসেছে, যে, সুরঞ্জন এই দলকে ঠিক মেনে নিতে পারে না কমিউনিস্ট দল হিসেবে। এই যে ধর্মে ছেয়ে আছে চারদিক, মন্দিরগুলোয় উপচে পড়া ভিড়, রাস্তার ওপর শনির মন্দির, কুসংস্কারে, জ্যোতিষে ছেয়ে যাচ্ছে শহর নগর গ্রাম! কী করে হয় এসব যখন তিরিশ বছর কমিউনিস্টরা ক্ষমতায়! এত বছর শাসন করলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি যেরকমই হোক, অন্তত মানসিকতার তো উন্নতি হওয়ার কথা। আস্তিকতা আর ধর্মবাদের বদলে ধর্মমুক্তি আর মানববাদ যদি সবার অন্তরে প্রবেশ করতো, তবেই হত কমিউনিজমের স্বার্থকতা, তবেই হত সত্যিকার উন্নয়ন। ধর্মমুক্ত মানববাদএর সঙ্গে কমিউনিজমের তো কোনও বিরোধ থাকার কথা নয়।

সুরঞ্জন বোঝে না চিন্তার এই দৈন্য কী করে এই রাজ্যে এত প্রকট। কেবল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করলেই কি সত্যিকার শিক্ষিত হয় মানুষ! বোঝে সে, খুব ভালো করেই বোঝে যে সে একটা ধর্মান্ধ দেশএর দিকে ঘেন্না ছুড়ে আরেকটা ধর্মান্ধ দেশে এসে পড়েছে। নিয়তিতে বিশ্বাস নেই তার, সে জানে এ নিয়তি নয়, দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণই তার সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে আফশোস সে করে না। তবে একটা সত্য পরিবারের আর সবার মতো সুরঞ্জনও স্বীকার করে যে এ দেশে তাদের অন্তত এই নিরাপত্তা আছে যে হিন্দু বলে তাদের ওপর চড়াও হবে না কোনও মুসলমান। নিরাপত্তার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুরঞ্জন শিউরে ওঠে ভেবে যে বোম্বের আর গোধরার ট্রেন-এর সেই বিস্ফোরণগুলোর কথা। সুরঞ্জন যদি কোনও একটি ট্রেনে থাকতো! তাকে তো মুসলমানের হাতেই মরতে হত! মুসলমানের শব্দটিকে শুদ্ধ করে সে বলতে চায় জঙ্গি মুসলমানের, বা মুসলমান মৌলবাদীদের। টেররিস্ট, কট্টরপন্থী, জঙ্গি, মৌলবাদী কোথায় নেই? সবখানে সব ধর্মে সব সমাজে মহা আনন্দে তারা বিরাজ করছে। সুতরাং একশ ভাগ নিরাপত্তা, সে বোঝে যে কোথাও নেই।


আর, সুরঞ্জন এই প্রথম একটা প্রশ্ন করে, যে মুসলমানরাই কি এই দেশে খুব নিরাপদ? এর উত্তর তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! সোবহানের সামনে দাঁড়াতে সুরঞ্জনের সত্যি বলতে কী লজ্জা হয়।

ধর্মের কথা বাদ দিলেও সে ঠিক বোঝে যে চারদিকের হতদরিদ্র মানুষের কারওরই নিরাপত্তা নেই। শুধু ধনীদের আছে, তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন! যে গোত্রেরই হোক না কেন। এই কথাটা কি সুরঞ্জন মনে মনে জানতো না যখন বাংলাদেশে ছিল! জানতো। সে যদি ধনী হত, তবে হয়তো দেশ ছাড়ার কথা ভাবতো না। যদি পার্টির বড় নেতা হত, ভাবতো না। ক্ষমতার কোনও জাত ধর্ম হয় না।

নিশ্চয়তার পায়ে অনিশ্চয়তা জোঁকের মতো কামড় বসায়। সুরঞ্জন দোলে, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন তাকে দোলায় দ্রুততর।


অন্ধ অভিমানের অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকা তার বিজ্ঞানমনস্কতা, তার সাম্যবাদ, তার ধর্মমুক্ত কুসংস্কারমুক্ত সুস্থ সুন্দর বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন একটু একটু করে উঠে আসতে থাকে। ক্রমশ আলোকিত হতে থাকে চারধার। সুরঞ্জন কি নিজেকে একটু একটু করে সেই আলোয় চিনতে পারছে না! নিজে সে তো এরকমই তৈরি করেছিল নিজেকে। তৈরি করা নিজেকেই সে ভেঙে দেয় কেন! কী হতে চায় সে? অন্য কিছু? সুরঞ্জন তার ভেতরেই ঘটতে থাকা অনেক ঘটনার মধ্যেই থই পায় না। তারও আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে নন্দননগর ঝিলে।


চলবে.......

২৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ: 
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন