আমার নির্ঝঞ্জাট জীবনে একমাত্র সমস্যা হলো আমার প্রেমিক। তার সাথে আমার প্রেম কী করে হলো সে নিয়ে আমার আফসোসের শেষ নেই। পটবো না পটবো না করেও কী করে যে তার প্রেমিকা হয়ে গেলাম সে এক আশ্চর্যের বিষয়। তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয়, এই মূর্তমান যন্ত্রণাকে আমি গত চার বছর ধরে সহ্য করছি। সহ্য না করে উপায়ও নেই। দুনিয়ার সকল ধরনের ফাজলামো তার নখদর্পনে থাকলেও ইসরায়েলী পণ্যের অনুরূপ বয়কট বাণী ঝাড়ার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। নারীলোভী পুরুষ আমার দু’চোখের বিষ। সে নতুন একটা প্রেম করলেই আমি মহোৎসাহে তাকে ছেড়ে যেতে পারি। কিন্তু সে অঙ্ক যোগী, সন্ন্যাসী। অঙ্কের ফরমুলা কষতে কষতে দিন-দুনিয়া ভুলে যায়। মেয়েমানুষ খেয়াল করার সময় তার নেই। এটুকু পড়ে তাকে নিতান্তই নিরীহ পুরুষ ভেবে হাপিত্যেশ করছেন নিশ্চয়? তবেই ভুল করলেন। সে একদমই নিরীহ মানব নয়। অঙ্কের সূত্রে মগ্ন থাকলেও শয়তানীর আগাগোড়া তার মুখস্থ। তার বেয়ারা রূপের পরিচয় দিতেই দিন কয়েক আগের এক ঘটনা বলি। 

ঘটনা শুরুর আগে পাঠকের জানা থাকা ভালো, সে আর আমি থাকি পৃথিবীর ভিন্ন দুই গোলার্ধে। যখন আমরা একই দেশে থাকতাম তখন আমাদের প্রেম মাত্রই ছিলো ঝগড়া। ঝগড়া আমিই শুরু করতাম। সে অত্যন্ত যুক্তিবাদী বিধায় সেই ঝগড়া স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠতো। কখনো-বা সে নির্বিকার মুখে সব মেনে নিতো। সব কথাতেই একই উত্তর, আচ্ছা। আচ্ছা। আচ্ছা। আমি রেগে যেতাম। প্রচন্ড রেগে গিয়ে আমার প্রথম কাজ হতো তার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া। আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে যে সে মজনুর মতো উড়ে উড়ে আমার কাছে চলে আসতো। অস্থির হয়ে পড়তো। এমন সিনেম্যাটিক কোনো ব্যাপার নেই। আগেই বলেছি, অঙ্কপ্রেমী মানুষেরা প্রেমিকাকে ভালোবাসতে পারে কম। আমার যতটুকু ধারণা, আমাদের ঝগড়া হলে তার আমাকে খুব একটা মনেও পড়ে না। মানানোরও চেষ্টা করে না। এমনকি ঝগড়ার কথাটাও ভুলে যায়। এক, দুই সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর সে হঠাৎ উদয় হয় আমার হলের গেটের সামনে। নতুন কোনো নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলে, 

' এই? তোমার ফোনে কল ঢুকছে না কেন? একটু নিচে নামো তো। আমার মনে হচ্ছে, তোমাকে আমি এক কোটি বছর ধরে দেখি না।' 

আমার তখন রাগে গা কিরকির করে। তারপরও এই উদাসীন, এলেমেলো ছেলেটিকে এড়িয়ে যেতে পারি না। রাগে চোখ-মুখ শক্ত করে নিচে নামি। সে আমাকে দেখেই ভুবন ভুলানো একটা হাসি দেয়। বলে,

' চা খাবে?' 

আমি উত্তর দেই না। সে প্রতিবার আমাকে দেয় একটা করে ঘাস ফুল। কোনো গোলাপ নয়, বেলী নয়, রজনীগন্ধা নয়। কেবল একটা সাধারণ ঘাস ফুল। ব্রহ্মপুত্রর পাড় ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সে গান গায়, 

' ভালোবাসি, ভালোবাসি।' 

তার গানের গলা চমৎকার। প্রতিবার আমার চোখে জল  আসে। তার সাথে আমার আর সম্পর্কচ্ছেদ করা হয় না। আমি তার গানে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে, কে জানে কত লক্ষবারের মতো বুঝি, এই লোককে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার নিশ্চয় আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছেন? ভাবছেন, আহা কী প্রেম! কী মিষ্টি! উদাসীন ছেলেটা নাহয় একটু উদাস হয়েই থাকে, তাতে ক্ষতি কী? ক্ষতি অবশ্যই আছে। এইযে দেখছেন? এসকলই আমাকে গলানোর পদ্ধতি মাত্র। তারপর সে দিবে আসল চাল। এইযে সপ্তাহ দুই আমি যোগাযোগ বন্ধ রাখলাম? বুদ্ধি খাটিয়ে এবার সে তার বদলা নিবে। এমনভাবে নিবে যেখানে আপনি ফাঁসবেন কিন্তু কিছু বলার অবকাশ পাবেন না। বুঝতে পারলেন না তো? চলুন বুঝাই। 

এই মাসখানেক আগের কথা। তার শীতের ছুটি শুরু হওয়ার আগে আগে তুচ্ছ এক কথা নিয়ে আমাদের মধ্যে ভয়ংকর ঝগড়া হয়ে গেলো। যেহেতু সে এখন পরবাসী; চাইলেই হলের গেটে এসে আমাকে গলিয়ে ফেলতে পারবে না। সুতরাং, আমি তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার নিমিত্তে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। দেশ ছাড়ার পর থেকে যোগাযোগ বন্ধ ব্যাপারটাকে সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। দুইদিনের বেশি যোগাযোগ বন্ধ থাকলেই অস্থির হয়ে উঠে। তাই ভাবলাম, এই সুযোগ ; একটা শিক্ষা দেওয়া যাক। কিন্তু যাকে শিক্ষা দিতে এতো কসরত তার শিক্ষা হলো বলে মনে হয় না। দুইদিনের জায়গায় এক মাস কেটে গেলেও তার কোনো দেখা নেই। নিমু আপাও দেশে এসেছেন। দেশে এসেই একদিন ফোন করে বললেন, 

' অন্তুর যন্ত্রণায় তো বাসায় টেকা যাচ্ছে না। তোমার ভাইয়া বন্ধুর বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভাবছি আমিও পালাবো। তোমার কাছে জায়গা হবে?' 

ফোন পেয়েই এমন অদ্ভুত প্রশ্নে অবাক হলাম আমি। বিস্মিত কণ্ঠে শুধালাম,

' ঘটনা কী?' 

' ঘটনা ভয়াবহ। অন্তু কোথা থেকে বিশাল এক কাঁঠাল গাছ কেটে এনে লোক দিয়ে ছাদে উঠিয়েছে। করাত, হাতুড়ি আরও কীসব কাঠ কাঁটার যন্ত্রপাতি জড়ো করে নিয়ে বসেছে। সারাদিন কাঠ কাটা, হাতুড়ি, করাতের আওয়াজে আমাদের রীতিমতো পাগল হওয়ার দশা।' 

আমি অবাক হয়ে বললাম,

' কাঠ কাটছে মানে কী? কাঠ কেটে করবে কী?' 

নিমু আপা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

' ঢেঁকি বানাবে। ওর হঠাৎ ঢেঁকি বানানোর শখ হয়েছে। এই কয়েকদিন ইউটিউব থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রিদের  সাক্ষাৎকারও নেওয়া শেষ। দারোয়ান চাচার গ্রামের বাড়িতে পুরোনো ঢেঁকি আছে। তার সাথে তার গ্রামে গিয়ে ঢেঁকির স্ট্রাকচার পর্যন্ত এঁকে এনেছে। ফিতে ধরে মাপঝোঁকের হিসেব করাও শেষ।' 

আমি বিস্মিত কণ্ঠে শুধালাম,

' তোমার ভাই কী অঙ্ক করতে করতে পাগল হয়ে গেলো আপা? ঢেঁকি দিয়ে সে করবে কী?' 

নিমু আপা জবাব দিতে পারলেন না। এক মাস পর আমি সেধে তাকে ফোন করবো সে-ও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, চুপ করে রইলাম। তার কয়েকদিন পর হঠাৎ শেরপুর কুরিয়ার থেকে টেলিফোন এলো। জানালো একটা পার্সেল আছে। আমি তখন ময়মনসিংহ। পরিচিত একজনকে পার্সেল আনতে পাঠালাম কিন্তু বাঁধলো বিপত্তি। তারা কিছুতেই পার্সেল দিবে না। একমাত্র আমিই গ্রহণ করতে পারবো। খুবই কনফিডেনসিয়াল জিনিস। আমার প্রায় প্রায়ই পার্সেল আসে কিন্তু এতো কনফিডেনসিয়াল কিছু কে পাঠাতে পারে ভেবে বিস্মিত হলাম। একবার ভাবলাম, যার কনফিডেনসিয়াল জিনিস তার কাছেই ফিরে যাক। রিসিভ করবো না। তারপর আবার কী ভেবে ময়মনসিংহ থেকে শেরপুরে ছুটে গেলাম কেবল একটা পার্সেল রিসিভ করার জন্য। কিন্তু সেখানে আরেক টুইস্ট। অফিসে গিয়ে শুনলাম, তারা পার্সেল ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কী বিপদ! ময়মনসিংহ যদি পাঠিয়েই দিতে হয় তাহলে আগে দিলো না কেন? আর আমার পার্সেল কার অনুমতিতে পাঠিয়ে দিলো ময়মনসিংহ? তারা বললো, আমিই নাকি বলেছি। আমি আশ্চর্য! কখন বললাম? তারা বলে, টেলিফোনে বলেছি। রাগে-বিরক্তিতে আমি পরেরদিন ময়মনসিংহ ফিরে এলাম। ময়মনসিংহ কুরিয়ার অফিস থেকে পার্সেল রিসিভ করতে গিয়ে দেখলাম বিশাল বড়ো বাক্স। ভেতরে ভীষণ ভারী কিছু আছে। আমি একা নড়াচড়াও করতে পারছি না। দুই তলা কুরিয়ার অফিস থেকে সেই বক্স নামাতে গিয়ে আমার কোমরের অবস্থা দফারফা হয়ে গেলো। হলে ফিরে রিকশাওয়ালা মামাকে বহু অনুরোধ করার পরও তিনি এই বাক্স পাঁচ তলায় তুলে দিতে রাজি হলেন না। সেই বাক্স পাঁচ তলায় তুলতে আমার সময় লেগে গেলো প্রায় দেড় ঘন্টা। সাথে ফ্রী পেলাম সুতীব্র কোমরব্যথা। এতো কোমরব্যথা, এতো কষ্ট, এতো ক্লান্তি নিয়ে যখন বাক্সটা খুললাম তখন আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভেতরে বিশাল বড়ো একটা আইস বক্স। তাতে বরফে বোঝাই। তার মধ্যে ছোট্ট একটা টিফিন বাটিতে কাঁচকলা-বরই ইত্যাদির ভর্তা। মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এটা কার কাজ। মাসখানেক আগে অন্তুর সাথে ঝগড়ার সূচনাতেই ছিলো বরই ভর্তার নাম। ছোটবেলায় কী করে বরই ভর্তা খাওয়া হতো, তার ইনগ্রেডিয়েন্ট কী ছিলো, সে শহুরে ফার্ম মুরগী বলে এসব কিছু তার জানার কথা না এসব নিয়ে হয়েছিলো ঝগড়ার শুরু। তাই সে প্রতিশোধের সূচনাও করলো এখান থেকেই। কোমরের ব্যথায় কাতর আমি রাগে দুঃখে তাকে কল করলাম। প্রথম তিনবার সে ফোন ধরলো না। চারবারের সময় হাসিমুখে শুধালো, 

' ভর্তা কেমন লাগলো? খেতে ভালো হয়েছে?' 

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

' আপনি! আপনি একটা অসহ্য৷ আপনার মতো শয়তান আমি এই ত্রি-ভূবনে দেখিনি।' 

সে কৃত্রিম মন খারাপ করে বললো,

' আমি নিজ হাতে কত কষ্ট করে তোমার শৈশব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। আর তুমি আমায় বকছো? এতো নিষ্ঠুর তুমি? এতো নির্দয়?' 

দুঃখে আমার কান্না পেয়ে গেলো এবার। তার থেকেও বেশি রাগ হলো যখন তার কৃত্রিম মন খারাপের পেছনে সুপ্ত হাসি টের পেলাম। সারারাত গা, কোমর ব্যথায় আমার ঘুম হলো না। ভোররাতে চোখ লেগে আসতেই হল ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন। লোক মারফত খবর পাঠালেন, নিচে আমার সাথে নাকি একজন দেখা করতে এসেছে। এই কোমর ব্যথা নিয়ে পাঁচ তলার সিঁড়ি বাওয়া আমার জন্য তখন এভারেস্ট জয়ের সামিল। তারপরও নামলাম। নিচে নেমেই রাগে আমার মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়। অন্তু নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে এনেছে মস্ত এক ঢেঁকি। হলের ভেতরে কেউ ঢেঁকি নিয়ে ঢুকে গিয়েছে এইরকম ঘটনা বোধহয় ইতিহাসে বিরল। সুতরাং, হলের সব মেয়েরা ঔৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে চাপা কণ্ঠে ধমক দিলাম, 

' এসব কী!' 

অন্তু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বললো,

' এটা তোমার ভ্যালেন্টাইন গিফ্ট। তুমি সেদিন বললে, আমি শহুরে ফার্ম মোরগ। এসব গ্রামীণ ইমোশন বুঝবো না। তাই এক মাস সময় নিয়ে এটা বানিয়েছি। তুমি যে ভর্তা পেয়েছো সেটাও এই ঢেঁকিতেই করা। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে জান। দেখেছো, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি?' 

আমার এবার কান্না পেয়ে গেলো। তার ভালোবাসার বহরের পেছনে যে কতখানি শয়তানী আছে তা আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু শয়তানী যে এতোদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে, চিন্তা করতে পারিনি বলেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছে হলো এই ঢেঁকির নিচে মাথা দিয়ে নিজের মাথাটাই গুঁড়াগুঁড়া করে ফেলি। হায় বিধাতা, এই শয়তান পুরুষকে নিয়ে আমি করবো কী! 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন