উপন্যাস        :        দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা        :         তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
Bangla Golpo দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা

৫১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৫২)


(ক)

দোলা চুপচাপ বসে ছিলো রুমে। এরই মাঝে নিশীথ ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে বললো,
---ব্যাগ গুছানো শুরু করে দাও।
স্বাভাবিকভাবেই দোলা চমকে গেলো। নিশীথের কথার সারমর্ম ধরতে পারলোনা তৎক্ষণাত! ও অবাক স্বরে বললো,
---কোথাও যাচ্ছি আমরা?
---হুম। কাপড়গুলো গুছানো শুরু করো। তোমার জুয়েলারি থেকে শুরু করে ইম্পর্ট্যান্ট যা যা আছে সব তুলে নিবে। কিছুই বাদ পড়েনা যেন!
---আচ্ছা। ক'দিনের জন্য যাচ্ছি আমরা?
---জানিনা!
নিশীথ শান্তভাবে জবাব দিলো। এবার দোলা আরেক দফা চমকালো। নিশীথের অঙ্গভঙ্গি এবং কথাবার্তার গাম্ভীর্যতা বলছে, ও এখন অত্যন্ত সিরিয়াস মুডে আছে। তাই এখন হেয়ালি করে কোনোকিছু বলার কথা না। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে না জানা অব্দি মেয়েটাত ভাত হজম হবেনা! তাই দোলা এবার খাট থেকে উঠে এগিয়ে গেলো। নিশীথের হাত ধরে বললো,
---এভাবে কথা বলছেন কেন? আর কোথায় যাচ্ছি আমরা? একটু ক্লিয়ার করে বলেন না! আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
নিশীথ তাকালো দোলার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েই রইলো স্ত্রীর দিকে। দোলাও জবাবের আশায় ধৈর্য সহকারে চাইলো ততক্ষণ। নিশীথ দোলার ধরে রাখা হাত৷ আরেকটু শক্ত করে ধরে বললো,
---আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, দোলনচাঁপা!
বিস্ময়ের প্রকোপে দোলার অক্ষিজোড়া বড় বড় হয়ে এলো! ঘটনার আকস্মিকতায় কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত ও যেন ভুলে গেলো! একিসাথে নিশীথের হাত ধরে রাখা ওর হাতটাও খানিকটা শিথিল হয়ে এলো! নিশীথ সেদিকে খেয়াল করলো। এক মুহুর্তের জন্য ওর মস্তিষ্কে ভয় ঢুকলো। দোলা কি তবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনে ওর সাথে যেতে রাজি নয়?
নিশীথের কপালে ভাজ পড়লো। ও জানে মনের প্রশ্ন ভেতরে রাখলে ভুল বুঝাবুঝি বাড়ে, আর এখন ও দুজনের মাঝে কোনোরুপ ভুল-বোঝাবুঝি চায়না। তাই নিশীথ মনের প্রশ্ন মনে রাখলোনা। দোলাকে দ্বিধাহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
---কি হলো? তুমি কি আমার এ সিদ্ধান্তে রাজি নও?
দোলা এতক্ষণ নিজেকে ধাতস্থ করছিলো, নিশীথ হঠাৎ করেই কেন এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাবছিলো। এর মাঝেই নিশীথের এ প্রশ্ন শুনে ও তাকায়। জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
---আপনি যদি পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন আমি কেন রাজি হবোনা? আমি তো ভাবছি আপনি হঠাৎ কেন এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন!
দোলা রাজি শুনে নিশীথ একটু নিশ্চিত হলো। এতক্ষণ ভেতরে চেপে রাখা দম ফেললো! দোলার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বললো,
---একটু আগে এ বাসায় তোমার সাথে কি কি হলো সব এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে?
অপমানের কথা মনে হতেই দোলা মাথা নিচু করলো। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে প্রশ্ন এলো, নিশীথ কি তবে ওর জন্য নিজের পরিবার থেকে দূরে হয়ে যাচ্ছে? আয়মান সাহেব তাহলে সত্যি কথাই বলেছিলেন? অনুশোচনা বোধে দোলার অন্তর হিম হয়ে এলো। ও এগিয়ে এসে আবারো নিশীথের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
---আপনি আমার জন্য এ বাসা ছেড়ে দিবেন? একবার মা-র কথা, দাদুর কথা ভাবলেন না? আপনি বাড়ি ছেড়ে দিলে তারা কতটা কষ্ট পাবে?
---আমি সবই ভেবে দেখেছি, দোলনচাঁপা। এ বাসায় আমরা থাকলে সবাই খুশি থাকবে, তুমি বাদে। কারণ আজ নয়তো কাল খালামনির মতো মেন্টালিটির কেউ না কেউ আসবে আর তারা এসে হয়তো তোমায় কোনো না কোনো ভাবে অপমান করার চেষ্টা করবে। আর দেখা যাবে, আমার বাবাও আজকের মতো সানন্দে তাদের সাথে যোগ দিবে। ওটা আমি মোটেও সহ্য করতে পারবোনা! তাই সময় থাকতে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। অন্তত এসব অশান্তি থেকে দূরে চলে যাবে!
দোলার চোখে পানি এলো নিশীথের কথায়। এটা সত্যি যে এ বাসায় থাকলে হয়তো ভবিষ্যতেও ওকে আজকের মতো অপমানিত হওয়ার সুযোগ আসতে পারে। কিন্তু লোকে কি বলবে? সবাই তো এখানেও দোলাকেই দোষ দিবে! বলবে, ওর জন্যই নিশীথ বাড়ি ছেড়েছে। ঘরের ছেলে তাদের থেকে দূরে চলে গেছে। লজ্জায় দোলার মন ভার হয়ে আসে! এদিকে ওর চোখে পানি দেখে নিশীথ হাত উঠিয়ে তা মুছে দেয়। সন্দিহান হয়ে শুধায়,
---কি হলো? তুমি রাজি থাকলে চোখে পানি কেন?
দোলা এবার নিজেকে ধরে রাখেনা। বহুকষ্টে এতক্ষণ চেপে রাখা অশ্রুগুলোকে আর আটকাতে পারেনা। নিশীথকে সম্বল মেনে ওকে জড়িয়ে ধরে তৎক্ষণাত। প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কাদতে থাকে। নিশীথ দোলাকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। যতক্ষণ না ফোপানো থামে, ততক্ষণ দু'হাতে আগলে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করে মেয়েটাকে। দোলা একটু থেমে বলে,
---আপনি যে কারণে আমায় এ বাসা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছেন, লোকে ঠিক সে কারণেই আমায় আবার দোষ দিবে!
---মানে?
নিশীথ দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠে শুধায়।
---দেখবেন, আমরা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সবাই বলবে আমিই আপনাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছি। আমার কথাতেই আপনি পরিবার থেকে আলাদা হচ্ছেন। তখন সবার নজরে আমি খারাপ হয়ে যাবো! তাহলে কি বাড়ি ছেড়ে লাভ আছে?
---তুমি কি এখন সবার নজরে ভালো? নাকি এখনো ওরা তোমাকেই দোষ দেয় আমায় ফাসিয়ে বিয়ে করার দায়ে? যে বাসায় থেকে রোজ রোজ অশান্তি করতে হয়, সেখানে থেকেও কি আদৌ লাভ আছে?
নিশীথের পাল্টা প্রশ্নে দোলা নিরব রয়। নিশীথের কথায় যুক্তি আছে ঠিকি কিন্তু দোলার মনে তখনো ভয়। নিশীথ যেন সবটা বুঝলো। বললো,
---যেখানে থেকে মানসিক অশান্তিতে থাকতে হয় সেখানে অন্তত ভালোভাবে সংসার করা যায়না, দোলনচাঁপা। আজ হয়তো তুমি আমি একা, দুজনে কোনোভাবে থাকলাম এখানে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের বাচ্চা হলে, এমন পরিবেশ চেঞ্জ না হলে ও একটা আনহেলদি পরিবেশে বড় হবে। যা আমি চাইনা। কারণ, যে বাসায় রোজ রোজ অশান্তি হয়, সে পরিবারে বেড়ে উঠা মানসিকভাবে কতটা কষ্টদায়ক সে অনুভূতি আমি জানি! আমি আবেগের বশে এ সিদ্ধান্ত নেইনি। ঠান্ডা মাথায় অনেক ভেবে তারপরেই নিয়েছি।
নিশীথের এত কথার জবাবে দোলার বলার মতো কিছু রইলোনা। আবার নিশীথের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে ও মনে মনে বেশ লজ্জায় পেলো। কিন্তু ও তো এতদূর ভাবেনি! দোলা তো শুধু নিশীথের কথাই ভেবেছে। ওর সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যাস আছে, নিশীথের তো নেই। ও কি পারবে সারজীবনের লাক্সারিয়াস লাইফস্টাইল ছেড়ে হুট করে আর দুটো সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মতো করে সংসার করতে?
দোলাকে চুপ থাকতে দেখে নিশীথ ওর বাহু ধরে ঝাকায়। দোলা তাকাতেই চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে, "কি ভাবছো?"
দোলা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
---আপনার ভীষণ কষ্ট হবে, নিশীথ। আমি আপনার জন্যই বলছিলাম এতক্ষণ। আমার কিন্তু বাড়ি ছাড়লেও কষ্ট হবেনা, কারণ আমি সবসময় এমন জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনি বুদ্ধি হবার পর থেকেই মা-বাবার আহ্লাদে বড় হয়েছেন। কোনো জিনিস দুইবার চাওয়ার আগেই চোখের সামনে হাজির পেয়েছেন। কোনো শখ আহ্লাদ অপূর্ণ থাকেনি আপনার। তবে যে জীবনে আপনি যেতে চাচ্ছেন, সেখানে কিন্তু এমন হয়না! আমরা মধ্যবিত্তরা ভীষণ হিসেব করে চলি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শখ সবসময় পূরণ করার মতো পরিস্থিতি আমাদের হাতে থাকেনা অনেকসময়। এজন্যই বারবার বলছি। কারণ, এমন জীবনে অভ্যস্ত হতে আপনার জন্য ভীষণ কষ্ট হবে!
দোলার কথায় যুক্তি থাকলেও নিশীথ হঠাৎ রে'গে যায়। ফোস করে উঠে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
---শা'লার কপাল আমার! যার জন্য করলাম চুরি, সেই বলছে চো'র!
দোলা ভ্রু কুচকে তাকাতেই ও বলে,
---তোমার আর বাবার কথার মধ্যে তো তাহলে কোনো ডিফারেন্সই থাকলোনা, দোলনচাঁপা! তুমি আমায় যেগুলো বললে, উনিও ঠিক এগুলোই বলেছেন। সাথে কি বলেছেন জানো? অভাবে পড়লে নাকি আমাদের ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালাবে! কিন্তু আমি তার কথায় বিশ্বাস করিনি। আমি তোমার উপর, আমাদের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করেই নিজের কম্ফোর্ট জোনের বাইরে যেয়ে তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তুমিই আমার উপর সন্দেহ করছো, তাহলে আমি কার জন্য এত বড় সিদ্ধান্ত নিলাম? কার উপর বিশ্বাস করা উচিত হবে? তুমিই বলে দাও শুনি।
দোলা মাথা চাপড়ায়। এ কেমন বিপদ রে বাবা? ও যা-ই বুঝাতে চাইছে, নিশীথ উল্টো বুঝে ছ্যা'ত করে উঠছে। এ রগচটা ছেলেটাকে নিয়ে ও কই যাবে?


(খ)

নিশীথের জিদের সামনে দোলাকে হার মানতে হলো। দুজনেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। নিশীথের মা এ বিষয়টি জানার সাথে সাথে পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। একটাই ছেলে তার কাছে আছে, সে-ও দূরে থাকবে এটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। নিশীথ অনেকক্ষণ ধরে মায়ের শিওরে বসে আস্তেধীরে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আসমা বেগম কোনোকিছু মানতে নারাজ। উনি ছেলেকে যেতে দেবেন না, মানে দেবেন না!
---আমি তোকে আশ্বাস দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর কেউ কখনো তোর বউয়ের সাথে খারাপ আচরণ করবেনা। তবু তুই এ বাসা ছেড়ে যাসনা, নিশু! আমি তোকে যেতে দিবোনা!
---আমাকে যে যেতেই হবে, মা। তোমার স্বামী ও বোন যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় রাখেনি আর!
---বাবার কথা কেউ গায়ে লাগায়? একটু না হয় রাগ করে কিছু বলেছেন। আমাকেও তো কতকিছুই বলেন। আমি কি কখনো বাড়ি ছেড়েছি? তুই কেন ছাড়ছিস তবে? তুই কোত্থাও যাবিনা। না মানে না। তোকে আমার কস...
---মা! এমন কোনো কসম আমায় দিয়োনা যা আমি পূরণ করতে পারবোনা! তুমি কি জানো, বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার যতটা না খারাপ লাগছে তার চেয়েও বহুগুণ কষ্ট লাগছে তোমার এ অবস্থা দেখে! প্লিজ নিজেকে সামলাও! আর একটা সত্যি কথা বলি? কিছু মনে করোনা। আমি তোমার জন্য প্রতিবাদ করলেও, তুমি সবসময় বাবার খারাপ আচরণকে প্রশ্রয় দিয়েছো বলেই উনি বারবার তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে আশকারা পেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছি সেটা। আমার সবসময় মনে হতো যদি সময় থাকতেই তুমি নিজে থেকে প্রতিবাদ করতে তবে হয়তো সময়ের সাথে উনার আচরণও বদলে যেতো! কিন্তু আমি ছেলে হয়ে তো আর তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কথা বলতে পারিনা তাই চুপ করে থাকতাম এতদিন। কিন্তু প্রসঙ্গ এবার আমার বউয়ের। আমি এ বাসায় থেকে দোলার অপমান হতে দিতে পারিনা, মা! আমার দিক থেকে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ!
---কিন্তু নিশীথ.. তুই চলে গেলে আমি কিভাবে থাকবো? আমাকেও নিয়ে যা তোর সাথে!
মায়ের সরলতায় নিশীথ হাসে! মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে তাতে চুমু খেয়ে বলে,
---এখন তোমার ছেলে খালিহাতে বাড়ি ছাড়ছে, মা। তাই চাইলেও তোমায় সঙ্গে নিতে পারছেনা। আগে নিজেদের থাকার মতো অবস্থান তৈরি করি, আল্লাহ সামর্থ্য দিক তখন যত দ্রুত সম্ভব এসে তোমায় নিয়ে যাবো! তাছাড়াও এখানে দাদু আছে, আমি চলে গেলে তুমি ছাড়া আর কে আমার বুড়োর খেয়াল রাখতে পারবে বলো?
নিশীথ নিজের কথায় অটল রইলো। অতঃপর বহুকষ্টে মা-কে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে নিজের দিকটা বুঝিয়ে কতক উপায় অবলম্বন করে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলো। এসবের মাঝে দোলনচাঁপা দূর থেকে তাদের মা-ছেলেকে দেখে গেলো শুধু৷ ওর নিজেরও খারাপ লাগছে আসমা বেগমকে এভাবে কাদতে দেখে, ও এটাও জানে যে নিশীথের অবশ্যই ওর চেয়েও হাজারগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে এভাবে নিজের আপনজনদের ছেড়ে চলে যেতে। বিশেষ করে মা ও দাদু নিশীথের বড়ই আপন। তাদের ছাড়া জীবন ও কল্পনাও করেনি কখনো। এজন্যই তো বড়ভাই বিদেশ যাওয়া সত্ত্বেও ও দেশেই থেকে গেলো। শুধুমাত্র মা ও দাদুর খাতিরে। আর আজকে ভাগ্যের নির্মম পরিণতি ওকে বাধ্য করলো এ বাড়ি ছাড়তে!
দাদু বেশ বিচক্ষণ মানুষ। উনি হয়তো আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন এমন কোনো পরিস্থিতি আসবে, যে কারণে তাকে আসমা বেগমের মতো অতটা বিচলিত হতে দেখা গেলোনা। উল্টো উনি শুধু রিক্ত চোখে বললেন,
---কোনোভাবে কি এখানে থাকা যায়না, দাদুভাই?
দাদুর কথায় নিশীথ মাথা নিচু করলো। দাদুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
---যদি আমার পক্ষে সম্ভব হতো তবে কি কখনো তোমায় এ বয়সে একা রেখে চলে যেতাম, বুড়ো?
দাদু নিশীথের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। নিশীথ চোখ বন্ধ করে বললো,
---দোলার মা-কে কথা দিয়েছিলাম তার মেয়ের কোনোরুপ অসম্মান হতে দেবোনা। তবে নিজের কথার বরখেলাপ কিভাবে করি, দাদু? আমরা তালুকদার, আমাদের জবানের দাম আছে তুমিই তো শিখিয়েছিলে! তোমার শিক্ষা কি করে ভুলি বলো?
দাদু যেন সবটা বুঝলেন সেভাবে মাথা নাড়লেন। বৃদ্ধার চোখদুটোও পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো! নিশীথের মাথায় হাত রেখে বললেন,
---তোকে ন্যায় ও মনুষ্যত্বের সঠিক শিক্ষা দিতে পেরে আমি ধন্য, দাদুভাই। যা তবে আল্লাহর নাম নিয়ে এ যেখানে যাচ্ছিস যা! কোথায় যাবি ঠিক করেছিস? এত জলদি তো বাসাও পাবিনা কোনো। আমাদের কলাবাগানের যে ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে ওখানে থাকবি? এখনো ভাড়া হয়নি ওটা। এসিও আছে, সব আছে। তোদের সুবিধা হবে!
দাদুর কথায় নিশীথ হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,
---ওই ফ্ল্যাটটা এখনো আমার নামে হয়নি গো, দাদু
ওটা তোমার ছেলের নামে আছে। আর আমি আপাতত তার নামের কোনো জিনিস গ্রহণ করতে চাইছিনা। এখন আমাকে এসব বলে কষ্ট দিওনা প্লিজ! বাসা নিয়ে চিন্তা করোনা। তুমি আকাশকে চেনোনা আমার বন্ধু? ওদের বাড়ির তিনতলা খালি হয়েছে এ মাসে। ভাড়া খুজছে ওরা। আমি ওকে বলবো ভেবেছি। তাই বাড়ি নিয়ে চিন্তা করছিনা আপাতত। লোকেশন এখান থেকে কাছেই আছে। তোমরা যেতে পারবে প্রায় প্রায়ই। আর আমি ভাবছিলাম আমাদের অফিস থেকেও রিজাইন নিয়ে অন্য কোথাও সিভি....
---নিশীথ! আর একটা কথাও বলবিনা।
নিশীথকে থামিয়ে দিয়ে দাদু ধমকে বললেন। নিশীথ বিস্মিত হয়ে তাকাতেই আবারো শুরু করলেন,
---বাসা নিয়ে তোর যেখানে ইচ্ছা যা আমি কিছু বলবোনা কিন্তু খবরদার যদি আমাদের বিজনেস ছেড়ে অন্যের অফিসে চাকরি করেছিস তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।
---কিন্তু দাদু আমি...
---তুই কি হ্যাঁ? এত কষ্ট করে তোকে ভালো ভালো জায়গা থেকে পড়িয়েছি অন্যের কোম্পানিতে তোর মেধা কাজে লাগানোর জন্য? বাপের সাথে তোর পারসোনাল লাইফে যাই হোক না কেন, অফিসে তোদের সম্পর্ক প্রফেশনাল। পারসোনাল সম্পর্কের জন্য প্রফেশনাল জায়গায় কেন লস করবি? নিশান দেশে থাকলেও এক কথা ছিলো। ও যেহেতু নাই, এখন তো তুই আমাদের এ ব্যবসার উত্তরসূরী। তবে কেন অযথা মানুষের কোম্পানিতে নিজের মেধা ব্যবহার করবি?
দাদুর যুক্তিতর্কে নিশীথ এবার হার মানলো। ও কিছু বলতে পারলোনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে দাদুর বক্তব্য মেনে নিলো। ইউনুস সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন! যাক একটা দিকে তো নাতিকে রাজি করাতে পেরেছেন! এদিকে দরজার পেছন থেকে সবার আড়ালে একজন ব্যক্তি এসব কথাবার্তা শুনছিলো। উনি হচ্ছেন আয়মান সাহেব। করুন চোখে নিশীথ ও ইউনুস সাহেবের কথা শুনছিলেন তিনি। বরং এতক্ষণ এখানে যা যা কথা হলো কোনোটাই তার অজ্ঞাতে হয়নি। উনি শুরু থেকেই উপস্থিত ছিলেন এবং সবটাই শুনছিলেন , যা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও খেয়াল করলো দোলনচাঁপা। ও তাকাতেই আয়মান সাহেব ভড়কে গেলেন, দ্রুত পায়ে দরজার পেছন থেকেই নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করলেন। তাকে চলে যেতে দেখে দোলা বড় করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো! পরিবারের এ টালমাটাল দেখে দুই চোখ বারবার জলে টইটম্বুর হচ্ছে ওর। এক সময় চোখের পাতা বেয়ে সে জল গালের উপর গড়িয়ে পড়লো।
তবু অশ্রুসিক্ত দোলা পুরোটা সময় শুধু একধ্যানে নিশীথের দিকেই চেয়ে রইলো। ও জানে এ মানুষটা শুধুমাত্র ওর আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে নিজের স্বার্থের বাইরে যেয়ে, নিজের সাজানো গোছানো পরিবার ও বিলাসবহুল জীবন ছাড়তে রাজি হয়েছে। এতকিছু এর আগে কেউ কখনো করেনি দোলার জন্য। নিশীথের এ কাজ দোলার কাছে যেমন ভাবনাতীত, ঠিক তেমনি ওর চোখে, ওর অন্তরে নিশীথের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা হাজারগুণে বৃদ্ধি পেলো! দোলার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই নিশীথ সবাইকে রেখে ওর দিকে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে দোলার গালে বেয়ে পড়া পানি মুছে দিলো তো বটেই, একিসাথে শক্ত করে ওর হাত ধরে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। বাড়ি ছাড়ার সব প্রস্তুতি শেষের দিকেই প্রায়। এবার শুধু বাড়ি থেকে বের হবার পালা!


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৫৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন