কবিতা              :         ভগবানের মুন্ডু
কবি                  :         নির্মলেন্দু গুণ
গ্রন্থ                   : 
প্রকাশকাল       : 
রচনাকাল         :         ২৩ জুলাই, ২০২২ ইং

বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণের “ভগবানের মুন্ডু” শিরোনামের এ কবিতাটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি সম্প্রতি নড়াইলে ঘটে যাওয়া উগ্র মৌলবাদী কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও হামলার ঘটনাকে উপজীব্য করে এ কবিতাটি লিখেছেন। যেখানে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বুক ফাটা হাহাকার স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
ভগবানের মুন্ডু || নির্মলেন্দু গুণ
ভগবানের মুন্ডু || নির্মলেন্দু গুণ

ভগবানের মুন্ডু || নির্মলেন্দু গুণ


এই কান্নার ছবিটি দেখে আমি একটু বিচলিত বোধ করেছি। মনে হয়েছে এটি কোনো বানানো কান্না নয়। সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে-মাটি সোনার বাড়া।
এই ছবির মধ্যে ধৃত কান্নাটায় চোখ রেখে আমার মনে হয়েছে, আমার সাতপুরুষের মাটির চেয়ে এই কান্নাটি কম খাঁটি নয়। মনে হচ্ছে, এই কান্নাটি আমার চেনা, খুবই চেনা।

ঐ মাতৃসমা মহিলার কাঁখে বসা ছোট্ট শিশুটির আশ্চর্যবোধক চাহনির মধ্যে, ওর বিস্মিত চোখের মণির মধ্যে যে জিজ্ঞাসাটা ফুটে উঠেছে--তার উত্তরও আমি জানি। 
তবে আজ নয়, অন্য একদিন বলবো।

না, অন্য একদিন নয়, আজই বলে ফেলি। বলা তো যায় না, আবার যদি ভুলে যাই? এর চেয়েও একটি বড় কান্না এসে যদি এই কান্নাটিকে ছোট করে দেয়? যদি মুছে যায় মন থেকে? এরকম তো কতই হয়েছে। 

১৯৪৭ থেকে ২০২২। এই সময়খন্ড তো বাঙলার পূর্ব ভূখন্ডের হিন্দুদের দেশান্তরের গল্পই। বাস্তুচ্যুত হয়ে ভারতে শরণার্থী হওয়ার করুণ ইতিহাস। আমার মনে হয়েছে, গল্পটা (গল্পই বলি। ঘটনা তো গল্পই, সে মহাভারতের দ্রৌপদীই হোক আর নড়াইলের ক্ষমাদাসীর জীবনের কথকথাই হোক) সম্ভবত এরকম হবে। 

ক্রন্দনরত দিদিমা/ঠাকুমাকে কাঁদতে দেখে বাচ্চাটি প্রশ্ন করছে-- " ঠাম্মা, আমি কাঁদলে তো তুমি বলো, কাঁদে না সোনা, কাঁদতে নেই। --হাসো, --হাসো, জন্মভূমিল মাটিল মতো হাসো। 

আর এখন দেখছি তুমিই কাঁদছো। 
তুমি শুধু কেঁদেই চলেছো। 
দিম্মা, কাঁদছো কেন তুমি? --হাসো,--হাসো। 
জন্মভূমিল মাটিল মতো হাসো।

বাবুটি প্রশ্ন করে বিষয়টা বুঝতে চায়।
 ঠাকুমা, তোমাকে ওলা বকলো কেন?
 তুমি কি দুষ্টুমি কলেছিলে? 
 ওলা তোমাকে মাল্লো কেনো? 
 তুমি কি ওদের মেলেছিলে? 
ওলা তোমার ঘলটা পুলিয়ে দিলো...। 
তুমি ওদেল ঘল পুলিয়ে দিয়েছিলে?

তোমার কি খুব ক্ষুধা পাচ্ছে? 
আমার মায়ের দুধু তুমি খাবে?

ও, বুঝেছি, যাদের ওপল ভস্যা কলে
 তুমি খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাতে, 
ভাবতে তোমাল বিপদে-আপদে 
ওলা তোমাল পাশে ছুটে আসবে, 
তালা আয়নি বলে তুমি কাঁদছো?

ছি! দিম্মা, তুমি একটা বোকা,
তুমি একটা বোকার হদ্দ। 
তালা আসবে কেমন কলে? 
তালা তো কবেই মিশে গেছে ঐ দলে।"

"তবে, বঙ্গবন্ধু থাকলে আসতেন।"

সাত রাজার ধন, ছোট্ট বাবুটির দিকে
 তার দিম্মাটি তাকাতে পারে না।
 অকথিত দুঃখের বেদনা কাঁখে নিয়ে
 ঠাকুমাটি শুধু কাঁদে, আর কাঁদে। 
এতো কান্না যে কোথা থেকে আসে, 
তার ভগবানও তা জানেন না। 
তিনিইবা জানবেন কী করে? 
তার ভগবান তো নিজেই কাঁদছেন। 

ঐ তো সাহাদের অগ্নিদগ্ধ বাড়ির উঠানে
গড়াগড়ি খাচ্ছে ভগবানের মুন্ডু, 
তার ভাঙা হাত-পা আর কবন্ধ শরীর। 

"দিম্মা দাঁলাও, আমি বলো হয়ে নিই। 
সমাধান যদি অস্ল দাবি কলে,
তবে আমি ঠিকই অস্ল খুঁজে নেবো।

কবি সংক্ষেপ :
নির্মলেন্দু গুণ একজন বাংলাদেশী কবি যিনি তাঁর সহজলভ্য পদ্যের জন্য পরিচিত। তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

কবিয়াল

কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন