গল্প            :         আমার প্রেমের গল্প শুনবেন?
লেখিকা        :         নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল    :         
রচনাকাল     :         ১১ অক্টোবর, ২০২২ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আমার প্রেমের গল্প শুনবেন?” শিরোনামের এই ছোট গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি অনবদ্য এ গল্পটি ২০২২ সালের ১১ অক্টোবরে লিখেছেন।
আমার প্রেমের গল্প শুনবেন? || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আমার প্রেমের গল্প শুনবেন? || নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আমার প্রেমের গল্প শুনবেন? || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


খুব জোর বৃষ্টি হচ্ছে। এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝেই জেদী কিশোরীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে আছে এক ফালি চাঁদ। হাসপাতালের ডিউটি শেষে মাত্র বের হয়েছি। ঘড়ির কাটার হিসেবে তখন প্রায় ভোর রাত। অন্যান্য দিনগুলোতে হাসপাতালেই রাত কাটাই। আজ ইচ্ছে হলো না। ছাতার তলায় মাথা বাঁচিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। রিকশা না পাওয়া গেলে হেঁটে যাওয়া যাবে। বাড়ি খুব দূরে নয়। স্ট্রিট লাইটের আলোয় চকচক করছে হাসপাতালের মসৃণ চত্বর। এই চত্বরের এক বেদীর উপরই নিশ্চুপ বসে আছে একটা বধূবেশী কন্যা। হুমায়ুন আহমেদ বোধহয় এই মেয়েকে দেখেই লিখেছিলেন, 'এক যে ছিলো সোনার কন্যা; মেঘবরণ কেশ'। মেঘবরণ কেশের মেয়েটি টুকটুকে বউ সেজে বৃষ্টিতে ভিজছে। 'হাসপাতাল' শব্দটাই খুব দুঃখ দুঃখ শব্দ। এখানে সবাই দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে থাকে। কেউ বধূ বেশে বৃষ্টিবিলাস করে না। তবে এই মেয়েটি করছে। মেয়েটির বোধহয় নিয়ম ভাঙার ব্যামো আছে। সে পৃথিবীর সকল নিয়ম ভেঙে ফেলতে চায়। আমি মেয়েটির নিয়ম ভাঙা দেখে মর্মাহত হলাম। বধূবেশী কোনো রমণী ভোর রাতে বর নামক অকুতোভয় পুরুষের বাহুবন্ধনে পি ষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। আঁচল ছড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করবে, তা স্বাভাবিক নয়। অসুস্থ সমাজের গন্ডিতে বড়ো হয়ে এই অস্বাভাবিকতায় আমার ক্ষেপে যাওয়া উচিত। আমি বিরক্ত হলাম। বিস্মিত হলাম তার থেকেও বেশি। আমাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি অবশ্য বিস্মিত হলো না। স্নিগ্ধ চোখ জোড়া তুলে শুধালো, 'আমার প্রেমের গল্প শুনবেন?' 


আমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে বোধ করি অতিমানবী ভেবে দৌঁড়ে পালাতো। আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র, অতিমানবী বিশ্বাস করি না। সুতরাং দৌঁড়ে পালালাম না। অপরিচিতা রমণী বলে এগিয়েও গেলাম না। স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম যেমনটি ছিলাম। বস্তুত, অদৃশ্য এক আকর্ষণে জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। সহজ ভাষায় বললে, মেয়েটির মুক্তো ঝরা কথাগুলো শোনার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বেদীর উপর পড়া টিপটাপ বৃষ্টিতে তার মসৃণ অঙ্গুলির আঁকিবুঁকি করতে করতে সে নত মুখেই বলতে আরম্ভ করলো, 
' সেদিন খুব বর্ষা ছিলো। ভার্সিটি হলের পাতলা খিচুড়ি আর একটা ডিম সিদ্ধ খেয়ে কেবল গায়ে কম্বল চড়িয়েছি। এমন সময় একটা ফোন এলো। অপরিচিত নম্বর। একটু দ্বিধান্বিত মনে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো খুব পুরুষালি এক কন্ঠস্বর। একদম ফর্মাল কন্ঠে বললো,  "ম্যাম আমি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলছিলাম। আমাদের একটা জরিপ চলছে। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের এমন দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কেমন সে বিষয়ে। আপনি আমাকে সময় দিলে, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতাম।' 
এতো সুন্দর কন্ঠ শুনে আমার নিজের কন্ঠস্বরের প্রতি বড়ো আফসোস হলো। আমি বুক জুড়ে আফসোস নিয়ে বললাম, 'জিজ্ঞেস করুন।' 
সেই সুন্দর কন্ঠস্বর আমার বাড়িতে সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না হয় নাকি সরিষা তেল দিয়ে, সে খবর পর্যন্ত জেনে ফেললো। কথা শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, 'শেষ প্রশ্ন ম্যাম। আপনি এখন আপনার বা আপনার পরিবারের তিনটা প্রয়োজনীয়তা বলুন যা এই মুহূর্তে মিটানো প্রয়োজন কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।' 
প্রশ্নটা করার সাথে সাথে আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেলো। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা নেই। আমি দ্বিধান্বিত কন্ঠে বোকার মতো বলে ফেললাম,
' তেমন কোনো প্রয়োজন তো মনে পড়ছে না। আম্মু আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে অবশ্য বেঁচে যান। কিন্তু মন মতো পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কী কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার আওতায় পড়ে?' 
গম্ভীর কন্ঠস্বরটা এবারে হেসে ফেললো। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললো,
' নিশ্চয় ম্যাম। আমাকে এতোটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ম্যাম। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।' 
আমি সালামের জবাব নিতেই ফোনটা কেটে গেলো। সেই বর্ষা ঝরা দিনটা আমি কেবল তাকে ভেবে কাটালাম। বার বার নিজের কন্ঠস্বর রেকর্ড করে শুনলাম, কেমন শুনালো? আহা, আমার কন্ঠটা এমন খসখসে কেন? আল্লাহ আমার কন্ঠটা আরেকটু সুন্দর দিলে কী হতো? ফোনের রেকর্ডারটা অন রাখিনি বলে আফসোসও হলো। বান্ধবী, রুমমেট যাকে পেলাম তাকেই পুরো কাহিনিটা বলে নিজেকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করলাম। কোনোভাবে খেলো ধরনের কথা বলে ফেললাম কি-না সে নিয়ে বড়ো অ*স্থি*র*তা হলো।  এই অ*স্থি*র*তা অবশ্য দুইদিনেই কে*টে গেলো। এসাইনমেন্ট আর ক্লাসের চা*পে একদম স্টিলের মতো সোজা হয়ে গেলাম। কোন কালে কে ফোন দিয়েছিলো মনেই রইলো না। প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে আবারও এক অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেদিনও আকাশ-বাতাস সফেদ করে ভীষণ ঝড়ো বর্ষা নামলো। সেই ঝনঝনে বৃষ্টির তালে তাল মিলিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠ বাজলো,
' আসসালামু আলাইকুম। আমি খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বলছিলাম।' 
আমার বুকের ভেতর অচেনা এক ঢিপঢিপ খেলে গেলো। হাত কেঁ*পে উঠলো। গলা শুকিয়ে গেলো। একদম ভুলেই গিয়েছিলাম যাকে তার দ*হ*নেই হৃদয়ে ভ*য়া*বহ অ*গ্নি*কা*ন্ড ঘটে গেলো। অবাক হয়ে বললাম,
' আবারও জরিপ হচ্ছে আপনাদের? আবারও আগের প্রশ্নগুলো?'
সে উত্তর দিলো,
' উঁহু। আজ অন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ফোন দিয়েছি। সেবার জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, 'কেমন আছেন আপনি?'
আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম,
' সে ভালো আছি। আপনি শুধু এই কথা জিজ্ঞেস করবেন বলে ফোন দিয়েছেন?' 
' ঠিক তা নয়। আমার মনের ইচ্ছেটা অন্যরকম। কিছুটা ভ*য়ং*ক*র। বললে ব*কা*ব*কি করতে পারেন বলে সাহস হচ্ছে না।' 
আমি নিশ্চুপ প্রশ্ন ছুড়লাম। সে নিজ থেকেই উত্তর দিলো,
'সেদিন আনমনেই আপনার নাম্বারটা টুকে নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো, আপনার সাথে আরও একবার কথা বলতেই হবে। সরি, আপনি কী বিরক্ত হচ্ছেন?' 
আমার কী হলো কে জানে? আমি বে*কু*বে*র মতোন ফট করে বলে ফেললাম, 
' বিরক্ত হচ্ছি না।' 
সে বললো,
' যদি আরও একটু বিরক্ত করি তবুও বিরক্ত হবেন না?' 
আমার গাল লাল হয়ে এলো লজ্জায়। লজ্জা রাঙা হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলো। গ্রীক দেবী আফ্রিদিতির প্রেম বাণের সবকটিই যেন দশ হাত তুলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি লাজুক কন্ঠে বললাম,
' হবো না।' 
সে এক বুক সুখ নিয়ে আমাকে বিরক্ত করতে আরম্ভ করলো। সেই বিরক্ত করার গল্পটা চললো প্রায় একটি বছর। আমরা প্রায় সারাদিনই কথা বলতে লাগলাম। সে চাকরির পাশাপাশি বিসিএস প্রিপারেশন নিচ্ছিলো আর আমার ভার্সিটির চা*প। এসবের বাইরে যতটুকু সময় পাওয়া যেতো আমরা মুগ্ধ হয়ে একে অপরের কথা শুনতাম। স্বপ্নের কথা। জীবনের কথা। পৃথিবীর কথা। কী কথা বাদ রেখেছিলাম আমরা? কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। তবুও কী করে যে ওমন একটা কথা বাদ পড়ে গেলো দু'জনের!
সে একদিন ফোন করে জানালো, সে ময়মনসিংহ এসেছে। আমার ভার্সিটির এক নম্বর গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা কালো জ্যাকেট। সে সামনাসামনি আমায় একটা সারপ্রাইজ দিতে চায়। 'সে আমার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে', এটুকুর থেকে বড়ো সারপ্রাইজ আমার জন্য দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আমার হৃদয় কেঁপে উঠলো। এই প্রথম সেই সুন্দর কন্ঠটিকে চোখে চোখে দেখবো। সেই সুন্দর কন্ঠটা বাস্তব সত্য। আমি তাকে ছুঁতে পাবো, ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে আসছিলো। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। উত্তেজনায় হাঁটতে পারার ক্ষমতাটাই যেন হারিয়ে ফেললাম। আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে এক নম্বর গেট মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। সেই পাঁচ মিনিটের পথও আমি রিকশা করে আসলাম। না*র্ভা*স*নে*সে  ক*ম্প*ন*র*ত হাত-পা নিয়েই আশেপাশে তাকালাম। রাস্তার ওপাশ থেকে হ্যাংলা-পাতলা লম্বা দেখতে এক শ্যাম পুরুষ এগিয়ে এলো। মৃদু হেসে শুধালো, 'জুঁই?'

 
আমার হৃদয় থ ম কে গেলো। হাত-পায়ের ক*ম্প*ন বেড়ে গেলো। আমার মনে হলো, এই বুঝি মাথা ঘুরে ধুলাবালি মাখা রাস্তাতেই শয্যাশায়ী হবো। আমি থরথর করে কাঁ*প*তে কাঁ*প*তেই ফিসফিস করে বললাম,
' আমি বোধহয় মা রা যাচ্ছি। আমাকে প্লিজ জড়িয়ে ধরো।' 
সে ব্যস্ত হয়ে আমাকে দু'হাতের বাঁধনে আবদ্ধ করে নিজের বুকের সাথে চে*পে ধরলো। আমার কী হলো জানি না, আমি হাউমাউ করে কেঁ দে উঠলাম। সে এতো সুন্দর! এতো সুন্দর তার হাসি! একদম রাজপুত্রের মতো সুন্দর! আমার বুকে ব্যথা করে উঠলো। আমি কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তেই বললাম,
' তুমি এতো সুন্দর কেন? আমি তোমাকে এতো সুন্দর ভাবিনি। তোমার সুন্দর হওয়া অ প রা ধ।' 
আমার কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসলো সে। ফিসফিস করে বললো,
' কালো ছেলে সুন্দর হয়? বিয়ের পর সেল্ফি তুললে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বলবে লোকে। তুমি এতো ফর্সা কেনো?' 
আমি হেসে ফেললাম। সে আমার চোখের দিকে চেয়ে বললো,
' যদিও আমার একটা শ্যামবতী বউ দরকার ছিলো। কিন্তু  এক তুষার রাজ্যের রাজকন্যেকে ভালোবেসে ফেলেছি। শুনো রাজকন্যা, আমি তোমাকে জীবনের থেকে বেশি আর স্বপ্নের থেকে একটু কম ভালোবাসি। যে স্বপ্নে তুমি আছো, সেই স্বপ্ন আমার কাছে তোমার থেকেও দামী।' 
সে একটা সুখের দিন! স্বপ্নের দিন! কা*ন্নার দিন। আমি সেদিন সারাটাক্ষণ শুধু কেঁ*দে*ছি। আর সে একটা নৌকো ভাড়া করে নৌকোর পাটাতনে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থেকেছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে হলুদ পাল তোলা নৌকা ভেসেছে আর আমরা ভেসেছি রূপকথার মতো সুখে। সেদিনই আমি জানতে পেরেছি, 'বিসিএসের ফলাফল হয়েছে। পূর্বে দিয়ে রাখা বিসিএস পরীক্ষায় তার প্রসাশন এসেছে। কোনো চিন্তা নেই, এবার নিরুদ্বেগে বিয়ে করা যাবে।' কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম সুখ বড়ো অপ্রতুল। সে স্বাধীন পাখি। এক খাঁচায় থাকতে তার ভীষণ কষ্ট। সন্ধ্যায় নৌকা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে গিয়ে তার ওয়ালেটের একটা ছবিতে আমার চোখ পড়লো। আমার সুখ উড়ে গেলো। বিস্মিত চোখে চেয়ে শুধালাম,
' ওটা কার ছবি?' 
সে ছবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
' আমার মা। আমার চেহারাটা মায়ের মতো হয়েছে না?' 
আমি বিস্মিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। তার চোখের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে ভর করলো ঘোর আতঙ্ক। আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,
' কী হয়েছে?' 
আমি তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম। কথাগুলো যেন কন্ঠে আটকে গেলো। আমার দুনিয়া ভেঙে গেলো। কম্পিত কন্ঠে শুধালাম,
' তোমার মায়ের... তোমার মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর? তুমি সনাতন?' 
তার মুখটা সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আমার বাহু চেপে ধরে চোখ দুটোতে ভীষণ ব্যথা নিয়ে বললো,
' আমার কথাটা শুনো। লেট মি এক্সপ্লেন।' 
আমার স্বপ্নের আকাশে তখন ঘোর কালবৈশাখী। আমার পৃথিবী গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বালুচর। আমার বুকে চেপে বসেছে ক্ষু*ধার্ত য*ম*দূ*ত। আমি শ্বাস নিতে পারি না। আমার এই জন্ম মিথ্যে মনে হয়। আমি তার হাত সরিয়ে দিয়ে টলতে টলতে দু'পা পিছিয়ে গেলাম। ইয়া বিধাতা এ কেমন অ ভি শা প? করুণ কন্ঠে শুধালাম,
' আমি তোমাকে ভালোবাসি। কেন করলে তুমি এমন? কেন? তুমি জানতে না আমার ধর্ম?' 
তার চোখে-মুখে ব্যথার কালো দাগ। মাথা নিচু করে বললো,
' জানতাম।' 
' জানতে! তবুও?' 
তার কন্ঠ নিঃসৃত হরফগুলো যেন আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার ভরসা, আমার এক জনমের উজার করা ভালোবাসা আমায় এতো বড়ো ধোঁ*কা দিতে পারলো? সে আমার দিকে এক পা বাড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
' একটু বুঝার চেষ্টা করো জুঁই। আমি নিরুপায় ছিলাম। যখন আমার বিষয়টা খেয়াল হয় ততদিনে খুব দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আমার ফিরে আসার আর পথ ছিলো না। আমি তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছিলাম না। প্লিজ, বুঝো।' 
আমার নড়বড়ে পা দুটো আরও একবার টলে উঠলে। ক্ষণিক আগের সুখটুকু সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা ক্লান্ত চিলের মতোই কে জানে কোথায় গা লুকালো। আমার চোখ থেকে মোটা মোটা দুই ফোঁটা জল গড়ালো। দুর্বল কন্ঠে বললাম,
' আমি তোমাকে ভালোবাসি।' 
সে ভঙ্গ কন্ঠে বললো,
' মায়ের দিব্যি জুঁই, আমার থেকে ভালো তোমায় কেউ বাসতে পারবে না।' 
আমি হালকা কন্ঠে বললাম, 
' তা হয় না।' 
' কেন হয় না?' 
' তুমি জানো, কেন হয় না। কেন করলে এমন? কেন এভাবে মে রে ফেললে আমায়? আমি তো ম রে গেলাম। আমি এখন বাঁচবো কী করে রাতুল?' 
রাতুল অ*স্থির কন্ঠে বললো,
' সব হয় জুঁই। অহরহ হচ্ছে। চেয়ে দেখো, কত মানুষ ভালো থাকছে। আমরা কেন পারি না? যার যার ধর্ম পালন করে দিব্যি চলে যাবে একটা জীবন।' 
আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বসে পড়লাম কাদামাখা নদীর পাড়ে৷ পা দুটোতে আর শক্তি হচ্ছে না। যেমন শক্তি হচ্ছে না মনে। দুই হাতে মাটি খামচে ধরে উদাস কন্ঠে বললাম,
' চলবে না রাতুল। চলতে পারে না। আমার ধর্মে এই নীতি নিষিদ্ধ। আমি কোনো বি*ধর্মীকে বিয়ে করতে পারি না।' 
অতঃপর চোখ তুলে রাতুলের চোখের দিকে চেয়ে করুণ কন্ঠে বললাম,
' তোমাকে আমি ভালোবাসতে পারি না রাতুল। তুমি কখনো আমার হবে না, এ আমি মানতে পারছি না। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।' 
রাতুলও হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো আমার সামনে। দুই হাতের আঁজলায় আমার অ*শ্রু*সি*ক্ত মুখটা তুলে ধরে বললো,
' কোনো একটা উপায় নিশ্চয় আছে জুঁই। তুমি এতো ভে*ঙে পড়ো না। আমি তো আছি, ভ*য় কী?' 


আমি তার চোখের দিকে স্থির চেয়ে রইলাম। তার অসম্ভব সুন্দর চোখদুটোতে কাতরতা। চোখের ঘন পাপড়িতে মুক্তোর মতো অশ্রু ফোঁটা। আহা! কত গভীরভাবেই না ভালোবেসেছিলাম আমরা। হৃদয়টা ছিঁ*ড়ে নিলেও বুঝি এতোটা য*ন্ত্র*ণা হতো না যতটা য*ন্ত্র*ণা নিয়ে আমি তাকে শুধালাম,
' তুমি তোমার ধর্ম পাল্টে ফেলতে পারবে রাতুল?' 
রাতুল চমকে উঠলো। চমকে হাত সরিয়ে নিলো। তার ভেজা ভেজা চোখ দুটো ধীরে ধীরে অশ্রু টলমল দুটো বিলের রূপ নিলো। ফ্যা*কাশে মুখটা নিয়ে চেয়ে রইলো স্থির। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,
' জানি পারবে না। ক্ষ*মা করো, আমি তোমার ধর্মকে অ*সম্মান করতে চাইনি। নিজেকে খুব ছোট লাগছে আমার রাতুল। এতো স্বা*র্থ*প*র আমি! ক্ষ*মা করো আমায়। ক্ষ*মা করো।' 
রাতুল কাদামাটিমাখা নদী তীরে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। দুই হাতে নিজের মায়া মায়া মুখটাকে চেপে ধরে অদ্ভুত ব্যথাময় কন্ঠে চিৎ*কার দিয়ে উঠলো। ফিসফিস করে বললো,
' আমি এমনটা করতে পারি না জুঁই। পারি না। আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে আমি। তাদের আমি এভাবে মে রে ফেলতে পারি না৷ আমাকে ক্ষমা করো জুঁই। ক্ষমা করো।' 
আমি হাতের পিঠে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু'পা এগিয়ে গেলাম। রাতুলের ঘন চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে নিচু হয়ে তার মুখের দিকে চাইলাম। ওর পাতলা ঠোঁট আর ঘন পাপড়িগুলো অভিমানী শিশুর মতো কাঁপছিলো। সে অভিমানী কাতর চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো। যেন আমি চাইলেই সমাধান করে ফেলতে পারি পৃথিবীর সকল যোগ-বিয়োগ। আমি ঠোঁট নামিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালাম। কপালে কপাল ঠেকিয়ে পৃথিবীর সব থেকে শক্ত কথাটা বললাম,
' ক্ষ*মা করলাম। আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রেখো না। যোগাযোগের চেষ্টা করো না। আমাদের গল্পটা এখানেই শেষ।' 
রাতুল অ*বিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি তার কপালে আরও একটা তপ্ত চুমু দিয়ে বললাম, 
' আমি তোমাকে ভালোবাসি রাতুল। তোমাকে ছাড়া বাঁচাটা খুব কঠিন হবে।' 
সেদিন রাতুল কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ফ্যা*ল*ফ্যা*ল চোখে চেয়েছিলো শুধু। তারপরের দিনগুলো ছিলো খুব দূ*র্বী*ষ*হ। আমি রাতুলের নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলেছি। রাতুলকে দমাতে সীম কার্ড চেঞ্জ করেছি। কম্বলের তলায় মুখ লুকিয়ে কত অন্ধকার রজনী অশ্রুতে ভাসিয়েছি। উপলব্ধি করেছি, এই শহুরে যাপন বড়ো ক*ষ্ট। এখানে মন খোলে কাঁ*দা যায় না। এক চিলতে হাসা যায় না। এই শহুরে যাপনে কেবল অভিনয় সত্য। এভাবে এক মাস কাটার পর একদিন হুট করেই রাতুলের দেখা মিললো। সে আমার ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। চুল উশকোখুশকো। চোখের নিচে বেদনার কালো ছোপ। জামা-কাপড় অবিন্যস্ত। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তার এই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হৃদয় গলে গেলো আমার। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না৷ দূরে থাকতে পারলাম না। এড়িয়ে যেতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম তার দিকে। সে আমার দিকে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
' কেমন আছো?' 
সে অনেকটাক্ষণ আমার দিকে স্থির চেয়ে থেকে আচমকা আমার হাত খামচে ধরে করুণ কন্ঠে বললো,
' আমি তোমাকে ভালোবাসি জুঁই। তুমি প্লিজ আমায় ভালোবাসো। এভাবে ইগনোর করো না। তোমার ইগনোরেন্স আমি নিতে পারছি না। আমার বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন মনে হচ্ছে। আমার বেঁচে থাকার খুব শখ জুঁই। খুউব। আমাকে একটু দয়া করো।' 
বি*ধ্ব*স্ত মানুষটির দিকে চেয়ে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো আমার। চোরাবালির বাঁধে বেঁধে রাখা অনুভূতিগুলো তার উপস্থিতিতে ভেসে গেলো। আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, ধীরে ধীরে সরে যাবো। ধীরে ধীরে সয়ে যাবে। আবারও আমাদের কথা হতে লাগলো। রাতুল আবারও ফিটফাট বাবুটি হয়ে অফিস করতে লাগলো। ছুটি পেলেই ময়মনসিংহ আসতে লাগলো। আমরা সব ভুলে মাসের একটা দুটো দিন নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। কখনও ভবিষ্যতের চিন্তায় নিশ্চুপ, তো কখনো গল্পের ফুলঝুরি ছুটতে লাগলো। এর মাঝে রাতুলের ট্রেনিংয়ের সময় হলো। আমিও পড়াশোনার দোহায় দিয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরার চেষ্টা করতে লাগলাম। রাতুলের এক বন্ধুকে খুব অনুরোধ করে রাতুলের বাবা-মাকে বিষয়টা জানাতে বললাম। তারপর কী হয়েছিলো আমার জানা নেই। রাতুল কেবল একদিন দেখা করতে এসে বললো,
' বাসা থেকে বিয়ের প্রে*শার দিচ্ছে। তোমাকেও তো বাসা থেকে বিয়ের প্রে*শার দিচ্ছে। রাজি হয়ে যাও না। আমার ফ্যামিলিকে আমি মানিয়ে নিবো। মা রাজি হবেন।'
আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,
' আমার পরিবার রাজি হবে না। এমন হয় না।' 
রাতুল করুণ চোখে চাইলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
' তুমি তো নিজেই চাও না। আমাকে ভালোবাসো না, না? জোর করে থাকছো?' 
' তোমার তাই মনে হয়?' 
' রে*গে যাচ্ছো কেন?" 
' রা*গার মতো কথা বললে রা*গ করবো না? দেখো রাতুল? এসব নিয়ে কোনোরকম আলোচনা আমি চাই না। যা হবে না, তা বারবার বলে বলে ব্য*থা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি তোমার বাবা-মার পছন্দমতো বিয়ে করে ফেলো। আমি তোমাকে ধরে রাখছি না।' 
রাতুল ব্য*থিত কন্ঠে বললো,
' কেনো ধরে রাখছো না? এতো কঠিন ব্যবহার কেন করছো আমার সাথে? আমার ধর্মে আমার হাতে ছিলো না।' 
আমি শক্ত কন্ঠে বললাম, 
' ধর্ম তোমার হাতে না থাকলেও গোটা ব্যাপারটা তো তোমার হাতেই ছিলো রাতুল। কেন তুমি ফাঁ সা লে আমায়? আমাকে ফাঁ সা নো র সময় মনে ছিলো না?' 
রাতুল বাক্যহারার মতো চেয়ে রইলো। প্রশ্ন করলো,
' আমি তোমাকে ফাঁ সি য়ে ছি?' 
আহা, আমার ভালোবাসা! আমি আমার ভালোবাসার রক্তাক্ত বুক দেখলাম। তার র ক্তা ক্ত বুকের উপরই কথার চা বু ক চালিয়ে ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*ত করে দিলাম। তার কাতর চাহনি আমার বুকটা ছিঁ*ড়ে ফেললো। তথাপি তার অসহায়ত্বের উপর তীক্ষ্ণ ক্ষু র বসিয়ে আমি উত্তর দিলাম,
' হ্যাঁ, ফাঁ সি য়ে ছো। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো তুমি। স্বা র্থ প র।'
রাতুল কাতর কন্ঠে বললো,
' আমার সাথে এতো কঠিন হয়ে থেকো না জুঁই। আমি আর কখনো বিয়ের কথা বলবো না। তবু তুমি বদলে যেও না। তোমাকে বদলে যেতে দেখলে আমার ক ষ্ট হয়।' 
রাতুল তার কথা রেখেছিলো। সে আর বিয়ের কথা বলেনি। ততদিনে আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। বাসায় বিয়ে নিয়ে নিত্য ক্যা*চাল স হ্য করেও চাকরির পড়া পড়ছি। রাতুলের ততোদিনে পদন্নোতি হয়েছে। সেই সাথে নি*স্পৃহ হয়ে গিয়েছে ব্যবহার। আমি তাকে তার নি*স্পৃহতার কারণ জিজ্ঞেস করিনি। সেও বোধহয় বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু একদিন থাকতে না পেরে বলেই ফেললো,
' আমার আর ভালো লাগছে না জুঁই। আমি এতো ম্যা*ন্টা*ল প্রে*শার নিতে পারছি না। সবাই কী ভুলে গিয়েছে যে আমিও মানুষ?' 
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
' বিয়ে করে ফেলো রাতুল। আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। আমারও বাসা থেকে বিয়ের প্রে*শার আসছে। এভাবে আর কতদিন? আঙ্কেল আন্টিরও তো একটা এক্সপেক্টেশন আছে।' 
' আর আমার এক্সপেক্টেশন?' 
' সেটা তোমার আগে চিন্তা করা উচিত ছিলো।' 
' ভালোবাসাটা কী অ*ন্যায় জুঁই?' 
আমি উত্তর দিলাম না। আমরা দীর্ঘ একটা ঘন্টা ফোন কানে চেপে চুপচাপ বসে রইলাম। মনে মনেও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে পারছিলাম না, ' তাকে আমার করে দাও আল্লাহ!' কী বলে প্রার্থনা করবো আমি? এই অসহায় অবস্থা থেকে কী করে বেরুবো আমি? কী করে তার ক*ষ্ট কমাবো? কমাবো আমার হৃদয় ব্য*থা। তার ক*ষ্ট, তার বি*ধ্ব*স্ত মুখ দেখে যে ঝ*লসে যায় আমার বুক। হে বিধাতা! আমি কী বলে প্রার্থনা করবো বলে দাও। দয়া করো! ক্ষ*মা করো! পাপ করেছি। এই পাপের প্রা*য়*শ্চি*ত্ত এতো কঠিন কেন? সেদিন সারাটা রাত আমরা জেগে রইলাম। দু'জনেই নিশ্চুপ থেকে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে গেলাম কেবল। সেই নিঃশ্বাসগুলোও যেন হা*হা*কার করে উঠলো কা*ন্নায়। আকাশে বাতাসে আকুতি ছড়িয়ে প্রার্থনা করলো, 'হে বিধাতা আমাদের বাঁচতে দাও। তার বেঁচে থাকার যে খুব শখ। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর শখ। প্রাণখোলে হাসার শখ। সে বহুদিন হাসে না। তাকে একটু হাসতে দাও। দোহায় তোমার! তাকে একটু বাঁচতে দাও।' একমাস পর রাতুল অনুভূতিহীন কন্ঠে জানালো সে বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছে। পাত্রী ভীষণ সুন্দর। আমার বুক ফেঁ*টে কা*ন্না পেলেও হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানালাম। রাতুল শুকনো হাসলো। আমিও বাসায় বিয়ের কথায় রাজি হলাম। রাতুলকে ফোন দিয়ে মজা করে বললাম,
' চলো দুজন একদিনেই বিয়ে করি। একইদিনে আমরা অন্যের হয়ে যাবো। একইদিনে আমাদের বাসর হবে। সুন্দর না?' 
রাতুল হাসলো। আমি হাসলাম। অথচ আমরা দুজনেই জানি আমরা হাসছি না। এ আমাদের কা*ন্না ঢাকার খোলস মাত্র। আমাদের ভেতরটা ফেঁ*টে যাচ্ছে। হৃদপিন্ডটা ক*ষ্টের পারদে পারদে ঝ*ল*সে যাচ্ছে। আমাদের বিয়ের ডেট ঠিক হলো একই দিনে। আমার হলুদ হলো। রাতুলের হলুদ হলো। রাতুল আমার ছবি চেয়ে নিয়ে দেখলো। বিস্তীর্ণ হেসে বললো,
' তোমাকে হলুদ পরির মতো লাগছে জুঁই। আমার কালো গায়ে হলুদ মানায়নি। কালো চামড়ায় হলুদ পড়ে বিদিগিস্তা অবস্থা।' 
আমি হেসে ফেললাম। আমরা হাসতে হাসতেই বুঝলাম, দু'জনের ভেতরটাই চেঁ*চি*য়ে উঠে বলছে,
' দোহায় তোমার, অন্য কারো হয়ে যেও না। আমি ম*রে যাবো। আমার স*হ্য হচ্ছে না।' 
পরের দিন আমাকে মন ভরে সাজানো হলো। রাতুল ঠিক যেমনটি বলতো, কেন জানি তেমনভাবেই সাজলাম। পার্লার থেকে ফিরে দরজায় পা দিতেই একটা পার্সেল পেলাম। পার্সেলে একটা চিঠি আর একটা লাল ওড়না। নাম-ঠিকানা নেই। আমি নিজের ঘরে ফিরে চিঠিটা খুললাম। চিঠিতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা, 
' ওড়নাটা তুমি চিনতে পারছো জুঁই? দুই তিন বছর আগে তোমার এই ওড়নাটা কত জে*দ করে আমার কাছে রেখেছিলাম মনে আছে? এই ওড়নাটাতে এখনও তোমার গন্ধ পাই। তোমার গন্ধ ছাড়া আমার ঘুম হয় না জুঁই। তুমি আমার জীবনে নেই ভাবলেই কেমন অ*স*হা*য় লাগে। হা*হা*কা*র করে উঠে বুক। আমি তোমাকে খুব য*ন্ত্র*ণা দিই, না? জুঁই, আমার জুঁই। আমার খুব বেঁচে থাকার তেষ্টা। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে যখন স্যার জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমার ইচ্ছে কী রাতুল? আমি বলেছিলাম, স্যার আমার অনেক বছর বাঁচার ইচ্ছে। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না। জীবন, বাবা-মা আর তোমাকে একই দাঁড়িপাল্লায় মাপার পর  জীবনটা ভালোবাসার যুদ্ধে হেরে গেলো। বুঝলাম, এ কয়েক বছরে বাবা-মা, তুমি আর জীবনের মাঝে সবচেয়ে কম ভালোবেসেছি জীবনটাকে।
জুঁই? আমি তোমাকে কেন পেলাম না জুঁই? তোমাকে 'বউ' বলার স্বাদ আমার কেন পূরণ হলো না? তোমার আল্লাহকে বলো, তিনি বড়ো অন্যায় করলেন আমার সাথে। কী হতো পৃথিবীর একটা কোণে আমাকে একটু বাঁচতে দিলে? এই পৃথিবীটা বড়ো নি*ষ্ঠুর*। এই নি*ষ্ঠু*র পৃথিবীতে তোমায় একা রেখে যাচ্ছি বলে রা*গ করো না, সোনা। তোমার খোদার কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসেছি প্রিয়তমা। জীবনের থেকে বেশি। হয়তো স্বপ্নের থেকেও বেশি। কিন্তু আফসোস, তোমাকে পাওয়া হলো না। 
ইতি 
তোমার ; শুধু তোমার 
রাতুল।' 


আমি চিঠিটা পড়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। কোনো অক্ষর, কোনো বাক্যই বোধগম্য হলো না। রাতুল! এমন চিঠি কেন লিখলো রাতুল? আমার হতভম্ব বিস্ময়ের মাঝেই ফোন বাজলো। ওপাশ থেকে রাতুলের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি জানালো,
' রাতুল আজ সকালে সু ই সা ই ড এট্যাম্প করেছে বৌদি। হাত-পায়ের সব র*গ কে*টে ফেলেছে। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হয়নি। কিছুক্ষণ আগে রাতুল মা*রা গিয়েছে।' 
এক মুহূর্তের জন্য আমার পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো। আমার রাতুল! আমার রাতুল আর নেই, এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমার রাতুল আমার প্রতি এতো অভিমান করতে পারে না। রাতুল, আমি বিয়ে করবো না। তোমাকেও বিয়ে করতে বলবো না। কখনো বলবো না। প্লিজ তুমি এতো অভিমান করো না। তোমার জুঁই একা একা এতো পাপমোচন করতে পারবে না।' 
মেয়েটি এই পর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার শব্দে যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো বজ্রপাতে অস্থির আকাশও। আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে দেখলাম, একজন প্রেশসীর হৃদয় বিদারক কান্নার হাঁক। মেয়েটি এক পর্যায়ে পাগলের মতো প্রলাপ বকতে লাগলো,
' আপনি ডাক্তার? আপনি ডাক্তার? আপনি ওকে একটু বুঝান না? আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। আমার হাতে তো আর উপায় ছিলো না। ওরা আমাকে একটিবার আমার রাতুলকে দেখতে দিলো না। আমার রাতুল এতো ক*ষ্ট পেলো। এতো ক*ষ্টের মৃ*ত্যু! আমি ওকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারলাম না।' 
মেয়েটি কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। চেতনা হারালো। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার গালে সত্যিকারের মানুষের মতো অশ্রু। এই অশ্রু বাঁধা মানছে না। টপটপ করে পড়ছে অপরিচিত এক তরুণী আর সদ্য মৃ*ত এক প্রেমিকের তরে। এই অশ্রুর রঙ হয় না। যেমন রঙ হয় না প্রগাঢ় প্রেমের। তেমনি প্রেমের কোনো রঙ হয় না।

সমাপ্ত


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন