উপন্যাস        :         রোদ শুভ্রর প্রেমকথন
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ নভেম্বর, ২০২০ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “রোদ শুভ্রর প্রেমকথন” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


৬৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ৬৭)


ঠিক দুপুরের মাথায় শুভ্র ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম আমি। শুভ্র ভাই তখন ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছেন। পুরো বাসায় নিস্তব্ধ নীরবতা। কেবল, শুভ্র ভাইয়ের ঘর থেকে বৈদ্যুতিক পাখার আওয়াজ আসছে। তালা খোলে ভেতরে ঢুকে প্রথমে গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এমন অস্বাভাবিক নীরবতায় হঠাৎ করেই নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারলাম না। সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। তারপরও অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে রইলো মন। সেই অস্বস্তি তীব্র হলো শুভ্র ভাইয়ের শোবার ঘরের সামনে যাওয়ার পর। নারীসুলভ সংকোচে ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, ফিরে যাই। এমন মধ্যদুপুরে এমন ফাঁকা বাসায় আসা উচিত হয়নি। ঘরের দেওয়ালগুলোও কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে কৌতুকমাখা কৌতূহল। নানারকম দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই দরজার আড়াল থেকে শুভ্র ভাইয়ের নাম ধরে ডাকলাম। প্রথমবার ডাকতে গিয়ে গলা কাঁপলো। দ্বিতীয়বার বেশ শক্ত শোনালো কণ্ঠ। পরপর কয়েকবার ডাকার পরও শুভ্র ভাইয়ের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। আমার কণ্ঠখানাই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে এলো। এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাজারখানেক সংশয়, সংকোচ নিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম।
শুভ্র ভাইকে দেখা যাচ্ছে; গায়ে কম্বল মুড়ে ঘুমোচ্ছেন। আমি দেওয়াল হাতড়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলাম, জ্বলছে না। পাখা চলছে অথচ আলো জ্বলছে না? আশ্চর্য! আমি আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করে এক রকম অতিষ্ঠ হয়েই বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবছা অন্ধকারে শুভ্র ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখখানা দেখাচ্ছে শিশুর মতো। নিষ্পাপ, শান্ত। আমি তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম, এই লোকের নাটকের শেষ নেই। এমনিতে নূপুরের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আর আজ ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অথচ খোঁজ নেই? আশ্চর্য! মরে টরে গেলো নাকি? ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে হাত নাড়লাম,
' এই যে, শুনছেন? শুভ্র ভাই? এক্সকিউজ মি? আপনি কী বেঁচে আছেন?নাকি ইন্তেকাল করেছেন? মরে গেলে বলে দিন, চলে যাই৷ হ্যা-লো?'
এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তার মানে, সত্য সত্যই ঘুমোচ্ছেন। নাটক হলে এতোক্ষণে উঠে বসতেন। গালের উপর সটান একটা চড় বসাতেন। অতঃপর পাকা আমের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়তো আমার কয়েক পাটি দাঁত। আমি হতাশ হয়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশে বসে পড়লাম৷ মানুষের ঘুম ভাঙানো যে কত কঠিন কাজ সে কথা ভেবে নিজের প্রতিই বড়ো করুণা হলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ খেয়াল হলো, শুভ্র ভাইয়ের জ্বর টর হয়নি তো? সিনেমায় যেমন দেখায়, নায়ক জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। দেখা গেলো, শুভ্র ভাইও তেমন বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছেন? আমি খানিক দ্বিধা নিয়ে হাত বাড়িয়ে শুভ্র ভাইয়ের জ্বর পরীক্ষা করলাম। জ্বর নেই। গা ঠান্ডা৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নানান ভাবনায় আনমনা হয়ে কপাল থেকে হাত সরাতে কিছু বিলম্ব হলো। এর মাঝেই বৈদ্যুতিক শকের মতো এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলেন তিনি৷ চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্তি ঝাড়লেন। মুখে আওড়ালেন অদ্ভুত সব কথামালা,
' সাওয়ারেডেনা কুডাসাই। আনাতাহ্আদারেডেস কাহ্?'
আমি বিস্ময় নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। হিন্দি সিরিয়ালের নায়কের মতো মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটিই শব্দ, 'হোয়াট?' কী সব বলছেন শুভ্র ভাই? সানাডা আনাডা এসব আবার কোন দেশীয় শব্দ? পড়াশোনা করতে করতে পাগল-টাগল হয়ে গেলেন না তো শেষ পর্যন্ত? কী সর্বনাশ! আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে আগ্রহী কণ্ঠে শুধালাম,
' শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই? আপনি কী পাগল হয়ে গিয়েছেন, শুভ্র ভাই ?'
শুভ্র ভাই তখন ঘুমে বিভোর ; প্রত্যুত্তর করলেন না। আমি দুঃখী দুঃখী চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার নানাভাইয়ের পূর্বপুরুষরা বোধহয় খাঁটি আর্য ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই ফর্সা, একহারা গড়নের লম্বা-চওড়া মানুষ। শুভ্র ভাইয়ের মাঝেও এই ব্যাপারটা প্রকট। চেহারায় একটা সম্ভ্রান্তবংশীয় ছাপ। একবার তাকালে হুট করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এমন একটা ছেলে হুট করে পাগল হয়ে গেলো, ভাবতেই তো মায়া হয়৷ আহারে! আমার নানাভাইয়ের আত্মঅহংকারী বংশ শেষমেশ কিনা পাগল বংশ হয়ে গেলো?
আমি শুভ্র ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে শেষবারের মতো তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম। সত্য সত্যই পাগল হলেন কি-না পরীক্ষা করার চেষ্টা। পরীক্ষা কিছু হলো না। বুকের ভেতর ঢাক-ঢোল পেটিয়ে কেবল এইটাই আবিষ্কার করতে পারলাম, শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে আজকাল কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। তাকে বড়ো বেশি সুদর্শন দেখাচ্ছে। 'শুভ্র ভাই সুন্দর' --- এ কথা আমি ছোট থেকেই জানি। কিন্তু 'হা' করে তাকিয়ে থাকার মতো আহামরি কিছু মনে হয়নি৷ কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই ছেলেকে 'হা' করে দেখলেই বা ক্ষতি কী? একে তো 'হা' করে দেখার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে! আমার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই আচমকা চোখ মেলে চাইলেন শুভ্র ভাই। আমি চমকে সরে বসলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা বেয়ে। শুভ্র ভাই আমার চিৎকারে স্প্রিংয়ের মতো উঠে বসলেন। কোনো কথা বললেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার, ধমকও দিলেন না। কেবল স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার ভয়ার্ত মুখের দিকে। তাকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। দ্বিধা নিয়ে শুধালাম,
' আপনি জেগে ছিলেন, শুভ্র ভাই?'
দারুণ প্রশ্নের নিদারুণ অপচয় হলো। শুভ্র ভাই জবাব দিলেন না। আগের মতোই বসে রইলেন, চোখের পলক পর্যন্ত পড়লো না। দৃষ্টি আমার দিকে স্থির। এবারে আমি ঘাবড়ে গেলাম। যে লোক সুযোগ পেলেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো মুখ ছুটায় তার আকস্মিক মৌনব্রত অস্বস্তিকর। আমার চোখে-মুখে তীব্র বিভ্রান্তি ফুটে উঠলো। তার থেকেও আশ্চর্য হলাম, যখন তার চোখের মণি সহসাই কেমন ধূসর ঠেকলো আমার কাছে। কেমন অস্বস্তিকর, নিষ্প্রাণ সেই চাহনি। অন্ধকারের জলছাপে মুখটাও দেখাচ্ছে অন্যরকম। যেন কোনো মানুষ নয়; যন্ত্র। শুভ্র ভাই নয়; অন্য কেউ। আমি কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, আমার কণ্ঠ কাঁপছে। সেই কম্পনকে ধামাচাপা দিয়ে শুধালাম,
' আপনি ঠিক আছেন, শুভ্র ভাই? কথা বলছেন না কেন? আপনার কী শরীর খারাপ?'
আমার এক ঝুড়ি প্রশ্নের জবাবে তিনি আমায় উপহার দিলেন সেই একই রকম নিষ্প্রাণ চাহনি। গা ছমছমে, ভীতিকর দৃষ্টি। অকস্মাৎ আমার মনে হলো, চারদিকে আরও ভীতিকর ব্যাপার ঘটছে। একইসাথে ঘটে যাচ্ছে আরও অনেকগুলো অদ্ভুত ঘটনা। এই যেমন, ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হচ্ছে শুভ্র ভাইয়ের চোখের ধূসরতা। ঘন হচ্ছে চারপাশের অন্ধকার। নেমে যাচ্ছে ঘরের তাপমাত্রা। আমি নিজেকে স্থির করে ভাবার চেষ্টা করলাম। ভেবে বের করলাম, শুভ্র ভাই বোধহয় এখনও ঘুমের ঘোরে আছেন। স্লো ওয়েভ স্লিপ ধরনের কিছু একটা হলেও তো হতে পারে? যদি আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁই তাহলে নিশ্চয় সজ্ঞানে ফিরে আসবেন তিনি? আমি বড়ো একটা দম নিয়ে হাত বাড়ালাম। শুভ্র ভাই তখনও নিষ্পলক চেয়ে আছেন। যেন কোনো মৃত মানুষ; স্পন্দনহীন তার শরীর। আমি কাঁপা হাতে তার চিবুক ছুঁতে চাইলাম। কিন্তু তার আগেই ঘটলো অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। শুভ্র ভাইয়ের ঠিক পাশে জ্বলজ্বল করে উঠলো এক জোড়া হলুদ চোখ। আমার হাত থমকে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে সেই চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর, কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই গা শিরশিরে চোখ জোড়া লাফিয়ে এলো আমার দিকে। আমি ভয়ঙ্কর এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে পড়লাম মেঝেতে। ভয়ে তখন আমার সারা শরীর কাঁপছে। প্রচন্ড আতঙ্কে বুজে এসেছে কণ্ঠস্বর। আমি ধরা কণ্ঠে শুধালাম,
' ওটা কী শুভ্র ভাই? ওটা কী? আমি ভয় পাচ্ছি।'
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। তবে সেই হলুদ চোখের মালিক থেকে উত্তর এলো৷ সে বললো,
' মেও।'
অতিরিক্ত আতঙ্কে শব্দটা প্রথমে ধরতেই পারলাম না আমি। কয়েক সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পর বুঝলাম, এ এক বিড়াল। বিড়াল! মামানিদের বাসায় তো কখনো কোনো বিড়াল ছিলো না। তবে কী অন্য কোথাও চলে এসেছি আমি? শুভ্র ভাই কোথায়? এই লোকটা নিশ্চয় শুভ্র ভাই নন। এরা কী তবে কোনো অশরীরী? আমি আড়চোখে লোকটার দিকে চাইলাম। লোকটা আগের মতোই বসে আছেন। দৃষ্টি আমার দিকে স্থির। আমাকে আড়চোখে চাইতে দেখেও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। কেবল জ্বলজ্বল করে উঠলো ধূসর দুটো চোখ। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো অচেনা এক ভয়ে। সেই হলুদ চোখের মালিক আমাকে ভয় পেতে দেখেই কি-না কে জানে? আরও এক পা এগিয়ে এসে ডাকলো, 'মেও।'
আমার হৃদপিণ্ড তখন দ্রুত ছুটছে। গা শিরশিরে হলুদ চোখদুটোকে এগুতে দেখে অবচেতনেই আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। পিছাতে গিয়ে চেয়ারের গায়ে লেগে প্রচন্ড আঘাত পেলাম মাথায়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই বুঝি প্রাণ বেরিয়ে গেলো। টলমল করে উঠলো চোখ। এবারে সেই নিষ্প্রাণ দেহে প্রাণের সঞ্চার হলো। শান্ত, ধীর পায়ে নেমে এলো আমার কাছে। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। কিন্তু এবার চেহারা উধাও। কোথাও কোনো নাক, মুখ নেই। তার উপরে কেবল সাদা প্রলেপ, এবড়ো থেবড়ো মুখ। আমি ভয় পেলাম ;প্রচন্ড ভয়। ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম,
' আমি বাসায় যাবো। প্লিজ, আমি বাসায় যাবো।'
তিনি কাছে এসে আমার সামনে বসলেন। ফিসফিস করে বললেন,
' রিল্যাক্স।'
সেই ভয়াল ডিপ্রেশন পিরিয়ড পেরিয়ে আসার পর সামান্য উত্তেজনাতেই শিথিল হয়ে আসে আমার মস্তিষ্ক। ক্লান্ত হয়ে আসে শরীর। চাইলেই রিল্যাক্স হতে পারি না৷ তাই বোধহয়, ক্লান্ত মস্তিষ্কে সেই ফিসফিস ধ্বনি ঝনঝন করে বাজতে লাগলো। হাতের কাছের চেয়ারটা দুর্বল হাতে উনার দিকে ঠেলে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
' আমি বাসায় যাবো। শুভ্র ভাই! শুভ্র ভাই কোথায়?'
লোকটা আগের মতোই নিষ্পলক চেয়ে রইলো। দূরে সরার পরিবর্তে আধো অন্ধকারে অনুভূতিহীন, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিটা ঝুঁকে এলো মুখের কাছে। অন্ধকারের জলছাপে তাকে দেখালো অদ্ভুত। বোধহয় কদাকার। মাঘের প্রচন্ড ঠান্ডাতেও শরীরে আমার ঘামের নহর ছুটলো। এয়ার কন্ডিশনার ঘর থেকে বেরুলে যেমন জ্বালাপোড়া করে দেহ। ঠিক তেমন জ্বালাপোড়া করে উঠলো শরীর। শ্রবণেন্দ্রিয়তেও কেমন অদ্ভুত শূন্যতা। অসীম শূন্যে যেমন প্রবলবেগে বাতাস বয় ঠিক তেমন শাঁ শাঁ ধ্বনিতে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে কান। আমি শুকনো কণ্ঠে বিড়বিড় করলাম,
' আমি বাসায় যাবো। আমি বাসায় যাবো। শুভ্র ভাই!’
কণ্ঠে আমার প্রচণ্ড তৃষ্ণা। শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলার মতো দমবন্ধতা। আমাকে বিড়বিড় করতে শুনে আরেকটু ঝুঁকে এলো সেই লোক। স্বরযন্ত্র থেকে ভেসে আসা মিহি, শীতল কণ্ঠে ফিসফিস করলো,
' শুভ্র চাই? কিন্তু শুভ্রকে তো মেরে ফেলেছে। হি ইজ ডেড!'
' কিহ!'
ভদ্রলোকের বুকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। ভদ্রলোক সরলেন না। বরং কানের কাছে হিসহিস করে বললেন,
' ইয়েস!'
আমি শূন্য মস্তিষ্কে তার দিকে চেয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই মরে গিয়েছে মানে কী? কী বলছে এসব? আমার চোখদুটো টলমল করে উঠলো ভয়ে। ততক্ষণে ওই হলুদ চোখ জোড়াও নেমে এসেছে নিচে। বসেছে আমার কাছাকাছি।লোকটা বিড়ালের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে মৃদুমন্দ হাসছে। কতোই না ঠান্ডা; কতোই না তাচ্ছিল্যের সেই হাসি! আমি কখনো মৃত্যু দেখিনি অথচ আমার মনে হলো এই বুঝি মৃত্যুর হাসি! তারপর... একদম আচমকা.. আমার মুখের সামনে ঝুঁকে এলো সেই মৃত্যু। সেই তীক্ষ্ণ, ধূসর দৃষ্টি। আমি বিড়বিড় করে বললাম,
' আমি শুভ্র ভাইয়ের কাছে যাবো। কোথায় উনি? শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই!' গলার সমস্ত জোর দিয়ে ডাকলাম আমি।
ভদ্রলোক হাসলেন। হিমশীতল কণ্ঠে বললেন,
' যাবে। নিশ্চয় যাবে। তার আগে....তার আগে আমার ঘুম ভাঙানোর অপরাধে দশবার কান ধরে উঠবস করে ফেলো তো, রোদু দ্য ছকিনার মা?'
কথা শেষে দারুণ দক্ষতায় চোখ টিপলো সেই লোক। ঠোঁটদুটোতে দেখা গেলো উপচে পড়া দুষ্ট হাসি। আমার প্রথমে বিশ্বাস হলো না। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। তারপর এক ধাক্কায় ভদ্রলোককে সরিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম,
' শুভ্র ভাই! আপনি! এতো খারাপ আপনি! সবসময় আপনার ফাজলামো! আপনি জানেন কত ভয় পেয়েছিলাম আমি?'
শুভ্র ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়ে বললেন,
' তুই এতো বোকা রোদু? সত্যি করে বল তো? তুই একাই এমন বোকা? নাকি তোদের বাংলা সাহিত্যের সকল মেয়েই এমন বোকা হয়?'
আমি অপলক চোখে চেয়ে রইলাম। ইচ্ছে হলো, উনার গলা টিপে দিই। এমন ভয়ংকর বেয়াদব মানুষও হয়? ভয়ে তখনও আমার শরীর কাঁপছে। চোখে টলটলে জল। ধমকে উঠে বললাম,
' আপনি যে কতটা অসুস্থ মানুষ তা জানেন? কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ আপনার সাথে থাকতে পারবে না। আপনার উচিত ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে নাট্যকলা নিয়ে পড়া। নাটক যা জানেন তাতে এতোদিনে শাকিব খানকে টপকে যেতেন।'
আমার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ শুভ্র ভাইয়ের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করলো বলে মনে হলো না৷ উনি নির্বিকার কণ্ঠে বললেন,
' শাকিব খানকে টপকাতে আমাদের এসব নাট্যকলা ফাট্যকলা পড়তে হয় না। আমরা কী তোদের মতো বাংলা সাহিত্যের ছাত্র নাকি যে আলাদা আলাদা করে পড়তে হবে? আমরা, ইঞ্জিনিয়ার নওজোয়ানরা এমনিতেই নায়ক। মাল্টিট্যালেন্টেড। আমাদের কাছে সব ফেইল।'
শুভ্র ভাইয়ের কথার প্রত্যুত্তরে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইলাম আমি। মেঝে থেকে উঠতে গিয়ে বুঝলাম, কোমরে সাংঘাতিক ব্যথা। কোমরটা ভেঙে গেলেও আশ্চর্য হবো না। আমি একই সাথে ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। এই লোকের মতো বেয়াদব, অসভ্য, প্রতিশোধ পরায়ণ পুরুষ আমি ইহজীবনে দেখিনি। এইযে আমি তার জন্য এতোখানি ব্যথা পেলাম? অথচ সে নিরুত্তাপ। বিন্দুমাত্র সন্তাপ নেই। আমি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,
' মাল্টিট্যালেন্ড না বলে বলুন মেন্টাল। মেন্টালি সিক। আপনার মতো মেন্টাল মানুষ আমি আজ অব্দি দেখিনি শুভ্র ভাই। সিম্পল একটা ঘুম ভাঙানোর জন্য আপনি আমার থেকে এভাবে প্রতিশোধ নিবেন? জানেন কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি? এখনও আমার হার্ট ঘূর্ণিঝড়ের বেগে ছুটছে। আজ যদি আমি স্টোক করে মরে যেতাম তখন কী হতো?'
শুভ্র ভাই নির্লিপ্ত মুখে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। শিষ বাজাতে বাজাতে ড্রায়ার থেকে বাল্ব বের করে মনের সুখে ঘরের বাল্ব লাগালেন। পর্দা সরিয়ে দরজা-জানালা খোলে দিয়ে চোখের পলকে ঘরে আলোর বন্যা বইয়ে দিলেন। বারান্দার বাহারি ফুলের সুবাস ছুঁয়ে, পর্দা দুলিয়ে, হুহু করে ঢুকে এলো মেঘ ভেজা ঠান্ডা বাতাস। তারপর শরীরের অর্ধেকটা বিছানার বাইরে রেখেই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। বললেন,
' কী আর হতো? জানাজা করে মাটিচাপা দিয়ে দিতাম। এই সুযোগে, দেশ ছাড়ার আগে একটা জানাজায় অংশগ্রহণের সওয়াব পেতাম। তুই যে পাপিষ্ঠ! আমার মতো ভালো মানুষের উছিলায় আল্লাহ তা'য়ালা তোকে ক্ষমা করে দিলে তোরও একটা লাভই হতো বল? মরার আগে একটা থেংকিউ দিয়ে মরিস তো।'
অভিশপ্ত পাতালপুরী চোখের পলকে স্বর্গ রূপ পেতেই উপলব্ধি করলাম কী ভীষণ আলোকশূন্যতা, বাতাসশূন্যতায় হাসফাস করছিলাম আমি। এবারে যেন মুক্তি পেলাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো শরীরে নেমে এলো ক্লান্তিরা। একটা মানুষ কতটা ফাজিল, অশিষ্ট আর বেয়াদব হলে এমন সাজিয়ে গুছিয়ে অন্যের মৃত্যুর কথা বলতে পারে তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হলো না। দুর্বল কণ্ঠে বললাম,
' ওদিকে সরুন। আপনার সাথে তর্ক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি আমি। আই নিড রেস্ট।'
শুভ্র ভাই বিনা প্রতিবাদে একটু সরে উনার পাশে জায়গা করে দিলেন। আমি ক্লান্ত দেহ বিছানায় ছেড়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কোমরটা কী প্রচন্ড ব্যথা করছে! যারা দূর থেকে শুভ্র ভাই ‘জোস জোস’ বলে হল্লা করে তাদের উনার এই রূপ দেখানো গেলে ভালো হতো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঘরের আলো তখনও নেভানো। জানালা ভেদ করে আসা আলো আর ঘরের জমাট অন্ধকারে ছাদের এক কোণায় অঙ্কিত হচ্ছে আলো-আঁধারের কারুকার্য। আমি নিরবিচ্ছিন্ন চোখে ছাদের দিকে চেয়ে রইলাম।
তর্ক-বিতর্ক-উত্তেজনার শেষে চারদিকে এখন নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা। পাশের কোনো ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে নজরুলের বিখ্যাত গান,
‘ ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি,ক্ষমিয়ো সে অপরাধ।’
মামানি গত হেমন্তে বারান্দায় শিউলি গাছ লাগিয়েছিলেন। এই শীতে বোধহয় ফুল এসেছে। শুভ্র ভাই চলে যাওয়ার পর অনেকদিন এই বাসায় আসা হয়নি আমার। তাই খোঁজ পাইনি, কী সুন্দর চাপা শেফালির গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘর। তার সাথে মিশেছে পাশে শুয়ে থাকা পুরুষটির গন্ধ। শুভ্র শুভ্র গন্ধ। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা, কে জানে? কিন্তু সেই জানুয়ারির ভোর থেকে শুভ্র ভাইয়ের উপস্থিতিতে তীব্র এক শুভ্র শুভ্র সুবাসে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে আমার চারপাশ। কেমন অদ্ভুত ঘোরের মতো সেই সুবাস। বুকের ভেতর টলটলে এক অনুভূতি আনে। সুখ-দুঃখ মিলেমিশে কেমন করুণ এক ব্যথা হয় বুক জুড়ে। হুট করে চোখে জল আসে। একটা অতৃপ্ত তৃষ্ণা ঘুরে বেড়ায় শরীরের শিরায় শিরায়। আমি ঘাড় ফিরিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এ যেন মানুষ নয়। কোনো দুর্লভ দেব মূর্তি। আমি একদৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। একটু আগের দেওয়া ব্যথা, নির্দয়তার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো তাকে। আমি মনে মনে বুঝলাম, প্রেম আর ভালোবাসার প্রভেদ। ভালোবাসা হলো শান্ত এক দিঘি আর প্রেম এক অশান্ত নদীর নাম। যে পাড় ভাঙার মতোই নিয়ম ভাঙতে চায়। নিষেধ ভাঙতে চায়। প্রথা ভাঙতে চায়। করে ফেলতে চায় দুঃসাহসিক সব ছেলেমানুষি। আমার দৃষ্টি ঘুরেফিরে গিয়ে আটকালো শুভ্র ভাইয়ের গলার বামদিকে। সেখানে মিষ্টি একটা তিল আছে। ফরসা গায়ে কী ভীষণ আদুরে তার রূপ! আরেকটা আদুরে আদর উঁকি দিচ্ছে তার কলারের নিচে। শুভ্র ভাই তার পোশাক নিয়ে খুব সচেতন। অযথা শরীর প্রদর্শন তার পছন্দ নয়। ছেলেবেলার কথা মনে নেই। কিন্তু বুদ্ধি হওয়ার পর তাকে আমি কখনোই উদাম দেহে দেখিনি। আজ বেখেয়ালে খুলে গিয়েছে উনার শার্টের প্রথম দুটো বোতাম। উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তে পাশে শুয়ে থাকা পুরুষটি কাল আমার থেকে হাজার মাইল দূরে থাকবে এই শোক আমার সহ্য হবে না। আমার বোধহয় দমবন্ধ হয়ে যাবে। আমি বোধহয় মরেই যাবো। আমার অবুঝের মতো কাঁদতে ইচ্ছে হলো। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো, কেন আপনার যাওয়াটা খুব দরকার? আমি এক হাতে ভর করে তার দিকে ঘন হয়ে এলাম। ফিসফিস করে শুধালাম,
' আপনি কী কাল সত্যি সত্যিই চলে যাবেন, শুভ্র ভাই?'
শুভ্র ভাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। উত্তর দিলেন না। আমিই শুধালাম,
' দেশ ছেড়ে চলে যেতে আপনার মন খারাপ হবে না?'
শুভ্র ভাই এবার চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে বললেন,
' তুই যাবি আমার সাথে?'
' আমি! আমি কেন যাবো? জাপানে তো আমার সাবজেক্টের কোনো পড়াশোনা নেই।’
‘ বাংলা সাহিত্যে তোকে পড়তেই হবে? ওখানে গিয়ে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে গ্রাজুয়েশন কর না? রুমমেট হিসেবে আমি খুবই ভালো। একটুও জ্বালাবো না।’
আমি হেসে ফেললাম। মুখ ঘুরিয়ে আবারও বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলাম। শুভ্র ভাই এবার একটু সরে এলেন। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে শুলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু কণ্ঠ বললেন,
‘ বেডমেট হিসেবে আমি আরও ভালো হবো দেখিস। যেহেতু আগের কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই তাই রেফারেন্স টানতে পারছি না। তবে তাবৎ দুনিয়ার সকলে জানে, শুভ্র যা করে সবই ভালো। শুভ্র খুবই ভালো ছেলে। এইযে পাশাপাশি শুয়ে আছিস, একটা এনার্জি পাওয়া যাচ্ছে না? এই এনার্জি দিয়েই তরতর করে পড়াশোনা হবে।’
আমার সমস্ত অস্তিত্ব ঝিমঝিম করে উঠলো। উনাকে দু'হাতে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
‘ দরকার নেই আমার এনার্জি। এতো তরতর করে পড়াশোনা আমার না হলেও চলবে। তাছাড়া, বাবা-মা, ভাইয়া, আপু কেউ আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না। ময়মনসিংহ নিজেও আমায় মিস করবে। এই শহরটা এতো সুন্দর!'
শুভ্র ভাইয়ের মেজাজ মুহূর্তেই বদলে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
' বাবা-মা, ভাইয়া, আপু কেউ আমায় ছাড়া থাকতে পারে না, নাটক! কেন রে? তুই কী অক্সিজেন সিলিন্ডার? তুই জাপানে গেলে তোর বাপ, ভাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাবে? এইজন্য তোর বাপকে আমার সহ্য হয় না। সারাদিন খালি নাটক।’
আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তাকালাম। মেজাজ খারাপ করে বললাম,
‘ ফালতু কথা বলবেন না। মেয়ে দূরে গেলে যেকোনো বাবা কষ্ট পাবে, স্বাভাবিক। এখানে নাটকের কী দেখলেন, আশ্চর্য!’
শুভ্র ভাই চেতে গিয়ে বললেন,
‘ কষ্ট পাবে! কী বুঝাতে চাস তুই? সব কষ্ট তোর আর তোর বাপের? আমরা সব মহা সুখী? সুখে সকাল বিকাল নাচানাচি করছি? আর কারো মেয়ে দেশের বাহিরে যায় না?তোর বাপ তো দেখি ভয়ংকর মিসোজিনিস্ট! মেয়েদের স্বাধীতায় আন্তর্জাতিক লেভেলের বাঁধা! এমন মানুষকে ছেড়ে রাখাই তো রিস্ক। সরকারের উচিত এই লোককে অতিশীঘ্রই জেলে পুরে দেওয়া। নয়তো মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার শ্রেণির ধ্বংস অনিবার্য।’
আবার বাবাকে নিয়ে অপমানজনক কথাবার্তা! আমি তীব্র বিদ্বেষে উঠে বসলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ আমার বাবা যদি মিসোজিনিস্ট হোনও তাতে আপনাদের ইঞ্জিনিয়ারদের কী ক্ষতি?’
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
‘ কী ক্ষতি! ক্ষতির কথা লিস্ট করার চিন্তা করতেই তো আমার কাগজ-কলম নিয়ে টেনশন হচ্ছে। এতো বড়ো লিস্ট কী আর লিখে শেষ করা যাবে? তাও যদি কেবল ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষতি হতো তবু একটা কথা ছিলো। এ তো রীতিমতো বৈশ্বিক ক্ষতি।’
‘ বৈশ্বিক ক্ষতি?’
‘ তা নয়তো কী? তোর বাপের ভাব-সাব দেখে তো মনে হচ্ছে না, তিনি আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের বংশ বিস্তার করতে দিতে ইচ্ছুক। তার হাংকিপাংকির যন্ত্রণায় আমাদের মরতে হবে চিরকুমার হয়ে। এইযে এতো এতো ট্যালেন্ট ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে না রাখতে পেয়েই মরে যাচ্ছি। এটা কী বৈশ্বিক ক্ষতি না? পৃথিবী মহৎ মেধার ফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল, শিট!’
আমি বিছানা থেকে উঠে গেলাম। এই লোকের সাথে যুক্তি তর্ক করা মানেই নিষ্ফল মাথাব্যথা। শক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আপনার সাথে ফালতু তর্ক করার সময় আমার নেই। উঠে তৈরি হোন। বাবা আপনাকে অতি অবশ্যই আজ দুপুরে আমাদের বাসায় খেতে বলেছেন।’
শুভ্র ভাই আমার কথাকে দু'আনা পাত্তা না দিয়ে উঠে গিয়ে কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়লেন। আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ আপনি আবার ঘুমোতে যাচ্ছেন নাকি, আশ্চর্য!’
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। আমি বাধ্য হয়ে নরম কণ্ঠে বললাম,
‘ শুভ্র ভাই প্লিজ চলুন। আজ রাফিয়ার বিয়ের কথা হচ্ছে। আপনি না গেলে বাবা মন খারাপ করবে।’
শুভ্র ভাই মাথা থেকে কম্বল সরিয়ে রাগ করে বললেন,
' রাফিয়ার বিয়ের কথা হচ্ছে তো আমি কী করবো? সেখানে আমার কী কাজ? আমার বিয়ের কথা তো আর হচ্ছে না। তোর বাপকে এই জন্য আমার সহ্য হয় না। অন্যের বিয়ের কথায় আমাকে এতো ডাকাডাকি কেন? আমি কী কাজী? আমার তো ধারণা, শুধু বাংলাদেশে কেন? আফ্রিকার জঙ্গলে কোনো বিয়ের দাওয়াত থাকলে সেখানেও আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে তোর বাপ। দেখাবে, দেখো বৎস, তুমি ছাড়া পৃথিবীর সকলের বিবাহ সম্পন্ন। সুসম্পন্ন। এই ব্যাটাকে তো আমি.... '
শুভ্র ভাই কথা শেষ করার আগেই আমি অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলাম। ধমক দিয়ে বললাম,
' খবরদার শুভ্র ভাই! বাবাকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবেন না।'
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
' আমি বাজে কথা বলছি? আমি? এই পৃথিবীর কেউ বলতে পারবে, কাউকে আমি কখনো বাজে কথা বলেছি? তোর জন্য আমার বিগত চারমাসের ঘুম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। হায়াৎ কমে গিয়েছে গড়ে দশ শতাংশ। এটা আমার বউ বাচ্চার জন্য কত বড়ো লস চিন্তা করতে পারছিস? তারপরও আমি ভালো ছেলে বলে চুপ করে আছি। আর সেই আমার সাথেই এমন ব্যবহার? ছি!’
আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম,
' আমি আপনাকে বলেছি না ঘুমাতে?’
‘ বলেছিসই তো!’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
‘কবে? কখন?’
শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
‘ কবে! তুই কবে বললেই আমাকে উত্তর দিতে হবে কেন? তুই কী প্রেসিডেন্ট? নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? নাকি আমার কোর্সের সুপারভাইজার? উত্তর না দিলে আমার নম্বর কাটা যাবে? একশোতে শূন্য? একশোতে শূন্য হলেও আমি উত্তর দিবো না। যে রমণী সামান্য বিড়াল দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় তার কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দিই না।'
কথা শেষ করে আবারও কম্বলে মাথা ঢেকে নিলেন শুভ্র ভাই। আমি অসহায়মুখে বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকের অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ। আমি অতিষ্ঠ কণ্ঠে বললাম,
‘ আচ্ছা, আমি মানছি আমার দোষ। আপনার মতো মহান ব্যক্তির ঘুম ধ্বংস করে ফেলার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। প্লিজ, এবার চলুন? আপনি না গেলে ছোট ফুপি আমার মাথা নষ্ট করে ফেলবে। দেখা যাবে, আমাকে আবার আসতে হচ্ছে।’
শুভ্র ভাই কম্বলের নিচ থেকেই জেদি কণ্ঠে বললেন,
' যাবো না।'
আমি করুণ কণ্ঠে বললাম,
' প্লিজ শুভ্র ভাই! আম্মু অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনার জন্য এতো শখ করে রান্নাবান্না করলো। আপনি না গেলে মন খারাপ হবে না?'
দয়াময় শুভ্র ভাইয়ের এবার দয়া হলো। নিজের ফুপির কথা শুনেই কম্বল সরিয়ে বিরক্ত চোখে চাইলেন। একটা মধ্যস্থতায় এসে বললেন,
‘ আচ্ছা, বেশ যাবো। কিন্তু তার আগে তুই যে আমার সাথে এতো বড়ো অন্যায় করলি তার একটা যোগ্য ক্ষতিপূরণ দরকার। আমি সহজ-সরল মানুষ, খাস দিলে সবাইকে মাফ করে দিই। কিন্তু অন্যায় করা এবং সহ্য করা উভয়ই অপরাধ বলে আমাকে একটা ক্ষতিপূরণে আসতেই হচ্ছে। আমার এমন পবিত্র চরিত্রকে তো আর তোর জন্য অপরাধী করে ফেলতে পারি না?’
আমি হতাশ চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বললেন,
‘ আজ রাতে তুই এই বাসায় থাকবি। বাই হুক অর বাই ক্রুক! চোখের বদলে চোখ, রক্তের বদলে রক্ত, ঘুমের বদলে ঘুম।’
ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে চোখ টিপলেন শুভ্র ভাই। ইচ্ছে হলো, পাশের চেয়ারটা তুলে উনার মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারি। যারা উনার ভোলাভালা মুখ দেখে গলে যান তারা নিশ্চয় জানে না এই লোক কত বড়ো শয়তান! উনি খুব ভালো করে জানেন, কীভাবে আমাকে বিপদে ফেলা যাবে। কাল উনি চলে যাবেন আজ রাতে আমার এই বাসায় থাকা কেমন দেখায়? বাবা বা আম্মু কী ভাববেন? ছিইইইই! আমি ভাবতেই পারছি না। শুভ্র ভাই আমাকে অধিক শোকে পাথর করে দিয়ে মনের আনন্দে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। তার মনে সুখের অভাব নেই। আমি এক বুক হতাশা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মাথাটা বিছানায় ছেড়ে দিতেই মাথাটা ঠুকে গেলো শুভ্র ভাইয়ের ফোনের সাথে। এই লোক বদ, এই লোকের ফোনও বদ। আমি বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে নিলাম। শুভ্র ভাইয়ের ফোনের পাসওয়ার্ড আমি জানি। সুতরাং দুঃখ কমাতে অম্লানবদনে কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করা যেতে পারে। আমি ফোন নিয়েই গ্যালারিতে ঢুকলাম। গ্যালারি একেবারে ক্রিকেট মাঠের মতো ফাঁকা। লাস্ট কয়েক মাসে একটা প্রাণীর ছবিও তোলা হয়নি। কাগজ-পত্রের ছবিতে ভর্তি। হোয়াটস্অ্যাপেও কোনো আগ্রহ জাগানিয়া ব্যাপার নেই। একটা মেয়ের একাউন্ট থেকে কিছু মাখো মাখো ম্যাসেজ পাওয়া গেলো কেবল। মেয়েটার নামটা একটু অদ্ভুত। ইংরেজিতে কথাবার্তা বলছে। শুভ্র ভাই তার প্রথম কয়েকটা ম্যাসেজের উত্তর দিয়েছেন। সবই কাজের কথা। শেষ ম্যাসেজে জানিয়েছেন, তিনি বিবাহিত। তারপর আর কোনো ম্যাসেজের উত্তর দেননি। উল্টো ব্লক সাইন এঁটে দিয়েছেন। আমার মুখ ভার হলো। উঁচু কণ্ঠে বললাম,
' আপনি শুধু শুধু ফোন ব্যবহার করেন শুভ্র ভাই। কিচ্ছু নেই ফোনে। ছবিও তো তুলেন না। ফেসবুকও ব্যবহার করেন না। প্রেমও করেন না। তাহলে কী লাভ?'
শুভ্র ভাই ওয়াশরুম থেকেই বললেন,
' সবাই কী তোর মতো বেকুব নাকি যে শুধু ছবি তোলা আর ফেসবুক ব্যবহার করার জন্যই ফোন চালাবে?'
অপমান! আচ্ছা যাক, অপমান গায়ে মাখলাম না। ফোন ফেলে উঠে গেলাম বইয়ের তাকের সামনে। শুভ্র ভাইয়ের বইয়ের বিশাল কালেকশন। অধিকাংশ বই'ই অপরিচিত। বইয়ের নাম পড়তে সমস্যা হচ্ছে দেখে ফিরে এলাম পড়ার টেবিলে। পড়ার টেবিলে আর্ট পেপার, খাতা, কলম, পেন্সিল, মার্কারের ছড়াছড়ি। একপাশে পড়ে আছে ল্যাপটপ। আমি উদাস মনে আর্ট পেপারগুলো উল্টে পাল্টে দেখলাম। সব পেপারেই যন্ত্রপাতির চিত্র। একটা কাগজে গিয়ে চোখ আটকালো। এই কাগজের আঁকা অসম্পূর্ণ। আঁকার মাঝেই ইংরেজি বাংলায় ছড়ানো ছিটানো লেখা। বোঝা যাচ্ছে, সবই আঁকতে বসে চিত্রশিল্পীর একান্তই মনের খেয়াল। আরও একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই আঁকার কাগজের উল্টো পাশে পেলাম বিশাল এক ফিরিস্তি। কাঠ পেন্সিলে লেখা বলে আগ্রহ দেখালাম না। কিন্তু আঁতিপাঁতি খুঁজে আগ্রহ জাগানিয়া আর কিছু খুঁজে না পেয়ে সেই ফিরিস্তিতেই ফিরে যেতে হলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে গাঢ় চোখে চাইলাম,
‘রোদু,
আমি চলে যাচ্ছি বলে কী তোর মন খারাপ হচ্ছে? হলে, হোক। আমি চাই তোর মন খারাপ হোক। এই পৃথিবী জানুক, তোর শুধু আমার জন্যই মন খারাপ হয়; আর কারো জন্য না। তুই জানিস? আমারও খুব মন খারাপ হয়। এতোটা মন খারাপ আগে কখনো অনুভব করিনি। মাঝরাত্তিরে হুট করে মনে হয়, সব ছেড়েছুড়ে দেশের পথে পা বাড়াই। মরা, বিষণ্ণ বিকেলে চরপাড়ার ওই পুরোনো দু'তলা বাড়িটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াই। যেভাবে দাঁড়াতাম চট্টগ্রামের বিদ্রোহী পাহাড়গুলোকে পিছু ফেলে? আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কী জানিস? আমার যখন অনেক টাকা হবে, আমি একটা উড়োজাহাজ কিনবো। ব্যক্তিগত এয়ারপোর্ট থাকবে। বেতনভুক্ত পাইলট থাকবে। তাহলে আর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ওমন দমবন্ধ হয়ে আসবে না। যখন ইচ্ছে, যত রাত্তিরে ইচ্ছে চলে আসতে পারবো মফস্বল ময়মনসিংহে। পুরো পৃথিবী, ঘোলাটে রাত, মেঘলা আকাশ সবাই জানবে সেই শেরপুর নিবাসী রমণীকে আমি কত ভালোবাসি। সবার সবার সবার থেকে বেশি ভালোবাসি। এতো ভালোবাসা উচিত হচ্ছে না, বুঝি। তবু ভালোবাসি। বাসবো। প্রয়োজনে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা কিনে দলিল করে দেবো তার নামে। সব ভালোবাসা হবে শুভ্রর রোদপাখির।’
আমি লেখাটা কয়েকবার পড়লাম। তারপর আগের জায়গায় রেখে দিলাম। টেবিলের এক কোণায় পেলাম, কাবিন নামা। শুভ্র ভাই সেখানে সুন্দর করে গুটি গুটি অক্ষরে স্বাক্ষর করেছেন। অথচ আমার হাতের লেখা হয়েছে দুনিয়ার বিশ্রী। আমার ইচ্ছে হলো, লেখাটা কেটে আবার নতুন করে সাক্ষর করি। শুভ্র ভাইকে বলতেই উনি খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
‘ খবরদার রোদ, ওটা আমার। ছুঁবি না। তোর নিজের কপিতে গিয়ে কাটাছেঁড়া কর গিয়ে।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
‘ আমার কাছে তো কোনো কপি নেই।’
‘ যার বাপ ইয়াহিয়া খানের মতো ধান্ধাবাজ হয় তার কাছে এসব থাকবে না, স্বাভাবিক। তুই আমার টেবিল থেকে দূরে থাক। ওখানে আমার অনেক দরকারি কাগজ আছে।’
আমি টেবিলে আর ঘাঁটাঘাঁটি করলাম না। টেবিল ব্যতিরেকে সারা ঘরই ঘুরঘুর করে ঘুরা শেষ। আলমারিতে উনার কয়টা শার্ট আছে, সেটা পর্যন্ত গুণে ফেলেছি আমি। এখন শুধু ময়লার ঝুড়ি বাকি পড়ে আছে। আমি ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। শুভ্র ভাই এতোক্ষণ ওয়াশরুমে কী করছে কে জানে! ফোনও সাথে আনিনি। কিছুক্ষণ অবসর কাটিয়ে কাগজে উপচে পড়া ময়লার ঝুড়ির কাছে চেয়ার টেনে বসলাম। ময়লা বলতে এখানে কেবল কাগজই দেখা যাচ্ছে। আমি এঁকে এঁকে দুমড়ানো মোচড়ানো কাগজগুলো যত্ন করে পরীক্ষা করতে লাগলাম। যেন কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আমি। এক্ষুনি ভয়ংকর কোনো প্রমাণ পেয়ে যাবো। তেমন কোনো প্রমাণ অবশ্য পাওয়া গেলো না। সবই বিরক্তিকর যন্ত্রপাতির আঁকাবুকিতে ভর্তি। কাঁটাছেড়া নষ্ট কাগজ। অলস হাতে সব নাড়াচাড়া করতে করতে একটা কাগজে লেখা পেলাম। সম্বোধনহীন টুকরো লেখা। বুঝা যাচ্ছে ভেবে লেখা হয়নি। ইংরেজি লেখার মাঝপথে হঠাৎ বাংলা লেখা শুরু হয়েছে,
‘ রোদু! রোদু! রোদু! তুই জানিস? এই এতো দূরের দেশে এসে কেমন পাগল পাগল হয়ে গিয়েছি আমি। এতো ব্যস্ততা, এতো চাপের মাঝেও হুট করে কেমন নিঃস্ব লাগে মন৷ দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি জোর করে স্বাভাবিক হই। ব্যস্ত থাকি। কিন্তু বুকের ভেতরে চাপা পড়া ওই দমবন্ধ বুদবুদ করে উঠে প্রচন্ড জেদে। ছোটবেলায় নাগরদোলায় উঠলে যেমন হাসফাস করে উঠতো বুক; ঠিক সেইরকম বুক বেয়ে নামে সেই ব্যথা। হঠাৎ করেই মনে হয়, আমার তুই নেই। আমার পৃথিবী নেই। আমার কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না। আজকাল আমার মনে হয়, আমি বোধহয় বেশিদিন বাঁচবো না। হুট করেই একদিন মরে যেতে হবে আমাকে। কথাটা ভাবলেই আমার কষ্ট হয়। আমি ভাবি, আমার কিছু হলে কী হবে তোর? আব্বু-আম্মুরই বা আমি ছাড়া কে আছে? সবথেকে বেশি কষ্ট হয়, আমার নিজের জন্য। আমি সবসময়ই খুব স্বার্থপর ধরনের মানুষ। নিজের বাইরে অন্য কারো দুঃখ আমায় তেমন একটা কষ্ট দিতে পারে না। আজকাল রাস্তাঘাটে কোনো পুরুষের কোলে শিশু দেখলেই কেঁপে উঠে বুক। চোখে ভাসে নিষ্পাপ একটা মুখ; ভীষণ মায়া নিয়ে ডাকে, 'বাবা'। আমার মনে হয়, আমি খুব ভালো বাবা হবো। এইযে, আমার এতো স্বপ্ন! এতো এতো স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে মরে যেতে হলে ভীষণ কষ্ট হবে আমার। তুই আমায় খুব শক্ত করে ধরে রাখিস, প্লিজ? আমি অনেকদিন বাঁচতে চাই। একা না, তোর সাথে বাঁচতে চাই। আরও অনেক অনেক ভালোবাসতে চাই। যতোটা ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তারও মায়া হবে। ভাববেন, একটা সাধারণ পুরুষের বুকে কী করে এতো ভালোবাসা ঢেলে দিলেন তিনি? কী করে? এসব কী শুভ্রর সাথে যায়? ছিঃ!’
আমি লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ মূর্তির মতো বসে রইলাম। বুকের ভেতর কোথাও একটা টলমলে ব্যথা কী হলো না? কাগজটা ভাঁজ করে নিজের কাছে রেখে দিয়ে বাকি কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। একইভাবে কাঁটাছেড়া করে আরও চারটা টুকরো লেখা পাওয়া গেলো। কোনোটা মেশিনের চিত্র আঁকতে গিয়ে লিখে ফেলা হয়েছে। কোনোটা রিপোর্টের লেখার মাঝপথে। আমি সেই পৃষ্ঠাগুলো আলাদা করলাম। তারপর সেগুলো নিয়ে চলে গেলাম বারান্দায়। বারান্দার মেঝেতে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে খুব ধীরে ধীরে পরপর পড়লাম লেখাগুলো। কারো এক সমুদ্র ভালোবাসা হঠাৎ সামনে চলে এলে যেমন এলোমেলো লাগে। তেমন এলোমেলো হয়ে গেলো মন। প্রচন্ড শীতের উঠোনে নরম রোদ নামার মতোন আরামও পেলাম। কিছুটা পেলাম নামহীন হাহাকার,
‘ তোর হাতের ওই কাটা দাগটা দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি। হুট করেই মহাকাশ সমান মন খারাপ জাপটে ধরেছে আমায়। এই মন খারাপ আমি কাটাতে পারছি না।কোনো যুক্তি-তর্ক ভালো লাগছে না। সকল প্ল্যান প্রোগ্রামে জল ঢেলে কেবল তোর পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। শুধাতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন এতো কষ্ট তোর? কেন এই পৃথিবী তোকে এতো কষ্ট দেবে? তুই নিশ্চয় ভাবছিস, কেন আমি ছিলাম না তোর পাশে? কেন আগলে রাখলাম না ছায়ার মতো? উত্তরটা খুব স্বার্থপর। আমি স্বার্থপরের মতো আগে নিজের কথা ভেবেছি৷ শুধু নিজের কথা। তোকে কী করে বুঝাই, ভালোবাসায় কত কষ্ট! তোকে কী করে বুঝাই, দেশের ভেতরে বসে থেকে দেশটাকে যত সহনীয় মনে হয়; দেশের বাইরে বসে দেশটাকে দেখায় ততটাই অসহনীয়। জ্বলন্ত নরকের মতো লকলক করছে তার জিহ্বা। সেই নরকে আমি তোকে রেখে এসেছি; দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এতো এতো অঘটনের খবরাখবর দেখে আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। এই স্বার্থ চিন্তায় আমি পারিনি তোর চট্টগ্রামে পড়ার সংগ্রামে সহযোদ্ধা হতে। আমি যে দেশে নেই। তোর কাছে নেই। সৃষ্টিকর্তা জানেন, আমার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দেশ থেকে আসা একটা দুঃসংবাদই যথেষ্ট।’
‘রোদু? তুই কী আমার উপর খুব রাগ করেছিস? তোর চোখের ওই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমায় খুব পীড়া দেয়। থেকে থেকে তুই আনমনা হয়ে যাস; আমি কিছু বলতে পারি না। তোকে আরও একবার নিজেকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলতে সংকোচ হয়। ভয় হয়। হঠাৎ করেই এতো বড়ো হয়ে গেলি তুই! তোর চোখের চাপা আগুনে আমার মাঝে মাঝেই থমকে যেতে হয়। ফুপির থেকে জানলাম, দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসার প্রস্তাব একেবারে নাকোজ করে দিয়েছিস তুই। প্রাইভেটে পড়বি না। এই শহর ছেড়ে কোথাও যাবি না। দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু কেন যাবি না? এ কেমন রমণীয় অভিমান তোর? ফুপা, ফুপি কেউ তোকে এই বিষয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না দেখে আমি হাসি৷ কী তেজ আমার রোদপাখির। ইশ! এই না হলে শুভ্রর বউ!
তোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুপি আমার কাছে খুব মন খারাপ করলেন। বুঝাতে বললেন। আমার তোকে কিছুই বুঝাতে ইচ্ছে করছে না। তোকে তোর মতো ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফুপিকে আমি বলেছি, 'লেট হার ফ্রী।' আমার বন্যপাখি? আই অ্যাম লেটিং ইউ ফ্রী। উড়ে যাও যতদূর মন চায়। উড়ো, ভেঙে পড়ো, আবার উড়ো। নিজের মতো করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাও। কাল কী হবে সেটা কাল দেখা যাবে। আজকের দিনটা তুমি প্রাণ ভরে বাঁচো।’
‘শুনেছি, ইকোনমিক্স ছেড়ে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হয়েছিস তুই। কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি, সবই আমাকে বিপদে ফেলার ধান্দা তোর। ফাজিল মেয়ে! এতো অভিমান আমার উপর? এইযে আমার সকল প্ল্যানে বিনা নোটিশে পানি ঢেলে দিলি? তারপরও ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। তোর খুশির জন্য এমন হাজারটা প্ল্যানে পানি ঢেলে দিতে রাজি আছি আমি। কিন্তু মনে রাখবি, জীবনের প্রতি এতো অভিমান করতে নেই। এই জীবনটা একান্তই তোর। আমি, আমরা তো কিছু চরিত্রমাত্র। জীবনের কোনো পৃষ্ঠায় এই চরিত্রগুলো হারিয়ে গেলেও ; একদম একলা হয়ে গেলেও হাঁটতে হবে তোকে। চালিয়ে নিতে হবে উপন্যাস। তাই আবেগ দিয়ে নয়। জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠা পেরিয়ে আসতে হবে ভেবেচিন্তে, মাথা খাটিয়ে। যেন কোনো পৃষ্ঠায় কিছু লেখা ছুটে না যায়। অনেক পথ পেরিয়ে এসে যেন লিখতে না হয় অনুশোচনার গল্প। জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হার, জিত, হতাশা সবকিছু থাকলেও অনুশোচনা থাকতে নেই। এই কথাগুলো তোকে বলা দরকার। কিন্তু সুযোগটা হচ্ছে কই!’
‘তোমাকে বলা হয়নি,
আজকাল তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। একদম অন্যরকম। গম্ভীর, শান্ত। রেগে রেগে তাকাও। শাড়ি পরো। হুট করে বড়ো হয়ে যাও। আবার কখনো হয়ে যাও স্নিগ্ধ নদীর মতো। দেখলেই মনে হয়, তোমার কোলে মাথা রাখলেই ঘুমে জুড়িয়ে আসবে চোখ। চঞ্চলা তুমি মুগ্ধ করতে; শান্ত তুমি শান্তি দাও। যতক্ষণ পাশে থাকো আমার কেবল হা করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। এই কয়েকদিন কতো বার চেয়ে থেকেছি! অথচ তুমি তাকাও না। কেন তাকাও না? আমাকে কী যথেষ্ট সুন্দর লাগছে না? সুন্দর না লাগলেও তাকাবে। তুমি তাকালেই রবিঠাকুরের মতো বলতে ইচ্ছে হয়, বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুদর্শন বলে অভিমান হয়। এই কয়েক বছরে তোমায় যতটা না ভালোবেসেছি তার থেকেও হাজারগুণ বেশি ভালোবেসেছি এই কয়েকদিনে। আগে শুধু ভালোবাসতাম। এখন বোধহয় প্রেমে পড়ছি। বাংলা কাব্যের মতো নরম সেই প্রেম। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মন। ফিসফিসিয়ে বলে-
তোমাকে ভালোবেসে যেতে পারি আমি ক্লান্তিহীন। কসম খোদার, তোমাকে না-ভালোবাসার মতো ক্লান্তি আমার জীবনে আর আসেনি।'
লেখাগুলো পড়ে হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে নিশ্চুপ বসে রইলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ের বারান্দায় হরেক রকম ফুল ফুটেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। দূরে কোথাও ডাকছে বিষণ্ণ কোকিল। কোকিল তো বসন্তের পাখি। এই শীতের শহরে কেন তার এতো উড়াউড়ি? সে কী আমায় মন খারাপের বার্তা দিতে এসেছে? তবে, ওকে বলে দাও, এই জেদি পুরুষের এই রকম ভালোবাসা ভুলে আমি কী করে তার মতো বিষণ্ণ হয়ে থাকি?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৬৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


নৌশিন আহমেদ রোদেলা’র গল্প ও উপন্যাস:

লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

4 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন