কবিতা              :         আমি জেলে যাবার পর
কবি                  :         নাজিম হিকমত
অনুবাদ            :         সুভাষ মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থ                   : 
প্রকাশকাল       : 


নাজিম হিকমতের এই কবিতাটি মূলত রচিত হয় তুর্কী ভাষায়। পরে ইংরেজিতে অনুদিতো হয়, আর সেখান থেকেই বাংলায় ভাবানুবাদ করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

আমি জেলে যাবার পর ।। নাজিম হিকমত
আমি জেলে যাবার পর ।। নাজিম হিকমত

আমি জেলে যাবার পর ।। নাজিম হিকমত

অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়




জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুণে গুণে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে –
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।’
আমি বলব –
‘না , আমার জীবনের দশটা বছর।’

যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব :
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’

যখন জেলে এলাম
খুনের আসামী ওসমান
কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল
তারপর চোরাই চালানের দায়ে
ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল
আবার খালাস হল।
কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।

আমি জেলে আসবার সময়
যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল
আজ তারা দশ বছরের বালক।
সেদিনকার রোগা ল্যাংপেঙে ঘোড়ার বাচ্চাগুলো
এখন রীতিমত নিতম্বিনী।
কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল
আজও তারা তেমনি শিশু।

আমি জেলে যাবার পর
দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক
আর আমার বাড়ির লোকে
এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায়
সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি।

যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম
রুটি ছিল তুলোর মত সাদা
তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ
এখানে এই জেলখানায়
লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল
আজ আবার অবাধে কিনতে পারো।
কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি।

যে বছর আমি জেলে এলাম
দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু
দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি
তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়।

টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল
তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়।
আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল।

কিন্তু আমি জেলে যাবার পর
আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন।
আর অন্ধকারের কিনার থেকে
ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে
অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ।

আমি জেলে যাবার পর
সূর্যকে গুণে গুণে দশ-বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে
যারা মাটির পিঁপড়ের মত
সমুদ্রের মাছের মত
আকাশের পাখির মত
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মত সরল
যারা ধবংস করে
যারা সৃষ্টি করে
কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে।

আর যা কিছু
-ধরো, আমার জেলের দশটা বছর-
ওসব তো কথার কথা ।





কবি সংক্ষেপ :  ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন কবি নাজিম হিকমত। মাত্র ১৯ বছর বয়সে যোগ দেন তুর্কির স্বাধীনতা সংগ্রামে। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাদর্শের কারনে জিবদ্দশায় বারবার তাকে জেল খাটতে হয়েছে। কমুনিষ্ট মতাদর্শ ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে ২০ বছর জেল খাটতে হয়েছে তাকে। সরকারি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাকে মোট ৫৬ বছরের সাজা দেয়া হয়, যা তার বয়সের থেকেও বেশি।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাহিত্যে হাতে খড়ি হয় নাজিম হিকমাতের। তিনি গত শতাব্দীর অন্যতম বিদ্রোহী কবি। শুধু তুরষ্কের সাহিত্যপ্রেমিদের প্রিয় কবিই নন, নাজিম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। জীবনের অর্ধেক সাহিত্যই কারাগারের অন্ধকার সেলে বসে রচনা করেন তিনি। তার লেখায় বিপ্লব-বিদ্রোহ থাকলেও তাকে ‘রোমান্টিক বিপ্লবী’ ও ‘জেলখানার কবি’ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। ১৯৫০ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যু বরণ করেন বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমত।

কবিয়াল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন