উপন্যাস        :        দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা        :         তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
Bangla Golpo দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা

৩৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৩৪)

(ক)

নিশীথের মুখশ্রী উদাসীনতায় জরাজীর্ণ, চোখের চাহনি অস্থির। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাচওড়া ছেলেটাকে দেখে কেন যেন দোলার ভীষণ মায়া হলো। ওর ভেতরকার মায়া কণ্ঠের মাঝে প্রকাশ পেলো। নিশীথের উদ্দেশ্যে শুধালো,
---এত রাতে বাসার নিচে শুধুই আমায় দেখতে এসেছেন?
দোলার বোকা প্রশ্নে নিশীথ কিঞ্চিৎ হাসলো। সহজভাবে বললো,
---তোমার কি আমাকে বিশ্বাস হচ্ছেনা, দোলনচাঁপা?
---হ,হচ্ছে!
দোলা সৎভাবে উত্তর দিলো। নিশীথ এবার জিজ্ঞেস করলো,
---তবে কেন ঐ প্রশ্ন করলে?
---না মানে বলছিলাম যে এ সময় কেউ আসে?
---নিশীথ আসে!
দোলা ঠোঁট টিপে হাসলো। জীবনে প্রথম ওর মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা চলছে, কেমন যেন প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে! মিনিট পাঁচেক সেভাবেই অতিক্রম হলো। নিশীথ বলে বসলো,
---একটু নিচে আসবে?
---এখন?
দোলা চমকে উঠে খানিকটা চিল্লায়। পরে নিজেই নিজের জিভ কামড়ে ধরে গলার স্বর নামায়। চুপিসারে জবাব দেয়,
---এখন কিভাবে যাবো নিচে? কেউ যদি দেখে ফেলে? আমার ভয় করে।
---তুমি আর তোমার ভয়! আমায় প্রেমটাও করতে দিবানা মনমতো!
দোলা কাচুমাচু মুখে তাকায় নিচে দাঁড়ানো নিশীথের দিকে। ও কিভাবে নিশীথকে বলবে, ওর মন চাইছে একছুটে নিশীথের কাছে যেতে। ওর হাতে হাত রেখে রাতের আধারে একটু হেটে বেড়াতে। কিন্তু, সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয়না! দোলার মন খারাপ হয়। নিশীথকে বলে,
---আমার দিকটাও একটু বুঝুন প্লিজ। আমি কিভাবে এ সময় বের হবো?
---আমার উপর যদি বিশ্বাস রাখো, ঠিকই বের হতে পারবে বাসা থেকে। বাকিটা তোমার ইচ্ছে!
---কিন্তু...
দোলার কথায় নিশীথ মলিন চোখে তাকায়। ফোনের ওপাশে বড় করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যে দীর্ঘশ্বাস মিশে ছিল হতাশা, মিশে ছিল পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ। দোলার বুক ভারি হয়। নিশীথ ফোন কেটে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। এমন সময় হাতে ধরে রাখা ওর ফোন ভাইব্রেশনে বেজে উঠে। দোলা ফোন দিয়েছে। নিশীথ পেছনে না তাকিয়েই ফোন কানে নেয়। ও কোনো জবাব না দেওয়ায় কিছুক্ষণ পর দোলা নিজেই বলে,
---পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি আসছি!
নিশীথ মনে মনে খুশি হয়। এবার সে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু দোলা ততক্ষণে ফুরুৎ! জীবনে এই প্রথম, এত বড় দুঃসাহসিক কাজ করতে দোলার বুক দুরুদুরু কাপে। বাড়ির সবাই ঘুমে কাদা, বিষয়টা নিশ্চিত করে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে ও পা টিপে টিপে বের হয় বাসা থেকে। যতটুকু সম্ভব শব্দ না করে বের হওয়া যায় দোলা করেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার পরেও দোলার বুক কাপা বন্ধ হয়নি! ওর মনে হচ্ছে এই বুঝি, মা এসে যাবে। ওকে দেখে প্রশ্ন করবে "এত রাতে চোরের মতো কোথায় যাচ্ছিস, দোলন?" তখন ও কি উত্তর দেবে?
নানান প্রশ্নের মেলা বসে দোলার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে। তবু বের যখন হয়েছে, তখন তো নিচে যেতেই হবে!
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ভয়ে ভয়ে দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে দোলা নেমে পড়ে দোতলায় ওদের বাসা থেকে। এ বাসায় দাড়োয়ান না থাকলেও দোলা ভাবছিলো দরজার কাছে কাউকে দেখতে পেলে কি হবে? ঠিক এমন সময় আশ্চর্যজনকভাবে দোলা লক্ষ্য করে গেটের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে দোলা উল্টোপথে তড়িঘড়ি করে ফিরতে যাবে এমন সময় সেই ব্যক্তিটি ধীরস্বরে ওর নাম ধরে ডাকে। বিস্ময়ের সাথে দোলা অনুধাবন করে লোকটা আর কেউ নয়, বরং তূর্য! ছেলেটা ওকে বললো,
---আরে ভাবি দাঁড়ান। সেই ১২টা থেকে ভাই আমাকে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছে আপনার জন্য। মাত্র এলেন। আমি তো ভেবেছিলাম আসবেন না। অথচ ভাই শিওর ছিলো আসবেন। এজ ইউজুয়াল, ভাইয়ের কথাই ঠিক হলো!
তূর্যর কথায় দোলা লজ্জিত হলো। তার মানে নিশীথ এখানে আসার সময় থেকে এতক্ষণ ছেলেটাকে গেটের কাছে দাড় করিয়ে রেখেছে? অথচ ওকে একবারো বলেওনি এ ব্যাপারে!
কি লজ্জার ব্যাপার। ছিঃ!
তূর্য কোনোরকম শব্দ ছাড়া গেট খুলে দিতেই দোলা তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এলো বাসার বাহিরে। নিশীথ দাঁড়িয়ে ছিলো বাসার সামনেই। দোলার অপেক্ষা করছিলো চুপচাপ। ওকে বেরিয়ে আসতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে দোলার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। দোলা কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজনে চলে এলো ওদের বাড়ির সাইডের আবছা অন্ধকার জায়গায়! এদিকটায় ল্যাম্পপোস্টর আলো পড়েনা ঠিকমতো। অর্থাৎ, কেউ দেখতেও পারবেনা ওদের এখানে। নিশীথ তা ভেবেই দোলাকে এখানে এনেছে।
দোলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এতক্ষণ বাসা থেকে বেরোনোর আগে ওর মনে প্রচন্ড ভয় ছিলো, পাছে কেউ দেখে ফেলবে কিনা এ ভয়! অথচ, এখন এই নিশুতি রাতে বাসার নিচে নিশীথ এর সাথে একা একা লুকিয়ে দেখা করছে বিষয়টা উপলব্ধি করতেই ওর তনে-মনে ভয়ের পরিবর্তে উল্টো লাজের আবরণ ছেয়ে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত লজ্জায় ঘিরে ধরেছে মেয়েটাকে! সারাজীবন প্রেম না করা মেয়েটা যৌবনের সূচনায় প্রেমিক পুরুষের সাথে এমন লুকোচুরি সাক্ষাৎ এর মুহুর্তে কেমন রিয়েকশন দেওয়া উচিত দোলা জানেনা।
নিশীথ এতক্ষণ একধ্যানে প্রেয়সীর মুখশ্রী লক্ষ্য করছিলো। মাথা নিচু করে লাজুক ভংগিতে চেয়ে থাকা এ মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে এই মেয়ে ওর প্রেমিকা নয়? ওদের দুজনকে একসাথে এ সময় দেখলে কে বলবে ওদের মাঝে আর দুটো কপোত-কপোতীর মতো কোনোরকম প্রেম-বিনিময় ঘটেনি? বরং, ওদের দেখলে যে-কেউ বলবে ওদের মাঝে নির্ঘাত মাখো মাখো প্রেমের সম্পর্ক আছে! নয়তো কেউ এভাবে প্রেমিকের এক ডাকে এ সময় বাড়ি ছেড়ে এভাবে চলে আসে? আসেনা!
দোলার দিক চেয়েই নিশীথের অন্তর অনেকটা প্রশান্ত হয়। আলতোভাবে মেয়েটার থুতনিতে হাত রেখে ওর মুখ তুলতেই দোলনচাঁপা লজ্জায় মিইয়ে যায়। এক ঝটকায় নিশীথের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। কাচুমাচু মুখে এদিক-সেদিক চায়। নিশীথ আড়ালে হাসে। দোলাকে এমন চুপ থাকতে দেখে বলে,
---আমার সাথে দেখা করতে নিচে কেন এলে, দোলনচাঁপা?
দোলা ভ্যাবাচেকা খায়। নিজেই ডাকলো দেখা করার জন্য আবার নিজেই এমন প্রশ্ন করছে? লোকটা অদ্ভুত। দোলা নিচু স্বরে বললো,
---আপনিই তো নিচে নামতে বল্লেন!
---আমি বললেই তুমি নিচে নামবে?
নিশীথ পাল্টা প্রশ্ন করে। দোলা বিস্মিত চাহনি দিয়ে শুধায়,
---মানে? কি বলছেন?
---বলছিলাম, একটা ছেলে রাত ১২.৩০টায় তোমায় বাড়ির নিচে ডাকলো দেখা করার জন্য আর তুমিও কিনা আসার জন্য রাজি হয়ে গেলে? একবারো কি নিজের জন্য চিন্তা হলোনা?
দোলা কিছুক্ষণ বিস্ময় চাহনি নিয়ে চেয়ে রয় নিশীথের দিকে। যেন বুঝার চেস্টা করছে ও কি বলছে। খানিক বাদে বোকা বোকা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
---আমার জন্য চিন্তা হবে কেন?
নিশীথ মাথা চাপড়ায়। এ মেয়ে আর সময় চতুরতা দেখালেও ওর কাছে এসে কেমন বোকা হয়ে যায়! কয়েক কদম দোলার দিকে এগিয়ে আসে। দোলা সরতে চাইলেও হাত দিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে নড়াচড়ায় বাধা দেয় নিশীথ। এবার দোলার অন্তরে ভয় জাগে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়। চোখদুটো বুজে আসে। এরই মাঝে নিশীথ ওর কানের কাছে মুখটা এলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
---আমার বোকা দোলনচাঁপা! আমি যদি এখন তোমার সাথে কিছু করি? তুমি কি ভয় পাচ্ছোনা?
দোলা বুজে থাকা চোখ খোলে তাকায় নিশীথের দিকে। ততক্ষণে নিশীথের মুখ ওর মুখের সামনে। ওই আবছা আধারেও দুজনের চোখাচোখি হয় কিছুক্ষণ! চোখে চোখে না বলা কথা বিনিময় হয়। দোলা যেন নিশীথের ওই চোখের ভাষা পড়তে পারে! ও সহজভাবে জবাব দেয়,
---আমি জানি আপনি কিচ্ছু করবেন না!
বলাবাহুল্য, দোলার এত সহজ স্বীকারোক্তিতে নিশীথ খানিকটা অবাকই হয় বটে। তার মানে, দোলা সত্যিই ওর সাথে সেইফ ফিল করে! নিশীথ এর ভালোবাসা, ওর নিয়ত সবটাই মেয়েটা ভালো করে বুঝে! নিশীথের ঠোঁটের কোণে প্রসন্ন হাসি ফুটে। ও ডান হাতে দোলার গালে আলতোভাবে হাত ছোয়ায়। যে স্পর্শে দোলা খানিকটা কেপে উঠে। কিন্তু নিশীথের হাত সরিয়ে দেয়না এবার। বরং, সাহস করে নিশীথের চোখের দিক চেয়ে থাকে! এমন অবস্থায় নিশীথ প্রশ্ন করে,
---আমায় পছন্দ করো, দোলনচাঁপা?
দোলা চমকায়। নিশীথের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ দ্রুতবেগে নামিয়ে নেয়! এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
---আ,আমি অনেকক্ষণ ধরেই তো আছি। আমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। মা মাঝেমধ্যে উঠে যায়!
দোলা যেতে নিলে নিশীথ পেছন থেকে ওর হাত চেপে ধরে। শান্তভাবে বলে,
---উত্তর না দিলে আজ তোমায় যেতে দিচ্ছিনা।
দোলা পেছন ফিরে তাকায়। দু'চোখে আকুতি মিশিয়ে অসহায়ভাবে বলে,
---প্লিজ? হাতটা ছেড়ে দিন!
---দোলনচাঁপা!
নিশীথ চাপাস্বরে ধমক দেয়। যেন সে আজ দোলার মুখে শুনেই ছাড়বে সে ওকে নিয়ে কি ভাবে। অথচ ওই সময় দোলনচাঁপা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে! বেশ চাপা অথচ কোমল স্বরে বলে,
---আমায় যেতে দিন, নিশীথ!
নিশীথ কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়। ধরে রাখা হাতটাও নিজ হতেই শিথিল হয়ে আসে। এ প্রথম দোলার মুখে "ভাই" ছাড়া নিজের নাম শুনতে বড্ড মধুর লাগলো ওর কাছে! হাত ছাড়া পেতেই দোলা এক ছুটে পালিয়ে যায়। নিশীথ একনজরে সেদিকে চেয়ে রয়। বাসার গেটে ঢুকার আগে কি মনে করে দোলনচাঁপা পেছন ফিরে আড়চোখে নিশীথের দিকে তাকায়। নিশীথকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়।
বাসার নিচে গেটের ধারে লাইটের আলোয় ঝলমলে প্রেয়সীর এমন হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে নিশীথ যেন একটা হার্টবিট মিস করে! ওর ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। হঠাৎ করেই নিশীথ অনুভব করে, গত দু'রাত ধরে অশান্ত বিক্ষিপ্ত থাকা ওর মনটা এখন নিজ থেকেই প্রফুল্ল হয়ে গেছে!


(খ)

ঢাকার গুলশানের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে তালুকদারদের পক্ষ থেকে খন্দকারদের জন্য ক্যাজুয়াল ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা সপরিবারে এসেছেন। ফরমাল আলাপের গন্ডি পেরিয়ে আজ কিছু বাহিরের আলাপও হলো। নিশীথও বাপ-চাচার সাথে স্যুট পড়ে হাজির হয়েছে। ও নিজের রেগুলার গেটাপে যেতে চাইলেও পারেনি। কেননা, নতুন ডিলারদের সামনে একটা ইম্প্রেশনের ব্যাপার আছে। সবমিলিয়ে ডিনারটা বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। দুই পরিবার একে-অপরের সাথে পরিচিত হলো। খন্দকার সাহেব ও নিশীথের বাবা নানারকম আলাপে মশগুল। নিশীথ এর ফোন আসায় ও উঠে গিয়েছিলো খাওয়া শেষে। পরে আর টেবিলে ফিরে না গিয়ে নিজের মতোন এককোণে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিলো চুপচাপ। ওয়েটার সবাইকেই সফট ড্রিংক সার্ভ করে অবশিষ্ট একটি গ্লাস নিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। তা দেখে নিশীথ ড্রিংকটা নেওয়ার জন্য ওয়েটারকে ডাকে। ওয়েটার ঘুরে নিশীথকে ড্রিংক দিতে যাবে একিসময়ে, একটি মেয়েলি ওয়েটারকে ডেকে উঠে "এক্সকিউজ মি"।
ওয়েটারের সাথে নিশীথ সামনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটিকে। ওকে চিনতে পেরে ভ্রু কুচকায়। ওটা খন্দকার সাহেবের ছোট মেয়ে, লিরা। হয়তো ওর সমবয়সীই হবে! আজকেই এখানে এসে পরিচয় পর্বের সময় দেখেছে ওকে। এদিকে, ওয়েটার দু'পাশ থেকে ডাক পাওয়ায় একবার নিশীথের দিকে তো একবার লিরার দিকে তাকায়। নিশীথ ওয়েটারকে হাত দিয়ে লিরার কথা শুনতে ইশারা করলেই ওয়েটার বলে,
---ম্যাম, কিছু বলবেন?
---ইয়েস। আপনি টেবিল সেভেন থেকে এ ড্রিংক নিয়ে আসছেন, রাইট? আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। দিস ইজ মাই ড্রিংক।
মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ড্রিংক নিতে গেলেই ওয়েটার বললো,
---ম্যাম, স্যার আমাকে আগে ডেকেছিলেন।
মেয়েটা মাথা ঘুরিয়ে নিশীথের দিকে তাকাতেই চমকে যায়। ওকে চিনতে পেরে বিব্রত স্বরে বলে,
---ওহ সরি। আপনি নিন। আমি টেবিলে গিয়ে বসছি, আমাকে আরেকটি ড্রিংক এনে দিন!
ওয়েটারকে কথাটি বলে লিরা কেটে পড়তে ধরলে নিশীথ ওকে থামিয়ে বলে,
---নো ইটস ওকে। আপনিই নিন। আমি এমনিতেও নিজেরটা খেয়েছি। দিস ওয়াজ ফর ইউ। ইউ টেক দিস প্লিজ।
---না না ইটস ওকে। ইউ ক্যান হ্যাভ দিস!
---আই ইনসিস্ট! আপনি নিয়ে নেন। ওয়েটার ড্রিংকটা উনাকে দাও। এক্সকিউজ মি!
ভদ্রতার খাতিরে কথাগুলো বলে নিশীথ ইতস্তত হেসে ওখান থেকে চলে যায়। লিরা গ্লাস হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিশীথের প্রস্থানের দিক তাকিয়ে টেবিলে ফিরে আসে। নিশীথ সেই যে গেলো, সোজা চলে এলো আরেফিন সাহেবের নিকট। চাচার কাছে এসে চোখমুখে কিছুটা বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে বলে,
---চাচ্চু, আর কতক্ষণ থাকবে তোমরা এখানে? ডিনার তো শেষ। রাত ১০টা পার হয়ে গেছে। বাসায় যাবেনা?
---যাবো তো, নিশীথ। মাত্র ডিনার শেষ হলো। এখনি উঠে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? আর কিছুক্ষণ ওয়েট কর। বেশি দেরি হবেনা আমাদের!
নিশীথ ভোতা মুখে বললো,
---আমার একটু কাজ আছে। আমি তবে বেরিয়ে যাই? তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও, কেমন?
ভাতিজার কথায় আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকান। যার জন্য এ ডিল হলো সেই কি-না ডিনার শেষ হতেই চলে গেলে, ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না? আর এই রাত-বিরেতে আবার কিসের কাজ? তাই উনি প্রশ্ন করলেন,
---কিসের এত তাড়া তোর? একসাথেই তো এলাম সবাই। একসাথেই বাসায় ফিরবো। একটু সময় দে না, বাপ! এ সময় কি এমন কাজ আছে তোর শুনি?
---তোমরা বুঝলে তো নিজেরাই যেতে দিতে।
নিশীথ বিড়বিড়িয়ে বললো। আরেফিন সাহেব তেমন কিছু বললেন না আর। কিন্তু নিশীথকে যেতেও দিলেন না। অগত্যা নিশীথকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হলো সেখানে। সবমিলিয়ে সবার বেরোতে বেরোতে রাত ১১টার মতোন বেজে গেলো!
বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হতেই সারাদিনের ব্যস্ততায় নিশীথের দু'চোখে ভর করলো রাজ্যের ঘুম। ঘুমের চোটে পকেট হাতড়ে ফোন বের করার সুযোগ অব্দি সে পেলোনা। তলিয়ে পড়লো ঘুমের সাগরে। অথচ ওর পকেটের তলে পড়ে থাকা ফোনে দোলনচাঁপার দেওয়া কয়েকটা মেসেজ জমে রইলো।
নিশীথ জানতেও পারলোনা!
___________________
পরদিন সকালে নিশীথ জিমে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো। আজ একটু দেরি করেই অফিসে যাবে সে। আয়মান সাহেবও এটা জানেন তাই নিশীথ নিজের মতোন ঘুম থেকে উঠে সব সেড়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাইক নিয়ে। এলাকা পেরিয়ে বাজারের সামনে সামান্য জ্যাম লেগে আছে। মেইনরোডের আগে সরু রাস্তা হওয়ায় দুটো গাড়ির একসাথে আটকে আছে। লোকজন মিলে কিভাবে রাস্তা ক্লিয়ার করা যায় তা নিয়ে ঝগড়া করছে। জ্যাম ছাড়তে বেশ ভালোই সময় লাগবে মনে হচ্ছে!
এরই মাঝে বাইকে বসে বসে নিশীথ লক্ষ্য করলো রাস্তার পাশ দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে পারভীন বেগম হেটে যাচ্ছেন। নিশীথের তাকানোর কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ পারভীন বেগম ওকে খেয়াল করলেন! নিশীথ খানিকটা হেসে তাকে সালাম দিলো। উনি সালামের জবাব দিলেন। নিশীথ ভেবেছিলো, পারভীন বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বাড়ির পথে চলে যাবেন। অথচ দেখা গেলো, উনি নিশীথের দিকে এগিয়ে আসছেন। নিশীথ কিছুটা বিস্মিত হলেও চোখেমুখে তা প্রকাশ করলোনা। ভাবলো, হবু শাশুড়ি নিজ থেকে এগিয়ে আসছে? ভালোই তো। ওর নিশ্চয়ই একটা ভালো ইমেজ আছে উনার নজরে!
পারভীন বেগম বাজারের বাগ মাটিতে রেখে নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,
---সকাল সকাল কই যাও, বাবা?
---জিমে যাচ্ছি, আন্টি। ওখান থেকে ফিরে রেডি হয়ে অফিসে যাবো! এ মাসেই জয়েন করেছি।
নিশীথ ইচ্ছে করেই উনার সামনে অফিসের কথাটা বললো। যাতে পারভীন বেগম বুঝেন, সে কাজে জয়েন হয়েছে, তার মেয়েকে নিজের টাকায় খাওয়ানো-পরানোর যোগ্যতা নিশীথের আছে! ওর কথায় পারভীন হেসে বললেন,
---আমি জানি তো!
---জি? কিভাবে জানলেন?
নিশীথ বোকার ন্যায় প্রশ্ন করে। ওর মুখের দিক তাকিয়ে পারভীন বেগম মিহি হেসে বললেন,
---তোমার দোলনচাঁপাই বলেছে আমাকে এসব কথা!
নিশীথের মন প্রফুল্ল হলো! "তোমার দোলনচাঁপা" কথাটা কানে সুরের ন্যায় বাজতে লাগলো কয়েকবার! ও বুঝেনি দোলনচাঁপা ওকে নিয়ে মায়ের সাথে গল্প করবে কখনো! তাইতো এ বিস্ময়।
কিন্তু দোলার মা ওকে এভাবে বলেছে, তার মানে একপক্ষ থেকে বিয়েটা পাকাপোক্ত প্রায়! এখন শুধু ওর পরিবার রাজি হলেই হয়ে যাবে। নিশীথ ঠোঁট কামড়ে ভাবলো। এরই মাঝে পারভীন বেগম বললেন,
---তোমার পরিবারে কি দোলার সাথে তোমার ব্যাপারে কথা বলেছো, নিশীথ?
এবার নিশীথের হাসি হাসি মুখটা কিঞ্চিৎ কালো হয়ে এলো। তা নিরবে ঠিকি লক্ষ্য করলেন পারভীন বেগম। উনি রাখঢাক না করে সরাসরি বললেন,
---এসব কথা হঠাৎ কেন বলছি জানো?
নিশীথ এবারো চুপচাপ মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে জানেনা। শুধু প্রশ্ন করে,
---কেন?
পারভীন বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
---জোয়ান মেয়ে ঘরে বসে থাকলে ওর বিয়ে নিয়ে নানারকম ঝামেলা পোহাতে হয়। তার মধ্যে মেয়েটার যদি বাবা না থাকে, তবে তো কথাই নেই কোনো। আমার দোলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই!
---মানে? কি বলছেন, আন্টি? একটু সরাসরি বলুন। আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
---দোলার আগের সম্বন্ধের কথা তো জানোই। ওটায় কত কাহিনি হলো! আমার ভুলেই বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিলো যদিও। তাই একটা বিয়ে প্রায় ভেঙে যাওয়ায় আমাদের পরিবারে ওর বিয়ে নিয়ে সবাই অনেক কাহিনি শুরু করেছে। যে যেখান থেকে পারছে, ইচ্ছে মতোন ছেলের সম্বন্ধ আনছে। বয়স অধিক হোক, কিংবা আগের বিয়ে হওয়া হোক না কেন, সেগুলো দেখার কেউ প্রয়োজন মনে করছেনা। অথচ, আমার এত ভালো মেয়ের ভুল কি জানো? ওর একটা বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। এদিকে রাকিব যে কতটা খারাপ ছিলো সেটা কেউ দেখবেনা। সমাজ শুধু মেয়েদের দোষটাই আগে খুজে!
পারভীন বেগমের কথায় নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রাগে। মাথায় আ'গুন ধরে যায়। এবার সে বুঝে, কাল অত রাতে দোলনচাপা কেন ওকে সেই মেসেজগুলো পাঠিয়েছিলো। নিশীথ ভাবনায় পড়ে যায়। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত পৌনে বারোটার দিকে দোলা ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে। যা কিছুটা এমন ছিলো-
"একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? রাগ করবেন না তো? আচ্ছা, আপনি কি বাসায় আমার কথা বলেছেন?"
মিনিট পাঁচেক পর আরেকটি মেসেজ,
"আমি জানি আপনি অফিসে জয়েন করেছেন বেশিদিন হয়নি। এখনি বাসায় বিয়ের কথা তোলা হয়তো অত সুবিধার হবেনা। কিন্তু..."
দশ মিনিট পর আরেকটি মেসেজ,
"ঘুমিয়ে পড়েছেন? এত তাড়াতাড়ি তো আপনি ঘুমোন না! আচ্ছা, আমি ঝোকের বশে আগের মেসেজগুলো দিয়েছি। কিছু মনে করবেন না। সরি।গুড নাইট!"
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দোলার এমন মেসেজগুলো পড়ে নিশীথ বেশ অনেকক্ষণ হেসেছিলো। সে ভেবেছিলো, ওর বোকা দোলনচাঁপা হয়তো সরাসরি ওকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছে তাই এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলছে কথাগুলো! অথচ, সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ওর লাজুক দোলনচাঁপা কতগুলো দুশ্চিন্তা বুকে চেপে ওকে মেসেজগুলো পাঠিয়েছিলো!
পেছন থেকে হর্ণের নিশীথ বাস্তবে ফিরে আসে। হাতের মুঠো পাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে পারভীন বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
---আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি দোলার ব্যাপারে সিরিয়াস। আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করে ঘরে আনতে চাই। এখনো বাসায় এ ব্যাপারে কথাগুলো বলার সুযোগ হয়নি। তবে জলদিই বলবো। বলে আমি নিজে আপনাকে জানাবো! আপনি প্লিজ ততদিনে কোনো আজেবাজে প্রস্তাবে সাড়া দিবেন না। দোলনচাঁপাকে আমার ছাড়া অন্য কারও হতে দিবেন না। কথা দেন?
অস্থির নিশীথের পাগল পাগল কথায় পারভীন বেগম শত পেরেশানির মধ্যেও হেসে ফেললেন! এই ছেলের হাতে মেয়ে দেবেন না তো কার হাতে মেয়ে দেবেন? তার আদরের দোলাকে নিশীথের চেয়ে বেশি ভালো কেউ বাসতে পারবে আদৌ? পারভীন বেগম মানেন না! তাই তিনি বাজারের ব্যাগটা হাতে তুলে বললেন,
---মেয়েকে অন্য কারও হাতে দেবোনা বলেই তো তোমাকে আজ এতকিছু বলা! মেয়ে জামাই হিসেবে আমারও তোমাকেই পছন্দ! ভালো থেকো, বাবা। জ্যাম ছেড়েছে মনে হয়। আসছি?
নিশীথ মৃদু হেসে তাকে বিদায় জানায়। বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবে কিনা জানতে চাইলে পারভীন বেগম মানা করে দেন। নিজেই হেটে চলে যান এলাকার গলির ভেতর। পেছনে রয়ে যায় নিশীথ। বাইক স্টার্ট করে সামনে এগোলেও ওর মন থেকে যায় পেছনেই। যে মনে ঘুরছে নানারকম চিন্তা। এবার বাসায় ফিরে পাকাপোক্ত ভাবে বিয়ের কথা বলতেই হবে। বাবা যতকিছুই বলুক সব শুনবে। দোলনচাঁপার জন্য নিশীথ সব শুনতে রাজি। তবুও দোলনচাঁপা ওর হোক। তবুও মন মানতে চায়না। মস্তিষ্ক ঠিকি প্রশ্ন করে বসে, ও কি আসলেই পরিবারকে মানাতে পারবে? নাকি এর মাঝে অন্যকোনো ঝামেলা তৈরি হবে ওর জীবনে?


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৩৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন