উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
১০ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ১১)
যেদিন দুপুরবেলা অবেলায় বাড়ি ফিরে সুরঞ্জনকে ধরে ফেলে, বাপের বাড়ির ভাইকে, সফিকুলকে সেদিনই তার সামনেই তিন তালাক বলে দিল মহব্বত। সুরঞ্জন জুলেখার বিছানায় বসে ছিল, সেই বসা বাপের বাড়ির ভাইয়ের মতো বসা নয়। জানালার পর্দাগুলো টেনে দেওয়া। অন্ধকার করে দেওয়া ঘর। সেখানে সুরঞ্জনের শার্টখানা খোলা, খালি গা। মহব্বত যখন ঘরে ঢুকেছে, জুলেখা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, পেছনে মাত্র এসে দাঁড়িয়েছে, হাতের ট্রেতে দুটো মাংসের কাবাব আর দু কাপ চা। ট্রেটা টেবিলে রেখে জুলেখা যেই না দাঁড়ালো, শুনলো তালাক উচ্চারণ। তালাক তালাক। তালাক হয়ে গেল। তালাক হয়ে যাওয়া মানে জুলেখাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। কিন্তু ছেলেকে নিতে গিয়ে বাধা পেলো মহব্বতের। ছেলে নাকি দেবে না।
সোহাগকে ফেলে জুলেখাই বা কোথায় কোন চুলোয় যাবে? বেনেপুকুর রোডে নিজের মামার বাড়িতে গিয়ে উঠলো। কাছেই মহব্বতের বাড়ি। ও বাড়িতে সোহাগ। মহব্বতের নতুন বউকে মা বলে ডাকতে হচ্ছে তার। জুলেখা বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া মেয়ে। কেঁদে বুক ভাসিয়ে আত্মহত্যা করে সে বাঁচতে চায় না। এত দিনে সে বুঝে গেছে বেঁচে থাকতে হলে মেয়েদের, বিশেষ করে মুসলমান মেয়েদের, জীবন বেরিয়ে যায় জীবন বাঁচাতে।
মহব্বত তাকে তালাক দেবার পর জুলেখা একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি। শুধু সুরঞ্জনের দিকে পাথর চোখে তাকিয়েছিল। ভাবছিল, এবার কী করবে তুমি? ছেড়ে পালাবে তো! দায়িত্ব নেবার ভয় বুকে বাসা বাঁধছে তো! জুলেখা মনে মনে জানতো মহব্বত তাকে একদিন না একদিন তালাক দেবে। এত দিন সোহাগের মুখের দিকে তাকিয়ে দিচ্ছিল না। না হয় ধর্ষিতা হওয়ার দিনই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিত।
মহব্বত কোনও থানা পুলিশ করেনি। যারা তার বউকে ধর্ষণ করেছে, তাদের খোঁজ যদি সে নেওয়ার চেষ্টা করতো। খোঁজ পেতো। লোক তো মহব্বতের কম নেই। কিছুই করেনি সে। কারণ দুএকজন বন্ধু বলেছে করে নাকি কোনও লাভ নেই, বরং, জীবনটা যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
আমজাদের সঙ্গে ব্যবসাসূত্রে মহব্বতের দীর্ঘদিনের শত্রুতা। আমজাদ এবং তার লোকেরা যে জুলেখাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তা মহব্বতের কানে গিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে ও বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। আমজাদ যদি জুলেখার সর্বনাশ করে মহব্বতের ওপর রাগ কমিয়ে ফেলে, তাহলে মহব্বতের জন্যও বরং এ শুভ সংবাদ।
মহব্বতের রাগ বরং এ ক্ষেত্রে পড়েছে জুলেখার ওপর। জুলেখার দোষ নেই সে জানে, তার পরও মহব্বতের মনে হয়, জুলেখারই দোষ। নিশ্চয়ই সে সুখ পেয়েছে ওসবে। নিশ্চয়ই তার আরাম হয়েছে। মহব্বতের মরলেও বিশ্বাস হবে না জুলেখা বাধা দিয়েছে ওই লোকদের। বরং সময় সুযোগ পেলে ঐ লোকদের কাছেই জুলেখা ছুটে ছুটে যাবে। জুলেখা সুখের সন্ধান পেয়ে গেছে। মহব্বতের ছোট গণ্ডি থেকে সে যে কোনও কারণেই হোক বেরিয়ে গেছে। সুখের সাগরে সে সাঁতরে এসেছে।
মহব্বতের আশঙ্কা হয় এই কিডন্যাপের পেছনে জুলেখারও হাত ছিলো। জুলেখা বলতে চেষ্টা করছে মুসলমান কিছু ছেলে এই কাণ্ড করেছে। কিন্তু মহব্বতের কানে হিন্দু ছেলেদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে। যদিও অভিযোগটি ভিত্তিহীন, কিন্তু কিছু লোকের এসব অভিযোগ করে, দল পাকিয়ে শয়তানি করে বড্ড আনন্দ হয়। মহব্বত হিন্দু-মুসলমানে যায় না, এক দুপুরের ছোট্ট অপহরণ বা ধর্ষণের ধোঁয়াও তাকে একটুকু স্পর্শ করে না। ওই নষ্ট মেয়েমানুষটাকে চোখের সামনে থেকে দূর করতে পারলেই মহব্বত শান্তি পাবে।
বিয়ে করার পর থেকেই মহব্বতের সহ্য হতো না জুলেখার নড়নচড়ন। মনে মনে তাকে তালাক দিত সারা দিন। বরং জুলেখার দুর্ঘটনা তাকে বিরাট একটা সুযোগ দিয়ে দিল তালাক দেওয়ার। এমন সুযোগ জীবনে সে আর পাবে না। ভালো ভালোয় শুভ কাজটি সেরে ফেলতে পারলে মহব্বতের প্রাণ জুড়োবে।
জুলেখা জানতো যে সে অসহায় অবস্থায় পড়লে সুরঞ্জন কেটে পড়বে। পুরুষরা তো এটাই বেশ ভালো জানে, বিপদ বাঁধানো, আর বিপদ দেখলে কেটে পড়া। সুরঞ্জনের অমন ব্যাকুলতা, সব ফেলে তার কাছে ছুটে ছুটে আসা, জুলেখাকে আনন্দ দিয়েছে অনেক। এই অশান্তির সংসারে সুরঞ্জনই তার সবচেয়ে বড় আনন্দ। জুলেখার এই আশঙ্কটি সত্যি হয়নি। সুরঞ্জন পালায়নি। যেদিন মহব্বত তালাক বলে দিল, শুধু তালাকই বলে দিল, সুরঞ্জনের ওপর হাত তোলেনি, জুলেখাকেও স্পর্শ করেনি, জুলেখা কাঁদেনি। শুধু পাথরের মতো বসে ছিল। সুরঞ্জনকে সে বলেছে বেরিয়ে যেতে। এক পাও সুরঞ্জন নড়েনি। সোহাগকে নিয়ে সে সেদিনই বেরিয়ে যাবে কিনা, ভাবছিল। ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে তাকে শূন্যের মধ্যে পাক খাওয়াচ্ছিল সারাক্ষণ।
আশেপাশের বাড়ির লোকেরা কেউ জানলো না কী ঘটে গেছে এ বাড়িতে। বিয়ে হয়ে বাড়িটিতে আসার পর থেকে পাড়া-পড়শি থেকে দূরেই থেকেছে জুলেখা। কারও বাড়িতে তেমন যাওয়া আসা নেই। বাড়িটিতে একাই ছিল। মহব্বতের আত্মীয়স্বজন সব থাকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে। মাঝে মাঝে জঙ্গিপুর থেকে লোক আসে। মহব্বত মাসান্তে যায়। বউ-বাচ্চা কখনও নেয়, কখনও একাই।
তালাক দিয়ে জুলেখাকে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে আদেশ করেছে মহব্বত। বলে দিয়েছে সোহাগকে সে পাবে না। সোহাগের খোঁজ যেন সে না করে। এক কাপড়েই জুলেখা বেরিয়েছিল, সুরঞ্জন ছিল পাশে। তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল ছ বছরের সংসার ছেড়ে।
জুলেখা সিউড়ি কলেজ থেকে পাস করা মেয়ে। অবশ্য তার এই পাসের মর্যাদা কেউই দেয়নি। নিজের চেষ্টাতেই সে পড়েছে। পাস করেছে। রবিউল ইসলাম নামের একজন শিক্ষক প্রেরণা দিতেন ভালো পড়াশোনা করে বড় হওয়ার জন্য। দেখা হলেই বলতেন, - মেয়েদের জীবনে পড়াশোনার দাম সবচেয়ে বেশি। তুমি যদি আজ শিক্ষিত হও, কোনও না কোনও কাজে তোমার শিক্ষাটাকে কাজে লাগাতে পারবে। জ্ঞান কখনও ওয়েস্ট হয় না। বলতেন, তোমার মাথাটা খুব ভালো। পড়াশোনা করলে তুমি অনেক বড় হবে।
বড় হওয়া জুলেখার হয়নি। মহব্বতের টাকা-পয়সা ছিল বলে সংসারে বাঁদিগিরি করতে হয়নি। কিন্তু ওই সংসারকে নিজের বলে কোনও দিন মনে হয়নি তার। মহব্বত তার বিএ পাস নিয়ে কোনও দিন কিছু জানতে চায়নি। জুলেখার অনেক গুণ আছে, কিন্তু মেয়ে হিসেবে তার সবচেয়ে বদগুণ ছিল ওই বিএ পাসটিই।
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তার পাস করার গুণকে কখনও ভালো চোখে দেখেনি। মহব্বত নিজে আইএ পর্যন্ত পড়েছে। বউ-এর বিএ তার কাছে কাঁটার মতো। নিজের টাকা রোজগারের নেশা, জঙ্গিপুরের বাপ দাদার কাঠের ব্যবসা ছেড়ে এক বন্ধুর পরামর্শে কলকাতায় হুট করে বাসনপত্রের ব্যবসায় নামলো। কাঠের ব্যবসার ভার বড় ভাইয়ের কাঁধে দিয়েছে। মহব্বতের জীবনে এক টাকা করা ছাড়া তেমন কোনও সাধ-স্বপ্ন নেই। বিয়ে করে ঘরে বউ আনা মানে ঘরের কাজকম্ম করার দাসী আনা। ছেলেপুলে হলে বুড়ো বয়সে তারাই দেখবে। মহব্বত নামাজ-রোজা, ধৰ্ম কর্মে মন কোনও দিন দেয়নি। মহব্বতকে রমজান মাসে সমাজের চাপে পড়ে উপোস থাকতে হয়, আর দুই ঈদে নিজের জন্য না হলেও অন্যের জন্য ঈদের নামাজটা পড়তে হয়। মদ-সিগারেট খায় না। নেশার মধ্যে এক পানের নেশা।
জুলেখা পাস করার পর সম্বন্ধ এলো, কলকাতায় ব্যবসা আছে, জঙ্গিপুরে বাড়ি আছে, স্বভাব-চরিত্র ভালো। দেরি না করে জুলেখাকে তার বাবা এবং আত্মীয়স্বজনরা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মা মরা মেয়ে বলে বাবা একটু আদর-যত্ন করতেন, কিন্তু নিজে পঙ্গু বলে মেয়েকে পার করার দুশ্চিন্তায় তিনি মগ্ন থাকতেন। পার হয়ে মেয়ে বাবার দুশ্চিন্তাকে নিজের ঘাড়ে নিয়ে বাবাকে অন্তত এ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তার কি এ শহরে চাকরি একটা জুটবে না?
এখনও চাকরির একটা চেষ্টা করছে সে। চাকরির চেষ্টা ওদিকে সুরঞ্জনও করছে। তবে চাকরি পাক বা না পাক, বেলঘরিয়ার নন্দননগর ছেড়ে এই পার্ক সার্কাসে তো এসেছে। চাকরি পাওয়ার চেয়ে কিছু কম প্রাপ্তি এটা নয়। সুরঞ্জন বলেছে আপাতত দুজনই টিউশনি দিয়ে চালাক, পরে কিছু একটা নিশ্চয়ই জুটবে। সুরঞ্জনের মতো উদাসীন থাকতে চায় না জুলেখা। কিছু একটা, ছোট হলেও করতে চায়। টিউশনি তার পোষাবে না। কদিন ঘোরাঘুরি করে আইনক্সের শপার্স স্টপে সেলস গার্লের চাকরিটা পেল। কেউ বুঝলোই না জুলেখা এক বাচ্চার মা। ভাবলো বিয়েই বুঝি হয়নি। সুরঞ্জন পছন্দ করে না চাকরিটা। বলে- তোমাদের খাটিয়ে মারে। অথচ পয়সা দেয় না। এত কম পয়সায় কারও চলে। জুলেখা যা উপার্জন করে, বেশিরভাগই ঢেলে দেয় মামার সংসারে। দিতে হয়। হাতে সামান্য যা থাকে, তা দিয়ে বাচ্চার জন্য কিছু কেনাকাটা। আর সুরঞ্জনের কাছে যখন সে আসে, খালি হাতে। নিঃস্ব। সুরঞ্জন বলে, - এই ভালো। তোমারও কিছু নেই। আমারও নেই। আমাদের মধ্যে কেউ বড়, কেউ ছোট নয়। আমাদের মধ্যে তাই কোনও বৈষম্য নেই।
জুলেখার মামার বাড়িতে সুরঞ্জন পারতপক্ষে যায় না, যেতে চায় না। সে যখন এসে গেছে কাছে। জুলেখার জন্য আসা। জুলেখাই যেন যখন খুশি চলে আসে জাননগরের বাড়িতে। সুরঞ্জন না থাকলেও কিরণময়ী আছেন।
মামার বাড়ির গল্প জুলেখা খুব একটা করে না। খুব যে ওখানে সুখে আছে সে তা সুরঞ্জন মনে করে না। তার সুখ একটাই, সোহাগ তার বাবাকে ফাঁকি দিয়ে জুলেখার সঙ্গে দেখা করতে আসে। জুলেখা সোহাগের জন্য চকলেট, বিস্কুট, জুতো, জামা, খেলনা কিনে রাখে। এলেই দেয় হাতে। জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। স্কুল কেমন চলছে, বাবা আদর করছে কিনা, নতুন মা কেমন, দেখাশোনা করছে কিনা এসব জিজ্ঞেস করে। সোহাগ সব কিছুতেই মাথা নাড়ে। এই ছোটবেলাতেই সোহাগকে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে যে সে তার নিজের মার সঙ্গে বাস করতে পারবে না।
জুলেখার নিজের জন্য নয়, কষ্ট যদি হয় কারও জন্য, সে সোহাগের জন্য। সোহাগের জন্য টানটা নাড়ির টান। আর সারা দেহে-মনে যার সোহাগ চায় জুলেখা, সে সুরঞ্জনের। সুরঞ্জনকে তত দিন সফিকুল বলেই পাড়ার অতি কৌতূহলী পড়শিরা জানতো।
এমনকি মামার বাড়িতেও বীরভূমের তুতো ভাই বলে চালিয়েছিল কদিন। কিন্তু ও বাড়িতে জুলেখার জন্য আলাদা কোনও ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়নি যে ওখানে তুতো ভাইকে নিয়ে একটু সময় একা থাকবে। মাটিতে বিছানা করে সে মামি আর মামাতো বোনরা যে ঘরে থাকে, সেই ঘরে শোয়। ও বাড়িতে সুরঞ্জনকে ডাকলে মামার ঘরে বসিয়ে চা-বিস্কুট খাইয়ে বিদায় দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
মামার মাংসের দোকান আছে ভবানীপুরে। অসচ্ছল নয় সংসার। কিন্তু খরচ করার তেমন অভ্যেস না থাকলে যা হয়, জীবনযাপনের মান খুব নিচুতে রয়ে যায়। জুলেখার বাপের বাড়িতে যে সচ্ছলতার ঢল নেমেছিল তা নয়, কিন্তু সে যে কোনও বিত্তেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।
কলেজের ধনী মেয়েদের বাড়িতে সে গিয়েছে, থেকেছে। আড়ষ্টতা ধীরে ধীরে কেটে গেছে। শিক্ষক রবিউল ইসলামের ধর্ম আর কুসংস্কারহীন জীবন, তাঁর অত্যন্ত সভ্য আচার-আচরণ, তাঁর রুচি সংস্কৃতি জুলেখাকে প্রভাবিত করেছে কলেজ জীবনের দীর্ঘ চার বছর।
সুরঞ্জনকে তার মানুষ বলে মনে হয়। স্রেফ একটা হিন্দু ছেলে বলে মনে হয় না। আর বিশেষ করে সেদিন ওই ধর্ষণের ঘটনার দিন সুরঞ্জন কী করে যে বাধা দিতে চাইছিল, কী করে সে জুলেখাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মার খেল, না, জুলেখার জীবনে এমন নাটকও কোনো দিন হয়নি, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেনি, যে, কোনও ধর্ষক পুরুষের চোখে জল জমেছে তারই হাতের মুঠোয় তারই শিকারের জন্য মায়ায়। এই মায়া, এই চোখের জল, জুলেখার বিশ্বাস, না মুসলিম না হিন্দু কোনও সম্প্রদায়ে পাবে না সে। এই সম্প্রদায় আলাদা সম্প্রদায়, তারা জাত ধর্মের অনেক ওপরে।
নিষ্ঠুরতা দেখে দেখে অভ্যস্ত জুলেখা। ছ বছর ধরে মহব্বতের কঠোর কঠিন মুখ দেখছে সে। কোনও দিন দু'জনে একসঙ্গে বেড়াতে যায়নি। গেছে যদি সে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে হঠাৎ কোনও প্রয়োজনে। নয়তো জঙ্গিপুরে। বাড়িতে কোনও বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, কোনও আত্মীয় স্বজনের ভিড় কিছু হয়নি। মহব্বতের ইচ্ছে কলকাতায় খেটে ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে একসময় জঙ্গিপুরে চলে যাবে। পুরনো কাঠের ব্যবসায় নামবে, নয়তো আসবাবপত্রের দোকান দেবে। বরং ভালোবাসারই কাঙাল ছিল সে। সে সন্ধ্যেয় জুলেখার সাতাশ বছরের আগুনকে সুরঞ্জন তার সাঁইত্রিশ বছরের জলে নিভিয়ে বলে, - কে এসেছিল জানো তো?
- কে?
- ওই ভদ্রমহিলাকে চেনো না?
- না তো।
- নিশ্চয়ই চেনো।
- উহু! জুলেখা মাথা নাড়ে। সে মনে করতে পারছে না।
- তসলিমা নাসরিন।
সুরঞ্জন একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথাটা খাটের রেলিংয়ে রেখে বলে। জুলেখা সুরঞ্জনের হাতের সিগারেটের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। তার সহ্য হয় না সিগারেটের গন্ধ।
- পড়োনি তার বই?
- অনেক আগে পড়েছিলাম। স্কুলে থাকাকালীন। নির্বাচিত কলাম।
- 'লজ্জা' পড়োনি?
- নাহ।
- বলো কী?
- কেন?
- 'লজ্জা' তো প্রায় সবাই পড়েছে বোধহয়। তুমি ছাড়া।
জুলেখা জোরে হেসে ওঠে।
- তো ওই লেখিকা তোমার বাড়িতে কেন?
- দেশেই চেনা ছিল।
- দেশতুতো।
- হ্যাঁ। জুলেখার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে, তুমি যেমন পাড়াতুতো।
- হুম।
জুলেখা কখনও বলে না যে মামার বাড়িতে থাকার বদলে সুরঞ্জনের বাড়ি এসে থাকতে সে পারে। সুরঞ্জনও বলে না জুলেখাকে একসঙ্গে বাস করার কথা। ভেতরে প্রত্যাশা ছিল অনেক দিন। সে ভেবেছে, সুরঞ্জন নিজেই একদিন বলবে যে, এত জ্বালা কী করে সইছো, এ বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়ি চলে এসো, চলো দুজন এক বাড়িতে একসঙ্গে থাকি। মনে যদি মেলে, শরীরে যদি মেলে, তবে দুজন একসঙ্গে না থেকে আলাদা থাকার কী অর্থ জুলেখা জানে না। কোথায় সুরঞ্জনের অসুবিধে। জুলেখা জিজ্ঞেসও করে না অসুবিধেটি কোথায়। জুলেখা একটা জিনিস এখন আর করে না, সে হলো প্রত্যাশা। প্রত্যাশা না থাকলে যা কিছুই সে পেয়ে যায়, প্রচণ্ড ভালো লাগা থাকে তাতে। সুরঞ্জন যেদিন বলবে চলে এসো, সেদিন সে চলে আসবে, এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
সুরঞ্জন কেন বলছে না জুলেখাকে চলে আসতে! সুরঞ্জন কি নিজে জানে! বেলঘরিয়া ছেড়ে এসে এই পার্ক সার্কাসে সে কি থাকছে শুধু প্রেম করার জন্য! ভেতরে কোনও স্বপ্ন নেই? ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে তার। জুলেখার জন্য তার মায়া হয়, করুণা হয়, ভালোওবাসে মেয়েটাকে। কী নিরীহ নিষ্পাপ, কী সৎ আর শক্ত মেয়েটি। সুদেষ্ণা যদি এমন হতো।
সুদেষ্ণার সঙ্গে তো প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল। জুলেখার প্রতি মূলত একটা অপরাধবোধ কাজ করেছে তার। ভয়াবহ একটা অপরাধবোধ। সেই অপরাধবোধ থেকে করুণা। করুণা থেকে কী রকম একটা মায়া পড়ে যাওয়া। মায়ার জন্য যেমন একটা মায়া সুরঞ্জনের সব সময় আছে, সে রকম। জুলেখার সঙ্গে শরীর বিনিময় করে সে। না, কেবল শরীরের জন্যই নয়। মন থাকে ওতে। কিন্তু জুলেখাকে হঠাৎ বিয়ে করে ঘরে তোলা, ওই এক চিলতে ঘরে, এ ঠিক সুরঞ্জন ভেতর থেকে মেনে নিতে পারে না।
পাড়ায় তার মুসলমান বন্ধুদের একটা দল আছে, দলটা ভারী হচ্ছে, সেখানে জুলেখাকে বিয়ে করতে চাইলে ঠিক কী অবস্থায় পড়তে হবে, সুরঞ্জন জানে না, তার ভয় হয়। হ্যাঁ, সুরঞ্জনের ভয় হয়। তার আগের সেই সাহস, সে লক্ষ করে, নেই আর। সাহসের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার ভেতরে, তা ওই সেদিনই সে দেখিয়েছে। অচিন্ত্যদের হাত থেকে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছে। অবশ্য বাঁচানোই বা কি একে বলে? চার চারটি পুরুষ তো ধর্ষণ করেইছে, ওদের তো বাধা সুরঞ্জন দেয়নি। প্রথম থেকে তো বাধা সে দিতে চেষ্টা করেনি। বরং প্রথম ধর্ষণটা সে নিজেই করবে বলে আশা করেছিল।
জুলেখার পরিণতির জন্য সুরঞ্জন একশ ভাগ দায়ী অপহরণ। তালাক। মামার মেঝের জীবন। দিন-রাত্তির অপেক্ষা আর অবজ্ঞার জীবন। মহব্বতের বাড়িতে অন্তত একটা অধিকার ছিল, স্ত্রীর অধিকার। স্বামীর অধিকারের তুলনায় তা অনেক কম যদিও। আর সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা যেটা ছিল, সেটা সোহাগ। সোহাগকে তার পাওয়া হতো। সুরঞ্জনের কারণে ধর্ষিতা হওয়া আর তালাক পাওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি জুলেখার হয়েছে, সে হলো সোহাগকে হারানো।
সুরঞ্জন হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে জামাকাপড় পরতে পরতে জুলেখাকে বলে— তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও।
- কোথায় যাবে?
- তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাবো এক বন্ধুর বাড়িতে। খুব দরকার।
- কোন বন্ধু?
- তুমি চিনবে না।
- না, বলো, দেখি চিনি কিনা।
- তুমি তো বলেছিলে আজ আর কারও বাড়িতে যাবে না।
- যাব না বলেছিলাম, কিন্তু যেতে হবেই।
- কার বাড়িতে? আমজাদের?
সুরঞ্জন কথা বলে না। জুলেখার মুখ খানা খুব বিষন্ন দেখায়। তার ধারণা সুরঞ্জন কোনও বন্ধুর বাড়ি যাবে না। অন্য কোথাও যাবে।
চলবে.......
১২তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন