পারাপার ।। শাহাদাত রাসএল |
নকশীকাঁথা ।। শাহাদাত রাসএল
শিউলির আজ রাতে ঘুম আসবেনা।
বারবার কাঁথাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরছে। একজন মানুষ যদি এতো সুন্দর করে সামান্য
একটা কাঁথার প্রশংসা করে তবে তো আনন্দে কিছুটা ঘুমহীন থাকার মতো অবস্থা হতেই পারে।
চোখদুটো মনে হচ্ছে হাজারো কথা বলার চেষ্টায় ছটফট করছে। সমস্যা একটাই সাব্বির যখন
কথা বলে তখন শিউলির মুখে আর কথা ফোটে না। মাত্র ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করা
গ্রামের সহজ সরল শিউলি গুছিয়ে কথা বলতে না পারার লজ্জায় নিজের কন্ঠকে রোধ করে
রাখে। ওর যতোকথা হয় তার সবটাই মনে মনে। অবশ্য শিউলির এই জড়তাকে হেসেই উড়িয়ে দেয়
ঢাকার শিক্ষিত যুবক সাব্বির
তুমি জানো তোমাকে আমি কেনো এতো ভালোবাসি ? তোমার এই লাজুক
সরলতার জন্যই। তুমি বেশি পড়াশোনা করোনি এটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে
শিউলি অবাক হয়ে যায়
কেনো ?
বেশি পড়াশোনা করলে তুমিও শহরের শিক্ষিত মানুষের মতো চতুরতা শিখে
যেতে। মুখোশ পড়তে শিখে যেতে
ধুর শিক্ষিত মাইনশে কি মুখোশ পড়ে নাকি ? মুখোশ তো পড়ে আমাগো
গ্রামের যাত্রাপালায় বাঘের অভিনয় করা সাদেক ভাই
তুমি শহুরে মানুষের মুখোশের গল্প জানোনা শিউলি। যখন তুমি আমি
বিয়ে করে শহরে ঘর বাঁধবো তখন জানতে পারবে
শিউলি লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। ওর
মুখে আর কোন কথা আসেনা। আজকে যখন মোবাইলে কথা বলছিলো শিউলি তখন সাব্বির শিউলিকে
দেখার বায়না ধরলে একটা লাজুক ছবি তুলে ফেসবুকে পাঠিয়েছিলো। সেই ছবিতেই দেখা গেছে
নকশিকাঁথার একটা অংশ। সেটুকু কাজ দেখেই সাব্বিরের কি উচ্ছ্বাস। বারবার অনুরোধে
শিউলির বাধ্য হয় পুরো কাঁথার একটা ছবি তুলে পাঠাতে। সাব্বির অবাক হয়ে যায় এটা জেনে
যে কেউ সামান্য কাঁথাতেও এতো চমৎকার নকশা করতে পারে! সাব্বিরের উচ্ছ্বাসের সাথে
সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে শিউলির লজ্জা। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই পাশের ঘরে
খায়ের চৌকিদারের কাশির দমক উঠে। শিউলি এককানে মোবাইল চেপে রেখেই আরেক কান খাড়া করে
বাবার কাশি কমার অপেক্ষা করে। কিন্তু খায়ের চৌকিদারের কাশি বেড়ে চলে। অনিচ্ছায়
মোবাইল রেখে বাবার কাছে ছুটে যায় শিউলি। রাতের বেলা খায়ের চৌকিদার চোখে দেখতে
পায়না। অথচ একসময় সে ছিলো উল্লাপাড়া দাসপাড়া আর পাইকপাড়ার জাঁদরেল চৌকিদার। রাতে
গ্রামে পাহারা দিতো। যতদিন খায়ের চৌকিদার রাতে গ্রামে পাহারা দিয়েছে ততদিন কোন চোর
এদিকে পা মারায়নি ভয়ে। যেমন ছিলো গায়ের জোড় তেমন ছিলো লাঠি চালানোর ওস্তাদ। খায়ের
মিয়া যখন রাতে হাঁক দিতো ‘হুঁশিয়ার সাবধান’ তখন তিনগ্রামের অন্ধকার ভেদ করে সেই
চিৎকার ছড়িয়ে পড়তো। স্ত্রী মারা যাবার পর শিউলি আর ছোট ছেলে সাদেককে নিয়ে তার
সংসার। গত দেরবছর ধরে বিছানায়। হাঁপানির সাথে বুকের ভেতর কোন একটা আজানা যন্ত্রণা
বাসা বেঁধেছে। গঞ্জের মোজাম্মেল ডাক্তার কয়েকবার দেখলেও বুকের ব্যাথার কারণ সনাক্ত
করতে পারেনি। আর হেঁয়ালি করে শহরেও গিয়ে অচেনা রোগটার পরিচয় খোঁজার আগ্রহ পায়নি
খায়ের চৌকিদার।
বাবা ও ভাইয়ের দেখাশোনা করেই
দিনপাত করে শিউলি। মাঝখানে কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব এলেও নানান অজুহাতে সেসব
সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়েছে সদ্য উনিশে পা রাখা শিউলি। ওর ভয় বাবার একা হয়ে যাবার।
সাদেক গঞ্জে রহমান মিয়ার আড়তে কাজ করে। বই পুস্তকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লিখে রাখা
মানবিক বুলিকে পাঁশ কাটিয়ে নয় বছর বয়স থেকেই এই আড়তে কাজ করে যাচ্ছে সাদেক। গত
অক্টোবরে সাদেক তেরোতে পা দিলো। মাস তিনেক হলো বেতনের টাকা থেকে বোনকে একটা
সেকেন্ড হ্যান্ড চাইনিজ মোবাইল কিনে দিয়েছে। অভাবের সংসারে মোবাইলের আগমনে প্রথমে
খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলো শিউলি। কিন্তু দিন যতযাচ্ছে মনে সাদেকের প্রতি একটা গোপন
কৃতজ্ঞতাবোধ বাড়ছে। এই মোবাইলের কারনেই তো সাব্বিরকে পাওয়া। অবশ্য সখি জাহানারার
কাছেও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই শিউলির। কারণ ফেসবুক নামক একটা জগত যে আছে আর এই জগতের
হাজারো অলিগলি তো জাহানারাই হাতে ধরে শিখিয়েছে শিউলিকে।
শিউলির আজকে সবকিছু ছাপিয়ে কেবল
নকশীকাঁথার কথাই মনে পড়ছে। এরমধ্যেই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরো কিছু নকশিকাঁথা
বানাবার। মায়ের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া দুই তিনটা পুরানো কাপড় এখনো ট্র্যাঙ্কে
রাখা আছে। একটা কাঁথা অন্তত হয়েই যাবে। শিউলি কাঁথাটাকে শরীরের সাথে আরো গভীরভাবে
জড়িয়ে নেয়। শরীরটা কেমন জানি মুচড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস দ্রুতালয়ে পড়ে। শিউলি নিজেই
কিছুটা লজ্জা পায়। কাঁথাটার নিচে মাথাটা গুটিশুটি করে রাখে।
তখন ভর দুপুর। একটা জলচৌকির উপর বাবাকে এনে বসিয়েছে শিউলি।
খায়ের চৌকিদার বসে একধ্যানে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের কাছে এক গামলা পানি
রাখা। রোদে পানিটা আরেকটু গরম হলেই যত্ন করে বাবার শরীর মুছিয়ে দেবে শিউলি। পানি
গরম হবার অবসরে ঘরের পেছনের ক্ষেত থেকে কিছু হেলেঞ্চা শাক তুলে এনে মাত্র ঘরের
দাওয়ায় রাখতে যাচ্ছিলো শিউলি। এমন সময় দৌড়ে এসে বাড়িতে ঢোকে সাদেকের সাথে একসাথে
আড়তে কাজ করা ইদ্রিস
শিউলি বু সাদেক এক্সিডেন করছে
শিউলি চমকে উঠে। ওর হাত থেকে
শাকের বোলটা কাত হয়ে পড়ে যায়
কিয়ের এক্সিডেন করছে ?
আড়তে ভ্যান থিকা বোস্তা নামানের সময় বস্তা ঘাড় থিকা পইড়া গেছে।
ওর ঘাড়ে ব্যাতা পাইছে। দোকানে শোয়াইয়া রাখছে
শিউলি আর কথা না বাড়িয়ে। দাওয়া
থেকে একটা ওড়না টেনে নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে
আব্বা আপনে থাকেন আমি দেইখা আহি
বলেই রাস্তার দিকে হাঁটা দেয়।
পেছনে পেছনে ছোটে ইদ্রিস।
শিউলি যখন আড়তে গিয়ে পৌঁছায়
ততক্ষণে সাদেককে গঞ্জের ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ছয়দিনের মাথায় যখন শিউলি
সাদেককে নিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন সাদেকের গলায় ব্যান্ডেজ। ঘাড়ের হাড় ফেটে গেছে। নড়াচড়া
করার মতো কোন ক্ষমতা নেই। বাড়ি থেকে হাসপাতাল কম ধকল যায়নি শিউলির। প্রতিদিন বাড়ি
এসে রান্নাবান্না করে বাবাকে গোসল করিয়ে খাইয়ে সাথে সাথে ছুটতে হয়েছে হাসপাতালে।
হাসপাতালে হিয়ে সাদেকের শরীর মুছিয়ে দিয়ে হাতে তুলে খাওয়াতে হয়েছে। হাসপাতালে
সাদেকের বিছানার পাশে বসে যেটুকু সময় পেতো নকশীকাঁথা সেলাই করতো শিউলি। এর মধ্যে
দুবার কথা হয়েছিলো সাব্বিরের সাথে। সাব্বির বারবারই সাহস দিয়ে গেছে। একবার শিউলির
সকল বাঁধা উপেক্ষা করে পাঁচ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠিয়েছে সাব্বির। শিউলি লজ্জায়
লাল হতে হতেই অনুভব করতে পারে ওর বুকের ভেতর সাব্বিরের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার
জায়গাটা আরো উপরে উঠে আসে। সাব্বিরের দায়িত্ববোধ শিউলিকে মুগ্ধ করে। শিউলির বুকের
ভেতর ভালোবাসার পায়রা বাকবাকুম ডাকে মাতোয়ারা হয়।
সাদেককে নিয়ে বাড়ি ফেরার দেরমাসের মাথায় শিউলি টের পায় ঘরের
আনাচেকানাচে বেড়ে উঠেছে অভাব নামের বিষলতা। বাড়ির পাশের দের বিঘা জমিতে ফসলের চাষ
আর সাদেকের উপার্জন এতোদিন কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিলো শিউলিকে। অভাব থাকলেও খুব একটা
টের পায়নি। ঘরে সঞ্চিত সামান্য কিছু টাকা ছিলো। বাকিটা গ্রামের দোকান থেকে বাকিতে
এনে এতোদিন চলে যাচ্ছিলো কোনোমতে। কিন্তু গফুর দোকানী গতকাল যখন বলে দিলো আর বাকি
দেয়া যাবেনা। তখনই শিউলির ঘোর কেটে গেলো। ভাতের চিন্তার চেয়ে বেশি চিন্তা হলো বাবা
আর সাদেকের ঔষধ কেনার চিন্তা। আশা ছিলো এরমধ্যে সাদেকের ঘাড়ের হাড়টা জোড়া লেগে
যাবে। সুস্থ হয়ে সাদেক আবার আড়তে গেলেই সমস্যা কেটে যাবে। কিন্তু সাদেকের সুস্থ
হবার কোন লক্ষণ দেখা যায়না।
রাতে শুয়ে শুয়ে শিউলি আকাশপাতাল ভাবছে। এমন সময় মোবাইলে রিং
বেজে ওঠে। সাব্বিরের কল। গতদুইদিন সাব্বিরের সাথে কথা হয়নি। পরশু রাতেই সাব্বির
বলেছিলো ওর বাবা ঢাকা থেকে চিটাগাং গিয়েছে ব্যাবসার কাজে তাই ঢাকার ব্যাবসাটা
সাব্বিরকে দুদিন দেখাশোনা করতে হবে। কথা বলার সময় পাবেনা। দুইএকবার কথা বলার খুব
ইচ্ছে জাগলেও সাব্বিরকে কল করেনি শিউলি। সাব্বিরের কাজের সময় ডিস্ট্রাব করবেনা বলে
নিজেকে শাসিয়েছে। শিউলি মোবাইল রিসিভ করে। অন্য সময়ের চেয়ে অনুত্তেজিত নির্জিব
কণ্ঠে বলে
হ্যালো
কেমন আছো
ভালো।
তুমি কেমন আছো ?
ভালোই
ছিলাম কিন্তু তোমার কণ্ঠ শোনার পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো
কেনো।
আমার কন্ঠে কি হইছে
তোমার
মন খারাপ
তুমি
কিভাবে বুঝলা ?
যদি
তোমাকে না বুঝতে পাড়ি তবে ভালোবাসি কিভাবে বলো। আমি তোমার কণ্ঠ শুনেই তোমার মনের
খবর পেয়ে যাই
শিউলির খুব কান্না পায়। এভাবে
কি কেউ কোনদিন শিউলিকে বুঝেছিলো ? মা মারা যাবার পর থেকে ঘর সংসার বাবা ছোটভাই
সবাইকে সামলাতে গিয়ে শিউলি নিজেই কি কখনো নিজেকে বোঝার জন্য অবসর পেয়েছিলো ?
শিউলির মনে পড়েনা। আচমকা গলা ধরে আসে।
কথা বলছো না যে ?
শিউলি একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে কান্নাটাকে লুকায়
এমনেই
কি হয়েছে আমাকে বলবে না ?
কিছু হয় নাই
শিউলি আমি আর তুমি কি আলাদা বলো ? তোমার কষ্টের কথা যদি আমাকে
না বলতে পারো তবে কাকে বলবা ?
শিউলি একটু ভাবে। তারপর
তেমন কিছু না। হাতে টাকা নাই তো। মানে অনেকদিন হইলো তো...
ধুর এটা কোন ব্যাপার। তোমার কতো টাকা লাগবে বলো
না না তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারমু না
আহা এখন তো নাও। আচ্ছা একদিন শোধ করে দিও
আমি কেমনে শোধ করমু ? আমি কি চাকরী করি কও
কথাটা বলেই শিউলির মনে হয়
‘আচ্ছা গ্রামের অনেকে মেয়েই তো শহরে গিয়ে চাকরী করে। গ্রামের অনেক মেয়েই গার্মেনসে
চাকরী করে। তবে আমিও তো করতে পারি’
আহা শিউলি লক্ষ্মী বৌ আমার, চুপ করে আছো কেনো ? বলো কতো টাকা
লাগেব
আচ্ছা আমারে ঢাকায় একটা চাকরী খুইজা দিতে পারবা ?
তুমি চাকরী করবা ?
হ করমু, অনেকেই তো করে। কোন গার্মেনসে...
ছিঃ কি বলো। দুদিন পড়ে তুমি আমার বৌ হবে। আর তুমি করবে
গার্মেন্টসে চাকরী ? দেখো শিউলি নিজেকে এতো ছোটো ভেবো না
ছোটর কি আছে আমি তো কাজ করমু, চুরি তো করমু না
উফফ তোমার সাথে কথায় পারা যাবেনা। আচ্ছা আমি দেখি কি করা যায়...
সাব্বিরের সাথে আরও ঘন্টাখানেক
কথা হয়। কিন্তু শিউলি অন্যসব দিনের চেয়ে বেশি কথা বললেও কথা বলে কোন স্বস্তি
পায়না। বুকের মধ্যে একটা হাঁপানির ইনহেলার আর কিছু ঔষধ ঘুরপাক খায়। সেদিন রাতে
ঘুমাতে গিয়ে শেফালির আর নকশিকাঁথা বিষয়ক কোন বোধ কাজ করেনা। টিনের ঘরের ভেতর
শিউলির বিছানার পায়ের কাছে একটা ছোট জানালা। জানালার কপাটের ফাঁকা গলে হালকা
চাঁদের আলোর একটা রেখা এসে বিছানায় পড়েছে। শিউলি আলোর রেখার সুত্র ধরে জানালার
দিকে তাকায়। শোয়া থেকে উঠে জানালাটা খুলে দেয় একঝাক অপেক্ষমাণ আলো যেনো আচমকা
মুক্তি পেয়ে ওর বিছানায় এসে গড়িয়ে পড়ে। জানালার দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে
শিউলি।
সুখবরটা আসে আরো দুদিন পর একদিন দুপুরবেলা। শিউলি রান্নাঘরে বসে
বাঁশের ফুকনি দিয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।
পাতগুলো কিছুটা ভেজা থাকায় জ্বলছেনা। কেবল ধোঁয়া উঠছে। শিউলির দুই চোখ জ্বালা করতে
করতে লাল হয়ে ওঠে। এমন সময় বেজে ওঠে মোবাইলের সাইরেন। সাব্বিরের কল। শিউলি কিছুটা
বিরক্তি নিয়েই মোবাইলটা রিসিভ করে
আমি রানতাছি পরে ফোন দিও
শোনো শোনো রেখোনা। একটা কথা শোনো
শিউলি ফোনটি রেখে দিতে গিয়েও
আবার কানে ঠেকায়
বলো
একটা সুখবর আছে
কি
তুমি
না চাকরী খুঁজতে বলছিলা। খুঁজছি
আচ্ছা
একটা
চাকরী পেয়েছি। আমার বাবার বন্ধু রায়হান আংকেলের অফিসে। আপাতত তুমি ওটা করতে পারো
ধুর
আমার মতো অশিক্ষিত মানুষেরে অফিসের চাকরী দিবো কে
আরে
দেবে দেবে। হ্যাঁ এটা সত্যি যে তোমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতে এমন চাকরী পাওয়া সম্ভব
না। তবে আমি আংকেলকে বলেছি বলেই সে এই চাকরীটা তোমাকে দেবে। তার সাথে আমাদের
পারিবারিক সম্পর্ক অনেকদিনের। তাই আমার অনুরোধ ফেলতে পারবেনা
না থাক
ওই চাকরী আমি করমু না
কেনো
সমস্যা কি ?
আচ্ছা
এহন রাখি। চুলায় রান্না বসাইছি। পড়ে কথা বলমু
শিউলি
মোবাইল রেখে দেয়। কিছুক্ষণ থ খেয়ে বসে থাকে। বুঝে উঠতে পারেনা যে কি বললো সাব্বির
আর এছাড়া কিইবা বলার ছিলো শিউলির। রাতে আবারও সাব্বিরের অনুরোধ নিয়ে বেজে ওঠে
মোবাইল ফোন। শিউলির খুব অস্বস্তি লাগে। ওইসব বড় বড় অফিসে শিউলির কাজ করার কি
দরকার।ওখানকার হাবভাব চালচলনের সাথে কি শিউলি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে ? এই
চিন্তাটাই ওর মস্তিষ্ক জুড়ে খেলা করে।
ধুর
একটা গার্মেনসের কাম হইলেই হইতো
এই বাক্যে এসেই শিউলির আত্মগত
বৈঠকের শেষ হয়। তবে সাব্বিরের এই দুশ্চিন্তা শিউলিকে শান্তি দেয়। ভালোবাসার
মানুষের আপদে বিপদে যদি দুশ্চিন্তা না করে তবে সে কেমন প্রেমিক। শিউলির একদিকে
অভাব আরেকদিকে নিজের যোগ্যতার চেয়ে বড় অর্জনের হাতছানি ওকে আতঙ্কিত করে তোলে।
সাব্বিরের সাথে সেদিনের ফোনালাপের সমাপ্তি হয় এভাবে
সাব্বির-
আচ্ছা তোমার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু বাবা আর ভাইয়ের চিকিৎসা তো চালাতে হবে। এই
মানুষগুলো কি চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে ? তুমি আমার কাছ থেকেও টাকা নেবেনা। তবে
করবে কি
শিউলি-
জানিনা কি করমু। তয় জানো আমার না খুব ভয় হয়। অতো বড় অফিসে আমি কি মানাইয়া নিতে
পারমু
সাব্বিরঃ আচ্ছা তুমি আমাকে ভালোবাসো
শিউলি নিশ্চুপ
সাব্বিরঃ বলো, ভালোবাসো ?
শিউলিঃ হু
সাব্বিরঃ তবে আমার কাছে তোমার তো লজ্জার কিছু নেই। আচ্ছা তুমি
শুধু একবার ওদের অফিসটা দেখো। সেখানকার মানুষদের সাথে কথা বলে দেখো। যদি তোমার মনে
হয় যে এদের সাথে তুমি মানিয়ে নিতে পারবেনা তবে চাকরী করোনা। তোমার ইচ্ছেমত
গার্মেন্টসেই চাকরী কোরো। জাস্ট একদিন এসে অফিসে একটা ফর্মাল ইন্টার্ভিউ দিয়ে যাও
শিউলি সাব্বিরকে বোঝাতে পারেনা
যে শিউলিদের দারিদ্রতা একসময় ঘরের চৌকাঠ পেড়িয়ে হৃদয়কেও আক্রান্ত করে ফেলে। তখন
কেবল পালিয়ে বাঁচতে মন চায়। একটা দুর্বাঘাসের পাশে দাঁড়ালেও নিজেকে ছোট মনে হয়।
একদিন ভোরে শিউলিকে পাইকপাড়া বড় বাসস্ট্যান্ডের ঢাকাগামী বাসের
ভেতর বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ঢাকার সাথে পাইকপাড়ার দূরত্ব
খুব বেশি না। বাসে গেলে দুইঘন্টার পথ। অবশ্য কখনো কখনো গাবতলিতে জ্যামে পরলে সেটা
চার থেকে পাঁচ ঘন্টাও হয়ে যায়। শিউলির মাথায় ঘুরছে বাবা ও ভাইয়ের খাবার আর ঔষধের
কথা। অবশ্য জাহানারাকে সব বুঝিয়ে বলা আছে। জাহানারা বলেছে সবকিছু ও দেখেশুনে
রাখবে। আর মাত্রতো একটা দিনের ব্যাপার। সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরে আসবে শিউলি।
সাব্বিরের এতোটা আন্তরিক আগ্রহ ফিরিয়ে দিতে পারেনি শিউলি। অবশ্য মনেমনে ঠিক করেই
রেখেছে যে পরিবেশ যতো ভালোই হোক ই চাকরীটা ও করবেনা। কেবল সাব্বিরকে খুশি করার
জন্যই আজ সেই অফিসে যাবে। আর চাকরীটা করবেনা বলেই চাকরীর ব্যাপারে আসার সময় বাবা
বা সাদেককে কিছু বলেনি শিউলি। বাসের সিটে বসে এসব ভাবতে ভাবতেই আচমকা মুখে একটা
লাজুক হাসি ফুটে ওঠে ওর। বাহির থেকে চোখ ভেতরে ফেরায়। আজকেই প্রথম সরাসরি দেখা হবে
সাব্বিরের সাথে। এর আগে ছবিতে ভিডিওতে দেখেছে। কিন্তু সেই দেখায় কি আর ভালোবাসার
মানুষকে দেখার তৃষ্ণা মেটে। শিউলি কোলের উপর রাখা ব্যাগটা আরেকটু নিবির করে চেপে
ধরে। ব্যাগের মধ্যে আছে ভালোবাসার নকশিকাঁথা। প্রতিটি সুঁইয়ের ফোঁড়ে রয়েছে গভীর
মমতা। সাব্বিরের জন্য শিউলির ভালোবাসার প্রথম উপহার। শিউলি কেবল ভাবে এই নকশিকাঁথা
যখন সাব্বিরকে দেয়া হবে তখন সাব্বিরের মুখটা আনন্দে কতোটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
পোশাকের মধ্যে মায়ের শেষ স্মৃতি বলতে ছিলো এই তিনটা পুরানো কাপড়। মায়ের সেই স্মৃতি
আজ ভালোবাসার উপহার হয়ে গেছে। খুব গুছিয়ে ভাবতে না পারলেও শিউলির ভাবনাটা এর
কাছাকাছি।
শিউলির ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে।
গাবতলির রেগুলার জ্যামটা আজকে একেবারেই হাওয়া। তবুও রাস্তায় একবার ইঞ্জিনের সমস্যা
হবার কারণে আধাঘন্টা লেইট মিলিয়ে দুইঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মাথায় যখন শিউলি এসে
শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে নামে তখনই মুখোমুখি হয় সাব্বিরের। সরাসরি সাব্বিরের চোখের
দিকে তাকাতে পারেনা শিউলি। লজ্জা । সাব্বিরের পরিপাটি পোশাক ও চুলের আধুনিক তবে
ভদ্রস্থ স্টাইল। কথাবলার ভঙ্গী সবকিছুই শিউলিকে আরো অপ্রস্তুত করে তোলে। কলেজগেইট
পাড় হয়ে যখন সাব্বিরের প্রাইভেটকার মোহাম্মাদপুরের দিকে টার্ন নেয় সেই সময় পর্যন্ত
অন্তত চারবার শিউলি মনেমনে নিজেকেই প্রশ্ন করেছে ‘মানুষ এতো সুন্দর হয় ক্যামনে ?’
যদিও আজকে শিউলিও ওর জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘসময় নিয়ে খুব যত্নে সাধ্যের পুরোটা দিয়ে
নিজেকে সাজিয়েছে। সাব্বির অফিসে গিয়ে কি করতে হবে। কি জিজ্ঞাসা করলে কি উত্তর দিতে
হবে সব বলে যাচ্ছে। হঠাৎ সাব্বির খেয়াল করে শিউলি নিজের দুই হাঁটুর দিকে মাথা নিচু
করে তাকিয়েই আছে। সাব্বির একটা হাত এগিয়ে দিয়ে শিউলির গাল ধরে ওর মুখটাকে নিজের
দিকে ফেরায়। শিউলি কিছুটা কেঁপে ওঠে। এটাই ওর ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ।
এভাবে মাথা নিচু করে থাকতে থাকতে একদিন দেখবা মাথাটা শিউলি
ফুলের মতো টুপ করে ঝরে পড়ে যাবে
সাব্বিরের কথায় শিউলি ফিক করে হেসে ফেলে। ড্রাইভার গাড়ি
চালাচ্ছে। পেছনের সিটে বসে আছে সাব্বির আর শিউলি। ড্রাইভার পেছনে না তাকিয়েই
প্রশ্ন করে
ভাই কোনদিকে যাবো
হাউজিং এ
আচ্ছা
গাড়ি চলতে থাকে। কিছুটা
স্বাভাবিক হয়ে আসে শিউলি। দুইবার ব্যাগটা হাতে ধরে সাব্বিরকে দেবার কথা ভাবে।
লজ্জায় বা কিভাবে কি বলে উপহারটা দেবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনা শিউলি। গাড়িটা এসে
হাউজিং এর নির্মানাধীন ভবনের প্লটের ভেতর ঢুকে যায়। একটা সদ্য নির্মিত চারতলা
বাড়ির কাছে এসে গাড়িটা থামা পর্যন্ত শিউলি কয়েকবার চেষ্টা করে নকশীকাঁথার ব্যাগটা
সাব্বির কে দিতে। গাড়ি দাঁড়াতেই সাব্বির আগে নেমে গিয়ে শিউলির পাশের ডোরটা খুলে
ধরে। মাথা ঝুঁকিয়ে হাসি হাসি মুখে বো করে
ঢাকা শহরের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম মহারাণী। দয়া করে নেমে
আসুন
শিউলি শব্দ করে হেসে ওঠে
সাব্বিরের ভালোবাসার উচ্ছলতায়। শিউলির বুঝতে অসুবিধা হয়না যে শিউলিকে প্রথম দেখার
আনন্দে জ্বলজ্বল করছে সাব্বিরের হৃদয়। সাব্বিরকে অনুসরণ করে চারতলা ভবনটিতে প্রবেশ
করে শিউলি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শিউলি দেখতে পায় ফ্লোরের সব ফ্ল্যাটের দরজাগুলো
হাট করে খোলা। কোন কোন ফ্লোরে টাইলস সিমেন্ট রাখা।সাব্বিরের থেকে তিন সিঁড়ি নিচে
থেকেই শিউলি প্রশ্ন করে
অফিস কই ?
উপরের ফ্লোরে। আসলে এই কোম্পানির এটা নিজস্ব ভবন বানিয়েছে। এখনো
পুরো অফিসের কাজ এখানে শুরু হয়নি। তবে চেয়ারম্যান আংকেল এখানে বসে
কথা বলতে বলতেই চারতলায় উঠে আসে
ওরা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় কলিংবেল লাগানো হয়নি এখনো। সাব্বির দরজায় কড়া
নাড়ে। পাঁচ ছয়বার দরজায় কড়া নাড়ার পর একজন এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দিয়েই সে
ভেতরে চলে যায়। শিউলি তাকে দেখতে পায়না। সাব্বির ঘরে ঢুকে
এসো
বলতেই ভেতরে ঢোকে শিউলি। ঘরের
মধ্যে একটা গুমোট ভাব। কিছুটা ধোঁয়া চোখে দেখা যায়। শিউলি অবাক হয় যে ধোঁয়া দেখা
গেলেও ধোঁয়ার কোন গন্ধ নেই। পাতা দিয়ে মাটির চুলায় শিউলি যখন রান্না করে তখন ধোঁয়া
থেকে একটা গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু এখানকার ধোঁয়া গন্ধহীন। সামনের রুমটাতে খুব
বেশি কিছু নেই। দুইটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার রাখা মাত্র। সাব্বির শিউলিকে নিয়ে বা
দিকের একটা রুমে ঢুকে যায়। সেখানেও রুমের মধ্যে কিছু নেই। একটা টুল রাখা আছে
মাত্র। ফ্লোরে কিছু ছোট ছোট সিরামিকের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে আছে। সাব্বির শিউলিকে হাত
ধরে এনে টুলটাতে বসিয়ে দেয়
এখান
একটু বসো। আসলে এখনো অফিসে ড্রয়িংরুম বা ওয়েটিংরুম কমপ্লিট হয়নি তো তাই এই অবস্থা।
আমি আংকেলের রুমে গিয়ে দেখে আসি সে ফ্রি আছে কিনা। বোঝোই তো যেহেতু সে বস তাই এগে
একটু অনুমতি নেয়া দরকার। তুমি এখানে বসো আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি
সাব্বির বেড়িয়ে যায়। টুলে বসে
কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই চারদিকে চোখ বুলায় শিউলি। নকশীকাঁথার ব্যাগটা বুকের কাছে
ধরে বসে আছে। সম্ভবত পাঁচ ছয় মিনিট পড়ে রুমে ফিরে আসে সাথে আরেকজন
দুজনে এসে দরজার কাছেই দাঁড়ায়।
বাহির থেকে কেউ একজন বলে
আমরা
বাইরে থাকি। তোরা আয়
শিউলি চমকে ওঠে আচমকা। এতক্ষণ
ভালোবাসায় ডুবে থেকে যেই আশঙ্কা ভাবনাতেও আসেনি সেই শঙ্কা পেয়ে বসে শিউলিকে।
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে সোজা সাব্বিরের মুখের দিকে। সাব্বির শিউলির দিকে একবার
তাকিয়েই বন্ধুর দিকে তাকায়
কিরে মাইনকা বোকাচোদা কি মনে হয় ?
দেইখা তো ইনটেকই মনে হয়। কিন্তু তোরে দিয়া বিশ্বাস নাই। তুই বড়
বাইঞ্চোদ
কসম কইরা কইতাছি ছুঁই নাই। তোর জন্মদিনের কেক কি তোর আগে আমি
কাটতে পারি। আমার জন্মদিনে তুই ইনটেক মাল গিফট করছোস তোর জন্মদিনে আমি শোধ দিলাম
শিউলির পা কাঁপছে। অনেকদিন
জ্বরে ভোগার পর বিছানা থেকে মাটিতে নেমে দাঁড়ালে যেমন অনুভূতি হয় শিউলির তেমনই
হচ্ছে। শিউলি দৌড়ে দরজার দিকে যেতে নেয়। সাব্বির চুলের মুঠি ধরে আটকে দেয়। শিউলির
মুখটা নিজের মুখের কাছে আনে
কই যাও সোনা ? ভালোবাসনা না ? তুমি খালি আমারে ভালোবাসতে
চাইছিলা কিন্তু আমার মন বড় তাই তোমারে আজকে অনেকের ভালোবাসা দিমু
শিউলি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু
করতেই মাইনকা শিউলির গলা চেপে ধরে
একদম চুপ চোতমারানি কোন শব্দ করলে কাইটা ফালাইয়া দিমু
শিউলি নিঃশ্বাস নিতে পারেনা।
চোখগুলো বেড়িয়ে আসতে চায়। এমন সময় সাব্বির চুলের মুঠি ধরেই ধাক্কা দেয় শিউলি কে।
শিউলি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে টুলের উপরে পড়ে তারপর ফ্লোরে। উঠতে চায় কিন্তু গলায়
অনেকটা সময় চেপে ধরায় চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখতে শুরু করে। ঝাপসা ঝাপসা চোখেই দেখে
সাব্বির চারদিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে। তারপর দুইপা এগিয়ে এসে নকশীকাঁথার ব্যাগটা
হাতে তুলে নেয়। টান দিয়ে ব্যাগটা ছিঁড়ে কাথাটা বিছিয়ে দেয় ফ্লোরে। মাইনকা এসে
শিউলিকে চুল ধরে টেনে নকশীকাঁথার উপর তুলে নেয়।বুকের উপর উঠে বসে মাইনকা। আচমকা
কেউ একজন নিচ থেকে টান দিয়ে সেলোয়ারটা খুলে ফেলে। শিউলি তাকায়। সাব্বির ! সাব্বির
মাথার কাছে এসে শিউলির মাথাটা চেপে ধরে। শিউলির কোমরের দুইপাশে পা রেখে শরীর থেকে
গেঞ্জি আর প্যান্ট খুলে উত্থিত পুরুষাঙ্গ নিয়ে দাঁড়ায় মাইনকা ।
প্রায় দের ঘন্টা পরে যখন শিউলির
জ্ঞান ফেরে তখন প্রথমেই মনে পড়ে
‘আচ্ছা কয়টা বাজে এখন? আব্বার বিকালের হাঁপানির ঔষধটা কি দেয়া
হইছে ? জাহানারা আবার ওষুধ দিতে ভুইলা যায় নাই তো ?’
গল্পটি শাহাদাত রাসএল'র "জীবন এক সুস্বাদু হেমলক" গল্পগ্রন্থ থেকে সংগৃহিত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন