উপন্যাস        :         যতনে রাখিলাম যাতনা
লেখিকা        :          মম সাহা
প্রকাশনা       :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ৭ জুলাই, ২০২৪ ইং

লেখিকা মম সাহার “যতনে রাখিলাম যাতনা” নামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। এটি মূলত লেখিকার ‘প্রেমোত্তাপ’ উপন্যাসের ২য় খন্ড। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ৭ জুলাই লেখা শুরু করেছেন। 
যতনে রাখিলাম যাতনা || মম সাহা
যতনে রাখিলাম যাতনা || মম সাহা 

যতনে রাখিলাম যাতনা || মম সাহা (পর্ব - ১)


সুইজারল্যান্ডের শহর জেনেভাতে একটি সুন্দর ভোর বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল। শীতের শহরের সূর্যটা যেন হাসতে হাসতে আকাশে উদয় হয়েছে। শীতের রাজ্য সুইজারল্যান্ডের বসবাসকারীদের কাছে সূর্য প্রিয় বস্তু। ঠান্ডার এই রাজ্যে গরম প্রভাকর কেমন আরামদায়ক লাগে! অতি আকাঙ্ক্ষিত সে। যেমন করে সদ্য নবজাতক জন্ম নেওয়ার পর বাবা-মায়ের আনন্দ হয় তেমন আনন্দ হয় এই দেশবাসীর অম্বরে সদ্য উদিত হওয়া ভানুকে দেখে।
‘মুন, তুমি আজ এত সকাল সকাল এখানে?’
চাঁদনী বসে ছিল কাঠের সুন্দর একটি বেঞ্চিতে। তার চোখের সামনে লেক জেনেভ বয়ে যাচ্ছে নরম স্রোতে। জেনেভ শহরের বুকের সৌন্দর্য যেন ধরে রেখেছে এই লেক জেনেভ। কী সুন্দর একটি মায়া মায়া হ্রদ। দেখলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়। চাঁদনীর আপন ধ্যান ভাঙলো ইংরেজি পুরুষ কণ্ঠে। যে কন্ঠে বাংলা টা একটু অদ্ভুতই শোনায়। সে চোখ উল্টে পাশ ফিরে তাকালো। সেখানে সুন্দর সুঠামদেহী ইংরেজ মানব লুসেফ নেরিও দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার হালকা সবুজ মনির চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। প্রশস্ত বুক-পিঠে লেপ্টে আছে খয়েরী রঙের একটি টি-শার্ট। তার উপরে বুক খোলা মোটা একটি ডেনিম জ্যাকেট। উচ্চতা যেন সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের সমান।
চাঁদনী লুসেফকে দেখে খানিক হাসল, ‘ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বলে এখানে চলে এসেছি। তুমি এত সকাল সকাল এখানে যে?’
লুসেফ চাঁদনীর পাশে বসল। অতিরিক্ত ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে ঠান্ডায়। র ক্ত জবার ন্যায় লাল টুকটুকে ঠোঁট গুলো নাড়িয়ে বলল,
‘আজ যাবে না বুটিক হাউজে?’
‘যাবো। আরেকটু বেলা হোক।’
‘আজ টুইংকেল বলেছে না একটা ভাঙালি রেস্টুরেন্টে যাবে?’
লুসেফের বাংলা উচ্চারণ মোটামুটি রকমের বাজে হওয়ায় চাঁদনী প্রায়ই বিরক্ত হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে কপালে তিন ভাঁজ বিরক্তির রেখা এঁকে বলল, ‘ওটা ভাঙালি নয় বাঙালি হবে। বি এ, বা, বাঙালি। ওকে?’
লুসেফ খানিক লজ্জা পাওয়ার মতন হাসল। বা’হাতে মাথা চুলকে লজ্জা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
‘সরি। আমি আসলে তোমার মতন ভাঙলা বলতে চাই।’
‘লুসেফ, ওটা বাঙলা। নট ভাঙলা।’
চাঁদনীর রুষ্ট কণ্ঠে লুসেফ পরাস্ত সৈনিকের মতন মাথা নত করল। অপরাধী স্বরে বলল, ‘সরি, সরি। মাই মিস্টেক। রেগো না মাই সুইট মুন।’
লুসেফের অপরাধীর মতন নরম কণ্ঠে চাঁদনী আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। হেসে দিলো তাই। লুসেফের দিকে তাকালে তার কেন জানি অতীতের সেই অধিক ভালোবাসতে পারা বোকা-সোকা প্রেমিক মৃন্ময়ের কথা মনে পড়ে। এমন করেই তো মৃন্ময়ও চাঁদনীর রাগকে ভয় পেত। কতকিছু করতো কেবল চাঁদনী যেন না রাগে সেই সেজন্য। অথচ আজ…
বুকে চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে জেনেভের কনকনে ঠান্ডা পবনের সাথে মিশে যায়। সুইজারল্যান্ডের এই মাটিতে ভিনদেশী মেয়েটার মতন এত দীর্ঘশ্বাস বোধহয় কেউ ফেলেনি।
চাঁদনীর ভাবনার মাঝেই চনমনে একটি মেয়ে ছুটে আসে। মাথায় ক্যাপ, বুট জুতা পরা, সাদা বড়ো জ্যাকেটে আদুরে মেয়েটির শরীর প্রায় হাবুডুবু খাচ্ছে। সে ছুটে এসেই চাঁদনী ও লুসেফের মাঝে বসে পড়ে বিনা অনুমতিতে। গা দুলাতে দুলাতে বলে,
‘আরে, মি.লুসেফ এত সকাল সকাল এখানে? কাহিনি কী?’
লুসেফ একটু দূরে সরে বসে। মুখ-চোখ কালো করে বলে, ‘টুইংকেল, তুমি এমন ভাবে হুট করে এসে মাঝখানে হাত দিবে না তো।’
লুসেফের অতিষ্ঠ কণ্ঠে টুইংকেল অবাক হয়। চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল,
‘বাব্বা লুসেফ! তুমি এটা কার থেকে শিখলে? বাম হাত দেওয়ার ব্যাপারটা?’
লুসেফ মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে, ‘তোমার থেকে।’
‘ধুরু। তুমি আমার থেকে শিখলে পুরোটাই শিখতে। এমন অর্ধেক শিখেছো কেন? ওটাকে মাঝখানে হাত দেওয়া বলে না। বলে, মাঝখানে বা'হাত ঢুকিয়ে দেওয়া। বুঝতে পারছো? কেউ যখন কোনো কিছুর মাঝে ইন্টারফেয়ার করে তখন তাকে বলে মাঝখানে বা'হাত ঢুকিয়ে দেওয়া। ওকে? মনে থাকবে? বলতে হলে পুরোটা বলবে। অল্প বলে অপমান করবা না কেমন?’
লুসেফ বিজ্ঞদের মতন মাথা দুলালো। অর্থাৎ সে বুঝেছে। টুইংকেলের এহেন কৃতকর্মে হেসে ফেলল চাঁদনী। মেয়েটার ভিতর কেমন চিত্রা চিত্রা ঘ্রাণ আছে। তেমন চঞ্চল, তেমনই দুষ্টু।
চিত্রার কথা মনে পড়তেই চাঁদনীর মন খারাপ হলো। খুব ইচ্ছে হলো চিত্রার সাথে কথা বলার। এবং সাথে সাথে সে কল দিল চিত্রার ফোনে। যথারীতি কল বাজলো কিন্তু মেয়েটার রেসপন্স নেই। এটাই তো হয়ে আসছে এতগুলো দিন যাবত। কল এলে যে মেয়েটা আকাশ-বাতাস ভুলে ছুটে আসতো, সে মেয়েটার ফোনে আজকাল হাজার খানেক কল এলেও ফিরে তাকায় না। তাদের বোনেদের ভাগ্যেই কি এসব লেখা ছিল?
জুনের এই জব্দ শহরে গরম পড়েছে। তা-ও মাত্রাতিরিক্ত গরম। বাড়িতে কারেন্ট নেই। জেনেরেটরেও সমস্যা হওয়ায় একটা উষ্ণ আবহাওয়া যেন সওদাগর বাড়িতে বিরাজমান। দীর্ঘক্ষণ যাবত মুনিয়া বেগম এক ধারে নিজের মেয়ের দরজায় নক করছেন। কতক্ষণ হবে? চার-পাঁচ মিনিট তো অনায়াসে হয়ে যাবে। চিন্তায় চিন্তায় মৃদু ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। আজকাল মেয়েটা দরজা খুলতে এত দেরি করে! কোনদিন জানি চিন্তায় মায়ের রুহটাই বেরিয়ে যাবে।
গুনে গুনে ছয় মিনিট পর অলস ভঙ্গিতে দরজা খুলল চিত্রা। মুখে আধ মণ ঘাম নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। কপালের সামনের চুল গুলো ঘামে লেপ্টে আছে কপালেই। কাঁধ সমান চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে উশৃংখল ভাবে। চোখ গুলো ফুলে একাকার। এ আর নতুন কী? নিত্য দিনের রুটিন হয়ে গিয়েছে।
মুনিয়া বেগম তপ্ত এক শ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। কপালের চুল গুলো গুছিয়ে দিলেন সস্নেহে। বুকের যতটুকু আহ্লাদ আছে তা যেন ঢেলে দিতে পারলে স্বস্তি পেতেন।
কাঁধের চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘সেই কখন কারেন্ট গিয়েছে। এই গরমে ঘুমিয়ে ছিলিস কীভাবে!’
মূর্তিমান চিত্রার কণ্ঠে উদাস। নেত্রযুগলে ক্লান্তি। অবসাদগ্রস্তের মতন বলল, ‘কারেন্ট নেই?’
মেয়ের প্রশ্নে থেমে গেল মায়ের ব্যস্ত হাত। তাকিয়ে রইল দু'টো চোখ ভূতগ্রস্তের মতন। মুখ ফুটে যেন শব্দ বের হচ্ছিল না। তবুও খানিক কষ্ট করেই বললেন, ‘কারেন্ট যে নেই সেটা তুই টের পাসনি?’
চিত্রা ডানে-বামে মাথা দুলালো নিবিড় ভাবে। যার অর্থ, সে টের পায়নি।
মুনিয়া বেগম মেয়ের এমন অধঃপতনে ক্লান্তির চেয়ে অধিক ক্লান্ত বোধ করলেন। সরল কণ্ঠে বললেন, ‘কালও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ছিলিস?’
চিত্রা আবারও ঘোরগ্রস্তের মতন উপর-নিচে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ, হ্যাঁ।
মুনিয়া বেগম বড়ো ব্যথিত হলেন। উদগ্রীব হয়ে বললেন,
‘এত ঘুমের ওষুধ খেলে বাঁচবি নাতো তুই, মা!’
‘বাঁচতে কে চায়, আম্মু? চাই না তো!’
মায়ের হৃদপিণ্ডের পেশি যেন গতি হারায়৷ সন্তানের এমন করুণ দশায় অসহায় হয়ে উঠে। ধমকে উঠেন তিনি, ‘এগুলো কী বলিস? এসব বলতে নেই মা।’
‘আচ্ছা।’ কী সুন্দর পোষ্য ছানার মতন মায়ের কথায় সায় জানায় মেয়েটা। অথচ এই সায় জানানো যে মুখের বুলি অব্দি তা কি মা জানেন না? জানেন। মনে মনে বিরাট আফসোস করেন। মেয়ের সুষ্ঠ জীবনের প্রার্থনায় মনে মনে মাথা ঠেকেন সৃষ্টিকর্তার দরবারে।
মুনিয়া বেগম ফ্লোরে রাখা টেবিল ফ্যানটা চিত্রার ঘরে দিয়ে আসেন। মেয়েটা নাহয় গরমেই শুয়ে থাকবে। যেতে যেতে বলে যান দরজাটা খোলা যেন থাকে। চিত্রা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দেয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মুনিয়া বেগম বের হওয়ার সাথে সাথে সে দরজা আটকে দেয়। বাহির থেকে ডাক এলেও সাড়া দেয় না। অচঞ্চল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় যায়। এরপর ধীরে ধীরে সোজা, টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে ফ্লোরে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে বিপরীত পাশের রঙচটা দোতালা বাড়িটির দিকে। যে বাড়িটির দরজায় দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময় যাবত একই তালা ঝুলতে ঝুলতে জং ধরেছে তালাটায়। অথচ কিশোরীর প্রেমে কোনো ধরণের নড়চড় হয়নি আজও।
এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ধরে আসে। মেয়েটা পলক অব্দি ফেলে না। রৌদ্র ঝলমলে আকাশের রূপ বদলে মেঘলা হয়ে আসে। তারপর কিছু সময়ের ব্যবধানে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি। একদম অনাকাঙ্ক্ষিত সেই বর্ষণেও নড়ে না চিত্রা। বৃষ্টির ছিঁটে এসে শরীর ভিজে যায় তার। পাশের বারান্দা থেকে মুনিয়া বেগম চেঁচিয়ে ডাকেন মেয়েকে। সাবধান করতে করতে বলেন,
‘মা, তোর ঠান্ডা। উঠে আয় ফ্লোর থেকে। বুকে ঠান্ডা জমে গিয়েছে। আর ঠান্ডা লাগলে নিউমোনিয়া গুরুতর হবে, মা। উঠে আয়।’
চিত্রা মায়ের দিকে না তাকিয়ে হাসে। বিড়বিড় করে বলে, ‘কে বলেছে বুকে ঠান্ডা জমেছে? আমার বুকে গোটা বাহার ভাই আর বিচ্ছেদ জমে আছে, আম্মু। তোমার ডাক্তার প্রেম বুঝে না। ধরিয়ে দিয়েছে কি-না ওষুধ। বোকা ডাক্তার সে! ওষুধ খেলে কখনো প্রেম কিংবা প্রেমিক মুছে যেতে শুনেছো? তোমরা আছো নিউমোনিয়া নিয়ে। এদিকে আমি বিচ্ছেদের জ্বরে জ্বলে যাচ্ছি সেদিকে হুঁশ নেই। হোক আম্মু নিউমোনিয়া, আমায় বৃষ্টিতে ভিজতে দেও আম্মু। বাহার ভাই বৃষ্টি পছন্দ করতেন। আমি তার পছন্দের বৃষ্টিতে ভিজবো না তা কেমন করে হয়?’
মেয়ের বিড়বিড় করে বলা কথা এ বারান্দা অব্দি আসে না। মুনিয়া বেগম ডাকতেই থাকেন অনবরত। সাথে তুহিনও যোগ হয়। কিন্তু চিত্রা শুনলে তো?
সে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। বিড়বিড় করে বলে,
‘বৃষ্টি তুমি তারে ছুঁয়ে দিও আমার হয়ে, তারে জানিও দিও— কী ব্যথা পুষেছি এই হৃদয়ে।’


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


মম সাহা’র গল্প ও উপন্যাস:

  1. যতনে রাখিলাম যাতনা 
  2. প্রেমোত্তাপ 


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা মম সাহা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন