উপন্যাস        :        দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা        :         তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
Bangla Golpo দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা

৩৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৩৭)


(ক)

বাসায় পৌঁছে নিশীথ লম্বা একটা গোসল শেষে বসার ঘরে আসতে আসতে আধা ঘণ্টা খানেক লেগে গেলো। ততক্ষণে বাকি সবাই নাস্তা সেড়ে বিশ্রাম নিতে বসেছে! ইউনুস তালুকদার নাতিকে দেখে হাসিমুখে পাশে জায়গা করে দিয়ে বললেন,
---এখানে বস, দাদুভাই!
নিশীথ গিয়ে দাদুর পাশে বসলো চুপচাপ। ওকে বসতে দেখে আয়মান সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
---খেয়ে নাও, নিশীথ। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।
বাবার কথার বিপরীতে নিশীথ বললো,
---আমারও আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
আয়মান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। যেন উনি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন নিশীথ কিসের কথা বলতে চাইছে সেভাবেই বললেন,
---সব কথা পরে হবে। সারাদিন অফিসে ছিলে, আগে খেয়ে নাও। এরপর বসে ঠাণ্ডা মাথায় সব কথা হবে!
নিশীথ কিছুটা বুঝলো বাবার ইংগিত, তাইতো আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো খেতে। খেতে খেতে আরও একবার ভেবে নিলো কীভাবে কথাবার্তায় এগোনো যায় বাবার সাথে। মনে মনে পরিকল্পনা শেষ হতে হতে খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো। হাত ধুয়ে বসার ঘরে যাওয়ার আগে নিশীথ আসমা বেগমের উদ্দেশ্যে বল্লো,
---মা, আজকে তোমাদের সবার সাথে একটা জরুরি আলাপ আছে। বসার ঘরে এসো!
---বসার ঘরে তো তোর বাপ-চাচা দাদারা বসে কথা বলছে। আমি ওখানে যেয়ে কি করবো, নিশীথ?
---তোমায় আসতে হবে, মা। যে কথাটা বলতে যাচ্ছি আজ সেখানে আমার মা হিসেবে তোমার উপস্থিতিটাও অত্যন্ত প্রয়োজন। এসো আমার সাথে!
আসমা বেগমের হাত ধরে নিশীথ টেনে নিয়ে এলো তাকে বসার ঘরে। ওরা রুমে ঢুকতেই সকলে চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। সবার মনোযোগ নিজের দিকে পেতেই নিশীথ ভাবলো আর দেরি করা উচিত নয়। তাই এবার রাখঢাক না করে ও সরাসরি বললো,
---আপনাদের সবার নিকট আমার একটি আবদার আছে! আমি আশা করছি বরাবরের মতো এবারো আপনারা আমার এই ইচ্ছে পূরণ করবেন।
নিশীথের কথায় আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকে বলেন,
---কি এমন আবদার আছে আমাদের নিশীথের যে এভাবে রিকোয়েস্ট করছিস সবাইকে, হু? তুই কবে থেকে এভাবে কথা বলা শুরু করলি? আগে তো যা মন চাইতো তা সরাসরিই চেয়ে নিতি!
নিশীথ ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
---এ পর্যন্ত যত কিছু চেয়েছি নিজের জন্য তাতে তোমাদের অনুমতি এতটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিলোনা, কারণ তোমরা আমার ওইসব আবদারের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেনা। কিন্তু এবার যা চাচ্ছি, তাতে আমার সাথে তোমরাও ইনডাইরেক্টলি জড়িত।
---তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, নিশীথ। এত ঘুরে পেচিয়ে না বলে সরাসরি বললেই তো পারিস, বাপজান!
আসমা বেগম বিচলিত হয়ে বললেন। তার কথার বিপরীতে নিশীথ বলে,
---মা আমি চাইছিলাম...
---নিশীথ বিয়ে করতে চাইছে। ও চায় আমরা যেন ওর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করি, তাইতো?
নিশীথ পুরো কথা বলতে যাবে এর আগেই ওর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে আয়মান সাহেব কথাটা বলে দিলেন। আসমা বেগম অবাক হয়ে একবার ছেলের দিকে তো একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। নিশীথ মাথা নেড়ে বললো,
---আপনি ঠিক বলেছেন। আমি বিয়ে করতে চাইছি। আমি একজনকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করে এনে আমাদের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করতে চাই। এজন্যই আপনাদের সাথে এসব কথা বলা।
আসমা বেগম বিস্ময়ের সাথে ছেলের মুখের দিক চাইলেন। তার ছেলের পছন্দের মেয়ে আছে অথচ একবারো তাকে জানালোও না? এটা কোনো কথা! কিন্তু এখানে সকলের সামনে নিশীথকে কিছু বললেন না তিনি। বরং, অভিমানি চোখে ছেলের দিক তাকিয়ে রইলেন শুধু। অন্যদিকে আয়মান সাহেব বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে রয়েছেন যেন নিশীথ এমন কিছু বলবে এটা তিনি আগে থেকেই জানতেন, অর্থাৎ তিনি বিন্দুমাত্র অবাক অথবা বিচলিত হননি!
আরেফিন সাহেব আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। আজকেই ভাইকে বলেছিলেন নিশীথের যদি পছন্দের মেয়ে থাকে তবে কি হবে আর সত্যি সত্যিই তার কথা ফলে গেলো! এরই মাঝে আয়মান সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
---তো কে সেই মেয়ে যাকে বিয়ে করতে তুমি এত মরিয়া হয়ে উঠেছো? ডিটেইলস এ বলো শুনি। সবকিছু না জেনেশুনে তো আর বিয়ের মতো ব্যাপারে ফট করেই কিছু বলা যায়না, তাইনা?
আয়মান সাহেবের কথায় নিশীথ একটু অবাক হলো প্রথমে, উনি এত স্বাভাবিকভাবে ওর পছন্দের মেয়েকে দেখতে চাইছেন বিষয়টা পুরোটা হজম হলোনা। তবুও মনে মনে একটু খুশি হলো এই ভেবে যে, ওর বাবা হয়তো এ প্রথম ওর খুশির কথা ভেবে দোলাকে দেখতে চাইছে! তাই ও হাসিমুখে ফোন ঘেটে দোলার ছবি বের করে বাপ-চাচার দিকে মোবাইল তাক করে বললো,
---এই যে! ওর নাম দোলনচাঁপা। দাদু চিনে ওকে। দেখাও হয়েছে দাদুর সাথে এর আগে!
নিশীথ এর হাত থেকে ফোন নিয়ে আয়মান সাহেব চোখ সরু করে ফোনের দিকে তাকালেন। নিশীথের ওয়ালপেপারে হাস্যোজ্জ্বল দোলনচাঁপার সুশ্রী মুখ দেখে মনে মনে খানিকটা মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না! আরেফিন সাহেব ভাইয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে ততক্ষণে দোলাকে দেখে ফেলেছে। উনার দোলাকে পছন্দ হয়েছে এমন ভংগিতে নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,
---মেয়েটা তো ভীষণ মিষ্টি রে, নিশীথ। দেখলে ভাইজান? আমার ভাতিজার পছন্দ আছে বলতে হবে!
চাচুর কথায় নিশীথ গর্বের সহিত ইষত হাসলো। ছোট ছেলের কথায় সায় দিয়ে ইউনুস সাহেব বললেন,
---মেয়েটা যে শুধু দেখতেই মিষ্টি তা নয়, আরিফ। ওর কথাবার্তাও বেশ নম্র। এত ভদ্র একটা মেয়ে! ওকে দেখলেই আমার ভীষণ মায়া লাগে।
আরেফিন সাহেব হাসলেন বাবার কথায়। এদিকে আয়মান সাহেব এখনো থমথমে মুখে বসে থাকায় ইউনুস সাহেব বড়ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
---তোর কি দোলনচাঁপাকে পছন্দ হয়নি, আয়মান? কিছু বলছিস না যে?
---আমার পছন্দ দিয়ে আর কি হবে, বাবা? তোমার নাতি তো নিজেই নিজের জন্য মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে। এখন আমাদের পছন্দ-অপছন্দে আবার কি যায় আসে?
নিশীথের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো বাবার কথা শুনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,
---কি কারণে দোলনচাঁপাকে আপনার পছন্দ হলোনা আমি কি জানতে পারি?
আয়মান সাহেব কিঞ্চিৎ হাসলেন। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। নিশীথের দিক এগিয়ে এসে বললেন,
---তোমার দোলনচাঁপা সম্পর্কে তো এখনো কিছুই জানলাম না যে পছন্দ হবে। ও কি করে, কোথায় পড়ে, কোথায় থাকে, ওর বাবা কি করে এসব না জেনেই কিভাবে পছন্দ করবো বলো?
নিশীথ কিছু একটা বলতে যাবে এর আগেই আয়মান সাহেব হঠাৎ বললেন,
---আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটা আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যাবে কিনা সেটাও দেখতে হবে। বিয়ের মতো সম্পর্ক তো হুট করেই আর করা যায়না তাইনা? তাহলে সবকিছু না জেনে আগেই আমার কেন ওকে পছন্দ করতে হবে?
নিশীথ এবার ক্ষেপে গেলো। বাবার ইংগিত বুঝতে পেরে ও বুঝলো তিনি কি বুঝাইতে চাইছেন! তাই হঠাৎ ও বললো,
---আপনার ছেলের দোলনচাঁপাকে পছন্দ এই একটা কারণই যথেষ্ট হওয়া উচিত ওকে পছন্দ করার জন্য! এটাই আমি মনে করি।
আয়মান সাহেব চমকে উঠলেন। অপরদিকে নাতির কথায় ইউনুস সাহেব হেসে উঠলেন। আরেফিন সাহেবও হাসলেন হালকা। এরা বাপ-ছেলে দুটোই সমান ত্যাড়া। কথায় এদের একেকজনের সাথে পেরে উঠা যাবেনা! এখন দেখা যাক বাপ-ছেলের বাকবিতন্ডার এ পাল্লায় এবার কে জিতে!


(খ)

দোলার মন দুশ্চিন্তায় জরাজীর্ণ। নিশীথ আজকে বাসায় ওর কথা বলবে এটা শোনার পর থেকেই ওর মন বিচলিত হয়ে আছে। সবকিছু ঠিক আছে তো? ওর পরিবার ওদের এই না হওয়া সম্পর্ক মেনে নিবে তো? চিন্তার পাহাড়ে দোলনচাঁপা মূর্ছিত প্রায়। নিশীথকে যে নিজে থেকে ফোন বা মেসেজ দিয়ে খোজ নিবে ওর বাসার অবস্থা সম্পর্কে, সেই সাহসটাও যেন দোলার হচ্ছেনা! এমন সময় ওকে বিরক্ত করতে রুমে প্রবেশ করলো শিমুল। মূলত নিজ রুমে বসে বসে বোর হওয়ায় বোনকে একটু জ্বা'লাতে চলে এসেছিলো রোজকার ন্যায়। কিন্তু বেচারা তো জানতোনা ওর বোনের মেজাজ আজকে অন্যদিনের ন্যায় ভালো নয়। বরং নিশীথের জন্য চিন্তা দোলার শিমুলের প্রতি ক্ষো'ভে পরিণত হয়। বেচারা শিমুল বোনের কড়া ধমকের শি'কার হয়! ফাইজলামি করে পেছন থেকে দোলার লম্বা চুল টানতেই এক সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে দোলা ধমকে উঠে শিমুলকে। ওর প্রতি রাগ দেখাতে চেচিয়ে বলে,
---এসব কি ধরনের ফাইজলামি, শিমুল? চুল কি কোনো খেলার জিনিস? ব্যাথা পাইনি আমি? তুই তো আর ছোট নেই যে বুঝবিনা। খবরদার আর এসব করবিনা আমার সাথে!
বলাবাহুল্য, দোলার এহেন ধমকে শিমুল ভীষণভাবে চমকে উঠে। আরেকটু হলে কেদেই দিতো সে। ওর শান্তশিষ্ট বড়বোনের এমন আচরণ মেনে নিতে না পেরে আহত কণ্ঠে বলে,
---স,সরি দোলাপু। আমি তো তোমায় বিরক্ত করতে এসেছিলাম তাই এমন করেছি। আর কখনো করবোনা!
কথা শেষ করেই শিমুল দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় দোলার রুম থেকে। আদরের ছোটভাইয়ের এমন আহত চোখমুখ দেখে দোলার ভেতরটা ছ্যাত করে উঠে! সে কি করতে যেয়ে কি করে ফেললো! নিশীথের দুশ্চিন্তায় রাগ কিনা ছোট্ট শিমুলের উপর ঝাড়লো? দোলা মনে মনে অনুতপ্ত হয়। ভাবে, এখনি যেয়ে শিমুলের সাথে কথা বলবে। কষ্ট পেয়েছে ওর ভাইটা! এই ভেবে রুম থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় ওর মায়ের সাথে ধাক্কা খায় দোলা। পারভীন বেগম যেন ওর রুমের ভেতরেই আসছিলেন। মেয়েকে ধরে টেনে আনলেন বিছানায়। দোলাকে বসিয়ে নিজেও ওর পাশে বসলেন। দোলা মূর্তির ন্যায় নিচের দিক চেয়ে আছে চুপচাপ। মায়ের দিক তাকানোর ইচ্ছে বা সাহসও যেন নেই এ মুহুর্তে ওর!
কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিক চেয়ে পারভীন বেগম যেন সব বুঝলেন। সেভাবেই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,
---নিশীথের পরিবার মানা করেছে বিয়ের জন্য?
দোলা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো! চোখ দুটো বড় বড় করে বললো,
---মানে? এসব কি বলছো, মা?
পারভীন বেগম ফোস করে শ্বাস ছাড়েন। মেয়ের উদ্দেশ্যে শান্ত গলায় বলেন,
---না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। তোকে দেখে অনেক বেশি ডিস্টার্বড মনে হচ্ছে। যেন তুই কোনোকিছু নিয়ে খুব চিন্তায় আছিস এরকম লাগছে। এজন্যই শিমুলের উপর ওভাবে রাগ ঝাড়লি!
মায়ের কাছে ধরা পড়ে দোলা লজ্জিত হয়। মাথা নিচু করে বলে,
---আমি ওর সাথে ওমন ব্যবহার করতে চাইনি বিশ্বাস করো। আমার যে হঠাৎ কি হয়েছিলো, কিছু একটা নিয়ে ভাবছিলাম এর মাঝে ও হুট করে চুলে টান দেওয়ায় মেজাজ বিগড়ে গেছে আর ঝেড়ে দিয়েছি ওকে। একটুপর ওর সাথে কথা বলে বুঝিয়ে দেবো!
---শিমুলকে না হয় বুঝালি। তুই কবে বুঝবি, দোলন?
---কিসের কথা বলছো, মা? আমি আবার কি বুঝবো?
---তোর কি মনে হয়, এইযে ক'দিন ধরে তুই এমন টেনশন করছিস বারবার ফোনের দিকে তাকাস আবার কারণে-অকারণে রে'গে যাস এসব কেন হচ্ছে আমি বুঝিনা?
মায়ের কথায় দোলা নিশ্চুপ হয়ে যায়। তা দেখে পারভীন বেগম আবারো বলেন,
---তোর এ বয়স আমিও পার করে এসেছি। তুই মুখে যতই বলিস নিশীথের সাথে এ সম্পর্কের ব্যাপারে তোর আগ্রহ নেই কিন্তু মনে মনে যে তুই একটু হলেও নিশীথের প্রতি দূর্বল এটা আমি বেশ ভালো করেই জানি।
দোলা বিস্ময়ে চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকায়। ওর ধরা পড়ে যাওয়া চাহনি দেখে পারভীন বেগম কিছুটা শব্দ করেই হাসলেন। তা দেখে লজ্জায় মেয়েটার গালদুটো ফুলে লাল হয়ে গেলো। পারভীন বেগম মেয়ের গাল টেনে দিয়ে বললেন,
--মা হই তোর। মেয়ের মন যদি না বুঝি তাহলে কার মন বুঝবো শুনি?
দোলা মৃদু হাসলো মায়ের কথায়। লাজুক বদনে মুখ লুকোলো মায়ের কোলে! মেয়েকে এভাবে দেখে আবারো হাসতে হাসতে পারভীন বেগম বললেন,
---ওরে বাবা! তুই যেভাবে লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছিস, এখন তো দেখে মনে হচ্ছে তুই নিশীথের প্রতি একটু নয় বরং অনেক বেশিই দূর্বল হয়ে পড়েছিস!
---মা! থামো তো। কিসব বলা শুরু করেছো?
মায়ের কথা আর নিতে না পেরে দোলা থামিয়ে দেয়। পারভীন বেগমও আর কথা বাড়ান না। তবে তিনি হঠাৎ করেই বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। অন্তত তার মুখভঙ্গি তো তাই বলছে। দোলাও নিরবে মায়ের চেহারার এ পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। শুধালো,
---কিছু বলবে, মা?
পারভীন বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,
---হ্যাঁ, সত্যি বলতে আমি খুশি যে তুই নিশীথকে পছন্দ করা শুরু করেছিস। কারণ আমার নিজেরও ওকে ভালো লাগে। ছেলেটা যেমনই হোক না কেন, তোকে ভীষণ ভালোবাসে। আমি বরাবর এ নিষ্ঠুর দুনিয়ায় তোর দায়িত্ব দেওয়ার মতো এমন কাউকে খুজছিলাম যে স্বেচ্ছায় তোকে ভালোবেসে আমার কাছে তোর হাত চাইবে। নিশীথ ঠিক ওমনই একজন! তাই ওকে মেয়েজামাই হিসেবে আমি সানন্দে স্বীকার করবো। কিন্তু, তোদের সম্পর্কটা মনে হয়না এত সহজ হবে রে, মা!
মায়ের কথায় এতক্ষণ দোলার মুখে মৃদু হাসি থাকলেও পরক্ষণেই ফুটে উঠলো কৌতুহল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুধালো "কেন?"
পারভীন বেগম হতাশ কণ্ঠে বল্লেন,
---আমরা মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির লোকজন, তার মধ্যে মেয়ে পক্ষ। এ সমাজে বিয়ে দিতে গেলে মেয়েপক্ষকে অনেককিছুই করতে হয়, যেসব করার মতো সামর্থ্য আমার সত্যি বলতে নেই। এ কারণেই আমি সবসময় আমাদের মতোন ফ্যামিলির ছেলে খুজতাম তোর জন্য। সেখানে নিশীথের মতো ছেলে তোর জন্য প্রস্তাব দিবে এটা আমার কল্পনাতীত!
দোলা মাথা নিচু করে নেয়। সে এসব জানে, তবুও নির্লজ্জ চোখদুটো ছলছল করে অশ্রুজলে। পারভীন বেগম আবারো বললেন,
---আমার কথায় মন খারাপ করিস না, দোলন। তোর শুনতে খারাপ লাগবে জানি। কিন্তু সামর্থ্য নেই কথাটা এজন্য বললাম কারণ আমাদের পরিবার ও নিশীথদের পরিবারের মাঝে বড়সড় একটা অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে। ঠিক এ কারণেই আমি ভয়টা পাচ্ছিলাম যে নিশীথের পরিবার মানবে কি না? কিন্তু এখন ক'দিন ধরে তোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমার ধারণাই ঠিক। নিশীথের পরিবার রাজি হয়নি তাইনা, দোলন? সত্যি করে বল আমায়!
দোলা বিষন্ন মুখে জবাব দেয়,
---উনি তো বলেছিলেন আজকে আমাদের ব্যাপারে বাসায় কথা বলবেন। এজন্যই একটু টেনশন করছিলাম। তাছাড়া আর কিছুই না। পরিবার রাজি হয়েছে নাকি হয়নি তা তো এখনো রাজি না! মেসেজ, ফোন কিছুই এলোনা তার কাছে থেকে।
পারভীন বেগম এবার বুঝলেন মেয়ের মনের অবস্থা। অথচ ওর শুকনো মুখ দেখে তিনি মনে মনে কত কিই না ভেবে বসেছিলেন এতক্ষণ! এখন দোলার কথায় একটু হলেও যেন আশ্বস্ত হলেন তিনি। তাই মেয়েকে আশ্বাস দিতে বললেন,
---তুই চিন্তা করিস না, দোলন। নিশীথের উপর আমার বিশ্বাস আছে। ওর চোখে আমি তোর প্রতি ভালোবাসা দেখেছি, ওর কথায় ভরসা পেয়েছি। আমার মন বলছে নিশীথ কোনো না কোনোভাবে ওর পরিবারকে রাজি করাবে!
মায়ের কথায় দোলনচাঁপা একটুখানি ভরসা পায়। তবুও মনে কু ডেকে চলেছে, তা থেকে নিস্তার পায়না। মা-কে বলে,
---তোমার কথা যেন সত্যি হয়, মা। আমি এসব নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি। আমার জীবনটা আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দিয়েছি। যদি নিশীথ আমার জন্য সঠিক হন, তবে আমি অবশ্যই তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবো। আর যদি ভাগ্যে না থাকে তবে কি আর করার?
মেয়ের বিচারবুদ্ধিতে পারভীন বেগম বেশ প্রসন্ন হলেন। দোলনচাঁপাকে তিনি পুরোপুরি তার মতোই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সকল পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মানসিকতা আছে ওর মধ্যে। তাই তিনিও আর বিশেষ চিন্তা করলেন না এসব নিয়ে। ভাগ্যে যা আছে দেখা যাবে, এর উপর কি কারো জোর আছে?
______________________
তালুকদার বাড়িতে আলাপ চলছে। উপরতলা হতে নিশীথের চাচিও নেমে এসেছেন। একদিকে নিশীথের মা-চাচি কথা বলছেন, তো অপরদিকে আরেফিন সাহেব ও আয়মান সাহেবের সাথে কথা বলছেন ইউনুস তালুকদার। নিশীথ মহাশয় নিজের বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়ে সোফায় বসে ফোন চাপছে নিজের মতোন। ওর মন চাইছে এখনি দোলাকে ফোন দিতে, ওর সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু নিশীথ ঠিক করেছে যতক্ষণ না ওর পরিবার থেকে কোনো পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত ওকে জানানো হয় ততক্ষণ ও দোলার সাথে কোনো যোগাযোগ করবেনা। এ কারণেই এভাবে দিশেহারার মতো বসে আছে। খানিক বাদে আয়মান সাহেবকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে নিজেও উঠে দাড়ালো।
নিজ থেকেই প্রশ্ন করলো,
---তারপর বলুন, কি ডিসিশন নিলেন আপনারা?
---তোমার প্রশ্নের জবাব আমি তখনই দেবো যখন তুমি আমার একটা সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করবে। বলো, করবে তো?
নিশীথ দ্বিধায় পড়লো। কোন সমস্যা? কিসের সমাধান? এসব কি বলছে তার বাবা? ও দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে শুধালো,
---বলুন! যদি পারি অবশ্যই হেল্প করবো।
আয়মান সাহেব কুটিল হাসলেন। নিশীথের মনে সন্দেহ হলো। ওর মনে হচ্ছেনা ওর বাবা এত সহজেই ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। নিশ্চয়ই তার মনে ভিন্ন কোনো চিন্তাভাবনা চলছে! কিন্তু সেটা কি হতে পারে? ব্যাপারটা সন্দেহজনক!


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৩৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন