উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। আজ প্রকাশিত হলো 'শরম' উপন্যাসের ৫ম পর্ব।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ০৫)
- আর তুমি?
- আমি এখানে বসি। আমার জন্য একটুও ভাববেন না। আমাকে সঙ্গ দেবার আতিথেয়তা করার কিন্তু একটুও দরকার নেই।
- তোমার কি কিছু বলার আছে? তুমি খামোকা বসে থাকবে কেন? কিছু বলার থাকলে বল।
- না আমার কিছু বলার নেই।
- তাহলে?
- তাহলে বসে থাকবো কেন, তা তো জানতে চাইছেন?
আমি কোনও উত্তর দিই না। মাথা নাড়ি না।
সুরঞ্জন বলে, আমার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে। - বসে থাকতে চাইছি, কারণ আপনাকে আমার খুব আপন বলে মনে হয়।
তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে খুব আপন মনে হয়, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, এ ধরনের বাক্য শুধু মনের ওপর নয়, গায়ের ওপরও একধরনের চাপ সৃষ্টি করে। কথাটা শোনার পর আমার গা টা কেমন শিথিল হয়ে আসে। যেন শক্তি ফুরিয়ে গেছে। ওই চেয়ার থেকে উঠতেও আমার খানিকটা সময় লাগে। মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছে। কী জানি ঠিক জানি না কেন ওই বাক্যটি আমাকে ভালো লাগা দিয়েছে। সম্ভবত এভাবে কেউ কখনও বলেনি বলে। আপন বলতে কটা মানুষই বা আমার আছে! যাদের আপন ভাবি, তারা তো আসলে কেউই আমাকে আপন ভাবে না। দূর বিদেশে এক বোন থাকে, অসুখ বিসুখ হলে, মন খারাপ হলে আমার খোঁজ করে। তা ছাড়া দেশভর্তি এত আত্মীয়স্বজন, এত বন্ধু, কেউ কোনওদিন এত কাছে থাকি, পাশের দেশে, দেখতে আসে না। বেঁচে আছি কী মরে গেছি এই খবরটাও কেউ নেয় না সুতরাং সুরঞ্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও ওর এই বাক্যটি আমাকে অদ্ভুত এক আনন্দ দেয়। কেউ আমাকে আপন ভাবছে। কাউকে আপন ভাবার চল এই বস্তুবাদী আত্মমুখী সমাজে নেই বললেই চলে। এখানে লোকে অন্যের প্রতি যে কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করে সেগুলোকেই আমরা ধরে নিই যে আপন মানুষের জন্য ভালোবেসে কিছু করা। সম্ভবত ভালোবেসে তার কিছুই করা হয় না। না করে উপায় নেই বলে করা।
সুরঞ্জনকে একটি ঘর দেখিয়ে দিই, শোবার ঘরটিই দিই, বিশ্রাম নিতে। সুজাতাকে বলে দিই, ওর চা টা কিছু দরকার হলে দিতে। নিজে স্টাডির বিছানায় একটি বই নিয়ে শুয়ে পড়ি। ইচ্ছে বইটা পড়বো। কিন্তু কয়েক পাতা পড়া হয়ে যাবার পর আমি বুঝতে পারি যে আমি আসলে পড়ে যাচ্ছি, প্রতিটি শব্দই আমি দেখে দেখে পড়ছি, কিন্তু এই পড়ার নাম সত্যিকার পড়া নয়। কারণ সবই আমার চোখের পড়া, মাথায় তিলতমও কিছু ঢোকেনি। মাথায় ঢোকেনি বলে আমি জানি না কী পড়লাম এতক্ষণ। কিন্তু কেন মাথায় ঢোকাচ্ছি না! মন কোথায়? মন সুরঞ্জনে। ছেলেটার ওপর আমার রাগ হয় খুব, কিন্তু এও ঠিক, ওকে খুব আপন মানুষ বলে আমার মনে হয়। একটা মানুষ যাকে আমি চিনি না, বেশি জানি না, সামান্য দেখা, অতি সামান্যই কথা, তাকে কেন আপন মনে হবে, এই রহস্যেরও আমি কোনও কিনারা করতে পারি না। কী সহজে নিজের শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম প্রায় অচেনা একটি ছেলেকে! আমার বিশ্বাস ও আমার কোনও ক্ষতি করবে না। যদি করে কিছু সে অপকার নয়, উপকারই।
- তোমার কি কিছু বলার আছে? তুমি খামোকা বসে থাকবে কেন? কিছু বলার থাকলে বল।
- না আমার কিছু বলার নেই।
- তাহলে?
- তাহলে বসে থাকবো কেন, তা তো জানতে চাইছেন?
আমি কোনও উত্তর দিই না। মাথা নাড়ি না।
সুরঞ্জন বলে, আমার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে। - বসে থাকতে চাইছি, কারণ আপনাকে আমার খুব আপন বলে মনে হয়।
তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে খুব আপন মনে হয়, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, এ ধরনের বাক্য শুধু মনের ওপর নয়, গায়ের ওপরও একধরনের চাপ সৃষ্টি করে। কথাটা শোনার পর আমার গা টা কেমন শিথিল হয়ে আসে। যেন শক্তি ফুরিয়ে গেছে। ওই চেয়ার থেকে উঠতেও আমার খানিকটা সময় লাগে। মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছে। কী জানি ঠিক জানি না কেন ওই বাক্যটি আমাকে ভালো লাগা দিয়েছে। সম্ভবত এভাবে কেউ কখনও বলেনি বলে। আপন বলতে কটা মানুষই বা আমার আছে! যাদের আপন ভাবি, তারা তো আসলে কেউই আমাকে আপন ভাবে না। দূর বিদেশে এক বোন থাকে, অসুখ বিসুখ হলে, মন খারাপ হলে আমার খোঁজ করে। তা ছাড়া দেশভর্তি এত আত্মীয়স্বজন, এত বন্ধু, কেউ কোনওদিন এত কাছে থাকি, পাশের দেশে, দেখতে আসে না। বেঁচে আছি কী মরে গেছি এই খবরটাও কেউ নেয় না সুতরাং সুরঞ্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও ওর এই বাক্যটি আমাকে অদ্ভুত এক আনন্দ দেয়। কেউ আমাকে আপন ভাবছে। কাউকে আপন ভাবার চল এই বস্তুবাদী আত্মমুখী সমাজে নেই বললেই চলে। এখানে লোকে অন্যের প্রতি যে কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করে সেগুলোকেই আমরা ধরে নিই যে আপন মানুষের জন্য ভালোবেসে কিছু করা। সম্ভবত ভালোবেসে তার কিছুই করা হয় না। না করে উপায় নেই বলে করা।
সুরঞ্জনকে একটি ঘর দেখিয়ে দিই, শোবার ঘরটিই দিই, বিশ্রাম নিতে। সুজাতাকে বলে দিই, ওর চা টা কিছু দরকার হলে দিতে। নিজে স্টাডির বিছানায় একটি বই নিয়ে শুয়ে পড়ি। ইচ্ছে বইটা পড়বো। কিন্তু কয়েক পাতা পড়া হয়ে যাবার পর আমি বুঝতে পারি যে আমি আসলে পড়ে যাচ্ছি, প্রতিটি শব্দই আমি দেখে দেখে পড়ছি, কিন্তু এই পড়ার নাম সত্যিকার পড়া নয়। কারণ সবই আমার চোখের পড়া, মাথায় তিলতমও কিছু ঢোকেনি। মাথায় ঢোকেনি বলে আমি জানি না কী পড়লাম এতক্ষণ। কিন্তু কেন মাথায় ঢোকাচ্ছি না! মন কোথায়? মন সুরঞ্জনে। ছেলেটার ওপর আমার রাগ হয় খুব, কিন্তু এও ঠিক, ওকে খুব আপন মানুষ বলে আমার মনে হয়। একটা মানুষ যাকে আমি চিনি না, বেশি জানি না, সামান্য দেখা, অতি সামান্যই কথা, তাকে কেন আপন মনে হবে, এই রহস্যেরও আমি কোনও কিনারা করতে পারি না। কী সহজে নিজের শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম প্রায় অচেনা একটি ছেলেকে! আমার বিশ্বাস ও আমার কোনও ক্ষতি করবে না। যদি করে কিছু সে অপকার নয়, উপকারই।
পাঁচটার দিকে এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে অর্থাৎ সুরঞ্জনকে পৌঁছে দিতে এবং কিরণময়ীর সঙ্গে দেখা করতে যাই জাননগরের গলিতে। আমি তো কলকাতায় বেরোলে পাঁচজনের এক পুলিশ বাহিনী যায় সঙ্গে। আর কলকাতার বাইরে হলে, সামনে প্যাঁ পুঁ করে পোশাক পরা পুলিশ বাহিনী ছোটে। পেছনে সবসময়ই থাকে একটা এসকর্ট কার, এসকর্ট কারে চারজন, আর আমার গাড়িতে বসেন একজন পিএসও, ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তারা, পার্ক সার্কাসে যাবো শুনে আপত্তি করলেন। কেন? মুসলিম এলাকায় যাওয়া আমার জন্য নিরাপদ নয়। মৌলবাদীরা আমাকে যে কোনও মুহূর্তে কতল করতে পারে। আমি তাদের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে বললাম, ... ধুৎ কিচ্ছু হবে না।
- কিচ্ছু হবে না মানে? যে কোনও সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। পুলিশ অফিসার বললেন।
- যে কোনও জায়গাতেই তা হতে পারে। তার জন্য পার্ক সার্কাসের দরকার হয় না। আর কেউ ওখানে কি দাঁড়িয়ে আছে নাকি আমাকে মারার জন্য। আর যদি তাই হয়, আপনারা তো আছেন। আমার তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একা তো যাচ্ছি না আমি।
পুলিশ চুপ হয়ে রইলো। আমি বললাম, - আর তাছাড়া, আমাকে যেতেই হবে।
হ্যাঁ যেতেই হবে কিরণময়ীর বাড়ি। কলকাতায় এসে এমন গলিতে এর আগে যাইনি কখনও। গ্রেট মেডিকেল স্টোরস, হোটেল শান এ ফেরদৌস, ইন্ডিয়ান সাইকেল স্টেট, জগন্নাথ জুয়েলার্সের গলির মধ্যে গাড়ি যদি দাঁড়ায়, দ্বিতীয় কোনও গাড়ি কেন, কোনও রিকশাও পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না, এমন অপ্রশস্ত। বিবর্ণ ঘরদুয়োর। ঘরে অসচ্ছলতা থিকথিক করছে। রাস্তার কিনারে আবর্জনার স্তূপ। নর্দমা হ্যাঁ করে আছে তার সব নোংরা মুখে নিয়ে। স্যাঁতসেঁতে গলিতে ঢুকে গা ছমছম করে আমার। ভূতুড়ে ভূতুড়ে চারদিক।
কিরণময়ী আমাকে দেখে ছুটে এসে আলিঙ্গন করলেন। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন আর ক্রমাগতই বলতে লাগলেন, -মা গো, তুমি কেমন আছো গো মা, মা গো তুমি ভালো আছ তো মা, মা গো তোমার কথা ভেবে ভেবে কত কষ্টে থাকি মা। মা গো তুমি এতদিন পরে এলে মা। যখন তাকে আলতো করে ছাড়িয়ে নিলাম, দেখি চোখে জল তার। আমার জন্য কারও চোখে জল? আমার মার ছাড়া আমি আর কাউকে দেখিনি। সারা গা আবারও শিথিল হতে থাকে। মন অস্থির। এ ঠিক এমন নয় যে ভালোবাসা পেয়ে আমার অভ্যেস নেই। প্রায় প্রতিদিনই কত মানুষ আমাকে উজাড় করে ভালোবাসা দিচ্ছে। লেখা পড়ে সাহস বা সততা দেখে তারা ভালোবাসে আমাকে। প্রতিদিনই গ্রহণ করেছি সে সব।
হ্যাঁ যেতেই হবে কিরণময়ীর বাড়ি। কলকাতায় এসে এমন গলিতে এর আগে যাইনি কখনও। গ্রেট মেডিকেল স্টোরস, হোটেল শান এ ফেরদৌস, ইন্ডিয়ান সাইকেল স্টেট, জগন্নাথ জুয়েলার্সের গলির মধ্যে গাড়ি যদি দাঁড়ায়, দ্বিতীয় কোনও গাড়ি কেন, কোনও রিকশাও পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না, এমন অপ্রশস্ত। বিবর্ণ ঘরদুয়োর। ঘরে অসচ্ছলতা থিকথিক করছে। রাস্তার কিনারে আবর্জনার স্তূপ। নর্দমা হ্যাঁ করে আছে তার সব নোংরা মুখে নিয়ে। স্যাঁতসেঁতে গলিতে ঢুকে গা ছমছম করে আমার। ভূতুড়ে ভূতুড়ে চারদিক।
কিরণময়ী আমাকে দেখে ছুটে এসে আলিঙ্গন করলেন। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন আর ক্রমাগতই বলতে লাগলেন, -মা গো, তুমি কেমন আছো গো মা, মা গো তুমি ভালো আছ তো মা, মা গো তোমার কথা ভেবে ভেবে কত কষ্টে থাকি মা। মা গো তুমি এতদিন পরে এলে মা। যখন তাকে আলতো করে ছাড়িয়ে নিলাম, দেখি চোখে জল তার। আমার জন্য কারও চোখে জল? আমার মার ছাড়া আমি আর কাউকে দেখিনি। সারা গা আবারও শিথিল হতে থাকে। মন অস্থির। এ ঠিক এমন নয় যে ভালোবাসা পেয়ে আমার অভ্যেস নেই। প্রায় প্রতিদিনই কত মানুষ আমাকে উজাড় করে ভালোবাসা দিচ্ছে। লেখা পড়ে সাহস বা সততা দেখে তারা ভালোবাসে আমাকে। প্রতিদিনই গ্রহণ করেছি সে সব।
কিরণময়ীকে ঠিক কী বলে সম্বোধন করবো, বুঝি না। মাসি, মাসিমা! বিদেশে দীর্ঘদিন থেকে একটা বদঅভ্যেস হয়েছে, নাম ধরে ডাকা। আজকাল তো দ্বিগুণ বয়সীগুলোকেও দিব্যি নাম ধরেই ডাকছি। আগে যাদের দা বা দি বলতাম, সেগুলো আর পাল্টাইনি, তবে নতুন যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের নামের শেষে আর দা বা দি বসাই না। কেউ যদি কটমট করে তাকায়, পছন্দ না করে, তবে মুশকিলে পড়ি। কিরণময়ীকে অগত্যা দেশি ঢঙে মাসি বলেই সম্বোধন করি, ...মাসি, বলুন কেমন আছেন। সম্ভবত, ঢাকায় যখন দেখা হয়েছে, মাসিই বলেছিলাম।
- সুরোর কাছে শুনেছো নিশ্চয়ই কেমন আছি। তুমি এলে মা, কটা বছর আগে এলে না কেন! সুরোর বাবা কত যে তোমার কথা বলতেন। কোথাও তোমার খবর দেখলে সেগুলো কেটে রাখতেন। কত বার করে যে পড়তেন। খালি বলতেন, মেয়েটার কত দুর্ভোগ হচ্ছে আমাদের জন্য। মেয়েটার কত যে কষ্ট হচ্ছে। মা বাবা ছাড়া বিদেশে পড়ে আছে। কেমন আছে, কী করছে কে জানে? তোমার জন্য কত চোখের জল ফেলেছেন সুরোর বাবা! তুমি এলে, এলে মা ঠিকই, তার সঙ্গে দেখা হল না।
কিরণময়ী বলতে বলতে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি হাত বাড়িয়ে তার একটি হাত ধরি, ধরে থাকি। কান্নার দমক থামলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলতে লাগলেন, - টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতেন, তোমার খবর যদি দেখায়। তোমার সাক্ষাৎকার হবে জানলে দুঘণ্টা আগে থেকেই বসে থাকতেন। তোমার লেখা তোমায় নিয়ে লেখা, তোমার খবর কিছু বাদ রাখেননি জমাতে। তোমাকে নিয়ে করা তার অনেকগুলো খাতা ছিল, খাতায় আঠা দিয়ে সেঁটে রাখতেন সব লেখা। খাতাগুলো আলমারিতে যত্ন করে তোলা থাকতো। মাঝে মাঝেই নামিয়ে এনে এগুলো পড়তেন। এত খবরের কাগজ তো আমরা রাখি না, উনি পত্রিকাওয়ালাদের সঙ্গে ভাব করে ওদের কাগজ খুলে দেখতেন তোমার সম্পর্কে কিছু লেখা আছে কী না, বাংলা হিন্দি ইংরেজি কিছু বাদ রাখেননি। তোমাকে নিয়ে লেখা বেরোলেই সে কাগজ কিনে তবে বাড়ি ফিরতেন। অভাবের সংসার, হলে কী হবে, ওগুলোর যত্ন সবসময় করেছেন। ওগুলোর ওপর ধুলো পড়তে দেননি। খালি বলতেন, মেয়েটা নিশ্চয়ই শিগগির ফিরে যেতে পারবে দেশে। মা গো চিতায় তার প্রিয় অনেক জিনিস দিয়েছি, ওগলোও দিয়ে দিয়েছি। জানি না কোথায় যাবেন, কোথাও যদি যান তিনি, সঙ্গে ওগুলোও যাক। প্রিয় আর তেমন কী ছিল, দেশের জিনিস মা, দেশের জিনিস। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না মা, বাংলাদেশের একটা পতাকা, তার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও দেশ থেকে কাকে দিয়ে বাখরখানি আনিয়েছিলেন, একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে খেতেন, আর ওই বাখরখানি নিয়ে কী যে উচ্ছ্বাস ছিল তার, ওই পুরোনো পড়ে থাকা কিছু বাখরখানি, আর তোমার খবর আর লেখার খাতাগুলো। কী হবে এসব রেখে এখানে। বুকের ওপর দিয়ে দিয়েছি। ওনার জিনিস উনি নিয়ে যান। আমরা কি আর সম্মান দিতে পারবো ওসবের? তুমি এসেছো মা, দেখলে কত যে খুশি হতেন উনি। বলেই আবার কিরণময়ী চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমি স্থবির বসে রইলাম পাশে। আমার গা এত শিথিল হয়ে আছে, যে, আমার হাতটাও কিরণময়ীর হাত থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে। কোনও কথা বলা সম্ভব হয় না আমার। অনেকক্ষণ আমি চুপ হয়ে স্থির বসে থাকি। কান্না বোধহয় কখনও কখনও বেশ সংক্রামক।
সুধাময় দত্ত কী মারা গেলেন, তার কোনও গল্প আমি শুনতে চাই না। হয়তো খুব নিষ্ঠুরের মতো মনে হয়, যে, মানুষটার কথা এত বলা হচ্ছে, আর তার কথা জানার জন্য আমি কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছি না। সত্যি বলতে কী, মৃত্যু নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। মৃত্যুর কথা আমি বলতে চাই না, শুনতে চাই না। তার চেয়ে জীবনের কথা হোক। যৌবনের কথা হোক। ঘরটির চারপাশ দেখে জিজ্ঞেস করি।
- মায়া কোথায়?
- মায়া তো শ্বশুরবাড়ি।
- ও।
- মায়া কী করছে?
কোনও মেয়ের প্রসঙ্গ উঠলে মেয়ে কী করছে, এই প্রশ্নটি সাধারণত আমি করিই। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করে মেয়েটি কিছু একটা কাজ করছে। কারও স্ত্রী বা কারও মা তাদের পরিচয় নয়। মেয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর। চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য, উপার্জনের জন্য যা হোক কিছু করে। আমার একেবারেই শুনতে ভালো লাগে না ও তো কিছু করছে না, বা ও হাউজওয়াইফ, এসব। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে যে করেই হোক স্বনির্ভর হোক, এ আমি যে করেই হোক চাই। পরনির্ভর মেয়েদের জন্য আমার করুণা হয়। স্বনির্ভর হওয়ার উদ্যোগ যারা নেয় না, তাদের ওপর মাঝে মাঝে রাগও হয়। জীবন তো একটিই এবং একবারই। বাধাবিপত্তি নানা কিছু সামনে আসবেই, তাই বলে ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে না কেন? ঠকবে, একবার দুবার তিনবার। মেয়েদের পথ কেউ মসৃণ করে দেয় না। নিজেদেরই পাথর সরাতে হয়।
কিরণময়ীকে আগে যেমন দেখেছিলাম, কপালের দিকটায় সামান্য কিছু পাকা চুল ছাড়া আর তেমন কোনও বয়সের ছাপ চোখে পড়লো না। শারীরিক পরিশ্রম করলে বয়স তেমন শরীরে এসে বসে না। আমার তো বসে থাকার কাজ। আমার বরং চৌদ্দ বছরে চৌতিরিশ বছর পার করেছি মনে হয়। শরীরে মেদ জমেছে যেমন ইচ্ছে। চুল পেকেছে নানি দাদিকে হারিয়ে দিয়ে। চেহারা নষ্ট হয়েছে। গলকম্বল বেড়েছে। অথচ 'লজ্জা' যখন লিখেছি, শহরের সুন্দরী বিদুষী মেয়ে হিসেবে এক নম্বর বলা হত আমাকে। চিরকালের মেদহীন ছিপছিপে শরীর এখন ধুমসি। কিরণময়ী আগের মতোই দেখতে। সুরঞ্জন অনেকটাই ভারী হয়েছে। হলে কী হবে, মুখখানা কেমন কচি কচি। বয়স হয়েও হইলো না বয়সের মতো। চোখের চাওয়ায় তার, ভুলও হতে পারে, নাও হতে পারে, মনে হয়েছে গভীরতা বেড়েছে। মায়া কেমন দেখতে? আগের মতোই কি? এই প্রশ্ন আমি কাউকে করি না। নিজেকেই করি, যখন কিরণময়ী আমার জন্য চা করতে গেলেন। দুটো ঘর, এক চিলতে রান্নাঘর। এটুকুর মধ্যেই বাস। বড় বিছানা। বিছানাতেই অতিথিদের বসানো হয়। দুটো স্টিলের আলমারি। একটা আলনা। আলনায় কাপড় চোপড় গোছানো। জানালায় ছোট ছোট পর্দা। দেয়ালে মন্দিরাকৃতি খোপ, ওতে দেবদেবীর কটি মূর্তি, মূর্তিগুলোর সামনে লাল জবাফুল।
চলবে.......
৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন