মুক্তমত : জয় বাংলা : আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে
লেখক : নীলা ইসরাফিল
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
রচনাকাল :
অভিনেত্রী, লেখক ও রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট নীলা ইসরাফিলের লেখা “জয় বাংলা : আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে” শিরোনামের এই মুক্তমতটি ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর লেখিকা নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন। তার এই লেখাটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
![]() |
| জয় বাংলা : আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে || নীলা ইসরাফিল |
জয় বাংলা : আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে || নীলা ইসরাফিল
যে শব্দটি নিয়ে আজ এত বিতর্ক, সেটার জন্ম আসলে আজকের রাজনীতিতে নয়। “জয় বাংলা” শব্দটি উঠে আসে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে, বিশেষ করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তখন বাংলাদেশ নামে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তখন কোনো রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না। তখন যারা “জয় বাংলা” বলত তারা ছিল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, পেশাজীবী, নারী-পুরুষ সাধারণ মানুষ।
এই শব্দটি তখন ব্যবহার হতো-
. ভয় কাটাতে,
. অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে,
. নিজেদের পরিচয় দিতে “আমরা বাঙালি, আমরা মুক্তি চাই।” অর্থাৎ ইতিহাসের সত্য হলো “জয় বাংলা” কোনো দলীয় অফিসে বসে বানানো শব্দ না। এটা রাস্তায়, মিছিলে, কারাগারে, যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া একটি শব্দ।
এখন প্রশ্ন হলো, যে শব্দ রাষ্ট্র জন্মের আগেই জনগণের মুখে ছিল, সেটা কীভাবে পরে কোনো দলের একক সম্পত্তি হয়ে যায়? আইনের ভাষায় এটাকে বলে পূর্বপ্রযোজ্য মালিকানা দাবি (retrospective ownership), যার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
এখন আসি আইনের কথায়। বাংলাদেশের কোনো আইন, গেজেট বা আদালতের রায়ে “জয় বাংলা” শব্দকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি বা দলীয় স্লোগান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। আইনের একটি খুব সাধারণ নীতি আছে, যা নিষিদ্ধ নয়, তা বৈধ। আর সংবিধান নাগরিককে যে অধিকার দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের অধিকার। কেউ যদি সহিংসতা না করে, বিদ্বেষ না ছড়ায়, রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ না করে, তাহলে একটি ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহারের কারণে তার রাজনৈতিক পরিচয় নির্ধারণ করা আইনসম্মত হতে পারে না।
এখন আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, “জয় বাংলা” ব্যবহারকারী সম্পর্কে যে ধারণা বা মত তৈরি করা হয় সেটাই আসল সমস্যা। আইন কখনোই অনুমানের ওপর দাঁড়ায় না। আইন প্রমাণ দেখে। উদাহরণ দেই, কেউ যদি বলে, “আমি সংবিধান মানি” তাকে কি নির্দিষ্ট কোনো দলের লোক বলা যায়? না। কেউ যদি বলে, “আমি মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করি” তাকে কি রাজনৈতিকভাবে ট্যাগ করা যায়? না। কেউ যদি জাতীয় সংগীত গায় বা পতাকা হাতে নেয় তাকে কি দলীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করা যায়? না। ঠিক একইভাবে কেবল “জয় বাংলা” বলার কারণে কাউকে নিয়ে রাজনৈতিক মত তৈরি করা অনুমানভিত্তিক, প্রমাণহীন এবং আইনের চোখে দুর্বল।
আইনের আরেকটা মৌলিক কথা আছে, আইন বিচার করে মানুষ কী করেছে, কী বলেছে মানুষকে নিয়ে অন্যরা কী ভাবছে, সেটা নয়। আজ যদি শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে কাল চিন্তা প্রকাশ করলেও মানুষকে চিহ্নিত করা হবে। এটা আর গণতন্ত্র থাকে না, এটা হয়ে যায় সামাজিক আদালত। আর ইতিহাস এখানে খুব পরিষ্কার- একটি দল কোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু শব্দটি তার হয়ে যায় না। যেভাবে “বাংলাদেশ” শব্দটি কোনো দলের না, “সংবিধান” কোনো দলের না, “মুক্তিযুদ্ধ” কোনো দলের না ঠিক তেমনভাবেই “জয় বাংলা”ও কারও একার না।
সবশেষে একটা কথা বলতেই হয় একটি ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করে কারও উদ্দেশ্য, রাজনীতি বা চরিত্র নির্ধারণ করা। আইনি যুক্তিতে টেকে না। গণতান্ত্রিক নীতির সাথেও যায় না এবং সমাজকে ভয়ের দিকে ঠেলে দেয়। আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে। এই পথ কখনোই ন্যায়ের পথ না।
আজ ২০২৫ সালে কেউ যদি “জয় বাংলা” বলে তার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে মব তৈরি করা হচ্ছে, ভিডিও করা হচ্ছে, হেনস্তা করা হচ্ছে, কখনো কখনো শারীরিক ভয়ের পরিবেশও সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই জায়গাটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ এখানে আর মতবিরোধ নেই এখানে আছে ভীতি প্রদর্শন ও গণহেনস্তা। আইনের চোখে, একটি শব্দ ব্যবহারের কারণে কাউকে ঘিরে মব তৈরি করা, জনসমক্ষে অপমান করা, ভয় দেখানো বা চুপ করাতে চাওয়া এগুলো মতপ্রকাশের বিরোধিতা নয়, এগুলো আইনভঙ্গ। আইন স্পষ্টভাবে বলে কোনো নাগরিকের ওপর ব্যক্তিগত বা দলগত ভাবে “সামাজিক শাস্তি” চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই।
আইন বিচার করে আদালতে, রাস্তায় নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আইন প্রমাণ ছাড়া কাউকে রাজনৈতিক ভাবে চিহ্নিত করতে দেয় না। কেবল একটি শব্দ ব্যবহার করে কারও উদ্দেশ্য, বিশ্বাস বা রাজনীতি নির্ধারণ করা অনুমানভিত্তিক, প্রমাণহীন এবং বেআইনি। উদাহরণ খুব সাধারণ যেভাবে “সংবিধান” বলা, “মুক্তিযুদ্ধ” বলা, জাতীয় সংগীত গাওয়া কোনোটাই দলীয় পরিচয় নির্ধারণ করে না, ঠিক তেমনি
“জয় বাংলা” বলাও কারও রাজনৈতিক পরিচয় নির্ধারণ করতে পারে না। আজ যদি একটি শব্দের কারণে মব তৈরি হয়, তাহলে কাল আরেকটি শব্দের কারণে হবে, পরশু চিন্তার কারণেও হবে। এই পথ গণতন্ত্রের না এই পথ ভয়ের রাজনীতির। একটি রাজনৈতিক দল শব্দ ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু শব্দটি তার হয়ে যায় না।
সবশেষে একটি কথাই বলব, একটি ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করে কারও বিরুদ্ধে মব তৈরি করা শুধু ইতিহাস বিকৃতি না, এটা আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত। আজ শব্দ নিয়ে বিচার হলে, কাল চিন্তা নিয়েও বিচার হবে। আর তখন কেউই নিরাপদ থাকবে না।
মুক্তমত বিভাগে লেখা পাঠাতে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল ঠিকানা- kobiyal.com@gmail.com
Follow Now Our Google News
লেখক সংক্ষেপ:
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন