উপন্যাস        :          শিমুল ফুল
লেখিকা         :          জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর
গ্রন্থ              :         
প্রকাশকাল      :         
রচনাকাল       :         

লেখিকা জাকিয়া সুলতানা ঝুমুরের “শিমুল ফুল” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২২ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
শিমুল ফুল || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর
শিমুল ফুল || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

৪০তম পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন

শিমুল ফুল || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর (পর্ব - ৪১)

পুকুরের কিনারে দাঁড়িয়ে পানির মাছটা দেখে মনে হয় ধরা খুব সহজ কিন্তু পানিতে নামলে বোঝা যায় মাছটা আয়ত্বে আনা কতোটা কঠিন। ঠিক তেমনি জীবন যুদ্ধে না নেমে রঙিন স্বপ্ন দেখা খুব সহজ কিন্তু মাঠে নামলেই টের পাওয়া যায় স্বপ্নের পথে হাটা এতো সহজ না। একবেলার ভাত যোগার করা যে কতোটা কঠিন যে এক বেলা উপোস থেকেছে সেই এর মূল্য জানে। শিমুল চাইলেই পলাশ কিংবা তিয়াশের কাছে সাহায্য চাইতে পারে কিন্তু সে এটা করবেনা। শওকত হাওলাদার যদি শুনতে পায় তাহলে উপহাস করবে। বলবে যে "ঠিক তো জেদ দেখিয়ে চলে গেলো এখন চলতে পারেনা কেন? বাপের কামাই ছাড়া চলতে পারেনা? ফুটানী শেষ? আমি জানতাম এমনটাই হবে, দুইদিন পরে সুড়সুড় করে বাড়িতে ফিরে আসবে।"

হোক একটু কষ্ট তারপরেও শিমুল এসব কথা শুনতে রাজি না। পলাশ আর তিয়াস কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিছু লাগবে কিনা জানিয়েছে, শিমুল তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে না করে দিয়েছে। লড়াইটা যেহেতু তার সে একাই লড়ুক অন্যদের কাছে কিছু বলে সান্ত্বনা নেয়ার মানে হয় না। দেড় মাস ধরে শিমুল গার্মেন্টসে চাকরি করছে। গার্মেন্টসের ম্যানেজার, সুপারভাইজারদের মুখের ভাষা এতো খারাপ, প্রকাশ করার মতো না। কি বিশ্রী টোনে কথা বলে, জঘন্য। শিমুল এসব কথার সাথে অভ্যস্থ না, অকথ্য কথা শুনলে মাথার রগ দপদপ করে জ্বলে উঠে। 

এই তো আজকের ঘটনা, চাকরিতে ঢুকেছে দেড় মাস। মাসের বেতন হাতে পেতে আরো দেরী। তার হাতে যা অল্প টাকা আছে এগুলো দিয়ে কোন রকম টানাটানি করে চলতে হচ্ছে। পনেরো বিশ দিন ধরে সবজি, সবজি ভাজি, করল্লা ভাজি, ডাল, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা খেয়ে দুজনে দিন কাটাচ্ছে। আজকে সকালে পুষ্প ডাল রান্নার সময় হাতে ডাল ফেলে বেশ কিছুটা জায়গা পুড়ে ফেলেছে। অতী আহ্লাদী মেয়েটা একটুও শব্দ করেনি। নিঃশব্দে তপ্তশ্বাস ছেড়ে হাতে পানি দিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দেয়। শিমুল যে কাজে যাবে, খেয়ে যেতে হবে দেরী করলে চলবে না। কিন্তু ফর্সা হাতে লালের ছোঁয়া শিমুলের নজর এড়ায় না। ব্যস্ত হয়ে বার্ণ ক্রীম এনে হাতে লাগিয়ে দেয়। শিমুল হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ডান হাতেই অনেকটা পুড়েছে কিন্তু পুষ্প নির্বিকার। প্লেটে বেশী করে ভাত নিয়ে নিজে খায় সাথে পুষ্পকেও খাইয়ে দেয়। সে জানে পরে পুষ্প খাবেনা আর শিমুলকেও কিছু বলবেনা। 

এই কারণেই শিমুলের অফিসে যেতে একটু লেট হয়ে যায়। ততক্ষণে গার্মেন্টসের চার লট মাল চলে গেছে। শিমুলকে দেখে ম্যানেজার এগিয়ে আসে।
"খান**র পোলা বা** ছিড়তে আসোছ?"
শিমুলের চোখ লাল হয়ে যায়।মাথা নেড়ে বললো, "স্যার একটু সমস্যা হয়েছিলো তাই.."
শিমুলের কথা শেষ হওয়ার আগে ম্যানেজার দাঁত কিড়মিড়িয়ে জোড়ে জোড়ে বললো, "সমস্যা থাকলে কাজ করিছনা, নাকি গার্মেন্টসের মাইয়াগো পাছা না দেখলে মন ভরে না হা/লা/রপো।"

শিমুল হাত দিয়ে প্যান্ট খাবলে ধরে। এমন করে কথা বলার সাহস কারো নেই কিন্তু পরিস্থিতিতে পরে এসব নিম্নমানের কথাগুলোই শুনতে হচ্ছে। কাজ শেষ করে শিমুল একটা অফিসে যায়। তিয়াসকে দিয়ে তার সার্টিফিকেট আর পুষ্পর বইখাতা আনিয়েছে। এক বন্ধু এই অফিসে চাকরী করে ও বলেছে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিবে। সে প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে আছে কিন্তু তার বন্ধু আসে না। পিয়নকে দিয়ে কয়েকবার খবর পাঠিয়েছে কিন্তু প্রতিবারই উত্তর এসেছে ব্যস্ত। এবার পিয়ন এসে বললো, কাল দেখা করতে আজকে বেশী ব্যস্ত। শিমুল মুচকি হেসে বেরিয়ে আসে। সে বেশ বুঝতে পারছে এসব ব্যস্ত ট্যস্ত কিছু না আসল কথা হচ্ছে শিমুলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না তাইতো এই বাহানা। 

ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে শিমুলের চোখে পুষ্পর মুখটা ভেসে উঠে। এই কয়দিনে পুষ্প তার কাছে কোনো আবদার করেনি কিছু খেতে চায়নি শিমুলকে কখনো বুঝতেই দেয় না পুষ্প যে কষ্টে আছে। কিন্তু শিমুল যে সব বুঝে, সান্ত্বনা হিসেবে পুষ্পকে শক্ত করে বুকে নিয়ে রাখে। এসব আবল তাবল ভাবতে ভাবতে তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে হতাশার নিঃশ্বাস।অন্ধকারের ভিড়ে হারিয়ে যায় একটা পুরুষের হাহাকার মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস। যে কিনা প্রিয় নারীকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়ছে।


পুষ্পর মোবাইলে তার মা রোকসানা ফোন দিয়েছে। পুষ্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করে। রোকসানা বলে, "কেমন আছিস? ফোন না দিলে তো বাঁচা-মরার খবরও জানতে পারবো না।"
পুষ্প কথা বলেনা। এই পরিস্থিতিতে মোবাইলে বিশ টাকা রিচার্জ করার চেয়ে আধা কেজী আলু কিনাই পুষ্পর কাছে বেশি আনন্দের। মুচকি হেসে বললো, "এইতো আম্মা ভালো আছি।তুমি আর আব্বা কেমন আছো?"
"ভালো।"
পুষ্প কি বলবে ভেবে পায় না। কিছু কিছু সময় অতী আপনজনের সাথেও কথোপকথন সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়, কথা ফুরিয়ে যায় আর অপর পক্ষের মানুষটা যদি খোঁচা দিয়ে কথা বলে তাহলে আরো খারাপ লাগে। সে জানে রোকসানা এখন শিমুল, সাফিন, মুন্নীকে নিয়ে কথা শুনাবে।
"শিমুল কই?"
"কাজে।"
রোকসানা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "কি কাজ করে বলিসনা কেনো? রিক্সা টিক্সা চালায় নাকি?সত্যি করে বল।"
পুষ্পর বুকটা ব্যাথায় চিরবিড়িয়ে উঠে। শিমুলের নামে কোনো অপমান তার সহ্য হয় না। নিভু গলায় বলে, "তোমাকে না বললাম একটা কম্পানিতে চাকরি করে।"
"কম্পানি না কি কে জানে! কতো বললাম এই নেতা ফেতা ছেড়ে সাফিনকে বিয়ে কর তুই ঘ্যাড় তেড়্যামি করে বিয়ে করলিনা এখন মজা বুঝ! মা বাপের কথা না শুনলে ছাড়াকালে যায়। তুইও গিয়েছিস।"

পুষ্পর বিরক্ত লাগে। এটা ঠিক তার আব্বা আম্মার এই পরিস্থিতি ভালো লাগছে না হয়তো মনে মনে কষ্টও পাচ্ছে কিন্তু সবসময় এভাবে কথা বলার মানে কি? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। শিমুলও কি ফেলনা নাকি? হোক টাকা কম কিন্তু সে পুষ্পর রাজা। সে বিরক্ত গলায় বললো, "এগুলো বাদ দাও না আম্মা।"
রোকসানা দিগুণ তেজ নিয়ে বলে, "কেনো বাদ দিবো শুনতে মজা লাগেনা? মজা লাগবে কিভাবে? তোর বোনের ঢাকায় ফ্লাট আছে আর তুই কিনা বস্তিতে থাকিস। নিজের কপাল নিজে বেছে নিয়েছিস। এখন আমাদের কিছু বলতে পারবিনা।"
"আমি তোমাদের কিছু বলি নাই আম্মা। আর বলবও না।"
"এই প্রেম কয়দিন পরে জানালা দিয়ে পালাবে। তুই কি মনে করছিস আমি কিচ্ছু বুঝি না?"
পুষ্প চোখ বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তর্ক করতে একদম ইচ্ছা করেনা। আস্তে করে বললো, "আচ্ছা।"
"সাফিনদের দুই দুইটা ফ্লাট আছে। বিয়ে হলে রাজরানীর মতো থাকতি। বুঝলি না পরে বুঝবি। নিজের কপাল নিজে পুড়লি। বিয়ে হলে সাফিনের ভালবাসা পেলে দেখতি এসব শিমুল টিমুল সব ভুলে গেছিস।"


পুষ্প কি করে বুঝাবে সাফিন না তার যে শিমুলকেই চাই। সাফিনও তাকে ভালোবাসতো আদরে ভরিয়ে দিতো কিন্তু তার যে শিমুলের ভালোবাসা চাই শিমুলের পাগল করা ছোঁয়া চাই। সবচেয়ে বড়ো কথা শিমুলের কাছে এলে যে শান্তি মিলে তা তো কোথাও মিলবে না!তাহলে এই ফ্লাট, সাফিন এগুলো দিয়ে কি করবে?
"আম্মা এগুলো বাদ দাও না। আমার কপালে যা আছে তাই হবে।"
পুষ্পর মন খারাপের আঁচ হয়তো কিছুটা রোকসানার গায়ে লাগে। গলার স্বর নরম হয়ে আসে। "কি রান্না করছিস আজকে?"


মায়ের একটু নরম কথায় পুষ্পর চোখে পানি জমে যায়। সে কিভাবে বলবে যে আজকে পনেরো বিশ দিন ধরে ঘরে মাছ আসে না। মাছ কেনার টাকা নেই আসবে কিভাবে! সবজি, ভাজি, ডিম, ভর্তা, ডাল এসব দিয়েই দিন যাচ্ছে। কিন্তু মাকে এসব বলার মানে হয় না। মিথ্যা করেই বললো, "টমেটো দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছি আর মশুরির ডাল।"
"ভালো আছিস তো পুষ্প? আমাকে বল। টাকা লাগবে?"
মা-রা কিভাবে যেনো না বলা কথাই বুঝে যায়। পুষ্প গলা ধরে আসে। "টাকা আছে আম্মা। আর লাগলে তোমাকে বলবো।"
"মুন্নী তোকে ফোন দেয় না? কতোবার যেতে বলছে যাচ্ছিস না কেনো?"
পুষ্প শুকনো ঢোক গেলে। বোনের বাসায় যেতে হলে টাকার দরকার। খালি হাতে তো আর বোনের বাসায় যাওয়া যাবে না। তার উপর মুন্নী ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। কিছু না নিলেও তো হাজার খানেক টাকা লাগবেই, জিনিসপত্রের দাম যা চড়া!
"যাবো আম্মা। আসলে ও নতুন চাকরি নিয়েছে তো ছুটি নেই। দেখি সময় পেলেই যাবো।"
"আচ্ছা। মুন্নী তোর আব্বার জন্য কতো কি কিনে পাঠিয়েছে। মেয়েটা আমাদের কথা কতো ভাবে।"

পুষ্প কথা বলতে পারেনা। তার বোন কতো কি দিতে পারে আর সে পারেনা। নিজের কাছে তো নিজেকেই ছোট লাগে। এসব শুনে কি বলা যায় সেটাই খুঁজে পায় না।
"আচ্ছা আম্মা রাখি। শিমুল আসছে।"
রোকসানা কিছু বলার আগেই পুষ্প ফোনটা কেটে দেয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। নিজেকে সামলে মোবাইলে টাইম দেখে, শিমুলের আসার সময় হয়ে গেছে জলদি বই নিয়ে বসে। রাতে দু'জনে একসাথে খেতে বসে। একটা ডিম পেয়াজ দিয়ে ভাজি করে দু'ভাগ করে দুজনে খায়। পুষ্প খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শিমুলকে দেখে বিয়ের পরে একমাস পুষ্প দেখেছে শিমুল ভোর-সকালে এক্সারসাইজ করে একসাথে ছয়টা সিদ্ধ ডিম খেতো আর ওই ছেলেই কিনা অর্ধেক ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছে, আসলেই পরিস্থিতি মানুষকে সহজ বানিয়েই ছাড়ে। পুষ্পর মন খারাপ হয় শিমুলের চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব হাবিজাবি পুষ্প খেতে পারলেও শিমুল খেতে পারেনা ওর যে অভ্যাস নেই। তারপরেও জোড় করে খায়, বলিষ্ঠ শরীর কিছুটা ভেঙে গেছে। 

শিমুল পুষ্পর করুণ চাহনি খেয়াল করে বললো, "কি দেখো?"
"তোমাকে।"
শিমুল প্লেটে হাত ধুয়ে বললো, "আবার প্রেমে পড়ার ধান্ধা করছো নাকি?"
পুষ্প হাসে।
"চুল দাড়ির কি অবস্থা দেখেছো? এই অবস্থায় প্রেমে পড়া বারণ।"
শিমুল মুচকি হেসে দাড়িতে হাত বুলায়। কিছুদিন না কাটার ফলে দাড়িগোঁফ বেশ বড়ো হয়ে গেছে। গতকাল এক সেলুনে গিয়েছিলো চুল দাড়ি কাটলে নাকি দুইশো টাকা লাগবে। শিমুলের পকেটে ছয়শ টাকা আছে এই টাকা দিয়ে বাকিটা মাস চলতে হবে এখন দুশো টাকা নিয়ে চুল দাড়ি কাটা তার কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুনা। উপায় হিসেবে বিশ টাকা দিয়ে একটা ছোট কেচি কিনে নিয়ে এসেছে যেটা এখন তার পকেটে আছে। উদ্দেশ্য আয়না দেখে নিজেই কাটছাট করে নিজেকে কিছুটা চলনসই করা। বাজারের সবচেয়ে ভালো সার্ভিস নেয়া ছেলেটা কিনা নিজেই দাড়ি কাটবে তাও টাকার ভয়ে! শিমুলের হু হা করে হাসি আসে। সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে গায়ে দেয়ার সাবান নেই। পুষ্প না করেছে সে বলেছে একটা সাবান কিনতে ষাট টাকা লাগবে তা দিয়ে এক কেজী চাল চলে আসবে। কিভাবে খরচ কমানো যায় মেয়েটা শুধু এটাই ভাবে। আজকে শিমুল সাবান নিয়ে এসেছে। এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো শুনতে হাস্যকর লাগলেও এগুলো সত্যি।


শিমুল পাতলা তোষকে ক্লান্ত শরীরটা ছেড়ে দেয়। পুষ্প লাইট নিভিয়ে সুরসুর করে শিমুলের কাছে চলে আসে। শিমুল মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে পুষ্পকে দেখে, শিমুলকে কাছে পেলেই মেয়েটা বিড়ালের মতো কাছে ঘেষে থাকতে চায়। পুষ্পর কপালে পড়ে থাকা চুল পিছনে ঠেলে বলে, "আজকে পড়া কতোদূর?"
পুষ্প শিমুলের হাতটা নিজের হাতে পুড়ে নেয়। আরেকহাত গালে ঘষে বললো, "পড়েছি।"
"পড়েছি বললে তো হবেনা। আমার ভালো রেজাল্ট চাই। কেউ যেনো না বলতে পারে বিয়ে করে পরিক্ষায় ডাব্বা পেয়েছো।"
"আচ্ছা।"
শিমুল গম্ভীর গলায় বললো, "আচ্ছা বললে হবে না অফিসার হতে হবে।"
পুষ্প শিমুলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়। কি হবে লেখাপড়া করে? তার শিমুল এমন পরিশ্রম করছে আর সে কিনা কোনো সাহায্যই করতে পারছেনা। শিমুলের ক্লান্ত, শুকনো মুখটা দেখলে পুষ্পর চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে হয়।
"কতো মেয়েই তো চাকরি করে। আমিও করি? তোমার গার্মেন্টসে ঢুকা যাবে না?"
পুষ্পর কথা শুনে শিমুল স্তব্ধ হয়ে যায়। মোবাইলের ফ্লাশ পুষ্পর দিকে করে। তার কথা গলায় আটকে আসে। রয়েসয়ে বলে, "মাথা ঠিক আছে?"
পুষ্প শিমুলের বলিষ্ঠ বুকে মাথাটা গুজে বললো, "সহ্য হয় না। তোমার এই কষ্ট একদম সহ্য হয় না।"

পুষ্প নিঃশব্দে কাঁদে। শিমুল মোবাইলের ফ্লাস অফ করে তার কান্নারত পাখিকে খাঁচায় স্থান দেয়। পুষ্প জানতেও পারল না তাকে বুকে ধরে শক্ত মনের পুরুষের চোখেও যে পানির আনাগোনা। পুরুষদের নাকি কাঁদতে মানা অথচ কেউ জানেনা অধিকাংশ পুরুষ কাঁদে তবে লুকিয়ে। শিমুল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদে।মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে আল্লাহগো একটা ব্যবস্থা করে দাওনা। আমার পাখিটাকে একটু সুখে রাখি।

পলাশ খাতা দেখায় ব্যস্ত। নিধি পাশে বসে পলাশকে দেখে। এই মানুষটা তার জীবনে না এলে জীবনের মানেটাই অজানা থেকে যেতো। সুখের মরণ যে কাকে বলে এটা কখনো জানাই হতো না। এই শান্ত স্বভাবের পলাশ যে এমন উন্মাদ প্রেমিক তা কে কল্পনা করেছে? নিধির মনে হয় স্বামী হিসেবে শান্ত পুরুষই মানানসই। পলাশের চুলে হাত বুলিয়ে বললো, "শিমুল ভাইয়ের খবর নিয়েছেন?"
"হ্যাঁ।"
"কিভাবে চলে? কিছু বলে না?"
"না। টাকা পাঠাতে বললে বলে টাকা আছে লাগবেনা।"
"কি জানি করে আল্লাহ'ই জানে।"

পলাশ মুচকি হাসে। তার ভাই তো! ছোটবেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে। হাড়েহাড়ে চেনা। শিমুলের আত্মসম্মানবোধ প্রখর। তার আব্বা খাওয়া, পরার খোটা দিয়েছে এবার শিমুল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেখাবে। পলাশের দৃঢ় বিশ্বাস শিমুল ভালো কিছু করবে। তার মতোই শিমুলও ইংরেজীতে ভালো ভার্সিটির ক্লাস টপার ছিলো কিন্তু শওকত হাওলাদার সেটা প্রকাশ করার সময় দেয়নি। এখন যেহেতু ঢাকা গিয়েছে অবশ্যই ভালো চাকরি হবে। এমন তুখোড় মেধাবী ছাত্রের চাকরি না হয়ে পারেইনা। নিধি পলাশের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুঞ্চন করে বললো, "হাসেন কেনো?"
"এমনি।"
"শিমুল ভাইয়ের কথা ভাবলে আমার চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। আর আপনি হাসেন?"
"নিধি।আমার ভাইটার প্রবল আত্মসম্মানবোধ। সম্মানে আঘাত করে এমন কিছু হলে সে কাজ করে দেখায়। দেখবে শিমুল আর পুষ্প এমন কিছু করবে যে সবাই চমকে যাবে।"
নিধি আনমনে বলে, "তাই যেনো হয়।"


শওকত হাওলাদারের চেয়ারম্যান অফিসে বিরোধী দলের লোক আক্রমণ করেছে। এতোদিন শিমুল ছিলো বিধায় কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি। যেই না শিমুলের চলে যাওয়ার খবর শুনেছে এমনি তীর্যক কথা, হাতাহাতি আজ শেষ পর্যায়ে অফিস ভাংচুর থেকে মারামারিতে গিয়ে ঠেকেছে। শিমুল নেই বিধায় তিয়াসও আসে না। শিমুল আর তিয়াসই সব বিষয় সামলেছে। শওকত হাওলাদারের মাথায় ইটের বাড়ি লেগে ফেটে গিয়েছে। সেখান থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। মজিব হাওলাদার তাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। পেশকারা দৌড়ে এসে এসব দেখে হাহাকার করে বললো, "শিমুইল্লাই এই প্যাচ লাগাই গেছে। ওরে শিমুইল্লারে কি সর্বনাশ করে গেলি।"

শওকত হাওলাদার বিরক্ত হয়। শিমুল এসব করবে কেনো? বরং শিমুল নেই তাই তো বিরোধী দলের লোক এতো ঝামেলা করার সাহস পেলো। শিমুল থাকলে এসব হবার কোনো চান্সই ছিলো না। শওকত হাওলাদার চোখ বন্ধ করে ভীষণভাবে শিমুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পেশকারাকে ধমকে বলে, "এতো ঘ্যানঘ্যান করো না তো। যাও।"

শওকত হাওলাদারের এই অবস্থায় রাবেয়া কাছেও আসে না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে আর হাসে, শিমুলের অভাব বুঝা মাত্র শুরু! সামনে যে আরো কী কী হবে তা দেখার বিষয়। তার শিমুল এই অহংকারীদের ছোঁয়া থেকে বেরিয়ে গেছে তাতেই তিনি খুশী। হোক একটু কষ্ট তারপরেও শিমুল ভালো থাক সুখে থাক।

শিমুল আজকে দুইটা টিউশনি পেয়েছে, গার্মেন্টসে এর কর্মীর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে উনি ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুইটা টিউশনি থেকে তিন হাজার টাকা আসবে। সেই খবরে তার মনটা খুবই খুশী তার উপর আজকে বেতন পেয়েছে। অভারটাইম সহ মোট নয় হাজার টাকা। বেতনটা পাওয়ার পরে সারা মাসের কষ্ট, গালিগালাজ সব ভুলে গিয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে বাসার বাজার করেছে। খুশীতে বউয়ের জন্য একটা কালো সুতির শাড়ি কিনে ফেলেছে। বাজার থেকে বাসায় আসার পথে শপিং ব্যাগ ফাঁক করে অনেকবার শাড়ীটা দেখেছে আর হাসছে এই দুমাসে বউটাকে কিছুই দেয়া হয়নি এই শাড়িটা দেখলে নিশ্চয়ই খুশী হবে! 

পুষ্প বাজারের ব্যাগ খুলে সাথে শাড়ি দেখে ঠিকই খুশী হয় কিন্তু অভাবের কথা মনে হতেই শাসিয়ে বলে, "কি দরকার শাড়ি আনার। আমার কি কাপড় নেই? কতোগুলো কাপড়।"
শিমুল গামছা হাতে উঠে দাঁড়ায়। বাথরুমে যেতে যেতে বললো, "আমার ইচ্ছা করলো তাই।"
শিমুল চলে গেলে পুষ্প বন্ধ দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে শাড়িটা কাধে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শিমুলের কালো পছন্দ। আর পুষ্পকেও কালোতে বেশী মানায়। পুষ্প মিটিমিটি হাসে। শিমুল দরজা ফাঁক করে এই দৃশ্য দেখে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। এই মেয়েটার মুখে হাসি ফুটলেই তার কষ্ট সফল।

রাতে পুষ্প শাড়িটা পড়ে। শিমুল শুয়ে শুয়ে দেখে। পুষ্পর শরীরটা কি হালকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না! হচ্ছে হয়তো। ভালো মন্দ খাওয়াতে পারে না বিধায় শরীর খারাপ হচ্ছে। পুষ্প শাড়ি পরে শিমুলের বুকে লুটিয়ে পড়ে। শিমুল দু'হাতে পুষ্পকে বুকে জড়িয়ে নেয়। পুষ্প আহ্লাদী গলায় বললো, "সোনা পাখি!"
শিমুল পুষ্পর জুলুজুলু চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "কি চাই? দাবীটা কি?"
"ভয়ংকর প্রেমিক পুরুষের দেখা চাই।"
শিমুল মাথা নাড়িয়ে হাসে। "প্রেমিক পুরুষ তো প্রস্তুত। এখন ইশারা দিলেই হলো!"
পুষ্প মাথা ঝুকিয়ে বললো, "কেমন লাগছে বললেনা যে!"
শিমুল তার গলার ভাজে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো, "বলতে হবে কেনো! তুমি বরাবরই সুন্দর। আমার রানী। শিমুল ফুলের রানী!"
পুষ্প মাথা সরিয়ে বললো, "তাও প্রশংসা করবে। প্রিয় মানুষের মুখে প্রশংসা শুনলে ভালো লাগে।"
"তাই?"
"হ্যাঁ।"
"আচ্ছা। সুন্দরী রাজকন্যা আপনাকে এতো এতো সুন্দর লাগছে যে নিজেকে আপনার কাছে সপে দিতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি এই অধম প্রজার পাগলামীগুলো সহ্য করতে প্রস্তুত?"
শিমুলের বলার ধরন দেখে পুষ্প খিলখিল করে হেসে উঠে। "প্রস্তুত। কিন্তু আজকে মনে হয় প্রজা নয় তার রানী স্বয়ং তাকে জ্বালাবে।"
"রাজকন্যা এতো আমার পরম সৌভাগ্য।"


পুষ্প শিমুলের লোমশ বুকে তার নরম ঠোঁট দিয়ে থেমে থেমে চুমু খায়। শিমুল আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। পুষ্প নাক ঘষে আস্তে আস্তে কামড়ে দেয়। কুট কুট করে কামড়ে শিমুলের শরীরে শিহরণ বয়িয়ে দেয়। শিমুল আস্তে গলায় বললো, "ব্যাথা পাই তো জান।"
পুষ্প বুজে আসা গলায় বললো, "আমার ভালো লাগে।"
শিমুল পুষ্পর কানে ফিসফিস করে বললো, "আমারো তো ভালো লাগে।"
পুষ্প চোখ খুলে তাকিয়ে বললো, "কি?"
পুষ্পর কোমল কবুতরসম বুকে নিজের দন্ত হালকা ছুঁইয়ে বললো, "এভাবে আদর করতে।"
শিমুলের আক্রমণের পরিমাণ কম হলেও পুষ্প আদুরী গলায় আর্তনাদ করে উঠে। শিমুল তার ফুলে মাঝে মজে যায়। পুষ্প আবেশে চোখ বুঝে। ছোট একটা রুমে আদুরে উল্লাসে মুখরিত হয়। চারদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকারকে জানান দেয় শিমুল পুষ্পর টাকা কম কিন্তু ভালোবাসা বেশী। এতো ভালোবাসা যেখানে সেখানে একটু কম খেলেও শান্তি। একটু টাকার অভাবে থেকে নাহয় সুখে থাকুক তাতে ক্ষতি কি! শিমুল ফিসফিস করে বললো, "খুব ভালোবাসি জান। ইচ্ছে করে বুকটার ভেতরে পুরে রাখি।"

পুষ্প আহ্লাদে ঘুঙ্গিয়ে উঠে। এমন কাতরভাবে কয়টা পুরুষ নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে? পুষ্পর শিমুল পারে। নিজেকে উজার করে দিতে তার একটুও সংকোচ নেই। রাতটা কেটে যায় ভয়ংকর ভালোবাসায়, কিছু অপ্রকাশিত কথায়, কিছু অলিখিতো অনুভূতির ছোঁয়ায়। আহা জীবন এতো সুখের কেনো? চারিপাশে এতো সুখের বাতাস কেনো?


আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে জানান


সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে। 


চলবে.....

৪২তম পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন


লেখক সংক্ষেপ :
তরুণ লেখিকা জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন