আত্মকথন : ঘটনাটা একবারেই ঘইটা গ্যাছে
লেখক : বাবু আহমেদ
প্রকাশকাল : ১০ নভেম্বর, ২০১৮
বাবু আহমেদের “ঘটনাটা একবারেই ঘইটা গ্যাছে” শিরোনামের এই আত্মকথনটি তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি এই আত্মকথনটি ২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা মগবাজারের ডাক্তার গলিতে বসে লিখেছেন। এ লেখায় তিনি গত দুই দশকে শাহাবাগ এলাকায় ঘটে যাওয়া উত্থান-পতনের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।
![]() |
ঘটনাটা একবারেই ঘইটা গ্যাছে || বাবু আহমেদ |
ঘটনাটা একবারেই ঘইটা গ্যাছে || বাবু আহমেদ
নাহ।
শাহবাগের শীতেও এখন আর আগের মতো উষ্ণতা নাই। সেই গন্ধ নাই। ছবির হাটের অন্ধকারের সেই আলো নাই।
ছবির হাট বন্ধ হৈয়া যাওনের পরে আমরা কয়েকদিন বেওয়ারিশ লাশের মতো এদিক-ওদিক ঘুইরা-বেড়াইতে থাকলাম। তখনও বোঝা যায় নাই, ঘটনাটা একবারেই ঘইটা গ্যাছে। জাকির চা'এর দোকান ছাইড়া বড় কম্পুটারের দোকানে চাকরি লইলো। আমরা স্বাদ ছাড়া যেই চা খাইতে খাইতে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতম, সেই চায়ের স্বাদ ভুলতে শুরু করলাম। রাস্তার ওইপাড়ে চারুকলার মুরগি বা আলু ভাজা, কিংবা ছবির হাটের ভিত্রের সবজি পাকোড়াও এখন ছবির ফ্রেমে জায়গা লৈছে। দাদু মইরা গ্যালো, যার কাছ থিকা তোমার কানের দুল কিংবা হাতের চুড়ি বা গলার মালা। ছবির হাটের আকাশে বাতাসে তখন বিপ্লব-সিনেমা-কবিতা আর প্রেমের গল্প। একটা জায়গা, ছবির হাট, যেইখানে বিশাল চিৎকারে ঢুকতে ঢুকতে জানাইতাম, আইছি, ঘরের থিকা বাইর হৈয়া আরেকটা ঘরে আইছি। বুড়া, জাকিরের বাপ, হারায়া গ্যালো জীবন থিকা। তুমিও গেলা।
পরীবাগের রাস্তাও বন্ধ হৈলো কয়দিন পর, যেইখানে আগে হাটতে হাটতে পার করতাম সন্ধ্যা কিংবা আরেকটু গভীর রাইতে ১ লিটার মাম পানির বোতলে হাফ বোতল কেরু'র চুমুক, সেইখানে এখন কোল্ড কফি-'কেবাব'-সাব স্যান্ডুইচ আইস্যা জায়গা কৈরা লৈলো। মানতে পারলাম না মন থিকা। পরীবাগের রাস্তা জ্বইলা উঠলো হাজার ওয়াটের সাদা আলোর বাত্তি, রাস্তা থিকা হলুদ মায়াবী আলো উইঠাই গ্যালো। ত্যক্ত-বিরক্ত মন, ঘরের মদ্ধ্যে বন্দী রইলাম৷
আগে, মানে ছোটবেলায়, বিকাল হৈলে বাইর হৈতাম, এখন এই যন্ত্রের শহরে, রাইত হৈলে বাইর হই, প্যাচা কিংবা রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মতো। নাহ, এই শহর সেই তোমার-আমার সময়ের থিকা অনেক বেশি বদলায়ে গ্যাছে, যারে মাইন্যা নিতে পারাটাই ভয়ানক এক স্যাক্রিফাইসের ব্যাপার, য্যানো বিশাল একটা সময়রে ডুবায়া দিতেছি, যাহ, আর ফির্যা আসিস না।
তারও আগে, যখনো উত্তরাধুনিক কবিতা আমাগোর মাথায় ঢুকে নাই অথবা মার্ক্স-মাও-লেনিন যখনো আজিজ'এর বারান্দায় বিপ্লব ছড়াইতেছে, তখন আমরা ডরে ডরে আজিজে যাই, এই বুঝি কোন বড় ভাই সিগারেট হাতে দেইখ্যা ফালাইলো। আজিজে যাই, টিশার্টে বিপ্লব দেখি, বইয়ের গন্ধে নাক ডুবাই আর চামে-চিকনে কোনো এক চায়ের দোকানে গিয়া সিংগারা-চা আর একটা বেন্সন খাই। না, শাহবাগের ওই এক টুকরা ছবির হাটের রুপ-গন্ধ তখনো অতোটা আপন হয় নাই। তখনো অবাক আবিষ্কারের সময় আমাদের। দুনিয়াটা একলা একলা নতুন চোখে দেখি আর যাবতীয় এস্টাব্লিশ্মেন্টরে দিন-রাইত গাইল দেই। "ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়" স্লোগান কিংবা আনন্দ-কল্যাণ-জয়ীতা-সুদীপ অথবা মাধবীলতা আর অনিমেষ তখন রক্ত গরম করে।
রোমান্টিক বাংগালির বিপ্লব, প্রথম প্রেমের মতোই সেই কবেই তো দাগ রাইখ্যা গ্যাছে মনে, কিন্তু সফল হয় নাই। সেই অসফল বিপ্লব কিংবা প্রেমের স্মৃতি নিয়াই লাল পতাকার আওয়াজ এখনো ওঠে আর আমিও এমন শীতের রাইতে ঠান্ডা পরীবাগের রাস্তায় কুয়াশার গন্ধ লৈতে লৈতে বাসার দিকে হাটা দেই। কিন্তু তবুও সেই পুরান গন্ধ এখন আর নাকে ধাক্কা দেয় না। এদিকে ওয়্যারলেস থিকাও এখন আর ডাইরেক্ট রিকশা যায় না পরীবাগ, শাহবাগ।
তোমার-আমার অলস ভালোবাসা-ঝগড়া-হাজারো পাওয়া-না পাওয়া স্মৃতির সব জায়গাগুলাই আস্তে আস্তে সব অন্যের হৈয়া যাইতেছে। যাউক। ওতে এখন আর কিছু আসে যায় না। মারজুক রাসেল-এর "আমি অনেক কিছু ছাইড়া আসা লোক" ফিলিংস এর সাথে সাথে সময় বদলায়ে গ্যাছে। আপডেটেড এন্ড্রয়েড ভার্সন-ফেসবুক-স্ন্যাপচ্যাট-ইন্সটা-হোয়াটসএপ-এর ব্যস্ততায় এখন আর খুবেক্টা স্মৃতি রোমন্থনের সময় হয়না। যাপিত এই জীবনে পরিবাগের কেরুর সন্ধ্যা এখন জায়গা নিছে গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে আর কাপের পর কাপ চা-এর বদলে জায়গা নিছে রুদ্রর 'সোনালী শিশির'।
_দশ নভেম্বর । দুই হাজার আঠারো ।
ডাক্তার গলি । মগবাজার। ঢাকা
লেখক সংক্ষেপ:
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন