উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
২২ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ২৩)
সুরঞ্জনের সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, দেখা খুব কম হয়, আমার দেখা হতে থাকে কিরণময়ীর সঙ্গে। তিনি কালিভক্ত। দক্ষিণেশ্বর কালিমন্দিরে তাঁকে একদিন বেড়াতেও নিয়ে যাই। কুশল চৌধুরীর প্রচুর অনুরোধে কয়েক বছর আগে আমি প্রথম দক্ষিণেশ্বর দেখতে যাই। ইউরোপে যেমন পুরোনো গির্জাগুলো দেখেছি, তেমন দেখি মন্দির মসজিদও। স্থাপত্যশিল্প আমাকে আকৃষ্ট করে। দক্ষিণেশ্বরে কালির ঘরটিতে আমাকে ঢোকানো হয়েছে, একথা শোনার পর কিরণময়ীর চোখে মুগ্ধতা উপচে উঠছিল। তিনি চান মা কালির ঘরটিতে তাকে একদিন আমি নিয়ে যাই। দিন তারিখ তক্ষুণি ঠিক করে ফেলি। আমার নিরাপত্তা রক্ষীকে দুদিন আগে জানিয়ে দিই যে মন্দিরে যাবো, সকালে। দক্ষিণেশ্বর যেতে গেলে পেছনে আমার এসকর্ট কার থাকে, স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক ভর্তি। আর সামনে প্যাঁ পুঁ বাজিয়ে খাকি পোশাকের রাইফেলধারী পুলিশের গাড়ি যায়। এভাবে সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি দেখে কিরণময়ী চোখ পলক হীন, মুখ হাঁ। আর যেই না দক্ষিণেশ্বর পৌঁছোলাম, লোকাল থানার পুলিশ এসে আমাকে রিসিভ করে দেয় গাইড করার ভার মন্দিরের কর্তাব্যক্তিদের হাতে। তাঁরাই আমাকে নিয়ে ওঠান কালির ঘরটিতে, দরজার বাইরে থেকে যেখানে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পুজোর ফুল দিচ্ছে দর্শনার্থীরা, আমার হাতে ফুলের ডালি। ডালিটি আমি কিরণময়ীর হাতে দিই। তার হাত থেকে ডালিটি নিয়ে সেই ডালি থেকে ফুল ঢেলে মন্ত্র পড়লেন পুজারি। চোখে তখন জল কিরণময়ীর। পুজারি দুজন আমাদের হাতে চরণামৃত দিলেন। চরণামৃত চোখ বুজে পান করলেন কিরণময়ী। আবেগে তিরতির করে কাঁপছেন তিনি। পুজারিকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বেরিয়ে যাই। কিরণময়ীর কাঁপা শরীরটাকে আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরি। তিনি আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, মা, তুমি আমার স্বপ্ন সার্থক করলে!
তক্ষুণি মনে পড়লো কুশল চৌধুরীর দেওয়া শাড়িটির কথা। কালিঠাকুরের পরা একটা লাল বেনারসি শাড়ি তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেই শাড়িটি সেদিনই বাড়ি ফিরে আমি আলমারি থেকে বের করে কিরণময়ীর হাতে দিই। ঘ্রাণ তখনও শাড়িটি থেকে বেরোচ্ছে। ফুলের, সুগন্ধির। কিরণময়ী দ্বিতীয়বার কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আগের জন্মে তুমি আমার মেয়ে ছিলে। কিরণময়ী পরজন্ম বিশ্বাস করেন জানতাম, পূর্বজন্মেও যে তার বিশ্বাস আছে, জানা ছিল না।
তিনি আর কত কালিঠাকুরের ভক্ত! ভক্ত বেশি মায়া। মায়া এ খবর শুনে ওই শাড়ি নিজে পাবার জন্য আঁকড়ে ধরলো। তসলিমা শাড়িটি কিরণময়ীকে দিয়েছে জেনেও সে সেটি পেতে চায়।
জানি না আমাকে তখন কোনওভাবে মায়া ক্ষমা করে দেয় কিনা। ওই বেনারসি শাড়িটি কিরণময়ী দেন মায়াকে। আমার বিশ্বাস, যতবারই শাড়িটি ছোঁয় মায়া, যতবারই শাড়িটিকে সে প্রণাম করে, আমাকে তার মনে পড়ে। শাড়িটি আমি দিয়েছি। শাড়িটি যে কালিঠাকুরের পরনে ছিল, এ আমি বলেছি। বলা কথা, প্রমাণ নেই। তারপরও আমার বলা কথাটিকে মায়া বিশ্বাস করছে। কেন? যেহেতু কিরণময়ী বিশ্বাস করছে? কিরণময়ীর সব কথা তো মায়া বিশ্বাস করে না। মায়া তো বিশ্বাস করে না যে আমি সত্যিই মায়ার কথা যা লিখেছিলাম, ভালোর জন্যই লিখেছিলাম, কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল না। আমি তার কষ্টে কেঁদেছিলাম, বিশ্বাস তো করেনি। তার অসহায়তা তার যন্ত্রণা আমাকে ছিঁড়ে খেয়েছে, রক্তাক্ত করেছে, সামান্যও বিশ্বাস করেনি। মায়ার খবরাখবর পেয়ে যাই কিরণময়ীর কাছ থেকে। মায়া নিয়ে আপাতত আমি ভাবছি না।
জুলেখা আর সুরঞ্জন যখন রিশপে বেড়াতে গেল, দুজন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে, কিরণময়ীকে নিয়ে এসেছিলাম আমার বাড়িতে। থেকেছিলেন আমার বাড়িতে কদিন। ওই কদিন আমি সারাক্ষণ তাঁকে সঙ্গ দিয়েছি। তাঁকে নিয়ে নাটক থিয়েটারে গিয়েছি, গানের অনুষ্ঠানে গেছি, দক্ষিণাপণে নিয়ে শাড়ি চাদর আর ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনে দিয়েছি, মার্কো পোলোতে, আইটিসি সোনার বাংলায় নিয়ে বুফে খাইয়েছি। কিরণময়ী যেন আমার খুব আপন কেউ, আত্মীয় কেউ। নিজের মা বা নিজের মাসি, এমন। তাঁর স্নান, তাঁর ঘুম, তাঁর খাওয়া, তাঁর আরাম আয়েসের দিকে, তার মন ভালোর দিকে আমার চব্বিশ ঘণ্টা নজর। নিজে আমি স্টাডিতে ঘুমোই। শোবার ঘরটা ছেড়ে দিয়েছি তাঁকে। এত ভালোবাসা আর আদর পেয়ে বারবারই তিনি বলেছেন, এ শহরে আত্মীয় তো কতই আছে, কারও বাড়ি কি যেতে পারি, কেউ কি একটা দিন থেকে যেতে বলে? তুমি আমার আত্মীয়ের চেয়েও বেশি মা।
জানি না হঠাৎ উথলে ওঠা কোনও আবেগে কিনা, তিনি বলেছিলেন নিজের জীবনের অনেক কথা। সংসারের কথা, স্বামী সন্তানের গল্প। কিরণময়ী শুয়ে, আর তাঁর বিছানায় আধশোয়া হয়ে তাঁকে মন দিয়ে শুনতে শুনতে সুরঞ্জনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় আরও আর সুধাময়ের ব্যাপারে তৈরি হয় সংশয়। যখনই জানতে চাই সুধাময়ের মৃত্যুর কথা, কিরণময়ী প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কী করে তিনি মারা গেছেন, তার কোনও বর্ণনা, চেয়েও আমি পাই না। প্রথম প্রথম ভাবতাম, কোনও না শুকোনো ক্ষতে বোধহয় হাত দিলাম। পরে ধীরে ধীরে টের পাই, কিছু গোপন করছেন কিরণময়ী। সুধাময়ের কথা বারবারই আমি জানতে চাই, কতবার আর পারবেন এড়াতে, ভুল করে হঠাৎ হঠাৎ বলে ফেলেন, আমাকে যে লুকোনো হচ্ছে তা ভুলে গিয়ে বলে ফেলেন, হঠাৎ খুব কাছের মানুষ ভেবে বলে ফেলেন। কিরণময়ী বলেন টুকরো টুকরো করে, যে, তিনি বাঁচতে চাননি। দেশ ছেড়েছেন বটে। সে শুধু শরীরে। মন পড়ে ছিল ওই দেশে। শেকড় উপড়ে তুলে অন্য কোনও মাটিতে অনেক বৃক্ষ হয়তো বাঁচে, সব বাঁচে না। সুধাময়ও তেমন না বাঁচা বৃক্ষগুলোর মতো। তিনি পারেননি এই মাটির সঙ্গে মিশতে। দারিদ্র ছিল, দারিদ্র মানা যায়, কিন্তু দারিদ্রের চেয়ে যেটা বেশি আঘাত করেছে তাকে, তা হল লোকের শঠতা, অনুদারতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা। প্রতিদিন তাকে দেখতে হয়েছে ওসব।
- আর?
- আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে হয়তো তিনি দেখতে পেতেন তিনি রোগি পাচ্ছেন, অভাব গেছে। মায়াকেও আর ওভাবে ওই অবস্থায় দেখতে হত না।
- আর?
-একবার তিনি চিন্তা করলেন না আমাদের কথা। আমাদের বেঁচে থাকা যে কী দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। কষ্টের সময় ছিল, কিন্তু সে সময়টা তো কেটেই গেছে। ও দেশ থেকে যারাই এসেছে, কটা মানুষ একেবারে সব মনমতো পেয়েছে। কষ্ট তো প্রথম প্রথম সবাইকেই করতে হয়েছে। কেন তিনি ভাবলেন তিনি চলে গেলেই সব ঠিকঠাক থাকবে! সব গেছে আমাদের।
হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলেন, - ঝিলটার ধারে বসে থাকতেন। কে জানতো ..।
- কী করে মারা গেছেন?
প্রশ্নের উত্তর কিরণময়ী দেন না।
বলি, - হার্ট অ্যাটাক?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
সে রাতে স্টাডিতে ঢুকে রাত্তিরে যখন ঘুমোবার চেষ্টা করছি, বারবারই তাঁর কথাগুলো ভেবে আমার সংশয় জাগছিল, সুধাময়ের কোনও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সুধাময় আত্মহত্যা করেছেন। নন্দননগর ঝিলে ডুবে আত্মহত্যা। কী কী কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক!
লোকেরা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে বলে?
দেশ ত্যাগটা মনে হয়েছে ভুল, তাই?
সুরঞ্জনের ভালো কোনও চাকরি হচ্ছে না বলে?
নিজের প্র্যাকটিস ভালো না বলে?
সুধাময়কে যতটুকু চিনি আমি, এগুলোকে কোনও কারণ বলে আমার মনে হয় না। সম্ভবত মায়ার কারণে আত্মহত্যা। মায়াকে হয় তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন অধপাতে যেতে। মায়া কি সেজেগুজে ডানলপের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল রাতে, কারও সঙ্গে কথা বলে কারও গাড়িতে উঠে গিয়েছিল? সুধাময় দেখে ফেলেছিলেন! মায়া ছাড়া সুধাময়ের আত্মহত্যার অন্য কোনও কারণ আপাতত আমার অনুমানে নেই।
মনে পড়ে ঝিল সম্পর্কে এর আগে একবার সুরঞ্জন বলেছিল যে, ইচ্ছে করে ওই ঝিলে ডুবে আত্মহত্যা করি। সম্ভবত টেলিফোনেই বলেছে। কিছুই তার আর ভালো লাগছে না। কটা ছেলেমেয়ে আসে পড়তে, ওদের নেহাত ভালো লাগে বলে পড়াচ্ছে সে। ওইটুকু থেকে যা উপার্জন। কিন্তু চাকরির জন্য কোথাও আর তার ঘুরতে ইচ্ছে করে না। দশটা পাঁচটার গোলামিও তার সইবে না। তার চেয়ে স্বাধীনতা যেটা সে ভোগ করছে থাকুক, একটা মানুষের কত আর দরকার হয় বাঁচতে হলে? এই ফালতু দুনিয়ায় অত স্বচ্ছলতার দরকারটাই বা কী। চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষ অস্বচ্ছল জীবন যাপন করছে। কিরণময়ীর ব্যবসার টাকা সংসারে ঢালা হচ্ছে। যখন কিরণময়ী থাকবেন না? তখন কী করবে? গাছের তলায় থাকবে? হেসে সুরঞ্জন বলে, না না ওইসব গাছের তলাটলা খুব রোমান্টিক ব্যাপার, ওসব আমার পোষাবে না। তার চেয়ে ঝিলে ডুবে আত্মহত্যা করবো। কোন ঝিলে? ঝিল টিল কিছু ঠিক করেছো মরার জন্য? সুরঞ্জন গম্ভীর হয়ে বলে, নন্দননগর ঝিল।
এসব কোনও প্রমাণ নয়, তারপরও আমার সংশয় ঘোচে না। সুধাময় থাকলে তিনি দেখতে পেতেন বছর না যেতেই ডাক্তারির পসার বেড়েছে, বাংলাদেশ থেকে আসা ডাক্তাররা চেম্বার খুলে বসলে প্রথম প্রথম রোগি হয় না, দুতিন বছর পর ধীরে ধীরে অবস্থা ভালো হয়। আজ সুধাময় বেঁচে থাকলে এই দুর্গতি হত না। কিরণময়ী জানেন সুরঞ্জনের ওপর ভরসা করা যায় না। তাই শাড়ির ব্যবসাটা তিনি শুরু করেছেন, এবং এটাই আরও পুঁজি খাটিয়ে বড় করতে চান। কিন্তু মুশকিল হল, ব্যবসাটা ভালো হতে পারতো বেলঘরিয়ায়। এই পার্ক সার্কাসে মুসলমান বাড়িগুলোয় কিরণময়ীর যাওয়া আসা নেই। না থাকলে শাড়ি কিনবে কে? লোকে তো নিউমার্কেট বা গড়িয়াহাট বাজার থেকেই কিনতে পারে যা কেনার। কিরণময়ীর কাছে আসার কারণ কম টাকায় ভালো জিনিস পাওয়া। হাতের কাজ ভালো, দামও বড় বড় দোকানের তুলনায় কম। কিন্তু প্রচারটা খুব নেই তার এই শাড়ির ব্যবসার। থাকলেও তিনি বোঝেন যে মুসলমানরা তার কাছ থেকে কিনবে কম। মুসলমানদের সঙ্গে সেই সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে ব্যবসার জন্য তিনি চাইছেন সম্পর্কটা গড়তে। সালোয়ার কামিজ রাখছেন, এমব্রয়ডারির কাজ করা কিছু বোরখাও রাখছেন। বিজ্ঞাপনও কিছু পাড়ায় দিয়েছেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের কয়েকজন এসে বেশ কিছু শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, এমনকি বোরখাও কিনে নিয়ে গেছে সেদিন। তারা কথা দিয়েছে আবার আসবে, তাদের সঙ্গে কিরণময়ী প্রাণ খুলে দেশের ভাসায় কথা বলেছেন। তাদের চা খাইয়েছেন, দেশের গল্প করেছেন।
কিরণময়ী ভালো থাকুন চাই। সচ্ছলতা এলে মনে ফুর্তি হবে, সুরঞ্জন আর মায়ার জন্য কিছু করে তিনি তৃপ্তি পাবেন। ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারাই জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ। সুরঞ্জনকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু ওর ওপর ভরসা করা যায় না। সংসারে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি দুর্বল আর পরনির্ভর ছিল, সেই মানুষই আজ সুধাময়ের মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছে, আর যে ছিল সবচেয়ে যুক্তি বুদ্ধি নিয়ে চলা, সেই মায়া আজ অযৌক্তিক কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে আছে, আর যে ছিল রাজনীতি পাগল ছেলে, সে রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদাসীন। পরিবর্তনটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। আর যে মানুষটা ছিলেন জীবন সংগ্রামী, হারি জিতি যুদ্ধ করে বাঁচবো মানসিকতার, দুর্যোগে একা হাল ধরতে তিনিই জানতেন, আর তিনিই কিনা ছাড়লেন হাল, পেছনে না তাকিয়ে একটিবার, কী হবে কার, সংসারে কে ভেসে যাবে কে ডুববে, কিছুই না ভেবে নিজেকে ডোবালেন তিনি।
সুরঞ্জনের বাবা তোমাকে যদি একটিবার দেখে যেতে পারতেন! কী শান্তিই না পেতেন। তোমার কথা খুব বলতেন।
আমি থামিয়ে দিই কিরণময়ীকে এই বলে যে, এসব শুনেছি আমি আগে, বলেছেন তিনি। জুলেখার কথা জিজ্ঞেস করাতে কিরণময়ীর শীর্ণ মুখটি আরও শীর্ণ আর শুকনো দেখায়। জুলেখা ভালো মেয়ে তিনি স্বীকার করেন, সুরঞ্জনের চেয়ে জুলেখার ওপর বেশি ভরসা করা যায়। তাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু কিরণময়ীর কি যথেষ্ট হয়নি? মায়া তার স্বামী নিয়ে ভুগছে, এ স্বামী থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আর সুরঞ্জন যদি ভোগে মুসলমান মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে, আত্মীয়স্বজন পাড়া পড়শি নিন্দা করবে, তার ওপর মায়া তো এ সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নেবে না বলে জেদ ধরেছে, আর জুলেখাও তো সমাজচ্যুত হবে। বিয়ে তো অন্য কিছু নয়, শুধু সামাজিকতা। যতক্ষণ ওরা সামাজিকতা করছে না, ততক্ষণ স্বাধীন।
- বিয়ে ছাড়া কি ওরা একসঙ্গে থাকতে পারে না? হঠাৎ প্রশ্ন করি।
- কিরণময়ী সজোরে মাথা নাড়লেন। না।
- তাহলে কী হবে এই সম্পর্কের?
কিরণময়ী বিরক্ত হয়ে উত্তর দেন, - জানি না। সুরঞ্জনকে অনেক বুঝিয়েছি ঝামেলায় না যাওয়ার জন্য, ও কিছুতেই শোনে না। ও তো কাউকেই মানে না। লক্ষ করেছি তোমাকে খুব মানে। তুমি যদি একটু বোঝাও ওকে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করি, - না না না। অমন কথা ভুলেও ভাববেন না। আমি কোনও বিষয় নই তার কাছে।
কিরণময়ী বলতে থাকেন, - তুমি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে কীভাবে মিশছো, কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি যদি বেলঘরিয়ার লোকদের বলি, কেউই বিশ্বাস করবে না, তোমার বাড়িতে আমি থাকছি। তুমি আমায় কী যত্ন করছো। ভাববে আমি বানিয়ে বলছি। তোমাকে বাইরে থেকে কেউ বলবে না, যে, তুমি সাধারণ মানুষকেও এত আপন করে নিতে পারো। কে করে কার জন্য আজকাল? কেউ না। আত্মীয়স্বজনরা কোনওদিন খবর নিয়েছে? জানোই তো হুন্ডির নাম করে কত টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল। আমাদের তো শেষ করে দিল। এখন তো...
আমি ধীরে ধীরে বলি, - কী গেছে তা নিয়ে দুঃখ করে কী লাভ! সুখ কিন্তু টাকা পয়সায় থাকে না। আমি তো জীবনে অনেক টাকা করলাম। টাকা কি আমাকে একবিন্দু সুখ দিয়েছে? দেশে যখন ছিলাম, চাকরির প্রথম দিকে, সামান্য টাকায় চলতাম, ওইসব দিনগুলোতে, বুঝি, কী ভীষণ সুখী ছিলাম। অভাব ছিল, কিন্তু অভাববোধ ছিল না। আসলে, ভালোবাসা থাকলে সুখ থাকে। ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।
কিরণময়ী শুনলেন। ঠিক অনুমান করতে পারি না কী ভাবছেন তিনি।
রিশপ থেকে ফিরে সুরঞ্জন প্রথমেই আমার বাড়িতে আসে, কিরণময়ীকে নিয়ে যাবে। সেদিন অনেকক্ষণই ছিল সে সঙ্গে। কিরণময়ী দুপুরে নিজে রাঁধলেন সেদিন। কই মাছের ধনে পাতা ঝোল, লাটি মাছের ভর্তা, দিশি মুরগি কষানো, বুটের ডাল, পটল ভাজা, বেগুন ভাজা, কলমি শাক। খেতে খেতে কথা হয়। সুরঞ্জনের মন খুশি খুশি। প্রেমিকার সঙ্গে তিন দিন কাটিয়ে এসেছে।
আমি বলি, - বলা হয়, পার্টনার চিনতে হয় ট্রাভেলএ। নন স্টপ তো কাটালে প্রেমিকার সঙ্গে কদিন। বোধ করছো কেমন?
সুরঞ্জনের কণ্ঠে কোনও কুণ্ঠা নেই। বললো, - ভালো।
- শুধু ভালো বললেই হবে?
এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করলো, - বেস্ট টাইম ইন মাই লাইফ।
বাক্যটি বিষমাখা তির ছাড়া আর কিছু না। সে তাকিয়েই আছে। আমি চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিই। কিরণময়ীও খাচ্ছেন। তার তো আবার পরিবেশন করার অভ্যেস। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে সবার পাতে পাতে খাবার ঢেলে দিতে যেই না শুরু করেছিলেন, আমি টেনে বসিয়ে দিলাম চেয়ারে। বললাম, ওসব ছাড়ুন। আমার বাড়িতে ওসব দাসিবৃত্তি চলে না। যার যার খাবার সে সে প্লেটে তুলে নেবে। এখানে কেউ পঙ্গু নয়।
এখানকার ছেলেদের মতো বাটি থেকে মাছ মাংস থালায় তুলতে গিয়ে সুরঞ্জনের হাতের চামচ পড়ে যাচ্ছে না, বা চামচ থেকে মাছ মাংসও পড়ে যাচ্ছে না। সে দিব্যি নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে আর খাচ্ছে। কারণটা সম্ভবত বাংলাদেশের ছেলে বলে। এখানে যেভাবে ছেলেদের নষ্ট বানানো হয়, ওখানে বোধহয় নয়। ওখানেও নষ্ট বানানো হয়, তবে ছেলেরা নিজে নিয়ে খেতে শেখে, এত নারী নির্ভর হয় না, কারণটা বোধহয় বহির্বাটিতে যখন পুরুষরা খায়, তখন অন্দরমহল থেকে বহির্বাটিতে গিয়ে মেয়েলোকদের খাবার পরিবেশন করার অনুমতি থাকে না। রক্ষণশীলতার কিছু কিছু ভালো দিক আছে, এটি একটি দিক। আমি যখন এসব ভাবছিলাম, সুরঞ্জন রিশপের বর্ণনা দিচ্ছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপের রূপের কথা শোনাচ্ছিল, আমি মুগ্ধ হয়ে ওর মুখের দীপ্তি দেখছিলাম। নিশ্চয়ই খুব প্রেম করে কাটিয়েছে দিন রাত। কী করে প্রেম সে করে, ভাবতে থাকি। সারাদিন চুমু খায়। সারাদিন হাত ছুঁয়ে থাকে! আমার শ্বেতি হওয়া হাতটি নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে ভাবি হাতদুটো একসময় কী সুন্দর ছিল! কত কেউ চেয়েছিল হাত স্পর্শ করতে, কাউকেই তো দিইনি। অহংকার আমাকে আঠার মতো সেঁটে ছিল। হঠাৎ কোথায় খসে গেল সব। জীবন ফুরোচ্ছে বুঝতে পারি। জীবন খুব দ্রুত ফুরোয়। জীবন তো সবারই ফুরোচ্ছে। এ সময় কেউ নেই হাতখানি ছোঁয়ার। আবার ভাবি, ভুল মানুষদের ছুঁয়েই তো জীবন কাটালাম। এবার না হয় হাতদুটো একলা কাটাক।
- আচ্ছা, হাতে হাত ধরে হেঁটেছো পাহাড়ে? আমার আচমকা প্রশ্ন শুনে কিরণময়ী আর সুরঞ্জন দুজনে চমকালো।
হেসে বললো সুরঞ্জন, - হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
- খুব প্রেম? জিজ্ঞেস করি।
- হ্যাঁ। খুব। সুরঞ্জন বলে।
এ সময় গালের তিলটা সে চুলকোয়। মুখটা দেখতে লাগে ছোটবেলায় দেখা আমেরিকান টিভি সিরিয়ালের নায়ক জনবয়-এর মতো। পেপার চেজ-এ ছিল ছেলেটা। ওরও ঠিক গালে এমন একটা তিল ছিল। তিলটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ছোঁয়ার ইচ্ছেটুকু ভেতরে রেখে বলি, - ওটা চুলকোবে না, চুলকোনো ভালো না। বুঝলে! চুলকোলে অনেক রকম ডিজিজ হয়। চুলকোলে...
সুরঞ্জন, বুঝি যে গাল তিল চুলকোনো এসব কিছুই শুনছে না। সে মগ্ন আগের প্রশ্নটির উত্তরে। - খুব প্রেম কি না? হ্যাঁ খুব। সুরঞ্জনের হাত ভাতের থালায়, চোখ আমার মুখে, মন অন্য কোথাও। আপ্লুত কণ্ঠটি বলে, - জীবনে ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই। ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান সত্যিই কিছু নেই আর। এটিকেই আমি মূল্য দিই। এটিই সুখ দেয়।
আমার মনের কথা ও জানলো কী করে? সুরঞ্জন কি আমার মনে ঢুকেছে? কবে থেকে আমার মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে সে? চোখ জ্বালা করে আমার।
- কেন, টাকা পয়সার বুঝি মূল্য নেই? টাকা না থাকলে রিশপ যেতে পারতে? দুজনে বেড়ালে বলে ভালোবাসতে পারছো। আর টাকা না থাকলে ওই পরিবেশ তো পেতে না! ছিলে কোন রিসর্টে?
- সোনার বাংলায়। দ্রুত উত্তর।
- ও।
আমি আর বলি না যে রিশপে ওই সোনার বাংলাতেই ছিলাম আমি। খসখসে গলায় বলি, - কী করবে? জুলেখাকে নিয়ে কী করবে শুনি?
- কী আবার করবে? কিরণময়ী আমাকে চুপ করাতে চান।
- বলো, ওকে নিয়ে বনবাস যাবে? ঠোঁটে হাসি, চোখে হাসি আমার।
- যাবো।
- দেশান্তরী হবে?
সুরঞ্জন হো হা করে হেসে বললো, - নাহ, সেই ইচ্ছে নেই।
- বিয়ে করবে?
- জুলেখা যদি চায়!
- তুমি নিজে চাও?
- আমি জুলেখাকে চাই। ও যদি বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকে, থাকবো। যদি চায় বিয়ে করতে, তাহলে করবো দুজন বিয়ে। বিয়ে ব্যাপারটা অর্থহীন। করেছিলাম তো একবার বিয়ে। পাঁজিপুঁথি দেখে, জাতগোত্র, নাড়িনক্ষত্র, ঠিকুজি কুলুজি হস্তরেখা মিলিয়ে। কী করিনি? হোম যাগযজ্ঞ, শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষী রেখে মন্ত্রোচ্চারণ, পাণিগ্রহণ, সপ্তপদী গমে, মালাবদল। সবই তো হয়েছিল? কদিন টিকেছে?
- আচ্ছা ওসব করেছিলে কেন? শুধু রেজিস্ট্রেশন করলেই তো হত।
- মেইনস্ট্রিম কালচারে ইনট্রিগেট করতে চেয়েছিলাম।
- কেন? সুবিধে হবে ভেবেছিলে?
- বোধহয় তাই।
- তারপর কী দেখলে? সুবিধে হয়নি?
- বোধহয় তাই।
- এখন কী করবে? কাজি ডেকে বিয়ে? ইসলাম ধর্ম মতে বিয়ে?
- শাটআপ।
- মুসলমান হবে না?
সুরঞ্জন হঠাৎ খাওয়া না শেষ করেই উঠে পড়লো। হাত ধুতে যাচ্ছে...
সুরঞ্জন কেউ না। কিচ্ছু না। হোপলেস। ওয়ার্থলেস। ভ্যাগাবন্ড। কোনও রুচি নেই আদর্শ নেই। সুস্থ চিন্তাভাবনা নেই। লেখাপড়া নেই। পেছনে অন্ধকার। সামনে অন্ধকার। নিজের শিকারকে আবার নতুন করে শিকার করে তার সঙ্গে ঝুলেছে। মেয়ে বুদ্ধিমতি, ভালো চাকরি পাবে। আর সুরঞ্জন ওর ওপর বসে বসে খাবে মাইনরিটিকে প্রটেকশান দিচ্ছে এই ছুতোয়। জুলেখা কোনও ভালো এলাকায় বাড়িভাড়া পায় না, মুসলমান বলে পায় না। সুরঞ্জনের সঙ্গে বিয়ে হলে আর সে অসুবিধে হবে না।
- জুলেখা কি সিঁদুর পরবে? শাঁখা পলা পরবে?
- ওর যদি ইচ্ছে করে পরবে, না ইচ্ছে করলে পরবে না। সুরঞ্জন কঠিন কণ্ঠে উত্তর দেয়।
- খুব দেখাচ্ছো যে ইকুয়ালিটি মানো। আসলে তো তুমিই চাপাবে। তোমার ইচ্ছেটা কি, শুনি?
- কেন এত জানতে চাইছেন?
- জাস্ট জানার জন্য।
- উপন্যাস লিখবেন নাকি?
- এখনও ঠিক করিনি। হয়তো লিখবো না। হয়তো লিখবো।
- যথেষ্ট হয়েছে লেখা।
- মানে?
- মানে যথেষ্ট লেখা হয়েছে। এবার আমাকে মুক্তি দিন।
- তোমাকে কি বন্দি করেছিলাম?
- হ্যাঁ করেছিলেন।
- কী রকম?
- করেছিলেন মানসিকভাবে।
চলবে.......
২৪ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন