গল্প               :         দুহিতা
গল্পকার        :         মুন্না শামিমা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         

তরুণ গল্পকার মুন্না শামিমা'র “দুহিতা” শিরোনামের এই ছোট গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া হয়েছে। তবে অনবদ্য এ গল্পের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট এখন অবদি জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হবে।

দুহিতা || মুন্না শামিমা
দুহিতা || মুন্না শামিমা

দুহিতা || মুন্না শামিমা


বারিধারা ডিওএইসএস এর বিশাল বাসার বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে আছেন আকরাম সাহেব। চার মেয়ের পিতা তিনি। মেয়েরা সবাই সাবলম্বী। নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ক'দিন বাদেই ছোট মেয়ের বিয়ে। পাত্র উপরের ফ্ল্যাটে আসা নতুন ছেলেটা। বাকি তিন মেয়েও একই বিল্ডিং-এ আলাদা ফ্ল্যাটে স্বামী শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি নিয়ে থাকে। বেয়াই বেয়ানরাও ভালো, রোজ আসে গল্প করে। মেয়েরাই প্লান করে এখানে এনেছে বাবা মাকে, এক সাথে থাকবে বলে। তাদের দেখাশুনার জন্য দুজন সার্বক্ষনিক কাজের লোক রাখা আছে। ব্যস্ততার মাঝেও মেয়েরা বাবা মায়ের সেবা নিজেরাই করার চেষ্টা করে। তবুও অতীত যেন হানা দেয় বুকের ভিতর।

পৌষের শেষ বেলায় অসম্ভব রূপবতী রোকেয়াকে বধূসাজে ঘরে তোলেন আকরাম সাহেব।তামাটে পোড়া গাযের রং আর বেসরকারি চাকুরীজীবী আকরামের মনে হয় পূর্ণিমার চাঁদ যেন তার ঘরে এসেছে। রোকেয়ার যেমন দুধে আলতা রং তেমনি গৃহ কর্মে নিপুনা। ভালোবাসা আর খুনশুটিকে মিলেমিশে সাজায় ছোট সংসার। 

বিয়ের এক বছরের মাথায় এক কন্যা সন্তানের পিতা হয় আকরাম। তারপর পুত্রের আশায় একে একে আরো তিন কন্যার পিতা। কি ভাগ্য গুনে মেয়েরা সব পেয়েছে বাবার রং। তারপর চেনা অচেনা সবার প্রশ্ন, 'কি মিয়া, এতগুলা মেয়ের বিয়া দিবা কেমনে?' আর সমবেদনা,'আহারে, শেষকালে দেখার কেউ নাই'। কথাগুলো কেমন যেন একটু একটু করে তাড়িয়ে বেড়ায়। ধীরে ধীরে দুরত্ব বাড়িয়ে দেয় সংসারের সাথে। স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক টিকে থাকে সাংসারিক হিসেব আর আদিম তাড়নায়। সবটুকু একাই সামলে মেয়েদের বড় করেছে স্ত্রী রোকেয়া। মেয়েদের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখা হয়নি কখনও অনিচ্ছায় বা অজানা অভিমানে।

নবম শ্রেণীতে উঠে বড় মেয়ে জানালো বিজ্ঞান বিভাগ নিতে চায়। আকরাম সাহেবের সোজা উত্তর, 'এত কোচিং, প্রাইভেটের টাকা দিতে পারবো না। অন্য বিভাগে পড়ো।' আর কথা বাড়ায় নি বড় মেয়ে। এরপর চার মেয়েই ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়েছে। প্রাইভেটের টাকা বাচাতে এক বোন আরেক বোনকে পড়িয়েছে।

বড় মেয়ে ঢাকা ভর্সিটিতে ভর্তির পরই ডরমিটরিতে উঠেছে। হয়ত দুই রুমের ছোট বাসায় এক রুমে চার বোনের জায়গা হতো না বলে। অনার্সে ভর্তির পর সবাই নিজেদের খরচ নিজেরাই সামলে নিয়েছে টিউশনি আর হাতের কাজ করে। 
এখন বড় মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার, আর জামাই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। মেজ মেয়ে ব্যাংকার, সেজ আর ছোট মেয়ে অনলাইন বুটিক শপ চালায়। কিছুদিন আগে একটা শো রুম দিয়েছে। মেজ আর সেজ জামাই ডাক্তার, হবু ছোট জামাই ব্যবসায়ী।

 আকরাম সাহেবের প্রচন্ড ইচ্ছে করছে পুরোনো দিন গুলোতে ফিরে যেতে। ছোট আংগুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে হাটা শেখাতে। আধো বুলির ভাংগা ভাংগা শব্দ শুনে প্রাণ খুলে হাসতে। চারটা ছোট মুখ বুকে নিয়ে ভীষণ আদর করতে। এক রুমের সেই স্বর্গটাতে একটু প্রশান্তি খুজতে।
প্রচন্ড একা লাগছে তার। পাশের ঘরেই চার মেয়ে মা মিলে হাসির ফোয়ারা বইয়ে দিচ্ছে। ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতে। অথচ সম্পর্কের সুতো আলগা করতে করতে কখন যে নিজেই কাটা ঘুড়ির মত বিশাল আকাশে একা হয়ে গেছেন। যে ঘুড়ি পারে না আকাশ ছুঁতে, না পারে নাটাইয়ের কাছে ফিরতে।

কিছুক্ষন পর দুই মেয়ে এসে বলে, 'আব্বা, আপনার হাটার সময় হয়ে গেছে। একটু হাটবেন।'
দুই মেয়ের কাঁধে ভর করে দাড়ায় আকরাম সাহেব। আজ প্রতি পদক্ষেপে শুকনো পাতার মত বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। দুচোখ বেয়ে কান্না নেমে আসছে।

বাবার চোখে পানি দেখে দুই মেয়ে তাকে চেয়ারে বসিয়ে  পাগলের মত বলতে থাকে, 'আব্বা, আপনার কি কষ্ট হচ্ছে। কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার বলেন আব্বা। আব্বা ও আব্বা। এক বার বলেন।'
মায়াভরা আব্বা ডাক আর পাগলামি আরো বেশি করে ভিতরটা দুমড়ে মুচরে দিচ্ছে দুহিতাদের পিতার। শরীরের সব কষ্ট এক সাথে জমা হচ্ছে বুকের বাঁ পাশে।

লেখক সংক্ষেপ : 

কবিয়াল

কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন