উপন্যাস : শেষের কবিতা
লেখিকা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গ্রন্থ : শেষের কবিতা
প্রকাশকাল : ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ
রচনাকাল :
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “শেষের কবিতা” গ্রন্থটিকে অনেকেই মনে করেন এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। মূলত এটি বিশ্বকবির রচিত বিখ্যাত একটি উপন্যাস। যার অমিত ও লাবন্য নামের চরিত্র দুটিও বিখ্যাত। এই উপন্যাসটি প্রথমে ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে ভাদ্র-চৈত্র অর্থাৎ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। যা পরবর্তী বছর ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ প্রকাশণী।‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য রবীঠাকুরের বিখ্যাত এই উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশ করা হলো। পাঠকদের জন্য “শেষের কবিতা”কে সতেরোটি পরিচ্ছেদে ভাগ করে প্রকাশ করা হলো।
![]() |
শেষের কবিতা || রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
1111111111111111111111
০৪ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শেষের কবিতা || রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পর্ব - ০৫)
আলাপের আরম্ভ
অতীতের ভগ্নাবশেষ থেকে এবার ফিরে আসা যাক বর্তমানের নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে।
লাবণ্য পড়বার ঘরে অমিতকে বসিয়ে রেখে যোগমায়াকে খবর দিতে গেল। সে ঘরে অমিত বসল যেন পদ্মের মাঝখানটাতে ভ্রমরের মতো। চারি দিকে চায়, সকল জিনিস থেকেই কিসের ছোঁওয়া লাগে, ওর মনটাকে দেয় উদাস করে। শেলফে, পড়বার টেবিলে, ইংরেজি সাহিত্যের বই দেখলে; সে বইগুলো যেন বেঁচে উঠেছে। সব লাবণ্যর পড়া বই, তার আঙুলে-পাতা-ওল্টানো, তার দিনরাত্রির-ভাবনা-লাগা, তার উৎসুক-দৃষ্টির-পথ-চলা, তার অন্যমনস্ক দিনে কোলের উপর পড়ে-থাকা বই। চমকে উঠল যখন টেবিলে দেখতে পেলে ইংরেজ কবি ডন-এর কাব্যসংগ্রহ। অক্স্ফোর্ডে থাকতে ডন এবং তাঁর সময়কার কবিদের গীতিকাব্য ছিল অমিতর প্রধান আলোচ্য, এইখানে এই কাব্যের উপর দৈবাৎ দুজনের মন এক জায়গায় এসে পরস্পরকে স্পর্শ করল।
এতদিনকার নিরুৎসুক দিনরাত্রির দাগ লেগে অমিতর জীবনটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, যেন মাস্টারের হাতে ইস্কুলের প্রতি-বছরে-পড়ানো একটা ঢিলে মলাটের টেক্স্ট্ বুক। আগামী দিনটার জন্য কোনো কৌতূহল ছিল না, আর বর্তমান দিনটাকে পুরো মন দিয়ে অভ্যর্থনা করা ওর পক্ষে ছিল অনাবশ্যক। এখন সে এই মাত্র এসে পৌঁছল একটা নতুন গ্রহে; এখানে বস্তুর ভার কম; পা মাটি ছাড়িয়ে যেন উপর দিয়ে চলে; প্রতি মুহূর্ত ব্যগ্র হয়ে অভাবনীয়ের দিকে এগোতে থাকে; গায়ে হাওয়া লাগে, আর সমস্ত শরীরটা যেন বাঁশি হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, আকাশের আলো রক্তের মধ্যে প্রবেশ করে, আর ওর অন্তরে অন্তরে যে উত্তেজনার সঞ্চার হয় সেটা গাছের সর্বাঙ্গপ্রবাহিত রসের মধ্যে ফুল ফোটাবার উত্তেজনার মতো। মনের উপর থেকে কত দিনের ধুলো-পড়া পর্দা উঠে গেল, সামান্য জিনিসের থেকে ফুটে উঠছে অসামান্যতা। তাই যোগমায়া যখন ধীরে ধীরে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন সেই অতি সহজ ব্যাপারেও আজ অমিতকে বিস্ময় লাগল। সে মনে মনে বললে, ‘আহা, এ তো আগমন নয়, এ যে আবির্ভাব!’
চল্লিশের কাছাকাছি তাঁর বয়স, কিন্তু বয়সে তাঁকে শিথিল করে নি, কেবল তাঁকে গম্ভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গৌরবর্ণ মুখ টস টস করছে। বৈধব্যরীতিতে চুল ছাঁটা; মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চোখ; হাসিটি স্নিগ্ধ। মোটা থান চাদরে মাথা বেষ্টন করে সমস্ত দেহ সম্বৃত। পায়ে জুতো নেই, দুটি পা নির্মল সুন্দর। অমিত তাঁর পায়ে হাত দিয়ে যখন প্রণাম করলে ওর শিরে শিরে যেন দেবীর প্রসাদের ধারা বয়ে গেল।
প্রথম পরিচয়ের পরে যোগমায়া বললেন, ‘তোমার কাকা অমরেশ ছিলেন আমাদের জেলার সব চেয়ে বড়ো উকিল। একবার এক সর্বনেশে মকদ্দমায় আমরা ফতুর হতে বসেছিলুম, তিনি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমাকে ডাকতেন বউদিদি বলে।’
অমিত বললে, ‘আমি তাঁর অযোগ্য ভাইপো। কাকা লোকসান বাঁচিয়েছেন, আমি লোকসান ঘটিয়েছি। আপনি ছিলেন তাঁর লাভের বউদিদি, আমার হবেন লোকসানের মাসিমা।’
যোগমায়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার মা আছেন?’
অমিত বললে, ‘ছিলেন। মাসি থাকাও খুব উচিত ছিল।’
‘মাসির জন্যে খেদ কেন বাবা?’
‘ভেবে দেখুন-না, আজ যদি ভাঙতুম মায়ের গাড়ি বকুনির অন্ত থাকত না, বলতেন—— এটা বাঁদরামি; গাড়িটা যদি মাসির হয় তিনি আমার অপটুতা দেখে হাসেন, মনে মনে বলেন—— ছেলেমানুষি।’
যোগমায়া হেসে বললেন, ‘তা হলে নাহয় গাড়িখানা মাসিরই হল।’
অমিত লাফিয়ে উঠে যোগমায়ার পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, ‘এইজন্যেই তো পূর্বজন্মের কর্মফল মানতে হয়। মায়ের কোলে জন্মেছি, মাসির জন্যে কোনো তপস্যাই করি নি—— গাড়ি-ভাঙাটাকে সৎকর্ম বলা চলে না, অথচ এক নিমেষে দেবতার বরের মতো মাসি জীবনে অবতীর্ণ হলেন—— এর পিছনে কত যুগের সূচনা আছে ভেবে দেখুন।’
যোগমায়া হেসে বললেন, ‘কর্মফল কার বাবা? তোমার না আমার, না যারা মোটর-মেরামতের ব্যাবসা করে তাদের?’
ঘন চুলের ভিতর দিয়ে পিছন দিকে আঙুল চালিয়ে অমিত বলে, ‘শক্ত প্রশ্ন। কর্ম একার নয়, সমস্ত বিশ্বের, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে তারই সম্মিলিত ধারা যুগে যুগে চলে এসে শুক্রবার ঠিক বেলা নটা বেজে আটচল্লিশ মিনিটের সময় লাগালে এক ধাক্কা। তার পরে?’
যোগমায়া লাবণ্যের দিকে আড়চোখে চেয়ে একটু হাসলেন। অমিতর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ হতে না হতেই তিনি ঠিক করে বসে আছেন, এদের দুজনের বিয়ে হওয়া চাই। সেইটের প্রতি লক্ষ করেই বললেন, ‘বাবা, তোমরা দুজনে ততক্ষণ আলাপ করো, আমি এখানে তোমার খাওয়ার বন্দোবস্ত করে আসি গে।’
দ্রুত তালে আলাপ জমাবার ক্ষমতা অমিতর। সে একেবারে শুরু করে দিলে, ‘মাসিমা আমাদের আলাপ করবার আদেশ করেছেন। আলাপের আদিতে হল নাম। প্রথমেই সেটা পাকা করে নেওয়া উচিত। আপনি আমার নাম জানেন তো? ——ইংরেজি ব্যাকরণে যাকে বলে প্রপার নেম।’
লাবণ্য বললে, ‘আমি তো জানি আপনার নাম অমিতবাবু।’
‘ওটা সব ক্ষেত্রে চলে না।’
লাবণ্য হেসে বললে, ‘ক্ষেত্র অনেক থাকতে পারে, কিন্তু অধিকারীর নাম তো একই হওয়া চাই।’
‘আপনি যে কথাটা বলছেন ওটা একালের নয়। দেশে কালে পাত্রে ভেদ আছে অথচ নামে ভেদ নেই, ওটা অবৈজ্ঞানিক। Relativity of Names প্রচার করে আমি নামজাদা হব স্থির করেছি। তার গোড়াতেই জানাতে চাই, আপনার মুখে আমার নাম অমিতবাবু নয়।’
‘আপনি সাহেবি কায়দা ভালোবাসেন? মিস্টার রয়?’
‘একেবারে সমুদ্রের ও পারের ওটা দূরের নাম। নামের দূরত্ব ঠিক করতে গেলে মেপে দেখতে হয় শব্দটা কানের সদর থেকে মনের অন্দরে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগে।’
‘দ্রুতগামী নামটা কী শুনি।’
‘বেগ দ্রুত করতে গেলে বস্তু কমাতে হবে। অমিতবাবুর বাবুটা বাদ দিন।’
লাবণ্য বললে, ‘সহজ নয়, সময় লাগবে।’
‘সময়টা সকলের সমান লাগা উচিত নয়। একঘড়ি বলে কোনো পদার্থ ত্রিভুবনে নেই, ট্যাঁকঘড়ি আছে, ট্যাঁক অনুসারে তার চাল। আইন্স্টাইনের এই মত।’
লাবণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আপনার কিন্তু স্নানের জল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।’
‘ঠাণ্ডা জল শিরোধার্য করে নেব, যদি আলাপটাকে আরো একটু সময় দেন।’
‘সময় আর নেই, কাজ আছে।’ বলেই লাবণ্য চলে গেল।
অমিত তখনই স্নান করতে গেল না। স্মিতহাস্যমিশ্রিত প্রত্যেক কথাটি লাবণ্যের ঠোঁটদুটির উপর কিরকম একটি চেহারা ধরে উঠছিল, বসে বসে সেইটি ও মনে করতে লাগল।
অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমা-রাত্রির মতো, উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন; লাবণ্যর সৌন্দর্য সকাল-বেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে গড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন; তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয়, সেইসঙ্গে আছে মননের শক্তি। এইটেতেই অমিতকে এত করে আকর্ষণ করেছে। অমিতর নিজের মধ্যে বুদ্ধি আছে, ক্ষমা নেই; বিচার আছে, ধৈর্য নেই; ও অনেক জেনেছে, শিখেছে, কিন্তু শান্তি পায় নি— লাবণ্যর মুখে ও এমন একটি শান্তির রূপ দেখেছিল যে শান্তি হৃদয়ের তৃপ্তি থেকে নয়, যা ওর বিবেচনাশক্তির গভীরতায় অচঞ্চল।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
০৬ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৬১ সালের ৭ই মে (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে একজন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে।রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্পও ১৯১৫টি গান[ যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতানসংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন