উপন্যাস         :         শরম 
লেখিকা          :         তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ               :         শরম 
প্রকাশকাল      :       

জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। 

পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
শরম || তসলিমা নাসরিন
শরম || তসলিমা নাসরিন


৬ষ্ঠ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ০৭)

সাতটা শাড়ির দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা। টাকাটা খুব কুন্ঠায়, খুব লজ্জায় তিনি নিলেন বটে, কিন্তু একটা শাড়ি, ভালো একটা সিল্কের শাড়ি আমাকে দিলেন।

পাশের ঘরের আমজাদ আমার উপস্থিতির কথা কিছু যেন না জানে। কিন্ত এ কথা কাকে বলি? আমার নিরাপত্তারক্ষীরা আমাকে এ বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। তারা জানে না কেউ ঢুকে গেছে বাড়িতে, তার নাম আমজাদ। আমজাদের মনে কী আছে, তা এক আমজাদ ছাড়া আর কেউ জানে না। সুরঞ্জন কি জানে?
সংশয় আমাকে স্বস্তি দেয় না।

- যে লোকটি এসেছে, তাকে চেনেন? কিরণময়ীকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি। আমার সারা মুখ থমথমে।
কিরণময়ী হেসে বলেন - তুমি কি ভয় পাচ্ছ নাকি? ও খুব ভালো ছেলে। আমজাদ। আমজাদ আমার ঘরের ছেলের মতো। ও মেদেনীপুর গেল কাজে। সুরঞ্জনের বাইকটা নিয়ে গিয়েছিল। ফিরলো তো প্রায় এক মাস পর।

এক মাস নিজের বাইক যাকে দিয়ে দেওয়া যায় তার সঙ্গে সুসম্পর্কই তো থাকে। আমার অস্থির পায়চারি দেখে তিনি চিন্তিত। বেরিয়ে যে যাবো তারও উপায় নেই। ও ঘর দিয়েই বাইরে বেরোবার দরজা। আর ও ঘরে যাওয়া মাত্রই আমাকে আমজাদ নামের লোকটা নির্ঘাত চিনে ফেলবে। চিনে ফেললে সে কি পথরোধ করবে, নাকি অন্য কিছু, অন্য কোনও হাড় হিম করা কিছু! সুরঞ্জন কি তখন রক্ষা করবে আমাকে?


আজ সকালেই যাকে আমার খুব আপন মনে হলো, তাকেই আমি তখন অবিশ্বাস করছি। কিরণময়ী আমার অস্থিরতা লক্ষ করেন এবং বোঝেন, কেন। তিনি দরজার পর্দা সরিয়ে সুরঞ্জনকে এ ঘরে ডেকে নিয়ে আস্তে করে বলে দেন আমজাদকে বিদেয় করতে। সে ঠিক বুঝে পায় না কেন কী কারণে তার বন্ধুকে হঠাৎ বিদেয় করতে হবে। এ রকম তো নয় যে মায়া ঘরে আছে বা কিছু। কিরণময়ী আমাকে আড়চোখে দেখিয়ে ঘটতে পারে এমন একটা বিপদের আশঙ্কার ইঙ্গিত করে।

সুরঞ্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। আমিও। দুজন দুজনকে চিনতে চেষ্টা করছি হয়তো। কিন্তু আমাকে চেনা তার জন্য কঠিন হওয়ার কথা তো নয়। আমাকে মুসলিম মৌলবাদীরা মেরে ফেলতে চায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এ দেশেও। মুখে চুনকালি যে মাখতে পারবে, গলায় জুতোর মালা যে দিতে পারবে তাকে কুড়ি হাজার টাকা দেওয়া হবে, টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম ফতোয়া দিয়েছিল। আর কদিন আগে ফতোয়া দিল, যে মেরে ফেলতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কত কুশপুতুল পুড়িয়েছে
ওরা আমার, সুরঞ্জন জানে না? সুতরাং কার মনে কী আছে কে জানে?
  
চাপা ক্রোধ তার স্বরে- কিছু লোক তো জগতে ভালোও হয়, নাকি?
_ হ্যা, হয়। কিন্তু ওর ব্যাপার তো। কিরণময়ী বলেন।
_ হুম।
সুরঞ্জন বেরিয়ে গিয়ে আমজাদকে বিদেয় করে।
_একবার মায়াকে দেখতে যাবো।
খাটের রেলিং ধরে নীল মশারি ছুঁয়ে শৈশবের সেই দিনগুলো যেন ছুঁয়ে, বলি,
- মায়া?
কিরণময়ী চমকে উঠে বলেন-- কিন্তু ও তো শ্বশুরবাড়িতে।
- তাতে কী?
_ তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে?
_ এতে আমার কিছু যায় আসে না- কার বাড়ি। আমি মায়ার কাছে যাবো।
- ওকে তোমার বাড়িতে নাহয় যেতে বলি, অথবা তোমার ওখানে যদি অসুবিধে থাকে, ও বাড়িতে আসতে পারে, তুমি এসো তখন।
টের পাই শ্বশুরবাড়ি খুব ভয়ংকর কোনও বাড়ি। যেখানে যাওয়া যায় না।
কিরণময়ী আমার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললেন, -মা গো তুমি যাই যাই করছো কেন! এ বাড়িতে তুমি এসেছো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি বুঝি! কী খাবে বলো। ভাত না খেয়ে যাবে না।


আমার মাথায় খাওয়াদাওয়া নেই। মাথায় সুরঞ্জনের সঙ্গে আমজাদের সম্পর্কের জটিলতা এবং ওর মধ্যে এখন পা পা করে হেঁটে এলো মায়ার শ্বশুরবাড়ির দুরবস্থা। মায়া যদি ও বাড়িতে ভালোই থাকতো, নিশ্চয়ই কিরণময়ী খুশি হতেন মায়াকে দেখতে তার শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত আমি যাবো বলে।
  আরেক কাপ চা খেতে চাইলাম। চা যখন করছেন কিরণময়ী, বললাম- মায়ার সঙ্গে দেখা করতে আপনি বা সুরঞ্জন কি যান না?
 কিরণময়ী বললেন, -মায়াই আসে। ওর তো আবার দুটো বাচ্চা। এলে বাচ্চাদের নিয়ে আসে।
 - একা আসে না?
 - একাও আসে মাঝে মাঝে।
 - সঙ্গে স্বামী আসে না?
কিরণময়ী চুপ করে রইলেন। দীর্ঘশ্বাসটা তাঁর নয়, আমার বেরোলো। ভেবেছিলাম কিরণময়ী বলবেন, জামাইয়ের তো চাকরি আছে, সময় পায় না। আবার কলকাতার বাইরেও এত যেতে হয়। তাই মায়াই অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে দেখা করে যায়। না, এ ধরনের কিছু যখন তিনি বলেননি, এ ধরনের ঘটনাও ঘটেনি।
  দ্বিতীয় কাপ চা-এর পর আমি যখন বেরোবো, একটি মেয়ে ঢুকলো সুরঞ্জনের ঘরে। পরনে সবুজ সুতি শাড়ি, একটু বেঁটে একটু কালো একটা মেয়ে। হাসিতে একটা স্নিগ্ধতা। বয়স বোঝার উপায় নেই। তেইশও হতে পারে, তেতাল্লিশও হতে পারে। চোখ দুটো বড়-বড়। একটু আড়ষ্ট, একটু কী-করবে-বুঝতে-না-পারা-মুখ, একটু আবার মাথা-তোলা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দিতে হয় বলেই বললো, - ও জুলেখা। আমার ঠোঁটে একটুখানি হাসি। এই হাসি কেন, কী কারণে এলো জানি না। আমি যাচ্ছি। জুলেখাকে ঘরে বসিয়ে সুরঞ্জন আমার গাড়ি পর্যন্ত এলো। পেছন পেছন চোখের জল মুছতে মুছতে এলেন কিরণময়ী। তাঁকে বিদায়ের আলিঙ্গনে বেঁধে বললাম, - কাঁদছেন কেন! কাঁদবেন না।
   কিরণময়ী অস্ফুট স্বরে বললেন, - এখানে ভালো লাগে না, মা গো। ইচ্ছে করে দেশে ফিরে যাই।
   এর কোনও উত্তর না দিয়ে আমি গাড়িতে উঠি। পেছনে কিরণময়ীর সাদা শাড়ি, পেছনে দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক শহর অন্ধকার।


চলবে.......

৮ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ: 
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন