![]() |
তরুর বাবা মারা যাওয়ার ১ মাস পরেই চাচারা তরুদের ঘরে এসে উঠলো। সেই সাথে চাচী তাদের কাজের মহিলাকে ছাড়িয়ে দিলো।দুই মাসের মাথায় তরুর আর তরুর মায়ের জায়গা হলো ঘরের সবচেয়ে ছোট রুমটায়। এরপর তরু বুঝতে পারলো এই ঘরটা এখন চাচাদের হয়ে গেছে, এবং মা হয়ে গেছে এই ঘরের বাঁধা কাজের লোক।
দুপুরে তরু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার কথা,তরুর মা তখন রুমে এলো।হাতে মাছের রক্ত।এসে তরুকে বললো,"বিকেলে লতার টিচার আসবে,আসরের পর আর বাসা থেকে বের হবি না বলে দিলাম।আমার আর ঝামেলা ভালো লাগে না। "
মায়ের কথা শুনে তরু বিরক্ত হয়ে বললো, "লতার স্যার আসলে আমার কি মা?ওর স্যার তো আমার কোলে উঠে বসে থাকবে না যে আমি বের হতে পারবো না।"
রাবেয়া রক্তমাখা হাতে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে বললো, "মুখে মুখে তর্ক করবি না তরু।এতো যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না আমার। তোর চাচী বলে গেছে তোরে নিষেধ করতে।মাঠের দিকে যাবি না।লতার পড়ার টেবিল থেকে তাকালে গেইটের সামনের দিকে দেখা যায়।"
তরু মন খারাপ করে বললো, "এমন করো ক্যান মা?তুমি জানো না বিকেলে সবাই মিলে আমরা মাঠে আড্ডা দিই।আমার ঘরে থাকতে হাঁসফাঁস লাগে মা।"
রাবেয়া মেয়ের কথা শুনে মন খারাপ করে বললো, "এমন অবুঝ হইস না মা।তোর ভালো না লাগলে ছাদে গিয়ে বসিস কিছুক্ষণ বিকেলে তবুও বের হবি না।"
তরুর ভীষণ মন খারাপ হলো। কিন্তু আর প্রতিবাদ করলো না।মাথার উপর বাবার ছায়া না থাকলে এরকমই হয়। জলভরা চোখে তাকিয়ে রইলো তরু জানালা দিয়ে।
ফাইজান এলো ঘড়ি ধরে বিকেল চারটের সময়। লতার এই টিউশনিটা ফাইজান নিতে চায় নি।কিন্তু বাবা মায়ের চাপাচাপিতে রাজি হতে হলো।ফাইজান এসে নিজের চেয়ারে বসলো।
লতা এসে বসলো ২ মিনিট পর। এসেই সালাম দিলো লতা।ফাইজান সালামের জবাব দিয়ে বললো, "বসো,বই বের করো।"
লতা এক নজর আড়চোখে তাকালো ফাইজানের দিকে।আর্মিকাট দেওয়া চুলগুলো ভীষণ ছোট ছোট। আশ্চর্য, লোকটাকে এই কাটে ভালোই লাগছে।
"একটু আসছি ভাইয়া।" বলে লতা দ্রুত পায়ে নিজের রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে লিপস্টিক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।ন্যুড কালারের লিপস্টিকটা ঠোঁটে হালকা লাগিয়ে নিয়ে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো।
না এবার সুন্দর লাগছে।সন্তুষ্ট হয়ে লতা বের হয়ে এসে আবারও চেয়ারে বসলো।
ফাইজান প্রথমে একাউন্টিং বইটা খুললো।লতাকে একটা অংক ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে খাতায় করে দিলো।
তারপর বললো, "এবার তুমি নিজে নিজে দেখো কোথায় বুঝতে অসুবিধা লাগছে,এরপর তুমি নিজে নিজে করবে।"
লতা মাথা নাড়িয়ে বললো ঠিক আছে।
পড়ানো শেষ করে ফাইজান বের হয়ে গেলো।
তরুর বিকেলটা কাটলো কেমন দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে। তরু ক্লাস নাইনে পড়ে। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে ভালোবাসে সারা বাড়িতে। এই বাড়িটা যদিও তরুর বাবার করা কিন্তু সে-সব কথা এখন অতীত। বাবা নেই যেখানে সেখানে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে যে এটাই ঢের বেশি।
রাবেয়া ঝামেলা পছন্দ করে না।ঝামেলা পছন্দ করলে এতো দিনে অনেক কিছু হয়ে যেতো।
তরু বিকেলে জানালার পাশে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো।বাহিরে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। নীল আকাশে একটা পাখি উড়ছে।একাকী।
তরুর মনে হলো পাখিটা বুঝি তরু নিজেই।ভীষণ একলা একটা জীবন তার।
বাবা মারা যায় তরু তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। এরপর থেকে তরুর জীবন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে।মা থাকে সারাক্ষণ সংসারের কাজে ব্যস্ত। রাতে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে মা রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে সব গুছিয়ে রেখে এসে শোয়।বিছানায় পিঠ রাখলেই সারাদিনের ক্লান্তিতে দুই চোখ বন্ধ হয়ে যেতো ঘুমে।
হারিকেনের আলোয় তরু তখন বসে বসে খাতায় পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতো।সময় কেটে যাচ্ছিলো তার নিজের মতো। তরুর জীবনে ও পরিবর্তন এসেছে। ছোট্ট তরু অনেককিছুই বুঝে এখন।
মায়ের সাথে মনের দূরত্ব বেড়ে গেছে হাজার ও মাইলের।
এই অলস বিকেল কাটলো তরুর একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে।
সন্ধ্যা বেলায় তরু বই নিয়ে বসলো। সস্তা কম আলোর একটা বাল্বের আলোয় তরু পড়তে বসেছে।এই টিমটিমে আলোয় তরুর কেমন মন উদাসী হয়ে যায়। তার উপর মাথা ঝিমায়।
তরু অংক বইটা নিয়ে বসেছে।মন খারাপ হলেই তরু অংক করতে বসে।যেসব অংকগুলো বেশ জটিল প্রকৃতির হয়,করতে বেশ সময় লাগে।সেগুলো একটা খাতায় লিখে রাখে তরু।যখন মনটা খুবই খারাপ হয় তখনই বসে অংকগুলো নিয়ে। নিজের জীবনের সমস্যা ভুলে গিয়ে অংকের সমস্যা সমাধান করে।
লতা এলো একটা আইসক্রিম হাতে নিয়ে। তরুর পাশের চেয়ারে বসে বললো, "এই তরু,গরম লাগছে না তোর?"
তরু চুপ করে রইলো। লতার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন।
কথা না বলে তরু অংক করতে লাগলো। লতা উঁকি দিয়ে তাকিয়ে বললো, "বাব্বা,একেবারে অংকের জাহাজ তুই।এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বসে অংক করছিস কিভাবে?নিউটন ও ফেইল হয়ে যাবে তোর কাছে। আমি ফ্যানের নিচে বসেও ঘেমে-নেয়ে উঠেছি।দেখছিস না এখন তাই আইসক্রিম খাচ্ছি। "
তরু বিরক্ত হয়ে বললো, "কোনো দরকারি কথা না থাকলে তুই যা তো এখন লতা।আমাকে পড়তে দে।"
মুখ কালো করে লতা বললো, "এরকম ভাব নিয়ে থাকবি না তরু আমার সাথে। আমি তোর এসব ভাবের ধার ধারি না বুঝলি।আসছে আমার পন্ডিত মশাই। "
তরু কথা বাড়ালো না।লতা উঠে চলে গেলো। ৫ মিনিট পর তরু দেখলো রুমের লাইট অফ হয়ে গেছে।বাহিরে চাচীদের সবার রুমে আলো আছে।শুধু তরুদের রুমের আলো বন্ধ। তরু জানে এটা লতার কাজ।তরুকে জব্দ করতে লতা এটা করেছে।
ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে তরু মায়ের কাছে গেলো।রাবেয়া তখন চুলার পাড়ে বসে রুই মাছ ভাজছে।পুকুরে সকালে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়েছে। অনেকগুলো মলা মাছ,গুড়ো মাছ পেয়েছে জালে।
প্রায় ১২ কেজি ওজনের একটা রুই মাছ ও উঠেছে অন্যান্য মাছের সাথে। দুপুর থেকে রাবেয়া মাছ কা//টা///কু///টির কাজে ব্যস্ত।
তরু রান্নাঘরে এসে দেখে মায়ের সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে।কপালে,নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম কণা জমে আছে।আগুনের লাল আলোয় ক্রিম কালার সুতি শাড়ি পরা মা'কে অপ্সরাদের মতো লাগছে।
তরু মায়ের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক ডিশ মাছ ভাজতে বসেছে মা।
তরুর দুই চোখ টলমল করতে লাগলো। কতো ক্ষণ ধরে মা বসে বসে এসব করছে কে জানে!
একটানা অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চয় বসে মাছ কে///টেছে।দুপুরেও তো মায়ের হাতে মাছের রক্ত দেখেছে।রাতে ঘাড় ব্যথা,কোমর ব্যথার জন্য ঘুমাতে পারবে না।
মায়ের জন্য তরুর ভীষণ আফসোস হয়।মায়ের বয়স কতোই আর।অথচ জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে অযথাই।চাচী তো কাজের লোক ছাড়িয়ে দিয়েছে কতো বছর আগেই। সবকিছু মায়ের উপর দিয়ে যাচ্ছে।
রাবেয়া মেয়েকে দেখে বললো, "কিরে পড়া রেখে এখানে দাঁড়িয়ে আছস কেনো?"
তরু কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, "মা,এই আগুনের পাশে বসে এতো কাজ করছো যে,তোমার গরম লাগে না মা?"
রাবেয়া বিগলিত হেসে বললো, "পাগল মেয়ে,গরম লাগবে কেনো?নারী গো জীবন এরকমই মা,চুলার গনগনে আগুনে পুড়ে পুড়ে এই জীবন শেষ হয়।"
তরু একটু ভেবে বললো, "মা,তাইলে চাচীর কেনো জীবন এরকম হয় না?চাচীর তো চুলার পাড়ে আসা লাগে না কখনো। উনিও তো নারী।"
রাবেয়া হাসলো মেয়ের কথা শুনে। বোকা মেয়েকে কিভাবে বুঝাবে স্বামী নামক অলংকার যার নাই তার জীবন সুখ বলতে কিছু নাই।তার জীবন খাঁখাঁ মরুভূমির মতো। সেই জীবনে না আছে সুখ,বা আছে শান্তি আর না আছে স্বস্তি।
একটা মানুষ মরে গিয়ে জীবিত মানুষটাকে জিন্দা লাশ করে দিয়ে গেছে।তার এখন আর কোনো কিছুতে কোনো অধিকার নেই,মতামত নেই।
রাবেয়ার দুই চোখ ভিজে উঠলো। চোখ মুছে রাবেয়া বললো, "এদিকে আয় তরু,একটা ভাজা মাছ খাবি?গরম গরম ভাজা মাছ কাহ একটা। নিজেগো পুকুরের মাছ,তোর বাপের পুকুর এইটা তরু।খা একটা, বড় স্বাদের মাছ।"
তরু মাথা নাড়িয়ে বললো, "না মা খাবো না।"
রাবেয়ার খুব খারাপ লাগলো। তারা মা মেয়ে দুজনেই এই পরিবারে যেনো উচ্ছিষ্ট। সবাই খেয়ে যাওয়ার পর তারা দুজন রান্নাঘরে বসে খায়।কখনো এক টুকরো মাছ মা মেয়েকে ভাগ করে খেতে দেওয়া হয় আর কখনো তো থাকেই না।
তরুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর রাবেয়া পারে নি মেয়েকে এক টুকরো মাছ ভালো করে খেতে দিতে।
আজ হঠাৎ করে মনে হলো সেই কথা। আহারে জীবন!
অথচ তরুর বাবা থাকতে রাবেয়া সবসময় মেয়েকে মাছ ভেজে দিতো।তরু ভাজা মাছ ছাড়া খেতো না।আর এখন নির্মমতার চাপে পড়ে সব কিছু খেয়ে নেয় বিনা বাক্য ব্যয়ে।
রাবেয়া করুন মুখে বললো, "আয় না তরু,একটা মাছ খা।কতো দিন একটু তোকে ভালো করে কিছু খাওয়াতে পারি না। "
তরু মায়ের কথা শুনে এগিয়ে গেলো। রাবেয়া এক পিস মাছ একটা বাটিতে তুলে মেয়েকে দিলেন খেতে।
তরু মুখে তোলার আগেই তরুর বড় চাচী আমেনা এসে হাজির হলো।
রাবেয়ার মুখটা ভয়ে পাংশুবর্ণ লাভ করলো। ছি ছি,আমেনা ভাবী এখন কি মনে করবে!
আমেনা হতবাক হয়ে বললো, "রাবু,এইডা কি করলি তুই?তুই কারে জিজ্ঞেস করে মেয়েরে মাছ খাইতে দিছস?সবার জন্য গুনে গুনে নাছ ভাজতে দিছি আমি।"
রাবেয়া সাহস সঞ্চয় করে বললো, "তরুর মাছ ভাজার উপর শখ ভাবী।সবসময় তো খাইতে পারে না, তাই আজকে একটা মাছ খেতে দিছি।আমি নিজেই জোর করে দিছি।তরু নিতে চায় নি।"
আমেনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো, "কি বললি রাবু তুই?সবসময় খাইতে পারে না! তোগোরে আমি ভাত মাছ দিই না?দুধ কলা দিয়া কালসাপ পুষি আমি?আমার খাস আমার বদনাম করস কেমনে? এতো নিমকহারামি তোরা?"
রাবেয়া থ মেরে গেলো। আমেনা বললো, "আইজ আমি এখন না আসলে তো জানতে পারতাম না রান্নাঘরে যে এসব চোরাকারবারি চলে তোর।কবে থাইকা এসব করস তুই?এজন্যই তো কই,হিসাব মিলে না ক্যান আমার। "
তরুর আর মুখে খাবার উঠলো না লজ্জায়,অপমানে।মাছের বাটি নামিয়ে রেখে তরু দৌড়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। মায়ের এতো অপমান তরু সহ্য করতে পারছে না।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তরুর।
চলবে......
কেয়া পাতার নৌকা (০১)
রাজিয়া রহমান
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন