উপন্যাস : তাজমহল প্রথম খন্ড
লেখিকা : প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১লা অক্টোবর, ২০২৫ ইং
লেখিকা প্রিমা ফারনাজ চৌধুরীর “তাজমহল - ১ম খন্ড” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশ করা হলো। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৫ সালের ১লা অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
| তাজমহল || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী |
তাজমহল || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী || প্রথম খন্ড (পর্ব - ৩৯)
তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর কথা শুনে আনিস হতভম্ব! এই ধরণের কথাও এভাবে জেনে নিতে হয়? নিজেদের মেয়েদের উপর তাদের এতটুকু ভরসা নেই? এইসব কি ধরণের কথা? এরকম হবে জানলে সে জীবনেও ছবি তুলে দিত না। এত সামান্য একটা বিষয়কে এভাবে ভাবার কি আছে?
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী তার বিরক্তি টের পেয়ে প্রশ্ন আর বাড়ালেন না। বললেন,
"আচ্ছা বাদ দাও। রাতে বাড়িতে এসো। কিছু কথাবার্তা বলবো।"
আনিস বাজার থেকে বাড়ি ফিরলো। মেজাজ ভীষণ রুক্ষ। শাহিদা বেগম তার চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন। বাজারের থলেটা হাত থেকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন,
"যা বলেছি তার সব তো আনিসনি আনিস। তেল মশলা আনিসনি।"
আনিস রুম থেকে বলল,"শাওনকে ফোন করে বলো নিয়ে আসতে। ওর বিকাশে টাকা আছে।"
"এটা কোনো কথা? তোর মন কোনদিকে থাকে?"
আনিস আর জবাব দিল না। শাহিদা বেগম দরজার সামনে এসে থামলেন। জানতে চাইলেন,
"বাজারে কারো সাথে ঝামেলা হয়েছে নাকি?"
আনিস ভাবলো মাকে বলবে না। কিন্তু শাহিদা বেগম নাছোড়বান্দা। তিনি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন।
"তোর বড়আব্বু কি কিছু বলছে?"
আনিসের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল।
"তুমি জানতে এইসব?"
শাহিদা বেগমের মুখখানা চুপসে গেল। আনিস বলল,"ওরা কি মনে করেছে আমাকে? আমাকে দেখে ওরকম মনে হয়? ওদের মেয়েই তো নিজ থেকে ছবি তুলে দিতে বললো। আর এটা অস্বাভাবিক কিছু? ও ছবি তুলে দিতে বললো আমি দিলাম। সেটা নিয়ে কে কি বললো তোমরা বিশ্বাস করে ফেললে আম্মা?"
"রাগছিস কেন? তোর স্যারের জন্যই ওই বাড়ির মেয়ের সম্বন্ধটা ভাঙলো।"
আনিস হতাশ হয়ে বলল,"এমনভাবে বলছো মনে হচ্ছে স্যারকে আমিই ইন্ধন যুগিয়েছি বিয়ে ভাঙার জন্য?"
শাহিদা বেগম বললেন,"মানুষ তো সেটাই বলছে।"
"কিহ?"
সাবরিনা দৌড়ে এল। শাহিদা বেগমকে বলল,"আম্মা মেঝ ভাই মাত্রই বাজার থেকে এল। উনাকে একটু বসতে দেন।"
শাহিদা বেগমকে টেনে নিয়ে গেল সে। আনিসের মাথায় রাগ টগবগ করছে। এরা সবাই তাকে এত ছোটলোক ভাবে? আশ্চর্য! তার খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই যে ওই বাড়ির মেয়ের বিয়ে ভাঙবে?
________
রাতে আশরাফ আর আনিসকে ডাকা হলো। সাথে শাইনার বাবাকেও যেতে বলা হলো। আনিস স্পষ্টভাবে বলে দিল সে যাবে না। এইসব ব্যাপারে কথা বলার রুচি নেই তার।
ওই বাড়িতে খবর পাঠানো হলো যে আনিস আসবে না। সে এইসব ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। ওই বাড়ি কি আদালত নাকি যে সবসময় তাদের কথাই মানতে হবে?
শাইনা সবটা শুনতে পেয়েছে। আবার কি অশান্তি শুরু হয় কে জানে। তাজদার সিদ্দিকী সবটা শুনছে চুপচাপ।
তৌসিফ দুই তিনবার গিয়ে ফেরত এল। আনিস ভাই আসবে না বলে দিয়েছে স্পষ্ট করে।
সেই ফাঁকে তাজদার বেরিয়ে গিয়েছে। শাইনাদের উঠোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে ফোনে মনোযোগ রেখে।
শাহিদা বেগমের গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুললো। শাহিদা বেগম ভেতরে ঢুকে গেলেন। ডাকলেন,
"ও আনিস! তাজ এসেছে তোর সাথে কথা বলতে। বের হ এবার। আনিস?"
আনিস বের হলো ঘর থেকে। সোজা উঠোনে নেমে এল। তাজদার তাকে দেখে বলল,"বাজারে গিয়েছিলি নাকি?'
আনিস বলল," হ্যাঁ।"
"বাড়িতে আয়। চা খাবি।"
"খেয়েছি।"
"আরেকবার খেলে সমস্যা হবে না। আয়। কথাবার্তা বলে সবটা ক্লিয়ার করে নেয়া দরকার।"
বোনের জামাইয়ের অনুরোধে আনিস গেল ওই বাড়িতে। সোজা সোফায় গিয়ে বসলো। চা নাশতা এসেছে ততক্ষণে। তিতলি ঘুরঘুর করছে। তৌসিফ তাকে চোখ রাঙিয়ে বলছে ভেতরে যেতে।
চা খেতে খেতে সবাই এমনি হালকাপাতলা গল্পগুজব করলো। আনিস বলল,
"আমার হাতে সময় কম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে দিলে ভালো হয়।"
তাজদার বলল,"তোকে ডেকে এনেছি যাতে তুই সবার সামনে তোর জায়গাটা ক্লিয়ার করে দিস। এইসব বিষয় নিয়ে যত জলগোলা হবে ততই ঝামেলা বাড়বে।"
তাজউদ্দিন সিদ্দিকীকে কোনো কথাবার্তা বলতে দিল না সে।
আনিস বলল,"নুভাকে ডাকা হোক। সে বলুক সবকিছু। স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক বাবা ছেলের মতো। আমি চাইনা এখানে স্যারকে টেনে কোনো কথা বলা হোক। নুভাকে ডাক।"
তাজউদ্দিন সিদ্দিকী বলল,"না ও আসবে না।"
তাজদার বলল,"ওর এখানে আসা দরকার। আমি ওর মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই। তিতলি?"
"জি ভাইয়া।"
"নুভাকে বলো আমি ডাকছি।"
তিতলি তাসনুভাকে ডাকতে চলে গেল। তাসনুভা কিছুক্ষণ পর এল। বুকে হাত ভাঁজ করে বাবার পেছনে এসে দাঁড়ালো। তাজদার তার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তুমি জানো এখানে কি নিয়ে কথা হচ্ছে?"
"আম্মুর কাছ থেকে শুনলাম এইমাত্র।"
"তোমার এই ব্যাপারে কিছু বলার আছে?"
তাসনুভা স্পষ্ট বললো, "আমিই আনিস ভাইকে ছবি তুলে দিতে বলেছি। সবাইকেই বলি।"
চাচা তৈয়ব সিদ্দিকী বলল,"মেয়েটা বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম। ভুলই ভেবেছি। সবাইকে কি ছবি তুলে দেন, বলা যায়? মানুষ এখন কত কি বলে যাচ্ছে।"
তাসনুভা বলল,"যা শুনেছ সবটাই বানোয়াট কথা চাচ্চু।"
আনিস দাঁড়িয়ে পড়লো। সবার চোখ তার দিকে ঘুরে গেল। আনিস বলল,"আমি এবার আসি। কথা বললে কথা বাড়বে।"
তাজদার মাথা নেড়ে বলল,"আয়।"
আনিস তাসনুভার পাশ কেটে বেরিয়ে গেল। আফসার সাহেব বললেন, রায়হানের মা আর আশরাফের মা মানুষের কথায় বেশি নাচে। আগে ছেলেমেয়েদের কথা শোনা দরকার। কতবড় একটা ঝামেলা বেঁধে যাচ্ছিল।"
আশরাফ আর উনি বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে এসে আশরাফ বলল,"হুটহাট এটা ওটা শুনে ঝামেলা বাঁধানোই মেয়েদের কাজ। মাথা নষ্ট করে দেয় এরা।"
আফসার সাহেব বলল,"তোর মাও কম না। লোকের কথা শুনে ঘরে অশান্তি করে।"
ওরা বেরিয়ে যেতেই তাজদার বলল,"একটা সম্বন্ধ ভেঙেছে দুইদিন হয়নি। ও কোন আক্কেলে রাস্তায় একটা ছেলেকে বলছে ছবি তুলে দিতে? আমি কক্সবাজারেও একই দৃশ্য দেখেছি। নুভা আমি মিথ্যে বলছি?"
তাসনুভা বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তাজদার রেগে গেল।
"তুমি ওদের দিকে তাকাচ্ছ কেন? সত্যি নাকি মিথ্যে বলছি আমি সেটা স্বীকার করো।"
তাসনুভা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজদার বলল,"একটা সম্বন্ধ থাকাকালীনও একটা ছেলেকে ছবি তুলে দিতে জোরাজোরি করা, সম্বন্ধ ভাঙার পরেও জোরাজোরি করা কীসের লক্ষ্মণ? আমার তো নিজের বোনকেই বেশি দোষী মনে হচ্ছে। তুমি অস্বীকার করতে পারো আমার কথা? চুপ থাকবে না। জবাব দাও।"
তাসনুভার নাকের ডগা কাঁপছে। তাজদার বলল,
"তোমার মা বাবা যা যা শুনেছে তা আসলে ভুল শুনেছে। আমার মনে হচ্ছে আসল কারণ এর উল্টোটা। সেটাও যদি না হয়ে থাকে তাহলে আজকের এইসব কাহিনীর জন্য একমাত্র দায়ী তুমি। আনিসকে আমি চিনি। ও এরকম ছেলেই নয়। তোমার মা বাবা তোমাকে নিয়ে খুব বড়াই করেন। উনারা সত্যিটা দেখেও দেখেন না। তাই আমি দেখিয়ে দিলাম। তোমার জীবন নিয়ে সব ভাবনা তোমার। আমি আর একটা কথাও বলবো না। তুমি বিয়ে করবে কি করবে না সেইসব নিয়েও আমি ভাববো না। তোমার ব্যাপারে কোনো কথা বললে আমাকেই কথা শুনতে হয়। আজও বলতাম না। বলতে বাধ্য হয়েছি কারণ ওই বাড়ির একটা মেয়ে এখানে থাকে। আমি সেই দায়বদ্ধতা থেকে ভুল বোঝাবুঝিটা ক্লিয়ার করেছি। ব্যস।"
বলেই তাজদার চলে গেল সেখান থেকে। তাসনুভা তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। তাজদার চলে যেতেই তাজউদ্দীন সিদ্দিকী মেয়ের দিকে ফিরে কিছু বলতে চাইলেন। তাসনুভা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। তাসনুভা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আমার জীবন নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না। আমার লাইফের বেস্ট ডিসিশনটা আমি একাই নেব। আমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে তোমরা কেউ কিচ্ছু বলবে না।"
রওশনআরা বলল,"তুমি তোমার ভাইকে চেনোনা? ও আমাকেও এমন কথা বলে। নিজের বউকে পর্যন্ত বলে। ওর কথায় কষ্ট পাওয়ার দরকার কি?"
তাসনুভা চেঁচিয়ে উঠে বলল,"আমি কারো কথায় কষ্ট পাওয়ার মতো মেয়ে নই। আমার জীবন নিয়ে আমি কাউকে ভাবতেও বলিনি। কাউকে ভাবতে হবে না। ফারদার বাড়িতে যেন কোনো বৈঠক না হয় আমাকে নিয়ে।"
_____
তাজদার বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লন্ডন থেকে ফেরার পর থেকে শাইনা মমতাজের পেছনে সে এমন আদাজল খেয়ে লেগে ছিল যে ঘোরাঘুরির কথা আর মাথায় রাখেনি। তবে আজ সকালে থেকেই তার প্রস্তুতি চলছে। কাপড় বাছাই, টুকটাক জিনিসপত্র গোছানো। শাইনা-ও পাশে বসে হাতে হাতে তার জিনিস গুছিয়ে দিচ্ছিল।
হঠাৎই কৌতূহলী হয়ে শাইনা জিজ্ঞেস করল,"কতদিন থাকবেন?"
তাজদার সামনে রাখা পারফিউম দুটো একবার দেখল, তারপর মজাচ্ছলে পাল্টা প্রশ্ন করল,"কতদিন থাকলে তুমি খুশি হবে?"
শাইনা চুপ করে গেল। চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দিল। তাজদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর শাইনা তার দিকে তাকাল, তারপর নরম স্বরে বলল,"দুই একদিন।"
তাজদার দরাজ গলায় হেসে উঠলো,"বেকুবচন্ডী, পনের দিনের জন্য যাচ্ছি।"
শাইনার চোখ হঠাৎ বড়ো বড়ো হয়ে গেল।
"পনের… দিন?"
তাজদার ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ সরু করে জানতে চাইল,"কেন? তোমার কষ্ট হবে একা থাকতে?"
শাইনা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,"ধুরবাবা!"
"লজ্জা পেয়েছ?"
শাইনা জবাব দিল না। কানের পাশে চুল গুঁজতে গুঁজতে কাজে মনোযোগ দিল। তাজদার বলল,
"উইল ইউ মিস মি?"
শাইনা শার্টগুলো ভাঁজ করতে করতে বলল, "আমি মিস করছি শুনলে কি আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন?"
তাজদার হঠাৎ সামনে ঝুঁকে তার মুখের খুব কাছে এসে বলল,"হোয়াই নট?"
শাইনা হাসলো। হাত দিয়ে তাজদারের মুখটা সরিয়ে দিল। তাজদার তার হাতটা ধরে সরিয়ে দিয়ে আরও নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,"আয়নায় মুখটা একবার দেখো।"
আঁড়চোখে তাকিয়ে শাইনা জানতে চাইল, "কেন?"
তাজদারের রসিকতা করে বলল, "লজ্জায় তুমি একেবারে লাল হয়ে গেছ।"
শাইনা হেসে দ্রুত ঘুরে গেল।
কিছুক্ষণ পর ফিরতেই দেখলো তাজদার এখনো তাকিয়ে আছে। শাইনা দেখামাত্রই সাথে সাথে পিঠ ফিরিয়ে বসল। হাতের তালু ভিজে উঠছে ঘামে, বুকের ভেতর কেমন হাঁসফাঁস।
কিছুক্ষণ পর সাহস সঞ্চয় করে ধীরেধীরে ফিরে চাইলো সে। দেখল তাজদার সিদ্দিকী একচুলও নড়েনি, আগের জায়গাতেই বসে আছে, আর দৃষ্টি এখনো তার দিকে নিবদ্ধ।
শাইনাকে এমন হাঁসফাঁস করতে দেখে সে বলল,"আমি রিসার্চ করে জেনেছি কাউকে দেখলে গলা শুকিয়ে এলে সেটা প্রেমে পড়ার লক্ষ্মণ। তুমি আমার প্রেমে পড়তে যাচ্ছ। নাকি পড়েই গেছ?"
শাইনা বলল,"আপনার ওই টিশার্টটা তো ছাদে শুকোতে দিয়েছিলাম।"
"ইউ ষ্টুপিড তুমি কথা ঘোরাচ্ছ কেন?"
শাইনা একনাগাড়ে বলল,"আসার সময় আমার জন্য, তিতলির জন্য, মেঝ আপুর জন্য কিছু নিয়ে আসবেন।"
তাজদার তার কপালে নিজের কপাল দিয়ে জোরে ঠোকা মেরে বলল,
"ওকে। তোমার জন্য কি কি আনবো আমি লিস্ট করে ফেলেছি।"
"কি?"
"এমনকিছু আনবো যা দেখে তুমি আমার ফাঁদে পড়ে যাবে।"
শাইনা কৌতূহলী হয়ে বলল,"কি আনবেন বলুন।"
তাজদার বলল,"বলবো না। সারপ্রাইজ। তুমি বলেছ হিসাবনিকাশ করে প্রেমে পড়া যায় না। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব হিসাবনিকাশ করেই কিভাবে প্রেমে পড়া যায়।"
শাইনা বলল,"খুব ভালো কথা। তবে সাবধান। হিসাব গুলিয়ে ফেলবেন না যেন। মাপজোক করে খুব সাবধানে প্রেমে পড়বেন।"
প্রেম কি আসলেই হিসাবনিকাশ করে হয়? হয় না। প্রেম একটা দহনজ্বালা, এখানে অহংকার ভস্ম হয়, দখলদারির দেয়াল ভেঙে যায়।
কে যেন বলেছিল, প্রেম বিভৎস বিপ্লবে আত্নসমর্পণ ! (সংগৃহীত)
এখানে দখলদারিত্ব চলে না। বরং এখানেই দখলদারির মৃত্যু হয়।
আত্মসমর্পণের পর প্রেম দিয়ে দখল করতে চাওয়া মানুষটা তখন উপলব্ধি করে, প্রেম দিয়ে আসলে দখল করা যায় না। প্রেমে পড়লে, ভালোবাসলে তাকে নিজের মতো করে ছেড়ে দিতে হয়। নিজের চাওয়ার আগে তার চাওয়াগুলো পূরণে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়।
পনেরদিন যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে টানা বিশটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে তাজদার সিদ্দিকী। তার ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।
কোনো রাগ, বিদ্বেষ কিংবা ক্ষোভের কারণে নয়। ফোনের ওপাশে "কবে আসবেন? ফিরে আসুন" বলতে না পারা শাইনা মমতাজের ছটফটানিগুলো আরও মন ভরে দেখার জন্য।
দখলদারি দেখানোর পিপাসায় তাজদার সিদ্দিকী শাইনা মমতাজের বাহ্যিক সৌন্দর্যটা দেখেছিল শুধু। অথচ দেখার মতো দেখলে আরও অনেককিছু দেখার ছিল। এই যেমন সামনে ফিরিয়ে রাখা শাইনা মমতাজের চুলে ঠিক কটা বিণুনী হয়েছে ফোনের ওপাশে গম্ভীর মুখে বসে সেগুলো মুখস্থ করে গিয়েছে তাজদার সিদ্দিকী। তাকে "কবে আসবেন" বলতে গিয়েও বারবার কথা আটকে যাওয়াটার মধ্যেও তাজদার সিদ্দিকী অনেককিছু দেখেছে। বন্ধুদের সাথে রোদে রোদে ঘুরেফিরে চেহারার বারোটা বাজানোর পর সেই চেহারার খুঁত ধরা শাইনা মমতাজের কপাল ভাঁজগুলো কি বলছিল সেটাও বুঝতে পেরেছে তাজদার সিদ্দিকী। সে বুঝেছে ভালোবাসা আর দখলদারি দুটো একসাথে হয় না।
"আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে ভেবেছি আপনার সাথে আর কখনো ঝগড়া টগড়া করবো না। কিন্তু আপনি কথার খেলাপ করেছেন। তাই এবার খুব বড়োসড়ো একটা ঝগড়া হবে। আমি আপনাকে ঘরেই ঢুকতে দেব না। আপনি বাড়ি আসার পর গুনে গুনে তিন ঘন্টা বাইরে থাকবেন। আরও একটা কথা ভেবেছি।"
শাইনা কথার জবাবে ল্যাপটপের স্ক্রীনের নীল আলোয় বসে গম্ভীরমুখে তাজদার প্রশ্ন করলো,
"কি?"
"চুলটা কেটে ফেলবো যাতে আপনি আমার বেণী ধরে টান দিতে না পারেন। আরও একটা কথা ভেবে রেখেছি।"
"কি?"
"আপনি আমাকে তিনশোটা ভোকাবুলারি শিখতে বলেছিলেন। আমি শিখেছি মাত্র পঁচাত্তরটা। বাকিগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি যা শিখেছি সেটাও ভুলে যাব। আমার আর আইইএলটিএস দেওয়া হবে না। আমি ভেবে রেখেছি আপনি যতদিন না ফিরবেন ততদিন আমি বইখাতা সব তুলে রাখবো। ও হ্যাঁ আমি আরও একটা কথা ভেবেছি।"
"কি?"
"আপনি এলে সেদিন আমি নাইওরে চলে যাব।"
তাজদার নড়েচড়ে উঠে বলল,
"না না, আমি ফিরবো। আমি তোমার উপর রেগে নেই।"
"আমি তো রাগ করার মতো কিছু করিনি।"
"করলেও আমি রাগ করিনি। আমি ফিরবো। আলমিরায় তোমার শাড়ির ভাঁজে একটা লাল শাড়ি আছে। আগাগোড়া লাল টকটকে। ওইদিন ওটা পরো ঠিক আছে?"
শাইনা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো"কেন?"
তাজদার বলল," তুমি সেজেগুজে বসে থাকবে, আমি এসে দেখবো।"
শাইনা প্রতিবাদী হয়ে বলল,"বনে বাঁদারে পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরেঘুরে জংলীর মতো লাগছে আপনাকে। আমি কোনো জংলীর গালের ঘষা খাওয়ার জন্য সাজগোছ করতে পারব না সরি।"
তাজদার সিদ্দিকী তার এই কথাটা শুনে হেসেছিল ভীষণ। এই হাসিটা শুনে ভালো বউ হওয়ার অভিনয় করে যাওয়া শাইনা মমতাজের কখনো এতটা বুকভার হবে সে কখনো ভাবেইনি।
শাইনার সাথে তার রোজ কথা হয়েছে ফোনে। সকাল, বিকাল, রাতে নিয়ম করে। কিন্তু শাইনা নিজ থেকে তাকে চলে আসতে বলেনি।
"চলে আসুন" বললেই তাজদার সিদ্দিকী ঠিকই চলে আসতো। শাইনা সেদিন সন্ধ্যায় প্রশ্ন করেছিল,"আপনি গুনে গুনে ত্রিশ দিন পর আসবে ভেবে রেখেছেন নিশ্চয়ই?"
তাজদার ফোনের ওপাশ থেকে বলল,"কেউ আমার ফেরার অপেক্ষায় আছে বললে আমি গুনে গুনে তিন দিন পর ফিরে আসতাম।"
শাইনা বলল,"আপনাকে ফিরতে হবে না। আপনি গুনে গুনে ত্রিশ দিন পর আসবেন।"
তাজদার সিদ্দিকী গুনেগুনে ওই ফোনকলের তিন ঘন্টার মধ্যে ফিরে এসেছিল শাইনাকে চমকে দিয়ে। তার জন্য অনেককিছু নিয়ে এসেছিল। এই যেমন প্লেলিস্ট ভর্তি হাবীব ওয়াহিদের গান, একটা দোলনা, কানের গোঁজবার ফুল, রাগ কমানোর ঔষধ ”জংলীর মতো গালটা ঘষে দিয়ে টুপটুপ করে পড়া কয়েকটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়া চুমু।”
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
চলবে ...
৪০ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরীর গল্প ও উপন্যাস:
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা প্রিয়া ফারনাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। কল্পনার ভূবনকে শব্দে রুপ দিতে লেখালেখির জগতে তার পদচারণা শুরু হয়েছে ২০২১ সালের মার্চ মাসে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রিমা পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত আছেন অনলাইনভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং পেশায়। ‘প্রিয় বেগম’ উপন্যাসের মাধ্যমে তার পরিচিতি বেড়েছে। ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠকদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। শব্দের জগতে তার পথচলা এখনো চলমান। ভবিষ্যতে আরও পরিপক্ক, আরও বৈচিত্রময় লেখালেখির মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিতে চান তিনি।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন