উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
৭ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ০৮)
সুরঞ্জন সেদিন আর বাইরে বেরোয় না। সন্ধ্যেয় তার যাওয়ার কথা ছিল আমজাদের সঙ্গে খিদিরপুর। যেতে ইচ্ছে না করার কারণ জুলেখা। জুলেখার সঙ্গে প্রায় এক সপ্তাহ পর তার দেখা। এ সময় কয়েক ঘণ্টা কেটে যাবে তার সঙ্গে। জুলেখা এই ঘরটিতে হাওয়া করার একটা পাখার মতো। ও এলে ফোসকা পড়া গরমকেও তেমন অসহ্য মনে হয় না। জুলেখাকে সুরঞ্জন কখনো বলেনি যে তাকে সে ভালোবাসে। কেবল মুখটি তুলে ধরে চুমু খাওয়ার আগে বলেছে- তুমি যে সাজো না, তাই তোমাকে এত ভালো লাগে।
জুলেখা শুনতে চায় আরও। সুরঞ্জন বলে, তবে নগ্ন দেহটি নিয়ে বলে। বলে- তোমাকে মৎস্যকন্যার মতো লাগে। তুমি ডুবে যাও, আবার ভেসে ওঠো। ভেসে ওঠো, আবার ডুবে যাও। জানি না কোন অতল থেকে সাঁতার কেটে চলে আসো, যখন ডাকি তোমাকে। তোমাকে চিনি, আবার চিনিও না। তুমি ডাঙার কেউ নও, চেনা কেউ নও। তুমি সত্যিকারের, নাকি মিথ্যেকারের বুঝি না। ডান হাতের মধ্যমাটি নগ্নিকার অলিতে-গলিতে ঘোরে। যেন শরীরের ক্যানভাসে ছবি আঁকছে সে। কপাল থেকে নাক বেয়ে গলায় নেমে দু বুকের চুড়োয় উঠে আবার নেমে গিয়ে মাঝখান ধরে সোজা পেট তলপেট উরুসন্ধি থেকে বাঁ উরুতে উঠে হাঁটু বেয়ে পা বেয়ে পা হয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে উল্টো পথে একই রকম ভাবে ফিরে আসে কপালে। কপাল থেকে আঙুল যখন বোজা চোখের পাতা স্পর্শ করে, তখন চোখ খোলে জুলেখা।
একসময় এই খেলাটি, বিছানায় প্রেমটি জুলেখার বাড়িতেই হত, যখন স্বামী চলে যেত কাজে, বাচ্চা স্কুলে। সুরঞ্জন উপগত হতে নিলেই পাড়ার একটা বেয়াড়া কুকুর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতো। কেন করতো কে জানে। শেষের দিকে কুকুরের চিৎকার শুনে সুরঞ্জনকে খেলা থামিয়ে বিদেয় নিতে হয়েছে। কুকুরের চিৎকারে জানালার কাছে কেউ ভিড় জমায়নি যদিও, কিন্তু জমাতেও তো পারতো-র একটা আশঙ্কা সব সময় থেকে যায়। পাড়ায় যারা অতি উৎসাহী ছিল সুরঞ্জনকে নিয়ে, জানতো যে জুলেখার বাপের বাড়ির লোক। বীরভূমে জুলেখার বাপের বাড়ি। অবশ্য বীরভূম থেকে, বছরের পর বছর যায়, কেউ উঁকিও দেয় না এদিকে। হঠাৎ উদয় হওয়া বাপের বাড়ির লোকের সঙ্গে খুব সন্তর্পণেই জুলেখা শুয়েছে মাসের পর মাস। কড়া দুপুরের দিকে জনমনুষ্যিহীন পাড়ায় সুরঞ্জনের কাছ থেকে পেয়েছে সে শরীরী প্রেম, যা মহব্বতের সঙ্গে অনেকগুলো বছর দিনের পর দিনের একঘেয়ে সেই সব সঙ্গমে পায়নি।
কী করে তার সঙ্গে পরিচয় জুলেখার, এই প্রশ্নটি করলে সুরঞ্জন দ্রুত কোনও উত্তর দিতে পারে না। সম্পর্কটি কি অনেক বছরের, নাকি অল্প কদিনের? এই প্রশ্নের উত্তরও তার পক্ষে খুব সহজ নয় দেওয়া। সুরঞ্জনের সঙ্গে আমজাদ নামের একটি মুসলমান ছেলের পরিচয় ছিল, ছেলেটির পার্ক সার্কাসে বাস, এ পাড়ায় আমজাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে আসতেই, চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতেই যে আরেকটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় সুরঞ্জনের, তারই আত্মীয় জুলেখা। কিন্তু জুলেখার সঙ্গে এ রকম সাদামাটা পরিচয়টি সুরঞ্জনের পছন্দ নয়। জুলেখার সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রথম দিন থেকে সুরঞ্জন অনেকটা ঘোরের একটি গল্প গড়ে উঠতে দেখে। মস্তিষ্কের কোষে কোষেই গল্পটির অঙ্কুর সে নিজেই বপন করেছে, নিজেই সেগুলোকে দেখছে চোখের সামনেই তরতর করে বড় হচ্ছে। গল্পটি বড় হয়ে হয়ে তাকে নিবিড় করে ডাল পাতা ফুল দিয়ে ঢেকে ফেলতে থাকে, তাকে আমূল আচ্ছন্ন করে রাখে বেশিরভাগ সময়, জুলেখার সঙ্গে যখনই সে ঘনিষ্ঠ হতে যায়, গল্পটিকে আর গল্প মনে হয় না, মনে হয় এই তো কিছুদিন আগে সবে ঘটে গেল ঘটনাটি। একসময় গল্পকেই সত্যি বলে মনে হতে থাকে। অবচেতন একটি মন একে সত্যি মনে করছে। সুরঞ্জনের মাথার দোষ এখনও কোনও ডাক্তার বা বাড়ির লোকেরা বা বন্ধুরা বা জুলেখা ধরেনি। সুরঞ্জন জানেও না একটি মিথ্যে গল্প তার ভেতরে দৈত্যের মতো বড় হচ্ছে। জুলেখার সঙ্গে তার সত্যটি তার ভালো লাগে না, জুলেখার সঙ্গে তার মিথ্যেটি অসাধারণ। মিথ্যেটিতে সে হিরো। এ শহরে তাকে কেউ চেনে না, জানে না। কিন্তু মিথ্যেটি তাকে অহংকারী করে তোলে। এই মিথ্যেটি তার সম্পদ। আবার এই মিথ্যেটি তাকে লজ্জাও দেয় খুব। জীবনে তার গোপন একটি মিথ্যেই আছে, মোট তাকে একই সঙ্গে অহমিকায় এবং অপমানে ভোগায়। মিথ্যেটি অথবা সুরঞ্জনের অবচেতনের সত্যটির মধ্যে একটি খুনের পরিকল্পনা আছে। ফোন বেলঘরিয়ার কয়েকজন মিলে পরিকল্পনাটি করে, সুরঞ্জন আর অচিস্ত্য ছিল ওদের দলে। অচিন্ত্যর সঙ্গে সুরঞ্জনের অনেক দিনের বন্ধুত্ব। বাকিদের সঙ্গে সম্প্রতি ওঠাবসা শুরু হয়েছে। খুন করতে হবে মহব্বতকে, কারণ দুটো ছেলেকে সে বেধড়ক পিটিয়েছে। খুন যদি সম্ভব না হয়, তবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছু ভেঙে কিছু কেটে কিছু থেঁতলে এমনভাবে ফেলে রাখতে হবে, যেন যত দিন বাঁচে, পঙ্গু হয়ে, যন্ত্রণায় ভোগে।
নিউ মার্কেটে মহব্বত হোসেনের বাসন-কোসনের ব্যবসা। দোকান বাসনপত্র, দেশি-বিদেশি ডিনার সেট, টিসেট, গ্লাসসেট, চামচসেট, ইলেকট্রিক কেতলি, ননস্টিক কড়াই পাতিল এ রকম অনেক কিছুর। এই নিরীহ মহব্বতের আবার দোষ কী? দোষ হলো, আকণ্ঠ মদ্য পান করা দুটো ছেলে মহব্বতের কাছে এসে টাকা চেয়েছিল। কিসের টাকা? কিছুর না। এমনি। মহব্বত আর তার বন্ধুরা মিলে ছেলে দুটোকে আচ্ছামতো পিটিয়ে পুলিশে দিয়ে দিল। এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে শহরে। এ এমনই তুচ্ছ ঘটনা যে, এর কোনও নিউজভ্যালুও নেই। কিন্তু তলিয়ে দেখলে এ নিতান্তই ভয়ংকর। ভয়ংকর না হলেও অন্তত ভয়ংকর বলেই ভয়ংকর লোকেরা ভেবে নেবে। কারণ, যারা মেরেছে তারা মুসলমান, আর যারা মার খেয়েছে তারা হিন্দু। এই দুঃসংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো সুরঞ্জনের বন্ধু মহলে। কারণ হিন্দু যুবকেরা বেলঘরিয়ার ছেলে, সুরঞ্জন অচিন্ত্যদের বন্ধু। সবাই এক রকম পালিয়ে পালিয়ে রয়েছে। পুলিশ না আবার বেলঘরিয়ায় ঢুকে তাণ্ডব শুরু করে। তার আশঙ্কা যে একেবারে নেই, তা কেউ বলতে পারে না। সাবধানের মার নেই।
হঠাৎই এক বিকেলে অচিন্ত্য একটা সুমোয় কয়েকটা বন্ধু নিয়ে সুরঞ্জনের বাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে সোজা পার্ক সার্কাসের গলির দিকে যাত্রা করে। সুমোয় লাঠিসোঁটা, রড কিরিচ, ছুরি ড্যাগার সব কালো কাপড়ের তলায় লুকোনো। গাড়িতে বসে মদ খাওয়া চলতে থাকে। সুরঞ্জন সানন্দে খাওয়ায় যোগ দেয়। সেদিন রোববার, মহব্বত বাড়ি থাকবে এ রকমই আন্দাজ করেছিলো ওরা। কিন্তু দলবল নিয়ে মহব্বতের বাড়িতে চড়াও হওয়ার পর দেখলো ব্যাটা নেই। স্ত্রী একা বসে আছে। ওই স্ত্রীকেই টেনে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আসা হলো। অচিন্ত্যের পরামর্শে দ্রুত গড়িয়াহাট। পুরনো বন্ধু পিকে মজুমদারের যে রেস্তোরাঁ আছে গড়িয়াহাটে, তার ওপরতলায় ছোট একটা ঘরে, যে ঘরটা মূলত সিয়েস্তার ন্যাপ-এর, আর মাঝে সাঝে হিসাব পত্তরের কোনও জরুরি মিটিং-এর জন্য রাখা, উঠে এল অচিন্ত্য আর সুরঞ্জন। বাকিরা দশ মিনিটে আসছে বলে বেরিয়ে গেল। ঘরে একটা চৌকি, চৌকিতে পাতলা তোশক আর তেল চিটচিটে বালিশ।
একটা সাধারণ কাঠের টেবিল আর দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার। টেবিলের ওপর পুরনো কিছু কাগজপত্র। ঘরটিতে আশ্চর্য যে, টেনে আনতে হলো না জুলেখাকে। নিজেই সে দিব্যি ওপরে হেঁটে এলো। অচিন্ত্য জলের বোতলে হুইস্কি আর জল মিশিয়ে এনেছে। বোতলটা বারবারই উপুড় করে গলায় ঢালছে।
- মহব্বত কোথায়? শালা কোথায়? জুলেখা শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল- ও তো দোকান বন্ধ করে এখন ওর একটা বন্ধুর বাড়িতে গেছে। - কী নাম বন্ধুর ?শান্ত কন্ঠ জুলেখার। - তৌকির।- তৌকিরের বাড়ি কোথায়?- রায় বাহাদুর রোড।- এটা কোথায়? সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে।অচিন্ত্য বললো- চিনি। চণ্ডিকলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে তো। জুলেখা মাথা নাড়ে- হ্যাঁ।
সুরঞ্জন ঠিক বুঝতে পারছে না কেসটা একটা কিডন্যাপ কেস হয়ে উঠছে, নাকি এর কাছ থেকে মহব্বতের খবর নেওয়ার জন্যই একে ধরা।অচিন্ত্যকে বললো, তাহলে একে আর ধরে আনার দরকার কী ছিল? খবর নিয়ে আমরা রায় বাহাদুর রোডেই চলে যেতে পারতাম। অচিন্ত্য এবার গলায় হুইস্কি ঢেলে বললো— ফোন করে টাকা চা।সুরঞ্জন বললো— বউ-এর জন্য কোন শালা টাকা দেবে রে? তাও আবার নেড়ে বলে কথা। হতো নাদুস-নুদুস পুত্রধন। চাওয়া যেত।অচিন্ত্য বললো— একে না এনে পুত্রধনকে আনলি না কেন?সুরঞ্জন বললো— কোনও ধনই ও বাড়িতে ছিল না।
এখন এই মদ খাওয়ার আসরে মহব্বতের স্ত্রীকে ঠিক কী কাজে ব্যবহার করা হবে সুরঞ্জন জানে না। অচিন্ত্য প্যান্টের বেল্ট খুলে ফেলে আরাম করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। বেল্টটাকে হাতে নিয়ে অচিন্ত্য হাওয়ায় দোলাতে থাকে। চোখ বউ-এ। ঠোঁটের হাসিটির অনুবাদ এলোমেলো। সুরঞ্জন আশঙ্কা করে, ঘটনা অন্যদিকে গড়িয়ে যেতে পারে। মহব্বত টার্গেট নয় এই মুহূর্তে। টার্গেট মহব্বতের স্ত্রী, জুলেখা। অচিন্ত্য কি প্যান্টটা খুলবে, নাকি বেল্টকে চাবুক হিসেবে ব্যবহার করবে? সুরঞ্জন দুটির কোনও একটি দৃশ্য দেখার জন্য এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয়।
অচিন্ত্যর বোতলটা তুলে নিয়ে সুরঞ্জনও ঢালে গলায়। জলের মতো ঢালে। ছাতি ফেটে যাওয়া তৃষ্ণায় যেমন ঢালে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে তখন বাকি তিনজন। সুব্রত, বিশ্ব আর গোপাল। সুব্রতর হাতে দুটো টিচারস মদের বোতল। গোপালের হাতে কয়েকটা প্লাস্টিকের গ্লাস, বিশ্বর আর তিনটে জলের বোতল। ঢুকেই ইয়াও হু বলে চাপা চিৎকার তিনজনের। সবার চোখ জুলেখার দিকে। জুলেখা একটা চেয়ারে পেছন ফিরে বসা। হঠাৎ বিশ্ব পেছন থেকে দাঁড়িয়ে জুলেখার স্তন খামচে ধরলো। সুরঞ্জন অনুমান করে, জুলেখা দাঁতে দাঁত পেতে বসে আছে। অচিন্ত্য জোরে হেসে উঠে বললো- আমার মালে আমার আগে হাত দিচ্ছিস যে বড়!
এরা সবাই সুরঞ্জনের বন্ধু। এত দিন এদের সঙ্গেই সে মিশেছে। মদ খেয়েছে। মাতাল হয়েছে। রাজনীতির গল্প করেছে। মুসলমানদের হাতের কাছে পেলে ঘাড় মটকে দিয়েছে। ল্যাং মেরেছে। অন্তত না মারতে পারলেও মারতে চেয়েছে। সত্যিকার বুকের পাটা যদি দলের মধ্যে কারও থাকে, সে সুরঞ্জনের। কিন্তু তার পরও আজ তার মনে হচ্ছে, জুলেখাকে এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা উচিত। সব্বনাশ হয়ে যাবে কোনওভাবে যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। জেল-ফাঁসি হয়ে যেতে পারে। ক্ষমতায় কমিউনিস্ট। হিন্দুর যা কিছু হোক ক্ষতি নেই, মুসলমানদের গায়ে কেউ হাত ওটালে তার চৌদ্দগুষ্টিকে আর আস্ত রাখা হবে না।
মাথা ঝিমঝিম করছে। মাথা উড়ে যাচ্ছে ধড় থেকে। মাথা গড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়াহাটের মোড়ে গোত্তা খাচ্ছে। প্যান্টের বেল্ট সুরঞ্জনেরও খোলা হয়ে গেছে। সে আগে, না অচিন্ত্য আগে? নাকি ওরা আগে? ওরা 'আগে গেলে বাঘে খায়' বলতে বলতে তড়িঘড়ি টিচারস ঢেলে গিলছে। সুরঞ্জন একবার চুমুক দেয় ওদের মদে আরেকবার অচিন্ত্যের মদে। এত ভালো মদ তার আদপেই খাওয়া হয় না। বন্ধুরাও টিচারস খাওয়ার লোক নয়। আজ ভালো দিন। ভালো খাবার-দাবারের দিন। আজ উৎসব।
সুরঞ্জন লক্ষ করে, চেয়ার থেকে একটানে জুলেখাকে বিছানায় ফেললো সুব্রত ময়লা তোশক-বালিশের মধ্যে। সুব্রতর মাথাও কোথাও গড়াচ্ছে। শরীর টলছে তার। টেনে খুলে নিল জুলেখার শাড়ি। সায়া-ব্লাউজও টেনে টেনে খুললো। উলঙ্গ একটা নারী পাঁচজন পুরুষের চোখের সামনে। সুরঞ্জন অপলক তাকিয়ে থাকে জুলেখার শরীরের দিকে। সুদেষ্ণার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সুরঞ্জন কোনও উলঙ্গ নারী দেখেনি। তরুণী একটা শরীর। ভরাট স্তন। বাচ্চা জন্ম দেওয়া স্তন বলে মনে হয় না। তলপেটে কিছু মেদ। মেয়েদের ওই মেদটুকু সুরঞ্জনের ভালো লাগে। প্রাকৃতিক বলে মনে হয়। না খেয়ে খেয়ে দৌড়ে সাঁতরে মেদ ঝরিয়ে ফেললে বড় কৃত্রিম লাগে। সুরঞ্জনের কি তৃষ্ণা জাগে! জাগে। উরুসন্ধির অঙ্গ ফুঁসে বেরোতে চায়। চোখ ফেরায় সুরঞ্জন অন্যদিকে। অচিন্ত্য টিপ টিপ করে মদ ঢালছে জুলেখার গায়ে। ঢালছে আর হা হা করে হাসছে। মেয়েটি, আশ্চর্য, কাঁদছে না । শাড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখও ঢাকা পড়ে আছে। কিছু সে দেখাতে পাচ্ছে না। জুলেখা চিৎকার করতে পারে, এই আশঙ্কায় অচিন্ত্য তার মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে দেয়। সে কাপড় মেয়েটি যেই না সরাতে নেয়, গালে কষে থাপ্পর খায়। কিন্তু সরায় শেষ পর্যন্ত, কোনও চিৎকার করে না। হাত-পা ছোড়ে না, শুধু নিজের চোখ দুটো ঢেকে রাখে। ঘৃণায়।
চলবে.......
৯ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন