উপন্যাস       :        তাজমহল প্রথম খন্ড
লেখিকা        :         প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১লা অক্টোবর, ২০২৫ ইং

লেখিকা প্রিমা ফারনাজ চৌধুরীর “তাজমহল - ১ম খন্ড” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশ করা হলো। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৫ সালের ১লা অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করেছেন।

তাজমহল || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
তাজমহল || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী


তাজমহল || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী || প্রথম খন্ড (পর্ব - ১৮)

শাইনা মেঝেতে নিঃশব্দে বসে রইলো। পুরো শরীরটা পাথরে রূপ নিয়েছে। নড়ার শক্তি নেই। তাজদার সিদ্দিকীর দৃষ্টিতে ঝলসে উঠলো তীব্র ক্ষোভ। টানটান হয়ে উঠলো মুখের রেখাগুলো। শাইনার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। রীতিমতো অপমানিত মনে হলো নিজেকে। ঘরজুড়ে অস্থির পায়চারি করলো, নিজের রাগ সামলাতে পারছে না।

কিছুক্ষণ পর তাজদার সিদ্দিকী ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো রকিং চেয়ারে। চেয়ারের কাঠ কাঁপিয়ে কেঁকিয়ে উঠলো একবার। সে পায়ের উপর পা তুলে ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে বসে রইলো। ঠোঁটের কাছে হাত তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালো শাইনার দিকে আঁড়চোখে, চাপা কোনো হিসেবি দৃষ্টিতে।

শাইনা তখনো মেঝেতেই। পা কুড়িয়ে বসে আছে নিঃশব্দে। কাঁধ সামান্য কুঁজো হয়ে এসেছে। হাতে ব্যথা পেয়েছে বেশ। চোখেমুখে কষ্ট লুকোনো যাচ্ছে না। অনেকগুলো চুড়ি ভেঙে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে হাতে।

অনেকটা সময় কেটে গেছে নিঃশব্দে। দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা ঘুরেছে। শাইনা মেঝেতে পা কুড়িয়ে বসে ঝিমোচ্ছে। চোখের পাতাগুলো ভার হয়ে এসেছে।

তাজদার সিদ্দিকী রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল পেছনে। চোখ প্রায় বন্ধ। হঠাৎ এক মুহূর্তে চোখ খুলে গেল। চট করে সামনে তাকিয়ে দেখলো শাইনা এখনো মেঝেতেই, নিস্তেজ ভঙ্গিতে ঝিমোচ্ছে। তার ভ্রু কুঁচকে উঠলো।

চেয়ারের আরাম ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে শাইনার সামনে বসে পড়লো হাঁটু ভেঙে।

শাইনা ধীরে ধীরে চোখ তুললো। বিস্ময়, সংশয় আর অসহায় কৌতূহলে তাকালো তাজদারের দিকে। চোখদুটি লাল, কাঁপা কাঁপা।

তাজদার ধীরে বলে উঠলো, “তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”

শাইনার গালে শুকিয়ে আসা জলের রেখা এখনো স্পষ্ট। সে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চোখে চোখ রাখার সাহস নেই, ইচ্ছেও নেই।

তাজদার এবার শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমার দিকে ভালো করে তাকাও শাইনা মমতাজ।”

শাইনা তাকালো না। নড়লো না অব্দি।

কোনোদিন সে মন ভরে, সময় নিয়ে তাজদার সিদ্দিকীর দিকে তাকায়নি। তাকানোর ইচ্ছেটাই জন্মায়নি কখনো।

ছোটবেলায় একবার, অপমানিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকিয়েছিলো তাজদার সিদ্দিকীর দিকে। আর তখনই তাজদার সিদ্দিকী আঙুল তুলে বলে দিয়েছিলো, “চোখ নিচে।”

সেই চোখ আজও নিচেই নেমে আছে। আর থাকবে। সে কোনোদিন মুগ্ধ হয়ে তাজদার সিদ্দিকীর চোখে চোখ রাখবে না।

এই লোকটা যদি জানতো সে একটুখানি তাকালেই কতখানি ঘৃণা ফুঁসে উঠে তার বুকের ভেতর তাহলে জীবনেও তাকাতে বলতো না। তার দুচোখে পট্টি বেঁধে দিয়ে বলতো আমার দিকে না তাকিয়ে সংসার করো।

সারাজীবন তাদের সাথে দাস গোলামের মতো ব্যবহার করে এখন ঠিক কি কারণে এত তুলোতুলো করছে শাইনা কি সেটা জানেনা? এরা ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ মমতা দেখায় পয়সা, সৌন্দর্য, আর স্ট্যাটাসের উপর ভিত্তি করে। অসম্ভব ঘৃণা করা, হেয় করা, তুচ্ছ করা মানুষ হুট করে ভিন্ন আচরণ করলে যে কারো মনে প্রশ্ন উঠবে। শাইনার মনও নিজেকে প্রশ্ন করেছিল। উত্তরটাও খুব সহজে পেয়ে গিয়েছিল সে।

দরিদ্র পরিবারের শেষ সন্তান ছিল সে। বাবার অল্প আয়। পাঁচ ভাইবোন বড়। সবার পড়াশোনা আর খাবারের খরচ মিটাতে হিমশিম খেতে হতো বাবাকে। তবুও বাবা চেয়েছিল সবাই পড়াশোনা করুক। মানুষ মূল্যায়ন করেনা বলে তিনি খুব দুঃখ পেতেন। চেয়েছিলেন কম খেয়ে হলেও ছেলেগুলো মানুষ হোক। ছেলেগুলো মানুষ হলে সমাজে একটা অবস্থান তৈরি হবে। মানুষ সম্মান করবে।

শাইনা শেষ সন্তান ছিল বলে মায়েরও যথেষ্ট অবহেলা পেয়েছিল। বুকের দুধও বেশিদিন পায়নি সে। দাদীমা তাকে ভাতের মাড় আর সাবুদানার পানি খাইয়ে খাইয়ে নাকি দুধের অভাব মিটাতেন।

মা অন্য ছেলেমেয়েদের খাওয়া পরার চিন্তায় ডুবে থাকতেন। শাইনাকে নিয়ে কোনো আলাদা ভাবনা ছিল না তার। দাদীমা তাকে মানুষ করেছে বলতে গেলে।

মায়ের শেষ সন্তান হওয়ায় সে জন্মেছিল খুবই দুর্বল আর রোগা হয়ে। ছোট থেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে। পা দুটো বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ছোটবেলার ছবি কত সুন্দর। আর তার? তার ছোটবেলার ছবিগুলো দেখলে এখনো চোখে জল আসে। দেখতে ইচ্ছে করে না একদম।

তার পা বাঁকা ছিল, গাল বসে গিয়েছিল, দাঁত বের হয়ে থাকত, চুল এলোমেলো, মুখশ্রী ছিল কঙ্কালের মতো ভাঙাচোরা। দেখতে মনে হতো রাস্তায় পড়ে থাকা অবহেলিত কোনো ভিখারির বাচ্চা। দুটো কাপড়েই কেটে যেত পুরো বছর। রোদেপুড়ে কাপড় ঝলসে যেত, ছিঁড়ে যেত, মা সেলাই করে দিত হাতে। নতুন জামা পেলে তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেত শাইনা।

সে তখন একরোখা, দুরন্ত ছিল। রোদে পুড়ে, মাটিতে গড়াগড়ি খেলে বেড়াত পাড়ার পর পাড়া। তার গায়ের রঙ আরও ঘোলা হয়ে যেত। সেই রঙ, সেই কুৎসিত রূপই হয়তো তাজদার সিদ্দিকী আর তাসমীন আর তাসনুভাদের চোখে চরম অপছন্দের ছিল। এজন্যই তারা ঘৃণা করত, তুচ্ছ করত।

যখন সে ক্লাস এইটে উঠে, তখন হঠাৎ করেই তার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সবাই বলতো এই মেয়েটা হিজড়া হবে, বুকে মাংস নেই, মাসিক হয় না, নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল আছে। মেয়েলি সৌন্দর্য নেই বলে উপহাস করত সবাই।

কিন্তু বয়ঃসন্ধির পর হঠাৎ করে তার শরীর রূপ নিতে শুরু করে। গায়ে মাংস লাগতে থাকে, কাঠের মতো পাটকাঠি দেহে ধীরে ধীরে ঢেউ ওঠে। হুট করে সে অনেকটা লম্বা হয়ে যায়, তার চলাফেরায় নরম ভাব আসে, চোখে-মুখে লজ্জা।

সবার চোখে পড়ে সেই বদল। শাইনা আগে আয়নার সামনে দাঁড়ালেও নিজেকে এড়িয়ে যেত, অত মন দিয়ে নিজেকে দেখতোই না। হঠাৎ একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে নিজেই চমকে উঠলো সে। স্তনের ভার, গভীর নাভি, মসৃণ ত্বক, কোমরের বাঁক সব মিলিয়ে একটা নতুন মানুষ সে! নিজেই নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ঘেমে উঠেছিল, লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। সময় কতকিছু পাল্টে দেয়। গোটা একটা মানুষকেও!

তার গায়ের রঙটা উজ্জ্বল, মসৃণ কিন্তু সেটা তখন চাপা পড়ে ছিল অপুষ্টি, রোদে পোড়া গা, আর অবহেলার ভারে। চুলের গোছাও ছিল ঘন আর মোটা কিন্তু অযত্নে এলোমেলো হয়ে থাকত সবসময়। ঘাড়ে, কাঁধে জমে গিয়েছিল কালচে দাগ।

কিন্তু ধীরে ধীরে বদল এল। যত্ন, সময় আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই কালচে দাগগুলো হালকা হতে লাগল, চুলে ফিরে এল জৌলুস, গায়ের ত্বকে ফিরে এল প্রাণ।

কেউ ভেবেছিল সেই রোগাপটকা, ছেঁড়াকাপড় পরা কুৎসিত মেয়েটা একদিন এলাকার সুন্দরীদের তালিকায় নাম লেখাবে?

শাইনা একদম ঘরকুনো হয়ে গিয়েছিল বয়ঃসন্ধির পর। নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতিও হতে লাগলো। আচমকা সবকিছু কেমন যেন পাল্টে গেল। মানুষের ব্যবহারও পাল্টে গেল। টাকা আর সৌন্দর্য আসলেই ম্যাটার করে। টাকা আর সৌন্দর্য ছাড়া কিচ্ছু হয় না। টাকা আর সৌন্দর্য না থাকলে কেউ দুই পয়সার দাম দেয় না সেটা শাইনার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা।

কলেজে যাওয়ার পথে অনেকের নজরে পড়েছে সে। তারপরপর অনেক সম্বন্ধ আসতে লাগলো। স্কুলে থাকতে যাদের টিটকারি শুনতো তাদের অনেকের কাছে প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে সে। গা গুলিয়ে আসতো তার। প্রতিবেশী রুম্পা আপার বিয়েতে সে হলুদ শাড়ি পরেছিল। তিতলি, তাসনুভা সবাই ছিল সেই হলুদের অনুষ্ঠানে। দূর দূরান্তের অনেক আত্মীয় স্বজন তখন শাইনাকে চিনতেই পারেনি। যখন শুনলো মেয়েটা আশরাফের ছোট বোনটা। তখন সবাই হাঁ হয়ে গিয়েছিল। লোকেমুখে ফিসফিসও করতো এটা বলে মেয়েটা আগে দেখতে কেমন ছিল না? পয়সা হওয়ার পর কেমন পাল্টে গেছে দেখ। টাকায় কত সুখ!

শাইনাকে তার মা বাবার অনেক আত্নীয়স্বজনও হুট করে চিনতে পারেনি। গায়ে হলুদে বাড়ির মেয়েদের গ্রুপ ছবি আর ভিডিওগুলো লন্ডনে বসবাসরত তাজদার সিদ্দিকীর কাছেও গিয়েছিল। সেও কৌতূহলেও জিজ্ঞেস করেছিল তিতলির পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা কে? রওশনআরা বলেছিল, ওই বাড়ির মেয়ে। শাইনা।

তার কিছুমাস পর তাজদার সিদ্দিকী দেশে এল। পুরো বাড়িজুড়ে মিষ্টি বিতরণ হলো। কি হৈচৈ ওই বাড়িতে।

শাইনা প্রথমদিনই দেখেছিল সেই বদমেজাজি, তেঁতো স্বভাবের তরুণ তাজদার সিদ্দিকীকে পূর্ণবয়স্ক, টগবগে যুবকরূপে। চেহারায় এসেছে ধার, চোখেমুখে একরকম ঝলক, শরীরের গঠনে পুরুষসুলভ দৃঢ়তা।

আগের রুক্ষ স্বভাব ছিল আর এখন প্রভাব বিস্তারকারী ভারী ভাব। চলাফেরা, তাকানো, এমনকি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাতেও কত আত্মগৌরব!

অহংকার আর দম্ভের চামড়ায় মোড়ানো তাজদার সিদ্দিকী দৈহিক সৌন্দর্য, আত্নগরিমা, আর গর্ব নিয়ে হেঁটে হেঁটে চারপাশটা কৌতূহল নিয়ে দেখছিল। বিশেষ করে তাদের বাড়ির দালানগুলো। হয়তো ভাবছিল এদেরও দালান হয়েছে?

শাইনা একবারও সামনেও যায়নি। দাদীমা এসে তাজদার সিদ্দিকীর কত নামধাম করলেন। মাটি হয়ে গেছে ওই বাড়ির ছেলেটা। এখন আর আগের মতো নেই। আগে তো কাউকে সালামটাও দিত না। এখন সবার সাথে হেসেখেলে কথাবার্তা বলছে। মেয়ে দেখছে তার জন্য।

দাদীমা অবশ্য কথাগুলো তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল সেদিন, যেটা শাইনা অনেকটা পরে বুঝেছে।

তাদের প্রতিবেশী এক চাচার বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠার জন্য ফুলের ঢালা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে সবার পেছনে। তিতলি তার সামনে। তারা দুজনেই চাচার বোকামোর কথা বলে হাসাহাসি করছিল। উনি কেকের মাঝখান থেকে গোলাপটা চামচ দিয়ে তুলে কান্নারত ভাইপোর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন কেকের ছবি তোলার আগেই। ক্যামেরাম্যান বকাঝকা করছেন।

ঠিক তখুন শাইনাদের পেছনে ছেলেপেলের দল এসে দাঁড়ালো। একজন হঠাৎ গলা ঝাড়লো। শাইনা চমকে তাকালো। তাজদার সিদ্দিকীও তার দিকে তাকালো। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।

সেই চাচার বিয়ের সবার মধ্যমণি ছিল তাজদার সিদ্দিকী। কারণ অনেকগুলো বছর পর সে গ্রামে এসেছে।

মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই তীক্ষ্ণ। তারা বুঝে ফেলতে পারে, কে কোন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কার চোখ লোভাতুর, কামুক। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে তাজদার সিদ্দিকী তাকে দেখছিল ঘুরেফিরে। শাইনা সাহস করে তাকালো এটা বুঝতে যে তার মনের ভুল কিনা? কিন্তু না। সে যা ভাবছে সেটাই। তাজদার সিদ্দিকী তাকে দেখছে। কপালটা হালকা কুঞ্চিত করে।

সে অস্বস্তিতে মানুষের গায়ের আড়ালে আড়ালে দাঁড়াচ্ছিল বারবার। একবার প্যান্ডেলের বাইরে চলে এসেছিল। সেখানেও তাজদার সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে। ফোনের স্ক্রীনের আলো তার মুখে। শাইনার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই শাইনা দ্রুত পালালো।

তার ঘাম ছুটে গিয়েছিল লজ্জায়, অস্বস্তিতে। বুকের ভেতর মস্তবড় একটা পাথর উঠে এসেছিল সেদিন। সাধারণত অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগ অব্দি সে কখনো অনুষ্ঠান ঘরে আসেনা। কিন্তু সেদিন অনেক আগে চলে এসেছিল। মা, দাদীমা তাকে হাজারটা প্রশ্ন করলো। কিন্তু সে কিছু বললো না। ওই রাতে সে একটুও ঘুমাতে পারেনি।

তখনও সে ভেবেছিল হয়তো মনের ভুল। কিন্তু না।
ভেজা চুল ঝেড়ে ছাদে কাপড় শুকনোর সময় ওই বাড়ির ছাদে হাঁটতে থাকা ছায়াটা তাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল সবটা। পুকুরঘাটে কাপড় ধোয়ার সময়ও সে দেখেছিল ছায়াটা। এমনকি ঘর থেকে উঠোনে বের হলেই যেন চোখদুটো তাকে ঘিরে ধরতো।

সে তাজদার সিদ্দিকীর বাজে চাহনি থেকে বাঁচতে পালাতে কতবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে তার হিসেব নেই। একটা মানুষ শুধু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে এটাই যথেষ্ট ছিল তার রাতের ঘুম হারাম করার। কি লজ্জা, কি গা গুলানো বিশ্রী অনুভূতি, ওই ধরণের কিছু ভাবতে গেলেই মনে হতো দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তাজদার সিদ্দিকীর সামনে দাঁড়াবে ব্যাপারটাই কতটা জঘন্য। যার চোখে চিরকাল ঘৃণা দেখেছে সেই চোখে অন্য কিছু কতটা অস্বস্তিকর!

নিজের সৌন্দর্যকে বাহবা দিয়েছিল সে। এই সৌন্দর্য তাকে কত মানুষ চিনিয়ে দিল। কত মানুষের কত রূপ দেখিয়ে দিল।

আননোন নাম্বার থেকে আসা কল, মেসেজ সব তাজদার সিদ্দিকীর ছিল। নাম্বারটা কোথায় পেয়েছিল কে জানে? শুরুতেই একবার কল রিসিভ করেছিল সে। গলার ঝাড়ার শব্দ পেয়ে ফোনটা ছিটকে পড়েছিল হাত থেকে। মেসেজ আর কলগুলো দেখলে তার হাত পায়ে কাঁপুনি ছুটতো। কি দুঃসাহস ওই লোকটার! সে ভাবে কি করে শাইনা তার সাথে ফোনে কথা বলবে? টাকা দিয়ে মন কেনা যায় নাকি? কি জঘন্য! তাজদার সিদ্দিকী অনেকবার তার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। শাইনা পালিয়ে পালিয়ে থেকেছিল। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। আর সেটাই হয়েছে।

যারা মানুষকে টাকা আর সৌন্দর্যের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপে সেই ছোটলোকদের বাড়িতে বউ হয়ে না আসার জন্য আল্লাহর কাছে দুহাত তুলেছিল সে। কেন কবুল হয়নি কে জানে? যে লোকটা তার অভাবগ্রস্থ নিরীহ রূপটাকে ঘৃণা করেছিল সেই লোকটাই তার সৌন্দর্যে ঘায়েল হয়ে বিয়ে করেছে। ভবিষ্যতে সে তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে। তখন?

_____

তাজদার সিদ্দিকী গমগমে গলায় বলল,"শাইনা মমতাজ কথা বলো। নয়তো তাকাও। আমি কি বলছি শুনতে পাচ্ছ?"

শাইনা অল্প করে তাকালো। এই চেহারায় কোনো মায়াদয়া নেই, আপাদমস্তক কঠিন, শক্ত ঠোঁটদুটোর কাঠিন্যই বলে দেয় কতটা রুক্ষভাষী এই লোক। এই লোকটা পুরো পৃথিবীর সমস্ত সুখ পায়ের কাছে এনে দেবে বললেও তার ক্ষত মুছবে না। তার মন বসবে না। না এই হিংস্র চেহারাটার দিকে তাকালে মন গলবে কখনো। অতি জঘন্য, অতি নৃশংস এই লোক। সে চোখ সরিয়ে নিল। তাজদার বলল,

"আমার সাথে সহজ হও। তাকাও আমার দিকে। এভাবে চলতে থাকলে সব শেষ হয়ে যাবে।"

শাইনা একদম তাকালো না। তার এত অস্বস্তি এত ছটফটানি দেখেও লোকটা সামনে থেকে সরলো না। এদের কাছে অন্য কারো সুবিধা-অসুবিধা, ছটফটানি, অস্বস্তি এইসব কোনো ব্যাপারই নয়।

বরং তাকে কোলে তুলে নিল আচমকা। শাইনা রেগেমেগে তাকালো।

তাজদার তাকে বুকের কাছে ধরে রেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

"পুরোনো কথা ভুলে যাওয়ার জন্য হলেও আমার দিকে তাকাও। আমি বারবার তোমাকে রিকুয়েষ্ট করবো না। আমাকে খেপাবে না। আমি আগের মতো না থাকলেও খুব ভালো মানুষ হয়ে যায়নি। আমি মানুষকে মাথায় তুলতে জানি। আবার মাথায় তুলে আছাড়ও মারতে জানি। আমার সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করবে না। তাকাও আমার দিকে।"

শাইনা অনেকবার তাকিয়েছে তার দিকে।
কিন্তু মনের চোখ দিয়ে যখনই তাকালো তখনই একটা ভয়ংকর অতি কুৎসিত, বিকৃত, বিকল, অমানুষের মতো চেহারা তার চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। কি করে সে বোঝাবে কারো দিকে তাকানোর জন্য ওই চেহারায় একটু মায়াদয়া, মানবিক ছাপ থাকা লাগে। যা তাজদার সিদ্দিকীর চেহারায় নেই। মানুষের মুখের আদলেও বোধহয় এক সময় স্বভাবের ছায়া পড়ে। মনের রং-ও লেগে থাকে চোখের কোণে, ভ্রুর রেখায়, ঠোঁটের বাঁকে।

হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে আর বোঝাতে পারে না শাইনা। পছন্দ হয় না। তাকাতে ইচ্ছে করে না।

কি পরিমাণ ঘৃণা জমে আছে তার ভিতর। ভাবলে নিজেকেই অবাক লাগে। তাজদার সিদ্দিকীর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতর একটা গা-গোলানো অনুভূতি হয়। একধরনের বিক্ষোভ, একরাশ বিতৃষ্ণা।

আর দশজনকে নিয়ে যেমন রাগ বা বিরক্তি হয়, ওটা ঠিক সেরকম না। অসহ্যকর একটা অনুভূতি। সে নিজেই পালিয়ে বেড়ায় এই অনুভূতি থেকে।

সে কখনো ভাবেনি তাজদার সিদ্দিকীর প্রতি নিজের ঘৃণা যেন একটু কমে, সে প্রার্থনাও করতে হবে আল্লাহর কাছে। সে আর পারছেনা। তার মাথায় আর কূলোচ্ছেনা। না সে ঘৃণা করে শান্তি পাচ্ছে, না সে তাজদার সিদ্দিকীর প্রতি মন বসাতে পারছে। মাঝপথে দাঁড়িয়ে নিজের এই অসহায়তা, দ্বন্দ্ব সবকিছুর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে নিজেই।

তাজদার তাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। তার সামনে বসে হাতটা দেখে নিয়ে নিজে নিজে বলল,"সকালে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে এইসব কাঁটাছেড়া কেন হলো তখন কি হবে?"

শাইনা চুপ করে রইলো। তাজদার তার দিকে তাকাতেই শাইনাও তাকালো। কিছুক্ষণ নীরব মুহূর্ত পেরিয়ে গেল।

"আমি কি খুব খারাপ?"

প্রশ্নটাই শাইনা কেমন চমকে গেল। সে ইচ্ছে করে উত্তর দিল না। তাজদার কঠোরভাবে বলল,"আনসার মি। তুমি আমার সাথে মনখুলে কথা না বললে সহজ হবে কিভাবে? কথা বলছো না, তাকাচ্ছ না, কাছে থাকতে দিচ্ছ না, আগেও পালিয়ে পালিয়ে থেকেছ। সমস্যা কি বলবে? তোমার কোনো ধারণা আছে তোমাকে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকে কতকিছু ফেস করতে হয়েছে? তুমি এরকম করতে থাকলে সবাই আরও পেয়ে বসবে আমাকে। কারণ আমি তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। তুমি এগজ্যাক্টলী চাইছোটা কি? আমার মানসম্মান শেষ করার পায়তারা করছো?"

শাইনা তার চোখে চোখ রাখলো। একনিশ্বাসে বলল,"কিন্তু আমি আপনাকে পছন্দ করিনা। আপনার স্পর্শ তো বহুদূর আপনার ছায়াকেও আমি ভয় পাই। আমি হয়তো দেখাইনা কিন্তু আমি সত্যি ভয় পাই। এইযে আপনি আমাকে ধরছেন এতেই আমার গা গুলিয়ে আসে। অহংকারী চেহারাটাতে আমি আমি আমার জন্য নিখাদ কিছু দেখিনা।"

কথাগুলো বলার সময় শাইনার গলা কাঁপছে। হাতের আঙুল, পা কেমন টানটান হয়ে উঠেছে।

"আপনি আমার সামনে বসে আছেন এটা ভাবতে বসলেই আমার কেমন জানি লাগে। আপনি আমার গায়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলবেন না। আপনি বাজেভাবে তাকান। আপনাকে আমার ভালো লোক বলে মনে হয় না।"

তাজদার সিদ্দিকী বলল,"আমি সবসময় তোমার দিকে বাজেভাবেই তাকাব। প্রমিজ।"

শাইনা দাঁত চিবিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,"বখাটে।"

"ইয়েস আইএম।"

শাইনা শুয়ে পড়লো বিছানায়। গায়ে আঁচলটা জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

"আপনার চেহারাটা আমি সহ্য করতে পারিনা এটা আমার দোষ নয়। আপনার চেহারার দোষ।"

তাজদার একঝটকায় তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল,

"দোষ তোমার চোখের। আমি সুন্দর। তুমি মনের চোখ খুলে দেখো।"

শাইনা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

"আপনার পিরিতি দেখে তো আমি অবাক হচ্ছি। মনে এত প্রেমের বাতাস লাগলো কবে থেকে? বাপরে বাপ। সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে সব।"

তাজদার বলল,

"আমি বিয়ে করেছি বলে ঠেকায় পড়িনি। তোমাকে আমি বিয়ে করেছি এটাই বেশি।"

"আপনি আমার মতো ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছেন এটাই বেশি।"

বলেই শাইনা সরিয়ে দিল শক্তপোক্ত শরীরটাকে। কথায় কথায় গায়ের উপর উঠে আসে। বাজেভাবে ছুঁয়ে দেয়। বেয়াদব!

তাজদার সিদ্দিকী এত অপমান সওয়ার মতো লোক নয়। চোটপাট দেখিয়ে দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। শাইনা বলল,

"ইগো খুব ব্যাথা পেয়েছে?"

দরজা খুলে গেছে ততক্ষণে। তাজদার সিদ্দিকী থেমে গেল দরজা একটা ধরে রেখে। ধীরেধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তারপর ভেতরে ঢুকে ধপাস করে আবারও দরজা বন্ধ করে দিল। শাইনা পায়ের নিচ থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে নিজেকে লাশের মতো পেঁচিয়ে নিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকলো। হাতটা ব্যাথা করছে।

তাজদার সিদ্দিকী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে হতাশ হয়ে বলল,"লাশের সাথে সংসার!"

শাইনার জবাব ভেসে এল,"আমার লাশও আপনার সাথে সংসার করবেনা।"

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 


 Follow Now Our Google News



চলবে ...

১৯ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

প্রিমা ফারনাজ চৌধুরীর গল্প ও উপন্যাস:

লেখক সংক্ষেপ:

তরুণ লেখিকা প্রিয়া ফারনাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। কল্পনার ভূবনকে শব্দে রুপ দিতে লেখালেখির জগতে তার পদচারণা শুরু হয়েছে ২০২১ সালের মার্চ মাসে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রিমা পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত আছেন অনলাইনভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং পেশায়। ‘প্রিয় বেগম’ উপন্যাসের মাধ্যমে তার পরিচিতি বেড়েছে। ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠকদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। শব্দের জগতে তার পথচলা এখনো চলমান। ভবিষ্যতে আরও পরিপক্ক, আরও বৈচিত্রময় লেখালেখির মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিতে চান তিনি।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন