উপন্যাস         :         শরম 
লেখিকা          :         তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ               :         শরম 
প্রকাশকাল      :       

জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। 

পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
শরম || তসলিমা নাসরিন
শরম || তসলিমা নাসরিন

11111111111111111111111111111

২০ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ২১)

- বাঙালি না?
- বাঙালি।
- পকেট চেক করেছিস। বোমাটোমা থাকে না?
- ধুত।
- বাঙালির সাথে মিশছিস, বাঙালির সাথে মেশ। হঠাৎ মুসলমানের পাল্লায় পড়লি কেন!
- সোবহান তো বাঙালি।
- বাঙালি আবার কী করে? ও তো মুসলমান।
- মুসলমানরা কি বাঙালি হয় না?
- কী করে হবে?
- যে করে হিন্দুরা বাঙালি হয় সেই করেই মুসলমানরা বাঙালি হয়। বৌদ্ধরাও, খ্রিস্টানরাও হয়। নাস্তিকরাও কিন্তু বাঙালি হয়। একটা হলো জাতি, আরেকটা ধর্ম। ধর্ম ভিন্ন হলেও জাত কিন্তু অভিন্ন হতে পারে।

সুরঞ্জনের কথা শুনে বন্ধুরা কেউ হো হো হেসে ব্যঙ্গ করে। কেউ সুরঞ্জনের পেটে গুঁতো দিয়ে বলে, শালা মুসলমানের মার পিঠে যথেষ্ট বুঝি পড়েনি।
সুরঞ্জন হেসে বলে, - পড়েছে, পড়েছে। যথেষ্টই পড়েছে। না পড়লে কি আর ও দেশ ছেড়ে আসি? তবে যাই বলিস তোরা, অবাঙালি মুসলমান যেমন আছে, তেমন যে বাঙালি মুসলমানও আছে, তা তো তোদের জানা উচিত। যেমন অবাঙালি হিন্দু আছে, তেমন বাঙালি হিন্দু আছে।

- অতো জ্ঞান দিস না তো! কেউ একজন বলে
- এগুলো তো জ্ঞান দেওয়া নয়। এগুলো সাধারণ জ্ঞান। তোদের তো বেসিক নলেজটাই নেই রে!
- ফুঃ
- ইতিহাসটা পড়।
- তুই কী জানিস ইতিহাসের?
- আমি তো কলেজে ইতিহাস পড়াতাম।
- কোন কলেজে শুনি!
- দমদম কলেজে।
- ও রকম কলেজে রাস্তা থেকে লোক তুলে নিয়ে গিয়ে টিচার বানিয়ে দেওয়া যায়। ও কলেজে আমিও এখন গিয়ে ফিজিক্স পড়াতে পারি। নো প্রবলেম।

সুরঞ্জন বাংলাদেশের ছেলে। তেরো কোটি বাঙালির সঙ্গে বাস করেছে সে। তাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। সুরঞ্জন জানে বাঙালির সংজ্ঞা। কিন্তু জানে না অশিক্ষিত বাঙালি মুসলমানরাও এই ভুল কোনও দিনই করেনি যে, বাঙালি মানে শুধুই বাঙালি মুসলমান, কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুও অহর্নিশি এই ভুল করে যাচ্ছে যে বাঙালি মানে বাঙালি হিন্দু।

তর্ক শুরু হলে একদিন সুরঞ্জন এক পক্ষে, বাকিরা অন্য পক্ষে। নিজেই পরে ওদের হয়ে সে ভাবতে চেষ্টা করলো যে, হয়তো চারদিকে অবাঙালি মুসলমানের বাস এত, তাই হয়তো ওদের শুধু মুসলমান বলেই উল্লেখ করে। কিন্তু বাংলায় কথা বললেও, সোবহান তো বাংলাতেই বললো, শুদ্ধ সুন্দর বাংলায়, সুরঞ্জনের চেয়েও শুদ্ধ বাংলায়, একেবারে ঘটি উচ্চারণে, তার পরও সোবহানকে গৌতম, মানস, অচিন্ত্য আর রূপক বললো যে ও মোহামেডান, বাঙালি না।

সুরঞ্জন রেগে ওঠে। রেগে ওঠে মুসলমানের প্রতি তার কোনও সহানুভূতির কারণে নয়। রেগে ওঠে হিন্দুদের অশিক্ষা এবং অজ্ঞানতা দেখে। সুরঞ্জন তার বন্ধুদের বোঝাতে চেষ্টা করে বাঙালি-অবাঙালির পার্থক্য। না, তারা বোঝে না। তাদের মাথায় ঢোকেই না যে হিন্দু ছাড়া কেউ বাঙালি হতে পারে। আপাতত ঢুকলেও আবার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যায়।

ফিডার রোডে সবাই বাঙালি, শুধু গোনা কজন মোহামেডান বা মুসলিম। সেই মুসলমানরা অবাঙালি নয় জেনেও তো সুরঞ্জনের হিন্দু বন্ধুরা এভাবেই বলে। 

সুরঞ্জন হাল ছেড়ে দেয়। পৃথক পাড়ায় বাস বা সেগ্রেগেশন যদি জন্ম থেকে কেউ দেখে আসে, ওঁর মধ্যেই বড় হয়ে ওঠে, তবে হয়তো এই ভাষাতেই লোকে কথা বলে। কিন্তু শিক্ষাটা থাকলে, শিক্ষায় ঘৃণাটা না থাকলে ভাষাটা নির্ভুল হতে পারতো।

এ তো কিছুই না, যখন জুলেখাকে দেখলো ওরা, তখন কয়েকজন চোখ ছোট করে হেসেছিল। কথোপকথন এ রকম ছিল।
- কী রে, এ আবার কে? কোন পাড়ায় থাকে?
- থাকে কলকাতায়।
- মাল তো খারাপ না।
- মুখ সামলা।
- ঝুলে আছিস নাকি?
- হুম।
- নাম কী?
- জুলেখা।
- মানে? মোহামেডান?
- নাম শুনে বুঝিস না?

সুরঞ্জনের বন্ধুদের মুখ থমথমে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে সবগুলোর। পারলে তারা হাসি হাসি তার মুখখানার আকৃতি কিলিয়ে বদলে দেয়।

এরপর জুলেখার সঙ্গে সুরঞ্জনের সম্পর্ক নিয়ে উত্তেজিত হতে থাকে আড্ডার পরিবেশ। কয়েক দিন জুলেখাকে বেলঘরিয়ায় নিয়ে এসেছিল সে। কথাবার্তা নিজের ঘরে বসেই ভালো বলা যায়। নন্দননগরে তার দুঘরের ছোট বাড়িটির জানালার ধারে বসে ঝিলের দিকে তাকিয়ে দুজন গল্প করতো। জুলেখার সঙ্গে কথা বলে সুরঞ্জনের কোনওদিন মনে হয়নি যে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। বন্ধুদের সঙ্গ একটা বিরাট আকর্ষণ। সেটা সন্ধ্যেবেলাতেই সে সমস্ত শরীর টের পায়। আকর্ষণটা বোঝে সুরঞ্জন, অভ্যেসের, মদের, হালকা মজার কথাবার্তা শোনার এবং বলার। এই আকর্ষণ ছেড়ে তার হঠাৎ নন্দননগরের এত দিনের বাস ছেড়ে পার্ক সার্কাসের মতো একটা উদ্ভট জায়গায় বাস করার কথা নয়। কিরণময়ী তো ভীষণ আপত্তি করেছিল। কিন্তু কোনও আপত্তি সে মানেনি। আমজাদকে বলাতে সে খোঁজ দিয়েছিল জাননগর রোডের বাড়ির। নন্দননগরের বাড়ির ভাড়া দেড় হাজার। শহরের বাইরে থাকার চেয়ে শহরের মধ্যে থাকার উপকারিতার কথা সে কিরণময়ীকে বুঝিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জুলেখা তো ছিলই। কারণ জুলেখাকে নিয়ে হেন অশ্রাব্য বাক্য নেই যে বন্ধুরা বলেনি। ওই মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সুরঞ্জনের বাপের সাধ্য নেই পাড়ায় থাকে বলে দিয়েছে। পকেটে ক্ষুর নিয়ে ঘোরে ওরা। সন্ধ্যেবেলা একদিন বেলঘরিয়া স্টেশনে জুলেখাকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে দেখে মানস দাঁড়ানো। মানস দৌড়ে ট্রেনে উঠলো। দেখে সুরঞ্জনের ট্রেনে ওঠার কথা ছিল না, কিন্তু ওঠে। জুলেখাকে আগলে রাখে। মানস বিধাননগরে নেমে যায়। দেখে সুরঞ্জনও নামে বিধাননগরে। মানসকে ধরে পেছন থেকে।
- কী রে, কী মতলব নিয়ে উঠেছিলি ট্রেনে?
- সাবধান হয়ে যা সুরঞ্জন। এই রিলেশন বন্ধ কর।
- এ আমার রিলেশন। তোর তাতে কী?
- আমার অনেক কিছু। তুই এখনও মুসলমানদের চিনিস না? ওদের দেশে তো ছিলি।
- চিনবো না কেন? খুব চিনি।
- জানিস না যে ওদের রক্তের মধ্যে বদমাইশি আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে?
- জানি।
- তাহলে জেনেশুনে এসব করছিস কেন?
- ইচ্ছে হচ্ছে।
- এসব হতে দেওয়া যায় না।
- তুই না সিপিএম-এর সমর্থক? তোর চৌদ্দগোষ্ঠী সিপিএম করে। তোর পাড়ার লোকেরা সব সিপিএম। গোটা এলাকা সিপিএম।
- গোটা বেলঘরিয়া। কয়েক দশক ধরে।
- তাহলে তোর মেন্টালিটি এমন কেন রে? মানুষকে মানুষ মনে কর।
- তুই যার-তার সাথে সম্পর্ক কর। কিন্তু মুসলমানের সাথে তোর সম্পর্ক আমরা মানি না।
- তোরা করিস না। আমি তো একটা ইন্ডিভিজ্যুয়াল। আমার ডিসিশন আমি নেব।
- সোসাইটিতে তো বাস করিস তুই, নাকি? ইন্ডিভিজ্যুয়াল যখন, পারবি কোনও জনমানুষহীন এলাকায় একা গিয়ে থাকতে? মানুষের এলাকায় বাস করলে মানুষের নিয়ম মানতে হবে।
- মানুষের নিয়মটা কী শুনি? হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব হবে না?
- না, হবে না। ওরা টেররিস্ট। ওরা হিন্দুদের ওপর আজ থেকে অত্যাচার করছে না। দেশভাগ হয়েছে। পাকিস্তানে চলে যাবে মুসলমানরা। ওদের জায়গা পাকিস্তান। পাকিস্তানে চলে যায়নি কেন? এখন চলে যাক আমাদের পূর্বপুরুষ পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। ওরা থাকছে কেন আমাদের দেশে? এ দেশ হিন্দুদের দেশ। দেশ ভাগ হয়েছিল তো এ কারণেই ভারতে হিন্দুরা থাকবে, পাকিস্তানে মুসলমানরা। আমরা কেন এখন ওদের জন্য সাফার করবো?

সুরঞ্জন স্তব্ধ হয়ে শোনে । পরে চোখ বড় হতে থাকে তার, মুখ খুলতে থাকে, - বলিস কি মানস? মুসলমানরা না সিপিএম-এর ভোটব্যাংক? ওদের জন্য মাদ্রাসা হচ্ছে মসজিদ হচ্ছে। ওদের মাথায় তুলে রাখা হচ্ছে।
- ওসব পলিটিশিয়ানদের পলিটিক্স। মানস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাদের নয়।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠে গিয়ে বসে। মানসের সঙ্গে সেই রাতে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় সুরঞ্জনের। মানস একটা সরকারি অফিসে চাকরি করে। পড়াশোনা করেছে ভালো কলেজে। এমএ পর্যন্ত পড়েছিলে, কিন্তু পরীক্ষা দেয়নি। মানসের সঙ্গে বাংলা মদের দোকানে পেট ভরে মদ খেয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফেরে সুরঞ্জন। মানস যদিও চেয়েছিল, জুলেখার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার কথা সুরঞ্জন তাকে দেয়নি। বারবারই সে বলছিল, দেখ সুরঞ্জন, কাজটা তুই ভালো করছিস না।

- ভালো করছি না তো করছি না। আমার ভালোটা আমাকে বুঝতে দে।
- এই সব ক্ষেত্রে যখন নিজের ভালোটা নিজে বুঝতে না পারিস তখন কাউকে কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়।
- দেখ, সবারই যার যার জীবন আছে। জীবনে নানা রকম সমস্যা আছে। এই সব সমস্যার সমাধান করতে করতেই তো জীবন শেষ হতে থাকে। এত কার সময় আছে কে কার সঙ্গে মিশলো, কার কী ধর্ম, কার কী জাত তা দেখার! তোর কার সঙ্গে কী রিলেশন, তা কি আমি জানতে চেয়েছি?

মানস তার হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ করে। চোয়াল তার শক্ত হতে থাকে। বলতে থাকে, - তুই ভালো হয়ে যা সুরঞ্জন, এখনও সময় আছে, ভালো হয়ে যা। নিজের কমিউনিটির সাথে বিট্রে করিস না। ওরা হোল ওয়ার্ল্ডকে টেরোরাইজ করছে। ওরা নন-মুসলিমদের হেইট করে। তুই বিয়ে করবি কর, যদি হিন্দু পছন্দ না হয়, খ্রিস্টান কর, বৌদ্ধ কর। বাট নো মুসলিম, নো মুসলিম। নো মুসলিম।

এর পরের রাতে সিসিআর ব্রিজের তলায় সুরঞ্জনকে মেরে ফেলে রাখে তারা। তার বন্ধুরা। সুস্থ হতে পুরো পাঁচ দিন লেগেছিল। পাঁচ দিন বাড়ি ফেরেনি তখন সে। সোবহান তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। সুস্থ হবার পর সোবহানই হাসপাতালের খরচ নিজের পকেট থেকে দিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। পাঁচ দিন হাসপাতালে আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন বলতে সে একাই ছিল। নিজের চাকরিবাকরি-ব্যবসা- বাড়িঘর প্রায় ভুলে গিয়ে সোবহান পড়ে ছিল হাসপাতালে। কোনও খবর না পেয়ে কিরণময়ী আর মায়া দুজনই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ভুগছিল... যদিও মাঝখানে সুরঞ্জন ফোনে জানিয়েছে সে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। কোনও দুশ্চিন্তা যেন তারা না করে। তাকে পৌঁছে দেবার পর সোবহানকে অকথ্য ভাষায় অপমান করেছিল মায়া। মায়া চেঁচাচ্ছিল অন্য ঘর থেকে, সোবহানের চেহারাটাও সে ভালো করে দেখেনি। চেঁচিয়ে বলেছিল যে মুসলমানরা কিডন্যাপ করেছিল সুরঞ্জনকে। তাকে মেরে ফেলাই উদ্দেশ্য ছিল তার এবং তাদের। সুরঞ্জন সোবহানকে কেবল ইশারায় বলেছে চলে যেতে। এ ছাড়া তার আর করার কিছু ছিল না। তার পক্ষে সম্ভব হয়নি সোবহানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। হাসপাতালের খরচ সব সোবহানই মিটিয়েছে। সোবহান সফট ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আবার কম্পিউটারের ব্যবসাও আছে তার। সুরঞ্জনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় যখন সে দমদম কলেজে পড়ায়। ওখানে সে দেখেছে লোকের কাছে নাম বলে, শোভন। কলেজে সুরঞ্জনকেও সে বলেছিল। শোভনবাবু বলেই সুরঞ্জন সম্বোধন করতো। সোবহান আপত্তি করেনি। এরপর নিজের ঘরে একটা কম্পিউটার সুরঞ্জন বসিয়েছিল, এর যাবতীয় কাজের দায়িত্ব সোবহানকেই সে দেয়। সফট ওয়্যারগুলো লাগানোর সব দায়িত্ব। নষ্ট হয়ে গেলে সারানোর। তখনও সুরঞ্জন জানে সে শোভন। খবর নিয়ে দেখেছে, সফটওয়্যারগুলো তাকে সে বিনে পয়সায় দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভালো কম্পিউটার দিয়েছে, এক পয়সা লাভ করেনি। একদিন সোবহানকে সে বললো, - আপনি তো অনেক বেশি দামে এসব বিক্রি করেন। আমাকে অর্ধেক দামে দিচ্ছেন। কেন? 
সোবহান বললো, - না, ঠিক আছে।
- সফটওয়্যারগুলোর দাম রাখছেন না কেন? ইনস্টল করার জন্যও কিছু তো রাখলেন না।
সোবহান মাথা নিচু করে বিনয়ের সুরে বললো, - ওগুলো তো আমার কাছেই ছিল। ওগুলোর দাম দেওয়ার কিছু নেই।

অদ্ভুত লেগেছিল তার। চায়ের নেমন্তন্ন করলো একটা দোকানে এক বিকেলে, দিব্যি সে চলে এল। তারপর তো ফিডার রোডে তার দোকানে গিয়ে দেখলো সুরঞ্জন, কী ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয় সোবহানকে। আর এই ব্যস্ত মানুষটিই নাকি সুরঞ্জনের মতো চালচুলোহীন ছেলের এক ভ্রুপল্লবের ডাকেই চলে আসে। সোবহানও তাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে অনেক। দুজনে কম্পিউটার, ইউনিভার্স, ন্যানো টেকনোলজি, ব্লুটুথ, বিগ ব্যাং, স্টেম সেল রিসার্চ এসব নিয়ে গল্প করে। সোবহান এমনিতে বিনয়ী। মাথা নিচু করে থাকা ছেলে। কিন্তু সায়েন্সের কথা বলাতে তার ভেতরে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, খলবল করে ওঠে। সুরঞ্জন ভীষণ ভালো শ্রোতা। এত ভালো শ্রোতা এবং বোদ্ধা সম্ভবত সোবহান পায়নি, তাই সুরঞ্জনকে সে নিভৃতে বন্ধু করে নিয়েছে ।

শোভন বাবু থেকে শোভন। শোভন থেকে সোবহান। এভাবে একটু একটু করে তাকে চিনেছে সুরঞ্জন। যেদিন জানলো যে সে আসলে সোবহান, চমকালো। তার চমকে ওঠা মুখের সামনে সোবহানের মাথা নত বিষণ্ণ মুখ।


চলবে.......

২২ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ: 
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন