চিঠি || সৈকত আমীন
চিঠি || সৈকত আমীন


কবিতা              :         চিঠি 
কবি                  :         সৈকত আমীন
গ্রন্থ                   :         
প্রকাশকাল       :      

চিঠি || সৈকত আমীন


মনে পড়ে সেই চিঠির কথা?

লোডশেডিংয়ের দিনে চিঠির বয়স যখন চার
আমি খামের ভেতর, তোমার ঘামের ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে ছিলাম;
সারি সারি সাজানো লাইন,
কোথাও স্পস্ট বিন্দুতে ঝাঁপসা হয়ে আসা শব্দ-অস্পষ্ট বর্ণমালা,
বোঝা যায়-পাশে মোমবাতি জ্বেলে লিখেছিলে অনেকক্ষণ,
একটা কলমের অনেকটা জীবন।
তখন বর্ষাকাল-জানিয়েছিলে তুমি
বাড়ির থেকে শ্মশানে যাবার পথটা কালিগঙ্গা’র পানিতে গেছে ডুবে,
জানতে চেয়েছিলাম আমি,
লাশ ওরা কিভাবে ন্যায়! ভাসায়ে দ্যায়?
পোড়ায় কোন বনে! নাকি শুধু স্মৃতিতে মানুষের মনে?
পরে পত্রিকায় পড়েছিলাম-
মরবার জন্যেও দেশে হিন্দু পাওয়া যাচ্ছে না আর,
শ্মশানে যাবার আগেই কারা যেন জ্বালিয়ে দ্যায় ওদের গৃহ,
ওদের কেউ কেউ ডিঙিয়ে যাচ্ছে মানচিত্র নিয়ে ধর্মের বিক্ষত দেহ।

এরপর কত চিঠির কত বয়স বেড়ে গেছে,
যুদ্ধে ঝরে গেছে পঁচাশি হাজার ইয়েমেনি শিশু
যশোর রোডের পিতামহী বৃক্ষগুলো সয়ে নিয়েছে করাতের সান,
ইরাবতী আর হরিণের জন্য রাজপথে নেমেছে মানুষ
এবং গাছ কাটা বন্ধের পোস্টারে সেঁটে গেছে শহরের সকল দেয়াল।
চিঠিতে জানিয়েছিলে তুমি-
যে ঠোঁট দিয়ে ভিখেরির দিকে থুতু ছেটায় মানুষ
সে ঠোঁট দিয়েই তারা সন্তানকে চুমো খায়।
কত ঘৃণা ভরে চুমো খায় মানুষ!
অথবা কত ভালোবেসে থুতু ছেটায়!
গাছ কাটা বন্ধের এতো পোস্টার
পোস্টারের কাগজ-ও নাকি গাছ কেটে আসে!
শান্তির জন্য এতো যুদ্ধ করলো মানুষ
যুদ্ধে কি আর শান্তি কখনো আসে?
বহুবার আমি হেঁটে গেছি
মুখোমুখি হয়েছি সেসব দেয়ালের
পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছি নিজেকে একা-
গাছ কাটা বন্ধ হলে-কাগজ আর চিঠি আসাও কি বন্ধ হয়ে যাবে?
ডাকটিকেট চেপে আসবে না কি আর
আসাদের শার্ট
গণতন্ত্রে লেখা নূর হোসেনের পিঠ
ভাঙা শহিদ মিনার?
জানা হবে না-১২ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগরের শীতে
তেলাপিয়া ভাজি আর গরম ভাত খেতে খেতে
চব্বিশ’টা বছরের প্রত্যাখ্যান
কেউ এক দৃষ্টিতেই পারে ঝেড়ে দিতে।
আমি মাছ খাই না,
মাছেরা ঘুমিয়েও তাকিয়ে থাকে
আমি জেগে জেগে ঘুমিয়েছি বহুকাল
আড়তে প্রতি মৃত মাছের চেহারায়
আমি দেখেছি নিজেরই অসহায় ছবি,
নিজেকে কি করে খাওয়া যায়!
অথচ পাউরুটির মতো কামড়ে
মনের মাংস খেয়েই বেঁচে আছি।
আমি আরো বেঁচে অপেক্ষা করে ভেবেছি-
যদি তোমার চিঠি না আসে-
আমি কি তবে ত্বকী হত্যার শোক ভুলে যাবো?
পাহাড়ে জ্বললে আগুন আমিও কি মানুষ জ্বালাবো?
পতাকার সবটুকু লাল আমি কি অভিজিতের শরীরেই ঢেলে দেবো?
এই ভাবনায় কেটে গেছে পৃথক তিনশত দিন
পাশাপাশি তিনশত সপ্তাহ
আর চিঠির বয়স যখন তিনশত পৃষ্ঠায়-
আমরা বুঝলাম
নিজেদের নয়
একে অপরের নয়
আমি প্রেমে পড়েছি চিঠির-গাছ কাটা কাগজের
আর তুমি পড়েছো প্রেমে ডাকপিয়নের।
এরপরও ভিন্ন ভালোবাসায়, নিজেদের ভিন্ন প্রয়োজনে
আমরা লিখে গেছি নিজেদের যার যার চিঠি
খরচ হয়েছে আরো অনেক পৃষ্ঠার
আমার সাথে সাথে অনেক কলমের জীবন হয়েছে শেষ;
চিঠিতে বলেছিলে তুমি-
কেউ না কেউ পূরণ করে যায় শূন্যস্থান ।
আমিও শূন্য হয়ে যাবো,
পাঁচ হাজার বছর আগে নিলামে তুলে
আবিষ্কার করবেন আমাকে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা।
তখনো তুমি চিঠি লিখে যাবে, উত্তর দিয়ে যাবে অন্য কেউ
ডাকপিয়ন পৌঁছে যাবে তোমার ঠিকানায়
তবু আমার চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলো না!
যেহেতু মানুষ যে হাত দিয়ে কাছে টেনে ন্যায়
সে হাত দিয়েই বিদায় দ্যায় তারা।
শুধু আমার চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলো না,
তোমার নামে চন্দ্রবিন্দু লাগাতে বলো উত্তরদাতাকে
ডাকপিয়নকে বলো পৃথিবীতে যেন প্রচুর গাছ লাগায়,
দাবানলের ভয় পেও না।
মনে পড়ে সেই সব চিঠির কথা!
নিজেদের নয়
তুমি ডাকপিয়ন আর
আমি তোমার লেখা কাগজের প্রেমে পড়েছিলাম।
অথচ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ছাড়া অচল...


কবি সংক্ষেপ :


কবিয়াল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন