উপন্যাস : রোদ শুভ্রর প্রেমকথন
লেখিকা : নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১১ নভেম্বর, ২০২০ ইং
লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “রোদ শুভ্রর প্রেমকথন” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ৬৬)
শহুরে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালে বাড়ির তোরণে তোরণে নানা রকম মনোহর নামফলক চোখে পড়ে। গীতাঞ্জলি, কুঞ্জবন, অপেক্ষা আরও কতশত নামের বাহার। আমাদের বাড়ির অবশ্য নাম নেই। থাকলে ; নিশ্চয় তার নাম হতো, 'হৈ-চৈ'। চরপাড়ার এই কোলাহলে ঢাকা মহল্লায় সর্বপেক্ষা হৈ-চৈ বোধহয় হয় আমাদের বাড়িতেই।৬৩৭৮ কিলোমিটার নিরক্ষীয় ব্যাসার্ধের পৃথিবীতে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলেই তার প্রভাব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায়। আমার গোষ্ঠী সেই ঢেউয়ে চঞ্চলা তটিনীটির মতো কলকলিয়ে উঠে। এই কলকলানো গোষ্ঠীতে শুভ্র ভাইয়ের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে হওয়া নিউক্লীয় বোমা বিস্ফোরণের থেকেও মসলাদার ঘটনা; ভয়াবহ ব্যাপার।এই মসলা-খবরের তাৎপর্য কল্পনা করেই বোধহয় কলকলানো গোষ্ঠীর কলকলানো এবার সমুদ্রের গর্জনকে ছাপিয়ে গেলো। দুই-চারদিন বাদেও সেই কলকলানোতে অব্যাহতির চিহ্ন পড়ার কোনো নাম-গন্ধ দেখা গেলো না। আর না দেখা গেলো, ফুপু- চাচি মহোদয়াদের নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তাড়া। হৈ-চৈ মহলে ভয়ঙ্কর এক হৈ-চৈ লাগিয়ে নিশ্চিন্ত প্রাণ হয়ে বসে রইলেন তারা। ভাবগতিক দেখে ধারণা করে ফেলা যায়, শুভ্র ভাইয়ের বিদায় দৃশ্য লাইভ টেলিকাস্ট হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই হৈ-চৈ-এর জোয়ারে কোনো ভাটা আসবে না; তর্জন-গর্জনের অত্যাচারে অপহত হতে হবে। কোনো এক চমৎকার ভোরে, কোনো এক খবর কাগজের শীর্ষে ঝকঝকে অক্ষরে লেখা বেরুবে, ' স্বীয় গোষ্ঠীর কলকলানিতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন ময়মনসিংহ নিবাসী রোদেলা।'
আমি যখন এই লেখাটা লিখছি তখন সময়ের চাকা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। কপাল থেকে কপোল সুয্যিমামার অহর্নিশ অত্যাচারে ঘামের সমুদ্রে খাবি খাচ্ছে। অথচ কল্পনা-চক্ষুদুটো ঘুরে বেড়াচ্ছে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের কুয়াশা ঘেরা এক সকাল বেলায়। ওই যে সেতার, বাঁশরি বাজিয়ে-
'পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে,
আয় রে চলে-
আয় আয় আয়।'
কবি গুরুর সেই ডাকাডাকি তখন সমাপ্তির নিশান উড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে মাঘের উঠোনে পা দিয়েছে। চুলোয় চেপেছে ভাপাপিঠার আয়োজন। বাতাসে ভাসছে ভাজা চিড়ার সুবাস। তাতেই নুন, কাঁচা লঙ্কা আর ঝাঁঝ ধরানো সরিষার তেল মেখে আড্ডা বসেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি-হৈচৈ... উফ! অসহ্য!
এই রকম কোনো পরিবেশে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ সুস্থভাবে ঘুমের চিন্তা করতে পারে না। চিন্তা করলে বেকায়দায় পড়তে হয়। আমি পড়েছি বেকায়দায়। কানের উপর ঢাক-ঢোল পেটানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। ভারী বালিশে কান চাপা দিয়েও একরত্তি ঘুম কুড়াতে পারছি না। মাথাব্যথায়, বিরক্তিতে জ্বলে যাচ্ছে গা। সেই জ্বলাজ্বলির ষোল কলা পূর্ণ করতেই আচমকা আমার গায়ের উপর তুফান তুলে দিলো রাফিয়া,
' এই রোদ? এগারোটা বেজে গিয়েছে। উঠ্!উঠ্!'
রাতে ঘুম না হওয়ায় আমার মাথায় তখন রুদ্র নৃত্য। সেই নৃত্যসভায় রাফিয়ার ডাকাডাকি যেন ঢোল বাদকের কাজ করলো। বারুদের মতোন জ্বলে উঠে বললাম,
' কী সমস্যা তোর রাফিয়া? সকাল সকাল জ্বালাচ্ছিস কেন? এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হবি তুই।'
রাফিয়া চোখ রাঙিয়ে বললো,
' খবরদার, আমাকে বকবি না। জেঠিমা ডাকতে বলেছে তাই ডাকতে এসেছি। দুনিয়ার সবাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে; তোর উঠার নাম নাই৷ এখন ঘুমাস কেন? রাতে কী করেছিস?'
' রাতে প্রেম করেছি। তোর কোনো সমস্যা?'
'অবশ্যই সমস্যা। প্রেম করেছিস মানে কী? কার সাথে করেছিস? ওই বিবাহিত লোকটার সাথে নয়তো, রোদু?'
রাফিয়ার কণ্ঠে টুইটুম্বর আগ্রহ। আমি মাথায় চাপিয়ে রাখা বালিশটা রাফিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কটমট করে তাকালাম,
' যাবি তুই এখান থেকে?'
রাফিয়া চট করে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ বাঁকালো,
' হুহ্! বয়েই গিয়েছে তোকে ডাকতে।'
তারপর খুব সাবধানে জানিয়ে গেলো,
'জেঠিমণি তোকে রান্নাঘরে যেতে বলেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে না গেলে ঝাড়ু ছুঁড়ে মারবে।'
আমি রাফিয়ার দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে থেকে আবারও চোখ বোজে ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু 'মা ডেকেছে' এই ভয়টা বারবার মস্তিষ্কে বার্তা পাঠানোই ঘুমটা খুব জমলো না। চোখে-মুখে অসন্তোষের স্থায়ী দাগ নিয়ে উঠে বসতে হলো। মুখটা আঁধারে ঢেকে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিরস মুখে বললাম,
' আম্মু? ডেকেছো কেন?'
আম্মু আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। নির্বিকার মুখে রান্নার প্রস্তুতিতে বহাল তবিয়ত রইলেন। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, রেগে আছেন। আম্মু আর শুভ্র ভাইয়ের এই এক সমস্যা, রেগে গেলেই সাইলেন্ট হয়ে যাবেন। হাজারখানেক কল করলেও, নো ভাইব্রেশন। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
' হয়েছেটা কী? বলবা? নাকি আমি চলে যাবো? কিছু করে দিতে হলে তাড়াতাড়ি বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।'
আম্মু এবার অগ্নি দৃষ্টিতে চাইলেন। ভাতিজা আর ফুপুর এই হলো দ্বিতীয় সাদৃশ্য। সাইলেন্ট মোড থেকে সরাসরি ভায়োলেন্ট মোডে পদার্পণ। কোনো মিডিল পয়েন্ট নেই; একেবারে বিস্ফোরণ। আমি বিরক্তমুখে আম্মুর বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রইলাম। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না; আম্মু বিস্ফোরিত হলেন৷ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
' আমাকে বলে দিতে হবে কেন? চোখ নাই? দেখিস না? সব মুখস্থ করে রেখেছি আমি? দশটা বিশ মিনিটে এই কাজ করতে হবে। দশটা ত্রিশ মিনিটে এই কাজ করতে হবে এমন করে লিস্ট দিতে হবে? হয়েছিস তো জমিদারপুত্রী, বিবেক বলতে কিচ্ছু নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে এতোগুলো মানুষের জন্য রান্না করছি। অথচ তোমরা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাও। ভাতটাও মুখে তুলে দিই? পেয়েছিস তো একটা মাগনা বান্দী, চিন্তা কী?'
আমি অসহায় চোখে আম্মুর দিকে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ কড়া মেজাজ দেখিয়ে আচমকা কোমল হয়ে এলো তাঁর কণ্ঠস্বর। নরম সুরে বললেন,
' মাংস ধুয়ে রেডি করে রেখেছি। একটু রেঁধে ফেল তো বাবু। সব রেডি। তোকে কিচ্ছু করতে হবে না, শুধু রাঁধবি।'
আমি বিস্মিত চোখে আম্মুর দিকে চেয়ে রইলাম। কী আশ্চর্য রূপ পরিবর্তন! চোখের পলকে বাবু? নবাবপুত্রী থেকে একেবারে বাবু? এ তো দেখি একেবারে শুভ্রবংশীয় ব্যবহার। কাজের সময় আদরে আদরে আদরিণী রোদ আর বাকি সময়? আমি গাল-ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম,
' অসম্ভব! বাসায় এতোগুলো মানুষ থাকতে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে রান্না করাতে হবে তোমার? সত্যি করে বলো তো আম্মু? আমাকে কী সত্যিই কুড়িয়ে পেয়েছিলে? আপুসহ সবাই পাশের ঘরে আড্ডা দিচ্ছে তাদেরকে তো একবার রান্নার কথা বললে না? মেঝ চাচী, ছোট চাচী, ফুপ্পিরা কত্ত মানুষ বাসায় আজ! তুমি শুধু কাজের সময়ই আমাকে দেখো। আমি কোনো রান্না-বান্না করতে পারবো না; ঘুমাবো।'
আম্মু তাঁর কোমল কণ্ঠে রাজ্যসম আদর ঢাললেন। গোপন ষড়যন্ত্র করার মতো গলা নামিয়ে বললেন,
' তোর মামানির চাচাতো বোন; ওইযে তোর সুরাইয়া আন্টিকে তো চিনিস? তোর সুরাইয়া আন্টির বড়ো বোন এসেছে তোর মামুর বাসায়। ওই আপার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছে। ভাবী তখন রাফিয়ার কথা বলেছে। এখন তারা রাফিয়াকে দেখতে চায়। আজ তোর মামুদেরসহ ওদের সবাইকে দুপুরের দাওয়াত দিয়েছি৷ কত কাজ বাকি! তুই একটু মাংসটা রেঁধে ফেল মা। জেদ করে না। বারোটা বেজে গেলো বলে!'
আমি কেবিনেটের উপর থেকে এক টুকরো পিঠে তুলে নিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে শুধালাম,
' ছেলে কী করে?'
' সচিবালয়ে চাকরি করে। নবম গ্রেডের চাকরি।'
পরমুহূর্তেই আবার কণ্ঠ নামিয়ে আনলেন আম্মু। ফিসফিস করে বললেন,
' ওরা এলে তোর আন্টির থেকে কোনোভাবে ছেলের ফেসবুক আইডিটা নিস তো। ছেলে দেখতে কেমন, স্বভাব-চরিত্র কেমন ঘেঁটে দেখবি৷'
আমি হেসে ফেললাম। শুধালাম,
' ফেসবুক থেকে কী আর স্বভাব-চরিত্র বুঝা যায় আম্মু?'
আম্মু যেন বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। বললাম,
' এখনই বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছে কেন চাচী? পড়ছে পড়ুক না?'
আম্মু ভাবুক কণ্ঠে বললেন,
' ব্যস্ত আর কী? দেখলেই কী আর বিয়ে হয়? দেখছে, দেখুক। পছন্দমতো হলে বিয়ে দিয়ে দিবে। আর বিয়ে হয়ে গেলেই ভালো। ঝামেলা শেষ। রুহিকেও এই বয়সে বিয়েটা দিয়ে দিলে আজ আর এই দিন দেখতে হতো না৷ তোর বাবার জন্য এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে গেলো আমার। চারটাতে লেটার পেয়ে পাশ করেও নানান কারণে আর পড়তে ইচ্ছে হলো না। তাই ভেবেছিলাম মেয়েদের পড়াশোনা শেষ না করিয়ে বিয়ে দিবো না। কিন্তু মেয়ে করলো কী? তবু, মেনে নিলাম। কাউকে পছন্দ করা খারাপ কিছু না। পছন্দ করেছিস ভালো কথা। ছেলেকে বাসায় আসতে বল; আমরা বিয়ের কথা বলি। তা না, এখানেও নাকি কমপ্লিকেশন। প্রেম করেছিস বিয়ে করবি, এখানে আবার কমপ্লিকেশন কীসের? নিশ্চয় ছেলেটাই রাজি হচ্ছে না? আমার নরম-সরম মেয়েটা চিন্তায় চিন্তায় এতোটুকু হয়ে গিয়েছে। সেদিন এসে বলছে, আম্মু, আমাকে আর বিয়ের কথা বলবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি কখনো বিয়ে করবো না। আশ্চর্য কথা! বিয়ে করবি না মানে কী?'
কথা বলতে বলতে আচমকা আমার নাম ধরে ডাকলেন আম্মু। সাবধানে শুধালেন,
' তোর কাছে ওই ছেলের ফোন নম্বর আছে? থাকলে আমাকে দিবি। এক থাপ্পড়ে তার নাকসা ফাটিয়ে দিবো। ওই ছেলের হাইট কত, জানিস?'
আরাফ ভাইয়া বেশ কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক। মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। আমাকে সর্বদাই ছোট বোনের মতোন স্নেহ করেন। সুতরাং, তার নাকসা ফাটানোর পরিকল্পনায় আমি খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে পারলাম না। নিরুৎসাহি কণ্ঠে বললাম,
' পাঁচ ফুট এগারো।'
আম্মু দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন,
' ঠিক আছে। আজ থেকে ছয় ফুটের নিচে কোনো পাত্রের সিভি এই বাসায় বরদাস্ত করা হবে না। ওই ছেলের থেকে লম্বা, সুন্দর ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দিবো আমি। ভেবেছেটা কী আমার মেয়েকে? এতোই সহজ!'
আম্মুর শিশুসুলভ জেদ হেসে ফেললাম আমি। পরমুহূর্তেই নিজের ফ্যাসাদের কথা মনে পড়ে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললাম,
' তাই বলে আমাকে রাঁধতে হবে কেন! আর কেউ নেই বুঝি? কত মানুষ বাসায়!'
আম্মু তখনও উত্তেজিত হয়ে আছেন। কঠিন কণ্ঠে বললেন,
' আর কেউ এসেছে? দেখছিস কাউকে? সব কয়টা হয়েছে নবাবজাদি। আমি বলতে গেলেই তো দোষ। তোর বাপের গোষ্ঠীকে কিচ্ছু বলা যাবে না। তারা সব ধোয়া তুলসীপাতা। এই যে মেয়েটাকে দেখতে আসবে, কারো কোনো চিন্তা আছে? গরুর পালের মতো বসে আছে আর হৈ-চৈ করছে। অসুস্থ শরীরটা নিয়ে সেই ভোর থেকে রান্না করছি। একটা মানুষ উঁকি দিয়েছে? ঘরদোরও তো গোছাতে হবে নাকি? রাতুলের মাকেও বলিহারি, নিজের মেয়েকে দেখতে আসবে সেদিকে কোনো চিন্তা নেই। বসে বসে শুধু রসের গল্প। এই কথাটা যদি আমি বলি তাহলেই তোর বাপের কাছে আমি খারাপ; তার ভাই-বোনকে দেখতে পারি না। সব নষ্টের গোড়া তোর বাপ। তোর বাপকে রান্নাঘরে আসতে বল। রান্না-বান্না করে আদরের ভাইবোনকে কোলে তুলে খাওয়াক।'
আম্মুর কণ্ঠে মুখস্থের মতো অভিযোগবাণী বেরিয়ে আসতে দেখে বিচলিতবোধ করলাম আমি। এই কথাগুলো ফুপুদের কানে গেলেই বাড়িতে একটা হেস্তনেস্ত বেঁধে যাবে। তারপর বাবা বাধাবেন লঙ্কাকাণ্ড। এদিকে আমারও রান্না করার ইচ্ছে নেই। বাংলা বর্ষপুঞ্জিতে '১৪২৮ বঙ্গাব্দ' যেমন ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়েছে সমাপ্তির দোরগোড়ায়; আমার অবস্থাও কিঞ্চিৎ সেরকম। ঘুমের ভারে অদৃশ্য দেখছি ত্রিভুবন। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি মাত্র নেই। অন্যদিকে আম্মুর মায়াও ছাড়তে পারছি না। বেচারি একা এতো কাজ করবেন? আহারে! ঘুমের থেকে মায়ের মায়া বড়ো। সুতরাং ঘুমের মায়াকে বিদায় জানিয়ে এক বুক দুঃখ নিয়ে বললাম,
' হয়েছে। বাবাকে আসতে হবে না; আমি রান্না করে দিচ্ছি মাংস। সব সময় তুমি এমন করো। কাজের সময় এলেই শুধু রোদ রোদ। একটু শান্তিতে ঘুমুতেও দেয় না কেউ আমায়। অসহ্য!'
পাশা খেলায় জিতে গিয়ে বেশ সন্তুষ্ট হলেন আম্মু। অন্যদিকে আমার মুখখানা হলো কালো। কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করলাম। আরও কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু আম্মু আমার সৎ ইচ্ছেটাকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না; চুপচাপ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ অসহায়মুখে দাঁড়িয়ে থেকে এক লক্ষবারের মতো বিশ্বাস করে ফেললাম, 'এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। কেউ ভালোবাসে না আমায়। কেউ না।' আমার ব্যথিত মন নজরুলের সাথে সাথে বিরহি সুর তুললো,
'বৃথা তুই কাহার পরে করিস অভিমান।
পাষাণ-প্রতিমা সে-যে হৃদয় পাষাণ॥'
আহারে, পাষাণ! পাষাণ! এই জগতের সকলেই পাষাণ; পাথর; পাষণ্ড। আমি আক্ষেপের নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দিতেই কোথা থেকে নাচতে নাচতে রান্নাঘরে এসে ঢুকলো রাফিয়া। এসেই ফিসফিস করে শুধালো,
' এই রোদু? রোদু রে? শুনলাম আজ শুভ্র ভাইদের সকলের দাওয়াত এই বাসায়? শুভ্র ভাইও আসবেন?'
আমি মেজাজ খারাপ নিয়ে রাফিয়ার দিকে চাইলাম। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালাম,
' আমি কী শুভ্র ভাইয়ের এসিস্ট্যান্ট? কী করে জানবো উনি আসবেন, নাকি আসবেন না? আর আসলেও তোর এতো নাচানাচি কীসের? তোকে না আজ দেখতে আসবে? নিজের কথা ভাব।'
রাফিয়া আশ্চর্য হয়ে বললো,
' দেখতে আসবে? কে?'
' নাহিদ ভাইয়ার বড়ো খালামণি। শুভ্র ভাইয়েরও খালামণি অবশ্য।'
আমাকে অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো রাফিয়া। উচ্ছল কণ্ঠে শুধালো,
' শুভ্র ভাইয়ের খালাতো ভাই? লতায় পাতায় একই জিন। দেখতে নিশ্চয় শুভ্র ভাইয়ের মতো হবে? দুধ না পেলে ঘোলই সই। কী বলিস?'
কথাটা বলে চোখ টিপলো রাফিয়া। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
' তোর মাথা! সবাই বলে শুভ্র ভাই অনেকটা নানাভাইয়ের মতো দেখতে হয়েছে। শুভ্র ভাইয়ের দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই নিশ্চয় আমার নানার মতো দেখতে হবে না? তাছাড়া, তোর না বয়ফ্রেন্ড আছে?'
রাফিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
' সো হোয়াট?'
আমি উত্তর দিলাম না। ঠিক তখনই বসার ঘর থেকে মামানির কণ্ঠ ভেসে এলো। রাফিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে শুধালো,
' এই? এই? তোর মামানির কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না? তারমানে শুভ্র ভাইও চলে এসেছেন?'
বাক্যটা শেষ করেই রান্নাঘরের দরজার কাছে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা। আমিও কৌতূহলবশত উঁকি দিলাম বাহিরে। রাফিয়ার সাথে ধাক্কাধাক্কি করে বাইরে নজর রাখা নিধি এবার অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
' রাফিয়াপু, কোথায় তোমার শুভ্র ভাই? এখানে ইয়াং কেউ নেই তো। ব্যাটা কী আসেনি?'
নিধির কথায় ভ্রু কুঁচকালাম। মেয়েটা রাফিয়ার মামাতো বোন। ইন্টারে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে। মমিনুন্নেসার হলে থাকে; বেড়াতে এসেছে। বয়সে শুভ্র ভাইয়ের থেকে কমপক্ষে নয়-দশ বছরের ছোট হবে। অথচ কথার ঢং দেখো! নিশ্চয় এই মেয়ের মাথাটাও খেয়েছে রাফিয়া? আমি নিজের বিরক্তবোধ সরিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলাম। বসার ঘরে তখনও আলোচনা চলছে। তারই খণ্ড খণ্ড অংশ ভেসে আসছে এখানেও। তরকারিতে হলুদ দিতে দিতে আনমনে সেদিকেই কান দিয়ে রাখলাম আমি।
' তোমার ভাই একটু বেরিয়েছে। নামাজ পড়ে আসবে। আমি ভাবলাম, বসেই যখন আছি আপাদের নিয়ে এই বাসায় চলে আসি। সবাই মিলে গল্পগুজব করা যাবে।'
' ভালো করেছেন। আমিও ফোন করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু শুভ্র কই ভাবী? এখানে সবাই হৈ-চৈ করছে। ছেলেটা একা বাসায় কী করে?'
শুভ্র ভাইয়ের কথা উঠতেই দরজার উপর ঝেঁকে পড়লো রাফিয়া-নিধি। মামানি বললেন,
' শুভ্র বোধহয় আসবে না৷ ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না। জ্বর উঠতে পারে। তাই আগেই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দিয়েছে। ডাকাডাকি নিষেধ৷ ভালো ঘুম হলে নাকি শরীর খারাপ কেটে যাবে। এই সময়ে জ্বর হলে তো ফ্লাইট ধরতে পারবে না। এমনিতেই দেশের যা অবস্থা! করোনা নাকি আবার বাড়ছে? গায়ের তাপমাত্রা একটু এদিক-সেদিক হলেই দেখা যাবে এয়ারপোর্টে আটকে দিয়েছে। এদিকে ওর যাওয়া নাকি খুব ইম্পোর্টেন্ট। আজকালকার ছেলেমেয়েদের কখন কী ইম্পোর্টেন্ট বুঝা দায়! তাই ছেড়ে দিয়েছি, যা ইচ্ছে হয় করো। আমি এর মধ্যে নেই।'
আম্মু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
' তাই বলে ছেলেটাকে আমি এক বেলা নিজের হাতে খাওয়াতে পারবো না? একটা মাত্র ভাতিজা আমার। আবার কবে না কবে আসে তার ঠিক আছে? শরীরের যা অবস্থা, আমিও যে অতোদিন বেঁচে থাকবো তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? আপনিও না ভাবী? ছেলেটাকে সাথে আনতেন। খেয়ে গিয়ে ঘুমোতে পারতো না?'
মামানি বোধহয় বিপন্নবোধ করলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
' আমাকে দোষারোপ করে লাভ আছে অরি? তোমার ভাতিজাকে তুমি চিনো না? কারো কথা শুনে কখনো? যা মনে হয় তাই করবে। তাই শুনতে হবে। নয়তো লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে।'
অতিথিদের মধ্যে থেকে এক প্রৌঢ়া রমণী বেশ কৌতুক করে বললেন,
' এই জন্যে বলি বিয়ে করিয়ে ফেল। বউ এলেই সব টাইট। মায়ের কথা না শুনলেও বউয়ের কথা ঠিকই শুনবে।'
এবার দৃশ্যপটে ছোট ফুপির আগমন ঘটলো। ফুপার সাথে তার চিরদিনের বিদ্বেষ প্রকাশ করে বললেন,
' সব ছেলে শুনে না আপা। আমার ভাইয়েরাই সারাজীবন বউয়ের কথা শুনে উঠলো বসলো। আমাদের ওমন জামাই ভাগ্য হলো না। সব সুখ আমাদের বাড়ির বউদের।'
আম্মু ও চাচিদের কটাক্ষ করার এবং আম্মুর ক্ষেপে যাওয়ার জন্যে মোক্ষম শব্দবাণ। আমি মনে মনে আতঙ্কবোধ করলাম। সুরাইয়া আন্টি এবার বেশ বুদ্ধি দেখালেন। কলহ লেগে যাওয়ার আঁচ পেয়েই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে বললেন,
' তা ঠিক। সবাই তো একরকম হয় না। শুভ্রর দাদা, আমাদের তালই-ও তো বেশ গম্ভীর মানুষ ছিলেন। একরোখা। অরির বিয়ের সময় কেমন বেঁকে বসলেন? কিছুতেই এই ঘরে মেয়ে দিবেন না। শুভ্রকে দেখে তালই-এর কথা মনে পড়ে যায়। তেমনই লম্বাচওড়া মানুষ। দাদার স্বভাব, রূপ সব পেয়েছে।'
আলোচনার মোড় ঘুরে গেলো। সেই প্রৌঢ়া বেশ প্রশংসণের কণ্ঠে বললেন,
' পেয়েছে বলতে! তালইয়ের মতোই নম্র, ভদ্র, ঝিমঝাম হয়েছে রেনুর ছেলেটা! হাসি ছাড়া কথা নেই। আজকাল ছেলেমেয়েরা বয়স্কদের সাথে কথা বলতে বিরক্ত হয়। কিন্তু রেণুর ছেলে কী সুন্দর গল্প করতে বসলো! হুবুহু তালইয়ের মতো মিষ্টবুলি৷ আমি বললাম, তোমার বাপ-দাদার যা আছে তা রেখে তোমার আবার বিদেশ গিয়ে পড়তে হয় কেন বাপু? বিয়েশাদি করে বংশ বাড়াও। ছেলে দেখি আমার কথা শুনে হাসে। এতো লক্ষ্মী! কথা শুনে প্রাণ জুড়ায়।'
ছোট ফুপি এবার মুখ খুললেন। ভাইয়ের বউদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও ভাতিজা-ভাতিজিদের প্রতি ভালোবাসার তার কমতি নেই। নিজের ভাতিজা-ভাতিজি ছাড়া অন্যকারো প্রশংসা তিনি কদাপি বরদাস্ত করেন না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, শুভ্র ভাইকে তিনি বরদাস্ত করলেন। খুশি মনে বললেন,
' শুভ্র এমনিতেও খুব ভদ্র আপা। খুব পরিশ্রমী। এমন পরিশ্রমী ছেলে এখন আর হয় না। একমাত্র ছেলে; বাবার দেওয়ার মতো যথেষ্ট আছে। তারপরও এইযে এতোদূর পড়াশোনা করলো, রোদের মামার একটা পয়সা খরচ করতে হয়েছে বলে মনে হয় না। সব শুভ্রর টিউশনির টাকা। বিদেশ যে গেলো এটাও গেলো নিজের টাকায়। রোদের মামা-মামির হলো সাত কপাল, আপা। এমন সোনার টুকরা ছেলে কয়জনের হয়? বাপ-মায়ের কথা মনে পড়তেই সব ফেলে চলে এসেছে বাপ-মাকে দেখতে। এমন বাপ-মা ভক্ত ছেলে এখন আছে?'
শুভ্র ভাইয়ের নামে এই অতিরঞ্জিত স্তুতিবাক্যে মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো আমার। শুভ্র ভাই যে কী জিনিস! তা না জেনেই তার নামে ফুলচন্দন ফুটানো নির্বোধ রমণীদের প্রতি বোধহয় স্বয়ং বিধাতাও কৌতুক বোধ করলেন। আর আমি ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্দুর বানিয়ে বসে রইলাম। নম্র-ভদ্র-ভালো মানুষ আর শুভ্র ভাই? অসম্ভব!
বসার ঘরের রমণী আলাপন চলতে থাকলো। আম্মু সেসকল গল্পে একদমই যোগ দিতে পারলেন না। তাঁর মন খারাপ। শুভ্র ভাই আসেননি বলে বারকয়েক দুঃখ প্রকাশ করলেন। সেই শুনেই হৈ-হৈ করে উঠলেন ছোট ফুপি। ছোট ফুপির এই স্বভাব, অল্পতেই হৈ-চৈ করে এলাকা গরম করে ফেলেন। অস্থির করে তুলেন চারপাশ। কখন কার দলে কথা বলেন তা বোধ করি তিনি নিজেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেন না। এবারও তাই করলেন। ধমকা ধমকি জুড়ে দিয়ে বললেন,
' সেই তো! একমাত্র ভাতিজা বিদেশ-বিভুঁইয়াই চলে যাবে ফুপুর বাসায় একবেলা খাবে না? হায়াৎ মউতের ঠিক আছে? এই ভাবী, আপনি শুভ্রকে ফোন দেন তো। আমি কথা বলছি। ফোন লাগান।'
মামানি বললেন,
' ফোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। ফোন দিলেও লাভ হবে না।'
ফুপি এবার আরও হৈ-চৈ শুরু করলেন। কিছুক্ষণের জন্য বোধ হলো আম্মুর থেকে মর্মবেদনা তারই বেশি। শুভ্র ভাই আজ দুপুরে এই বাড়িতে না খেতে পেলে তার নিজেরই দম আটকে যাবে। মরেও যেতে পারেন। ফুপির হৈ-চৈ অচিরেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। আমাকে ডেকে বললেন,
' এই রোদ? রোদ কোথায়? রোদকে পাঠিয়ে দেন; ডেকে আনুক। দুপুরে সবার সঙ্গে খাবে এখন আবার কীসের ঘুম। বহুত ঘুম ঘুমাতে পারবে; এখন ঘুমোতে হবে না। এই রোদ? যা। গিয়ে শুভ্রকে ডেকে আন।'
আদেশ জারি করতে করতে রান্নাঘরের দরজায় উঠে এলেন ফুপি। আমি মিনমিন করে বললাম,
' আমি রান্না করছি ফুপি।'
' রান্না করছিস তো কী হয়েছে? রান্না চুলায় বসিয়ে দিয়ে যা। তরকারি তো বসিয়েই দিয়েছিস। যা, গিয়ে ডেকে আন।'
রাফিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
' ফুপি? আমি আর নিধিও যাই?'
ফুপি চাপা ধমক দিয়ে বললেন,
' তুই যাবি কেন? একজনকে ডাকতে দশজন যাওয়া লাগবে? ঘরে গিয়ে মুখে স্নো, পাউডার লাগিয়ে একটু ভদ্রা হ। জামা পাল্টা। মেহমানদের সাথে কথাবার্তা বল। স্মার্টলি কথা বলবি। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া একটা মেয়ে, কথার মাঝে বেআক্কেলর মতো দাঁত বের করে হাসবি না। মুচকি হাসবি। এই নিধি? যাও, ওকে একটু গুছিয়ে দাও। এগুলোকে দেখলে কে বলবে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে? বেআক্কেলের বেআক্কল। এই রোদ? গেলি না?'
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ছোট ফুপির চিৎকার-চেঁচামেচিতে দুই মিনিটে মাথা ধরে গেলো। ইচ্ছে হলো নিজের মুণ্ডুটা কেটে তরকারির জায়গায় মুণ্ডুটাকেই বেজে ফেলি। মেহমানদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলি, 'এই নিন, খান৷ মুণ্ডু ফ্রাই।' এ কেমন সার্কাস ফ্যামিলিতে জন্মে গিয়েছি আমি বিধাতা? সব জায়গায় শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি আর রোদ রোদ রোদ। আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখে না এরা? অসহ্য!
মেজাজের উপর চণ্ডী নৃত্য নিয়ে যখন মামুর বাসার জন্য রওনা হলাম পেছন থেকে ডাকলেন মামানি। একটা চাবির গোছা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
' শুভ্র জীবনেও উঠে দরজা খুলবে না। চাবি নিয়ে যা।'
আমি চাবিটা হাতে নিয়ে অসহায় চোখে মামানির দিকে চাইলাম। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম,
' সত্যি করে বলো তো মামাণি? আমাকে কী সত্যিই কুড়িয়ে পেয়েছিলে তোমরা? সবাই শুধু সব কাজে আমাকেই দেখে। তোমার ছেলের ঘুম ভাঙাতেও এখন আমাকে পাঠাতে হবে? একটুও মায়া হয় না তোমাদের? তোমার ছেলের যা স্বভাব! ঘুমে বিরক্ত করলে আমাকে চারতলা থেকে ফেলে দিতে এক সেকেন্ডও চিন্তা করবে না।'
মামাণি আমার থেকেও অসহায় কণ্ঠে বললেন,
' আল্লাহ আল্লাহ করে যা। তোকে কিছু বলবে না।'
আমি রুষ্ট কণ্ঠে বললাম,
' তুমি সব সময়ই এই একই সান্ত্বনাবাণী দিয়ে আমাকে দুঃসাহসিক মিশনে পাঠাও। এসব মিশনে আমি শহীদও হয়ে যেতে পারি।'
মামাণি হেসে ফেললেন। কপালে আলতো আদর করে বললেন,
' ধুর বোকা! আমার ছেলে এতোটাও ভয়ঙ্কর না। বরং, জাতে পাগল তালে ঠিক। তোকে কিচ্ছু বলবে না।'
আমি অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললাম,
' আবার!'
মামাণি এবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন। আমি মামাণির উচ্ছল মুখের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে থেকে 'এক লক্ষ এক' বারের মতো বিশ্বাস করে ফেললাম, এই পৃথিবীতে কেউ আমায় ভালোবাসে না। না, না, না।
ঠিক দুপুরের মাথায় শুভ্র ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম আমি। শুভ্র ভাই তখন ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছেন। পুরো বাসায় নিস্তব্ধ নীরবতা। কেবল, শুভ্র ভাইয়ের ঘর থেকে বৈদ্যুতিক পাখার আওয়াজ আসছে। তালা খোলে ভেতরে ঢুকে প্রথমে গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এমন অস্বাভাবিক নীরবতায় হঠাৎ করেই নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারলাম না। সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। তারপরও অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে রইলো মন। সেই অস্বস্তি তীব্র হলো শুভ্র ভাইয়ের শোবার ঘরের সামনে যাওয়ার পর। নারীসুলভ সংকোচে ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, ফিরে যাই। এমন মধ্যদুপুরে এমন ফাঁকা বাসায় আসা উচিত হয়নি। ঘরের দেওয়ালগুলোও কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে কৌতুকমাখা কৌতূহল। নানারকম দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই দরজার আড়াল থেকে শুভ্র ভাইয়ের নাম ধরে ডাকলাম। প্রথমবার ডাকতে গিয়ে গলা কাঁপলো। দ্বিতীয়বার বেশ শক্ত শোনালো কণ্ঠ। পরপর কয়েকবার ডাকার পরও শুভ্র ভাইয়ের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। আমার কণ্ঠখানাই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে এলো। এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাজারখানেক সংশয়, সংকোচ নিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম।
শুভ্র ভাইকে দেখা যাচ্ছে; গায়ে কম্বল মুড়ে ঘুমোচ্ছেন। আমি দেওয়াল হাতড়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলাম, জ্বলছে না। পাখা চলছে অথচ আলো জ্বলছে না? আশ্চর্য! আমি আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করে এক রকম অতিষ্ঠ হয়েই বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবছা অন্ধকারে শুভ্র ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখখানা দেখাচ্ছে শিশুর মতো। নিষ্পাপ, শান্ত। আমি তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম, এই লোকের নাটকের শেষ নেই। এমনিতে নূপুরের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আর আজ ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অথচ খোঁজ নেই? আশ্চর্য! মরে টরে গেলো নাকি? ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে হাত নাড়লাম,
' এই যে, শুনছেন? শুভ্র ভাই? এক্সকিউজ মি? আপনি কী বেঁচে আছেন?নাকি ইন্তেকাল করেছেন? মরে গেলে বলে দিন, চলে যাই৷ হ্যা-লো?'
এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তার মানে, সত্য সত্যই ঘুমোচ্ছেন। নাটক হলে এতোক্ষণে উঠে বসতেন। গালের উপর সটান একটা চড় বসাতেন। অতঃপর পাকা আমের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়তো আমার কয়েক পাটি দাঁত। আমি হতাশ হয়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশে বসে পড়লাম৷ মানুষের ঘুম ভাঙানো যে কত কঠিন কাজ সে কথা ভেবে নিজের প্রতিই বড়ো করুণা হলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ খেয়াল হলো, শুভ্র ভাইয়ের জ্বর টর হয়নি তো? সিনেমায় যেমন দেখায়, নায়ক জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। দেখা গেলো, শুভ্র ভাইও তেমন বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছেন? আমি খানিক দ্বিধা নিয়ে হাত বাড়িয়ে শুভ্র ভাইয়ের জ্বর পরীক্ষা করলাম। জ্বর নেই। গা ঠান্ডা৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নানান ভাবনায় আনমনা হয়ে কপাল থেকে হাত সরাতে কিছু বিলম্ব হলো। এর মাঝেই বৈদ্যুতিক শকের মতো এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলেন তিনি৷ চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্তি ঝাড়লেন। মুখে আওড়ালেন অদ্ভুত সব কথামালা,
' সাওয়ারেডেনা কুডাসাই। আনাতাহ্আদারেডেস কাহ্?'
আমি বিস্ময় নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। হিন্দি সিরিয়ালের নায়কের মতো মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটিই শব্দ, 'হোয়াট?' কী সব বলছেন শুভ্র ভাই? সানাডা আনাডা এসব আবার কোন দেশীয় শব্দ? পড়াশোনা করতে করতে পাগল-টাগল হয়ে গেলেন না তো শেষ পর্যন্ত? কী সর্বনাশ! আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে আগ্রহী কণ্ঠে শুধালাম,
' শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই? আপনি কী পাগল হয়ে গিয়েছেন, শুভ্র ভাই ?'
শুভ্র ভাই তখন ঘুমে বিভোর ; প্রত্যুত্তর করলেন না। আমি দুঃখী দুঃখী চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার নানাভাইয়ের পূর্বপুরুষরা বোধহয় খাঁটি আর্য ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই ফর্সা, একহারা গড়নের লম্বা-চওড়া মানুষ। শুভ্র ভাইয়ের মাঝেও এই ব্যাপারটা প্রকট। চেহারায় একটা সম্ভ্রান্তবংশীয় ছাপ। একবার তাকালে হুট করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এমন একটা ছেলে হুট করে পাগল হয়ে গেলো, ভাবতেই তো মায়া হয়৷ আহারে! আমার নানাভাইয়ের আত্মঅহংকারী বংশ শেষমেশ কিনা পাগল বংশ হয়ে গেলো?
আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে শেষবারের মতো তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম। সত্য সত্যই পাগল হলেন কি-না পরীক্ষা করার চেষ্টা। পরীক্ষা কিছু হলো না। বুকের ভেতর ঢাক-ঢোল পেটিয়ে কেবল এইটাই আবিষ্কার করতে পারলাম, শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে আজকাল কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। তাকে বড়ো বেশি সুদর্শন দেখাচ্ছে। 'শুভ্র ভাই সুন্দর' --- এ কথা আমি ছোট থেকেই জানি। কিন্তু 'হা' করে তাকিয়ে থাকার মতো আহামরি কিছু মনে হয়নি৷ কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই ছেলেকে 'হা' করে দেখলেই বা ক্ষতি কী? একে তো 'হা' করে দেখার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে! আমার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই আচমকা চোখ মেলে চাইলেন শুভ্র ভাই। আমি চমকে সরে বসলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা বেয়ে। শুভ্র ভাই আমার চিৎকারে স্প্রিংয়ের মতো উঠে বসলেন। কোনো কথা বললেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার, ধমকও দিলেন না। কেবল স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার ভয়ার্ত মুখের দিকে। তাকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। দ্বিধা নিয়ে শুধালাম,
' আপনি জেগে ছিলেন, শুভ্র ভাই?'
দারুণ প্রশ্নের নিদারুণ অপচয় হলো। শুভ্র ভাই জবাব দিলেন না। আগের মতোই বসে রইলেন, চোখের পলক পর্যন্ত পড়লো না। দৃষ্টি আমার দিকে স্থির। এবারে আমি ঘাবড়ে গেলাম। যে লোক সুযোগ পেলেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো মুখ ছুটায় তার আকস্মিক মৌনব্রত অস্বস্তিকর। আমার চোখে-মুখে তীব্র বিভ্রান্তি ফুটে উঠলো। তার থেকেও আশ্চর্য হলাম যখন তার চোখের মণি সহসাই কেমন ধূসর ঠেকলো আমার কাছে। কেমন অস্বস্তিকর, নিষ্প্রাণ সেই চাহনি। অন্ধকারের জলছাপে মুখটাও দেখাচ্ছে অন্যরকম। যেন কোনো মানুষ নয়; যন্ত্র। শুভ্র ভাই নয়; অন্য কেউ। আমি কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, আমার কণ্ঠ কাঁপছে। সেই কম্পনকে ধামাচাপা দিয়ে শুধালাম,
' আপনি ঠিক আছেন, শুভ্র ভাই? কথা বলছেন না কেন? আপনার কী শরীর খারাপ করছে?'
আমার এক ঝুড়ি প্রশ্নের জবাবে তিনি আমায় উপহার দিলেন সেই একই রকম নিষ্প্রাণ চাহনি। গা ছমছমে, ভীতিকর দৃষ্টি। অকস্মাৎ আমার মনে হলো, চারদিকে আরও ভীতিকর ব্যাপার ঘটছে। একইসাথে ঘটে যাচ্ছে আরও অনেকগুলো অদ্ভুত ঘটনা। এই যেমন, ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হচ্ছে শুভ্র ভাইয়ের চোখের ধূসরতা। ঘন হচ্ছে চারপাশের অন্ধকার। নেমে যাচ্ছে ঘরের তাপমাত্রা। আমি নিজেকে স্থির করে ভাবার চেষ্টা করলাম। ভেবে বের করলাম, শুভ্র ভাই বোধহয় এখনও ঘুমের ঘোরে আছেন। স্লো ওয়েভ স্লিপ ধরনের কিছু একটা হলেও তো হতে পারে? যদি আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁই তাহলে নিশ্চয় সজ্ঞানে ফিরে আসবেন তিনি? আমি বড়ো একটা দম নিয়ে হাত বাড়ালাম। শুভ্র ভাই তখনও নিষ্পলক চেয়ে আছেন। যেন কোনো মৃত মানুষ; স্পন্দনহীন তার শরীর। আমি কাঁপা হাতে তার চিবুক ছুঁতে চাইলাম। কিন্তু তার আগেই ঘটলো অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। শুভ্র ভাইয়ের ঠিক পাশে জ্বলজ্বল করে উঠলো এক জোড়া হলুদ চোখ। আমার হাত থমকে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে সেই চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর, কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই গা শিরশিরে চোখ জোড়া লাফিয়ে এলো আমার দিকে। আমি ভয়ঙ্কর এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে পড়লাম মেঝেতে। ভয়ে তখন আমার সারা শরীর কাঁপছে। প্রচন্ড আতঙ্কে বুজে এসেছে কণ্ঠস্বর। আমি ধরা কণ্ঠে শুধালাম,
' ওটা কী শুভ্র ভাই? ওটা কী? আমি ভয় পাচ্ছি।'
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। তবে সেই হলুদ চোখের মালিক থেকে উত্তর এলো৷ সে বললো,
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৬৭ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
নৌশিন আহমেদ রোদেলা’র গল্প ও উপন্যাস:
- আজ ওদের মন ভালো নেই
- মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
- রোদ শুভ্রর প্রেমকথন
- তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে
- আরশিযুগল প্রেম
- নীল চিরকুট
- প্রিয়দের কাল্পনিক সাক্ষাৎ
- প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প
- আজি এই সন্ধ্যাক্ষণে
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন