গল্প : ছারপোকা
লেখিকা : আভা ইসলাম রাত্রি
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ২০২১ ইং
লেখিকা আভা ইসলাম রাত্রির “ছারপোকা” শিরোনামের এই ছোট গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য গল্পটি তুলে ধরা হলো। লেখিকা তার এই ছোট গল্পটি লিখেছেন বছর খানেক আগে। তিনি এই গল্প সম্পর্কে তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “অনেক আগের লেখা। ঘষামঝা করে পোস্ট করলাম।”
![]() |
ছারপোকা || আভা ইসলাম রাত্রি |
ছারপোকা || আভা ইসলাম রাত্রি
দুপুরে খাবার পর্ব শেষ করে ভাতঘুম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে আমার সমস্ত পরিকল্পনায় পানি ঢেলে বাবা সহাস্যে জানালেন, আমরা বিয়েতে যাব। বাবার কলিগের মেয়ের বিয়ে। এই কলিগের নাম আনোয়ার হোসেন। বাবার সাথে তার গলায় গলায় ভাব। একসঙ্গে অফিসে চা খেতে খেতে গল্পের আসর জমানো, বসের ঝাড়ি খেয়ে একে ওপরের দুঃখ মুছে ফেলা, ক্যান্টিনে হুটহাট বিড়বিড় করে গানের আসর, এসবে বাবার একমাত্র সঙ্গী হচ্ছেন আনোয়ার চাচা। তার মেয়ের বিয়ে আজ। বাবাকে স্পস্ট জানিয়েছেন তিনি, বাবা না এলে এই বিয়েই হবে না।
' বিয়ে হবে না ' এ মহা সমস্যার কথা জেনে বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। তার জন্যে কারো বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ক ভেঙে যাবে, এ তিনি কিছুতেই মানতে চাইলেন না। অগ্যতা আমি, আমা ছোট বোন প্রীতি ও মা'কে বগলবদাবা করে নিয়ে চললেন বিয়েতে। বাদামি রঙের শাড়ি পড়ে প্রীতির সাথে বসে আছি আমি। প্রীতি ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছে। লিপস্টিক দেওয়া শেষ করে আমার দিকে চেয়ে বলল,
' দেখ তো আপা, ঠিকঠাক হয়েছে কি না? '
আমি বিজ্ঞ চোখে তাকাবার চেষ্টা করলাম। অতঃপর আঙ্গুলের কোণ কর্তৃক ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা লিপস্টিকের দাগ মুছে দিয়ে বললাম,
' এবার ঠিক আছে। '
' তুই লিপস্টিক দিবি? ঠোঁট বড্ড ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তোর। '
প্রীতির মুখে তুই সম্বোধন শুনে আমার মা চেতে উঠলেন। প্রীতির পিঠে শক্ত এক থাপ্পড় বসিয়ে সুধালেন,
' এই পাজি মেয়ে। তুই কি? বড় বোনকে কেউ তুই করে বলে? '
প্রীতি শাড়ির আঁচল ঠিক করে মুখ লটকাল। মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
' দুই মিনিটের বড় ও। যমজ বোনকে কেউ আপা করে ডাকতে শুনেছ? কিন্তু আমি ভালো মেয়ে বলে ওকে আপা করে ডাকছি। তুই বলা ছাড়তে পারব না। এসব আমাকে বলে কাজ হবে না। '
মা চোখ রাঙানি দিলেন প্রীতিকে। প্রীতি নাছোড়বান্দার ন্যায় আমার সাথে লেগে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল। মা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের হাল ছেড়ে দেওয়া প্রকাশ করলেন।
ভেবেছিলাম, বিয়েতে আর যাই হোক মজা হবে। সুন্দর সুন্দর ছবি তুলব, মজাদার খাবার খাব আর গান শুনব। তবে তার কিছুই হল না। বিয়েতে এত মানুষের ভিড় দেখে ছবি তোলার ইচ্ছে নিঃশেষ হল। সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করছে। কিন্তু কবে যে খাবার খেতে দেবে জানি না। প্রীতি আমার পাশে বসে রাগে গিজগিজ করছে। বিয়েতে কেন এল, তা নিয়ে হাজারখান অভিযোগ শুনাচ্ছে। আমি আমার ব্যাগ থেকে মায়ের ফোন বের করলাম। প্রীতির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম,
' ফোন দেখ। তাহলে আর বিরক্ত লাগবে না। '
প্রীতি মুখ লটকে ফোন লুফে নিল। ডুবে গেল ফোনের নীল সাদা দুনিয়ায়। আমি নখ খুঁটতে খুঁটতে সবার দিকে তাকাচ্ছি। সবাই অনেক সেজেগুজে এসেছে। একেকজন মেয়েকে দেখলে বোধ হচ্ছে কনে স্টেজ ছেড়ে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আরো একবার স্টেজের দিকে তাকালাম। কনেকে সুন্দর লাগছে। তবে বরটাকে কনের পাশে মানায় নি। বরের চোখে ইয়া বড় চশমা, হাতে মেয়েদের মত মেহেদী দেওয়া, আবার কনের পাশে বেশ খাটো দেখাচ্ছে বরকে। তবে ওরা নিজেরা সুখী হলে আমরাও সুখী। সুন্দর দিয়ে আর কি আসে যায়। আমার কপালে এমন কেউ যেন আল্লাহ্ না জুটান। নাহলে দেখা যাবে, বিয়ের দিন আমি প্রেমিক ছাড়া একা একাই পালিয়ে যাচ্ছি।
' আপা, ওই ছেলেকে দেখ। '
প্রীতি আমার হাতে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে কাউকে ইশারা করল। আমি ভাবনার সমাপ্তি টেনে সেদিকে তাকালাম। একটা ছেলে। আমার মত বাদামি রঙের পাঞ্জাবি পড়া। লম্বাটে, আকর্ষণীয় দেহের গড়নের এক সুপুরুষ। গালে চাপ দাড়ি, চোখে ছোট করে কাচের চশমা। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছে। চোখে কণ্ঠে বিনয়ের আধিপত্য। ফুলো বুকে দাম্ভিকতার ছাপ। হাসছে খুব। হাসির সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণা বেশ চওড়া হচ্ছে। হাসিতে যেন মুক্ত ঝড়ছে। চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দু চোখে রাজ্যের আদর। আমি চমকে গেলাম এক মুহূর্তের জন্যে। ছেলেটা কে? আনোয়ার চাচার কি হয়? আমি প্রীতিকে দেখলাম। সেও হা করে ছেলেকে দেখছে। আমি গলা কেশে উঠলাম। প্রীতি বিরক্ত হল বোধহয়। আমি খানিক রাগ দেখিয়ে বললাম,
' দিনদিন তুই চূড়ান্ত বেয়াদব হয়েছিস। ছেলেদের দিকে এত তাকিয়ে আছিস কেন? থাপ্পড় দিয়ে ছেলেদের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে দেব। '
প্রীতি বরাবরের ন্যায় এবারেও মুখ লটকাল। খানিক ভেংচি কেটে বলল,
' এ্যাহ! তুই নিজেও তো চেয়ে ছিলি। আর এখন সব দোষ আমার?'
আমি হতভম্ব হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
' তুই ইশারা করেছিলি দেখে আমি তাকিয়েছি। আর একটাও কথা বলবি না। ঘুরে বস বলছি।'
প্রীতি চোঁখ বাঁকিয়ে আমাকে দেখল। আমি পুনরায় চোখ রাঙালে সুরসুর করে ঘুরে বসে গেল। আমি নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কোণা চোখে আবারও ছেলেটাকে দেখলাম। এবার বাবার সাথে কথা বলছে সে। বিনয়ের সঙ্গে মাথা বটে বেশ সম্মানের সাথে সবাইকে অ্যাপায়ন করছে। আমি চিন্তা করলাম। সে কি কনে পক্ষের কেউ?
দেখলাম সে এবার খাবারের স্থানে যাচ্ছে। আমি চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম। প্রীতি আমার দিকে তাকাল। আমি খানিক গম্ভির হয়ে বললাম,
' ওয়াশরুমে যাব। '
' আমিও আসি? '
' কেন? লাগবে না। '
' ভয় পাবি না তো? '
' ভয়ের কি আছে? তুই বস। আমি আসছি। '
প্রীতিকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে আমি এগিয়ে গেলাম সামনে। খাবারের স্থানে এসে ইতি-অতি চেয়ে দেখলাম। না, সে কোথাও নেই। হঠাৎ দূরে একস্থানে নজর পড়ল। সে দাড়িয়ে আছে। খাবারের তদারকি করছে। আমি পা টিপেটিপে এগিয়ে গেলাম। টেবিল থেকে একটা শুকনো গ্লাস নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালাম।
' শুনছেন? '
ছেলেটা ঘুরে তাকাল। প্রশস্ত কাধের দিকে চোখ পড়লে শিউরে উঠলাম আমি। ভীষন সুন্দর এই পুরুষকে দেখে বুকের ভেতর কেমন ছটফটিয়ে উঠল।
' জী,বলুন। '
ইশ। কি দারুন কণ্ঠ। কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। আমি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললাম
' পানি চাইছিলাম। '
ছেলেটাকে কিছুটা ভ্রু কুচকে বলল,
' যেকোন ওয়েটারকে বলুন। দিয়ে দেবে। '
ছেলেটা চলে গেল। আমি ভদ্রতা স্বরূপ গ্লাস হাতে নিয়ে চলে এলাম জায়গায়।
নাম তার বাদল। বাদল দিনের এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় সেদিন আমি তাকে দেখেছিলাম। চওড়া দেহের গড়নে কেমন যেন আকর্ষণীয় চোখ টানটান সৌন্দর্য্য। তার মুখের শ্যামবর্ণের রঙেই আমি কেমন যেন বুদ হয়ে রইলাম। সেই যে বুদ হলাম, আর নিজেকে টেনে তুলতে পারলাম না। সম্পূর্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে তার থেকে চোখই সরাতে পারলাম না। চেয়েই রইলাম, অতঃপর মন হারালাম।
প্রীতি কাছে এসে বসলাম খানিক পর। প্রীতি এখনো ফোন দেখছে। আমি ঝট করে প্রীতির কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিলাম। প্রীতি চমকে উঠে তাকাল। আমি মোবাইলে কিছু ঘাটতে ঘাটতে বললাম,
' কাজ আছে। একটু পর দিচ্ছি। '
প্রীতি মুখ লটকে বলল,
' কি কাজ? আমাকে দে ফোন। আমি চ্যাট করছিলাম না? '
' তোর চ্যাটের থেকেও মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি। কথা বলবি না। চুপ করে বসে থাক। নাহলে দেব এক চড়। '
চড়ের কথা শুনে প্রীতি রেগেমেগে উঠে চলে গেল আমার পাশ থেকে। আমি ফেইসবুকে ঢুকে তার নাম ' ফারহান সৈয়দ বাদল ' লিখে সার্চ করলাম। খানিক ঘাটাঘাটি করার পর হঠাৎ তার নামের নিচে, ' এনগেজড ' লেখা দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলাম। বুকের ভেতরটা খামচে ধরল যেন কেউ। আমি পাগলের মত তার আইডি ঘুরলাম। বেশি ঘুরতে হল না। হঠাৎ দেখলাম, একটা মেয়ের সঙ্গে তার ছবি। নিজের চেয়েও সুন্দরী মেয়েকে তার পাশে দেখে ঠিক যেন সহ্য করতে পারলাম না। ছবিতে তার হাত মেয়েটার হাত ধরে আছে। উপরে ক্যাপশন লেখা, ' আলহামদুলিল্লাহ, এনগেজড।'
না চাইতেই আমার চোখ থেকে জল গড়াল। মনের ব্যথায় নীল হয়ে গেল সম্পূর্ন শরীর। বিষাক্ত পোকায় মন খেল, খেল আমার অনুভূতি। জীবনের প্রথম একটা ছেলেকে ভালো লাগল। আর সে কি না আমার জন্যে নিষিদ্ধ। আমি মাথা তুলে চাইলাম। তাকে বেহায়ার ন্যায় খুঁজলাম। পেয়েও গেলাম। সেই..সেই মেয়েটাই। তার পাশে দাড়িয়ে। তারা বড়দের সঙ্গে কথা বলছে। একসঙ্গে দাড়িয়ে আছে। দোয়া চাইছে সবার কাছে। ওই..ওই মেয়েটা আমিও হতে পারতাম। কেন হলাম না? তার জীবনে আমি ওই মেয়েটার আগেও আসতে পারতাম। কেন এলাম না? আমি কখনো কিছু নিয়ে আফসোস করিনি। তবে আজ জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোসটাই করে বসলাম। বাদল প্রেমের গল্পটা আমাদের এভাবে না শেষ হলেও পারত। যাকে প্রথম দেখাত ভালবাসলাম, সে আমার জন্যে এমন বিচ্ছিরি ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও পারত। তার চোখে নিজের সর্বনাশ দেখা আমি, তার তরে এভাবে না মরে গেলেও পারতাম। বাদলের নামের ছারপোকা আমার অনুভূতিতে বি*ষ না ছড়ালেও পারত। নিষিদ্ধ মানুষকে ভুল করে চেয়ে বসার য*ন্ত্রণার মত বোধহয় সৃষ্টিকর্তা আর কিছু দিতে পারতেন না। তার তরে মন হারানোর মত নীল রঙের ব্যথার ন্যায় বি*ষ আমি পান করলাম। নিজ ইচ্ছেই পান করলাম। অতঃপর হেরে গেলাম।
সমাপ্ত
প্রিয় পাঠক, গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো? আপনার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি কমেন্ট বক্সে জানান।
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা আভা ইসলাম রাত্রি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে। তবে তিনি তার ফেসবুক পেজে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, “গল্প লেখে সে, কলমের কালিতে কল্পনার চিত্র আঁকিবুকি করা তার নেশা! অক্ষরের ভাজে লুকায়িত এক কল্পপ্রেয়সী!”
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন