গল্প : ভালবাসার এপিঠ ওপিঠ
গল্পকার : শাহাদাত রাসএল
গ্রন্থ : জীবন এক সুস্বাদু হেমলক
প্রকাশকাল :
রচনাকাল :
তরুণ লেখক শাহাদাত রাসএল'র “ভালবাসার এপিঠ ওপিঠ” শিরোনামের এই ছোট গল্পটি তার 'জীবন এক সুস্বাদু হেমলক' গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। তবে এ গল্পটি রচনার সময়-কাল ও অবস্থান এখন অবদি জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হবে।
![]() |
ভালবাসার এপিঠ ওপিঠ || শাহাদাত রাসএল |
ভালবাসার এপিঠ ওপিঠ || শাহাদাত রাসএল
‘তুমি কি জীবনেও মানুষ হবা না ? কতোদিন বলেছি বাজারে গেলে চোখ কান খোলা রাখবে। এই গুলা কি মাছ এনেছো ? চোখে দেখে মাছ কিনো না নাকি মাছওয়ালা তোমাকে ফ্রি মাছ দিয়েছে ? জীবনে শুনিনি টাকা দিয়ে কেউ মরা কৈ কিনে, একে এক আঙ্গুল সাইজের কৈ তার উপরে সবগুলো মাছ মরে পচে গেছে, আজকে আমি আর এই মাছ কাটবো না, তোমাকে ঘাড় ধরে মাছ কাটাবো’’
এই পর্যন্ত শুনেই অরিন্দম বারান্দা থেকে ঘরে চলে আসে। বারান্দার থাই গ্লাসটা বন্ধ করে দেয়। দুটো বাড়ির লাগোয়া বারান্দা হওয়ায় শব্দ আর অর্পির এই ঝগড়াটা অরিন্দম প্রায়ই শোনে। অরিন্দম আর স্বাতীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তেমন ঝগড়া হয়না। খুবই শান্ত জীবন । অপরদিকে শব্দ আর অর্পির জীবন সবসময়েই উত্তাল, সেই উত্তাল ঢেউ মাঝেমাঝে আছড়ে পড়ে অরিন্দমের বারান্দায়। অবশ্য এই ঝগড়াটা শুনতে অরিন্দমের ভালোই লাগে, অরিন্দম কিছুটা সস্তি পায়। কেননা এই নিত্য ঝগড়াটা অরিন্দমের কাঁধেও আসতে পারতো। যদি সেদিন অরিন্দমের বাবা অরিন্দমকে তার লাইসেন্স করা রাইফেল হাতে দৌড়ানি না দিতো।
অরিন্দম শব্দ আর অর্পি একই সাথে কলেজে পড়তো। একদিন হুট করে অরিন্দম অর্পির প্রেমে পড়ে গেলো। হুট করে প্রেমে পড়া মানে, একদিন রাতে অর্পিকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায় অরিন্দমের। আর ঘুম আসেনা। শুধু অর্পিকে ভাবে। ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে যখন পাশের মসজিদে ফজরের আজান শোনা যায় ঠিক তখনি অরিন্দম বুঝতে পারে যে সে অর্পির প্রেমে পড়েছে। অরিন্দমের কাছে প্রেমে পড়ার বিষয়টা বিস্ময়ের। অরিন্দম বুঝতে পারেনা ও কি করবে। সেই আজানের সময় অরিন্দম অর্পিকে কল করে, অর্পির মোবাইল বন্ধ। কেননা শব্দের সাথে সারারাত ফিসফিস করতে করতে কক্ষনোই শেষ রাতে অর্পির মোবাইলে চার্জ থাকেনা। অসহায় অরিন্দম প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি নিয়ে এই শেষ রাতে কার কাছে যাবে ? অরিন্দম একজনের কাছে যায়। অরিন্দম ওর বাবা মায়ের রুমে গিয়ে ওর বাবা মাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তোতলাতে তোতলাতে শুধু বলতে পারে
‘বাবা আমি পাশের মহল্লার শফিক সাহেবের মেয়ে অর্পিকে ভালবাসি, আমি ওকে বিয়ে করবো’
অরিন্দমের বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষ ঘুম ভাঙ্গা লাল চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে পাবদা মাছের মতো ফ্যালফ্যাল করে অরিন্দমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা বিশ্বজিৎ ঘোষের মনে পড়ে যে তার লাইসেন্স করা রাইফেলটা রয়েছে পুরানো কাঠের আলমারির তিন নাম্বার তাঁকে।
সেদিন রাতে মহল্লার অনেকেরই ঘুম ভেঙ্গেছিলো বিশ্বজিৎ ঘোষের চিৎকারে। অরিন্দম খালি পায়ে মহল্লার অলিতেগলিতে দৌড়াচ্ছে আর অরিন্দমের পেছনে রাইফেল হাতে দৌড়াচ্ছে বিশ্বজিৎ ঘোষ
‘হারামজাদা তোর এতো বড় সাহস! হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলমানের মেয়েকে বিয়ে করবি ? আমার জাত মারবি ? আমার জাত মারার আগে আমি তোকে গুলি করে মারমু’
সেদিন রাতে অরিন্দমের বাবা অরিন্দমকে মারেনি ঠিক তবে সেই মাসের শেষ শুক্রবার ঘটাকরে স্বাতীর সাথে অরিন্দমের বিয়েটা দিয়েছিলো ।
তাই বারান্দা থেকে অরিন্দম যখন শব্দ আর অর্পির ঝগড়া শোনে তখন ওর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষের প্রতি কৃতজ্ঞতায় একটা অদৃশ্য প্রনাম দেয়।
এবার সেই আলোচিত পচা কৈ মাছের দিকে চোখ ফেরানো যাক।
শব্দ । ভালো নাম শব্দ আহমেদ । আবস্য আরও একটা নাম আছে তার । সেই নামটা কেবল মাত্র অর্পি জানে । প্রেমের শুরুতে অর্পি শব্দকে মানুষের আড়ালে আবডালে সাধু বলে ডাকতো। শব্দ যদিও নিজের ভেতর সাধু পুরুষ সুলভ কিছু খুঁজে পায়না তবুও সাধু নামটা ধীরেধীরে শব্দের প্রিয় হয়ে ওঠে । তাই উপহার স্বরূপ শব্দ অর্পিকে একটা নাম দেয় ‘বাচ্চাবউ’ । শব্দ খুব গোপনে অর্পিকে বাচ্চাবউ বলে ডাকে।
বেডরুমে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে শব্দ। হাতে সদ্য জ্বালানো গোল্ডলিফ। জামার উপরের দুইটা বোতাম খোলা। যদিও রুমে ফ্যান চলছে, তবুও ফ্যানের নিচে বসে ঘামছে শব্দ। শব্দ একবার মাথা তুলে বিরক্তি নিয়ে ফ্যানটার দিকে তাকায়। পুনরায় চোখ ফিরিয়ে একটু উঁকিমারে রান্না ঘরে। যেখান থেকে পচা মাছ বিষয়ক তীব্র বাক্যবাণ ছুড়ে দিচ্ছে অর্পি ।
শব্দ বিড়ালের মতো নরম পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। রান্নাঘরের দরজার দিকে পেছন ফিরিয়ে গ্যাসের চুলায় কিছু রান্না করছে অর্পি। মেঝের উপর একটা স্টিলের বোলের ভেতর রাখা সেই আলোচিত মরা কৈ। শব্দ শব্দহীন পায়ে গিয়ে মেঝে থেকে কৈ মাছের বোলটা তুলে নেয়। রান্নাঘরের দরজার ফ্রেমের এক পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় শব্দ। দরজা থেকে কিছুটা দূরে রাখা ময়লার ঝুড়ি। শব্দ ময়লার ঝুড়িটা দেখে। তারপর বোল থেকে একটা কৈ মাছ তুলে নিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিসের ভঙ্গিতে কৈ মাছটা ছুড়ে দেয় ময়লার ঝুরিতে। কৈ মাছটা ময়লার ঝুড়ির ভেতরে পড়েনা। শব্দ লক্ষ্যছুঁতে ব্যর্থ হয়। অস্ফুট ভাবে আক্ষেপ করে শব্দ
‘শিট হলো না’
পুনরায় আরেকটা কৈ মাছ তুলে ছুড়ে দেয়। এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়না। শব্দের মুখে হাসি। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস
‘ইয়েস গুড শর্ট মিস্টার শব্দ’
এরপর আরেকটা ছুড়ে দেয়। তারপর আরেকটা। অতপর আরেকটা
অর্পি পেছনে শব্দের উচ্ছ্বাস ও হতাশার শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখে শব্দ কৈ মাছ দিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। বিরক্ত মুখে অর্পি এগিয়ে যায় শব্দের কাছে। শব্দের হাত থেকে কেড়ে নেয় মাছের বোল। তারপর রান্নাঘরের দরজার ফ্রেমের অপর পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। শব্দের মতোই অর্পির চোখ নিবদ্ধ হয় ময়লার ঝুড়িতে। অর্পি ময়লার ঝুড়িতে ছুড়ে দেয় বিতর্কিত কৈ। কৈ মাছ ময়লার ঝুড়িতে পড়ে না। অর্পি বিরক্ত হয়ে বলে ‘ওহহ নো’। অর্পি টার্গেট পুরন করতে না পারায় খুশি হয় শব্দ। শব্দ বিজয়ীর মতো উল্লাস করে ‘ইয়েস গুড শর্ট’
পুনরায় একটা কৈ মাছ ছুড়ে দেয় অর্পি। এবার কৈ সোজা ময়লার ঝুড়িতে। অর্পি চিৎকার দেয় ‘গুড শর্ট গুড শর্ট’। শব্দ হতাশ হয় ‘ওহ নো’
অর্পি তীক্ষ্ণ চোখে শব্দের দিকে তাকায়
অর্পিঃ কি আমার সাথে মজা নেয়া হচ্ছে ? দাড়াও
অর্পি শব্দের গায়ে মাছের আঁশটে মাখা হাত মুছে দিতে চায়। শব্দ দৌড় দেয়। পেছনে পেছনে দৌড়ায় অর্পি। রান্নাঘর থেকে ড্রইংরুম ডাইনিংরুম ঘুরে ওদের দৌড় শেষ হয় বেডরুমে গিয়ে। শব্দ পালানোর পথ পায়না। অর্পি কৈ মাছের আঁশটে মেখে দেয় শব্দের শার্টে। শব্দ নিজেকে বাঁচাতে চায় কিন্তু লাভ হয়না। অর্পি মাছের আঁশটে হাত শব্দের গালে লাগিয়ে দেয়। শব্দ মাছের আঁশটে মাখা শার্টটা খুলে বিছানায় ছুড়ে দেয়। অর্পি শব্দকে জব্দ করার আনন্দে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুড়ে নাচছে । শব্দ মুখ থেকে মাছের আঁশটে মোছার জন্য অর্পির ওড়না টেনে নেয়। অর্পি দুই হাতে বুক ঢাকে। অর্পিকে দুই হাতে বুক ঢাকতে দেখে শব্দ পেয়ে যায় অর্পিকে জব্দ করার পথ। অর্পির ওড়না নিজের গলায় জড়িয়ে এক পা এক পা করে অর্পির দিকে এগিয়ে যায় শব্দ। অর্পি এক পা এক পা করে পেছনে যায়।
অর্পিঃ দেখো একদম অসভ্যতা করবে না
শব্দঃ বিবাহিত জীবনে অসভ্যতা না করাটাই অসভ্যতা
অর্পিঃ আর একটুও এগুবে না প্লিজ এখন দিনের বেলা
শব্দঃ নববিবাহিতের দিন আর রাত বলতে আলাদা কিছু থাকে না
অর্পিঃ চুলায় কিন্তু রান্না...
অর্পির কথা শেষ হবার আগেই শব্দ এক হাতে অর্পির কোমর জড়িয়ে ধরে। বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে এক হাতেই অর্পিকে মাটি থেকে একটু উপরে তুলে নেয় শব্দ। তারপর অপর হাতে জানালার পর্দাটা টেনে দেয়। বিছানায় শুইয়ে দেয় অর্পিকে। শব্দ চুমু দেবার জন্য নিজের ঠোঁটটাকে অর্পির ঠোঁটের দিকে বাড়াতেই অর্পি বাঁ হাতের দুই আঙ্গুল ঠেকিয়ে দেয় শব্দের কপালে। আর ডান হাত দিয়ে শব্দের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা টেনে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। শব্দ অবাক হয়
শব্দঃ ওহ শিট আমার ঠোঁটে যে সিগারেট ছিলো সেটা...।
অর্পিঃ চুপ একদম চুপ। কাজের সময় কোন কথা নয়...।
অর্পি শব্দের চুল খামচে ধরে। শব্দকে নিজের দিকে টানে। শব্দ কিছু বলতে চায় কিন্তু শব্দ কথা বলতে পারেনা। আর কেবল শব্দ কেনো, এভাবে মুখ বন্ধ রেখে পৃথিবীর কোন মানুষই কথা বলতে পারেনা ।
গল্পের এই সময়ে অপর ফ্ল্যাটে অরিন্দম রান্নাঘরে গিয়ে স্বাতীকে বলছে
অরিন্দমঃ এই শুনেছো, আজকে আবার শব্দ আর অর্পির ঝগড়া লেগেছে
স্বাতীঃ হ্যা শুনলাম
অরিন্দমঃ ওদের জন্য সত্যি আমার খারাপ লাগে। কি অসুখী দম্পতী। ওরা এভাবে থাকার চেয়ে ডিভোর্স নিয়ে নিতে পারে
স্বাতীঃ ওরা ডিভোর্স নিলে বুঝি তোমার লাভ হয় ? অর্পির পেছনে আবার ছুঁকছুঁক করতে পারো। ভুলে যেওনা যে তোমার বাবা মারা যাবার সময় তার রাইফেলটা আমার জিম্মায় দিয়ে গিয়েছে। দরকার পড়লে ব্যাবহারও করতে বলেছে
অরিন্দমঃ ধুর তুমি কিসের মধ্যে কি বলো...
অরিন্দম মুখ গুমরা করে রান্নাঘর থেকে ড্রইংরুমে চলে আসে। টিভিতে নিনজা হাতুড়ি কার্টুন চলছে। এটা অরিন্দমের খুব প্রিয় কার্টুন ।
লেখক সংক্ষেপ :
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন