মুক্তমত         :        সীমান্তে চোরাচালান, জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই গডফাদার
লেখক          :         আয়শা এরিন
গ্রন্থ              :         
প্রকাশকাল   :          ৩১ মে,২০২৪
রচনাকাল     :         
 
তরুণ সমালোচক আয়শা এরিনের লেখা “সীমান্তে চোরাচালান, জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই গডফাদার” শিরোনামের এই মুক্তমতটি ২০২৪ সালের ৩১ মে তারিখে অনলাইন পোর্টাল ‘ঢাকা মেইল’এ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি এই লেখায় সীমান্তে চোরাচালান ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন।

সীমান্তে চোরাচালান, জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই গডফাদার || আয়শা এরিন
সীমান্তে চোরাচালান, জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই গডফাদার || আয়শা এরিন

সীমান্তে চোরাচালান, জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই গডফাদার || আয়শা এরিন


রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ আইনি নীতির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন তারা। হয়ে যাচ্ছেন এমপি, কেউ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি। তাদের সম্বল কালো টাকা। চোরাচালান করতে গিয়ে পেশিশক্তিও তদের অস্ত্র। নিজ দলের সাংগঠনিক নীতির দুর্বলতায় ও অতি স্বজনপ্রিয়তার নজির হয়ে উদাহরণ তারা। এভাবেই নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক পর্যায়ে বড় বড় 'নাম' হয়ে তারা বিচরণ করছেন। পাঁচ বছর পর জাতীয় নির্বাচন এলে দলীয় মনোনয়ন পেতে তাদের বেগ পেতেও হচ্ছে না।

এদিকে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলার সংখ্যা বত্রিশটি। তন্মধ্যে ভারতের সাথেই ত্রিশটি। মিয়ানমারের সাথে তিনটি। জেলা রাঙ্গামাটি, ভারত ও মিয়ানমার উভয় দেশের সাথেই সীমান্ত রয়েছে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের তিনটি সীমান্তবর্তী জেলা হলো কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। ঠিক সে কারণেই মিয়ানমারের মাদক ইয়াবাসহ আরও কিছু নেশাপণ্য অবাধে বিচরণ করছে। কক্সবাজারকে 'পর্যটন' যেন নয়, মাদকের শহর বলা হচ্ছে। বিশেষত টেকনাফের প্রত্যেক ঘরেই যেন মাদকসেবনকারী, নচেৎ মাদক চোরাচালানের লোক রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে চোরাচালান কারবারি হিসেবে একজন সাবেক এমপিকে নিয়ে বারংবার করে প্রতিবেদন তৈরি করা হলেও কাজের কাজ হয়নি। বাস্তবতায় মামলা মোকদ্দমায় জড়ালেও তিনি হেসে খেলেই জীবন পার করছেন। বলাবাহুল্য, তিনি না হলেও তার সহধর্মিণী এখন সংসদ সদস্য।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সেদিন সদ্য প্রয়াত তথা ভারতে নিখোঁজ হওয়া এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের স্বর্ণ চোরাচালান কানেকশন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বললেন, ‘আপনারা আগে কেন অনুসন্ধানি সাংবাদিকতার মাধ্যমে তা লেখেননি কিংবা বলেননি?’

প্রশ্ন জনাব ওবায়দুল কাদেরের কাছে, এই নির্দিষ্ট ইস্যুতে লিখে বা বলেও দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হওয়ার মতো রাজনৈতিক কৃষ্টির অনুশীলনে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আছে কিনা? যদি থাকত, তবে সীমান্তবর্তী জেলার এমপিদের মাদক, স্বর্ণ কিংবা মানবপাচারের গডফাদার বনে যাওয়ার অযুত প্রমাণিত সত্যতার আলেখ্য আছে। আপনি দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর সম্পাদক কিংবা হেড অব নিউজকে আদেশক্রমে অনুরোধ করুন। ফল, হাতেনাতে পাবেন। শুধুই কি স্বর্ণ বা মাদকের চোরাচালান?

সূত্রমতে, ভারত থেকে যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে গরু চোরাচালানের সাথেও অনেক এমপির নাম পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। যেমন, রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ির মাদক চোরাচালানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমে ওমর ফারুকের নাম এলেও তিনি গরু চোরাচালানের পথিকৃৎ ব্যক্তিসত্তা, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। কারণ, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ব্যবসায়ীদের 'গডফাদার' হিসেবেই তিনি ফলত পরিচিত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে এই ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম মাদকের গডফাদার হিসাবে থাকলেও তিনি এখন দিব্যি সংসদ সদস্য হয়ে আইন প্রণেতা হিসেবে হুংকার দিচ্ছেন। গোদাগাড়ী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলামের নামেও একই অভিযোগ ছিল। যিনি ওমর ফারুকের কাছের মানুষ। এই সেই ওমর ফারুক চৌধুরী, যিনি একসময় ছাত্রদল করতেন, করতেন ফ্রিডম পার্টিও। অথচ, রাজনৈতিক সংস্কৃতির কত রুগ্ন রূপ, তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন, সংসদ সদস্য হওয়ার অভ্যাসে আছেন।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে তার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি। খুলনা বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া। রাজশাহী বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও জয়পুরহাট। রংপুর বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম। ময়মনসিংহ বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা। সিলেট বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।

উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি জেলায় ভারতনির্ভর চোরাচালানের সাথে রাজনৈতিক পর্যায়ে কতিপয় নেতাদের বাস, সখ্যতা, স্বার্থ রয়েছে। কখনো প্রত্যক্ষ রূপে, কখনো পরোক্ষ আবহে। এমনও হচ্ছে যে, সরাসরি যুক্ত না হয়ে চোরাচালান কারবারদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে প্রশাসনিক সুবিধা দিয়ে। আবার কখনো গোপনে অর্থ বিনিয়োগ করে। একজন আনোয়ারুল আজীম আনারের অনৈতিক কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়ার বাস্তবতা, তাঁর নিজের এলাকার কারও কাছেই অজানা ছিল না। আওয়ামী লীগের মতো শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোকে তাই ভবিষ্যতে সতর্কতার সাথে এই সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সংসদ সদস্য আনারের অযাচিত হত্যাকাণ্ডে যত না জনশ্রেণি ব্যথিত, তা ছাপিয়ে গিয়ে অবৈধ সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা- দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে 'ছোট' করে। আন্তর্জাতিক বিশ্বেও ছোট হয় তখন বাংলাদেশ।

লেখক সংক্ষেপ:
গণমাধ্যমকর্মী, গবেষক ও নির্মাতা

কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন