উপন্যাস        :          শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত
লেখিকা         :          মানদা দেবী
গ্রন্থ              :         
প্রকাশকাল      :        ১৯২৯ ইং
রচনাকাল       :         

লেখিকা মানদা দেবীর ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’ গ্রন্থটি মূলত আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ। তিনি তার ব্যক্তিজীবনের চড়াই উৎরাইকে উপজীব্য করে এটি লিখেছেন। এই গ্রন্থটি ১৯২৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর পরই তৎকালিন উচ্চবিত্ত সমাজে ব্যপক সোরগোল শুরু হয়ে যায়। এমনকি যা আদালত অবদি গড়ায়। মানদা দেবীর বিখ্যাত এই আত্মজীবনীটি ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল।
শিক্ষিতা পতিতার আত্ম-চরিত || মানদা দেবী
শিক্ষিতা পতিতার আত্ম-চরিত || মানদা দেবী

1111111111111111111111111111

১১ তম পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন

শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত || মানদা দেবী (পর্ব - ১২)

টি-পার্টি


ভবানীপুরে উঠিয়া আসিয়াছি পর হইতে আমি মিস্ মুখার্জ্জি নামেই পরিচিত। আমি এখন আর “মানদা” “ফিরোজা বিবি” বা “মানী দিদি” নহি। প্রতিদিন আমি নূতন নূতন মতলব আঁটিতে লাগিলাম! আমার এই মতলবের মধ্যে টি-পার্টি ছিল প্রধান। আফিস ছুটীর পর আমার দালাল আসিতেন। যাঁহারা আসিতেন তাঁহারা ভাল মন্দ উভয় শ্রেণীরই ছিলেন। দুই এক ঘণ্টা আলাপ পরিচয়েই আমার প্রয়োজনীয় ব্যক্তিটীকে বাছিয়া লইতে পারিতাম। এভাবে যাঁহারা আসিতেন তাঁহাদের দ্বারা আমার তেমন ভাল আয় হইত না, বিশেষতঃ এদের জন্যও খরচ হইত। বড়লোকের পকেটে হাত দিতে না পারিলে আমার ও দালাল দ্বরের কি করিয়া পোষাইবে।

একদিন ব্যারিষ্টার সাহেবকে বলিলাম, দেখ একটা কাজ কর। এই কলিকাতা সহরের বড় ব্যবসায়ী, বড় চাকুরে, ডেপুটী, মুন্সেফ, জমিদার, উকীল, ব্যারিষ্টার, স্কুলের শিক্ষক, প্রফেসার, দেশকর্ম্মী, সংস্কারক―এদের মধ্যে যাহাদের পকেটে বেশ টাকা আছে তাদের প্রত্যেক শ্রেণী হইতে পাঁচজন ক’রে নিমন্ত্রণ ক’রে একটা ভাল পার্টির বন্দোবস্ত কর দেখি।

ব্যারিস্টার সাহেব দিন চারের মধ্যে একটা লিষ্ট করিয়া আমাকে দেখাইলেন, লিষ্ট মধ্যে পূর্ব্ব জীবনের পরিচিত তিনটী ভদ্রলোকের নাম আমি ছাঁটিয়া দিলাম। তিনি নূতন নাম দ্বারা তাহা পূরণ করিলেন। এক রবিবারে এই পার্টির আয়োজন হইল। আমার নামে ছাপান নিমন্ত্রণ কার্ড দরোয়ান দ্বারা পাঠান হইল। স্কুলের শিক্ষক এই নিমন্ত্রণে একজনও আসেন নাই, মুনসেফ্‌ মাত্র একজন আসিয়াছিলেন, তিনি পার্টি শেষ হইবার পূর্ব্বেই চলিয়া যান। দেশকর্ম্মী এবং উকিল ও ব্যারিষ্টার প্রায় সকলেই আসিয়াছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যেও প্রায় অনেকেই আসিয়াছিলেন। জলযোগের সামান্য বন্দোবস্ত ছিল―আর ছিল বিলাতী তরল পদার্থ। অবশ্য এ জিনিসটা সকলের মধ্যে পরিবেশিত হয় নাই। এই উপলক্ষে একটা ব্রহ্মসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথের চারিটী গান আমি গাহিয়াছিলাম। শ্রীযুক্ত প্রদীপ কুমার রায়ও কয়েকটি গান গাহিয়াছিলেন। একজন দেশকর্ম্মী একটা স্বদেশ-সঙ্গীত গাহিতে আমায় অনুরোধ করিলেন। আমি এই নূতন গানটি গাহিয়াছিলাম।

হাত দিয়ে তুই বাঁধ্‌লি হাত
প্রাণ দিয়ে প্রাণ বাঁধ্‌লি না;
এযে সোণা ফেলে দিলি গের
আঁচলে তা’ বুঝ্‌লিনা।
তিরিশ কোটি বন্ধু পেলে,
জগত জয় অবহেলে
কর্‌তিস্ তা আর পার্‌লি না।

গান শেষ হইলে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক আরম্ভ হইল; একজন কর্ম্মী পদ্ম সরকারের নিন্দা আরম্ভ করিলেন―তার নাকি কোথায় দুই একটা রক্ষিতা আছে, তাহার কথা, তাহার জাল জুয়াচুরির কথা তুলিয়া তাহাকে অত্যন্ত হেয় প্রতিপন্ন করিলেন। মিঃ ঘোষ ইহার প্রতিবাদ করিলে, অন্য এক দেশকর্ম্মী মিঃ ঘোষকে পর্য্যন্ত আক্রমণ করিতে ছাড়িলেন না। তিনি ইহাও বলিতে একটু ইতস্ততঃ করিলেন না যে, দেশবন্ধু এদের লাই দিয়ে বড় করে বড়ই ভুল করেছিলেন। দেশবন্ধু ভুল করিয়াছিলেন―এ কথাটাতে আমার প্রাণে যেন কেমন লাগিল, তখন আমিই ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম―দেশবন্ধু ভুল করিয়াছিলেন কি ঠিক করিয়াছিলেন তাহা তোমার আমার মত লোকের বুঝিবার শক্তি নাই―সে অগাধ সমুদ্রের তলস্পর্শ তোমার আমার মত লোকের কাজ নয়। তিনি কাহারও উপর কোন কার্য্য বিশেষের জন্য বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসা পোষণ করিতেন না। তিনি লোক চিনিতে পারিতেন বলিয়াই এমন লোকও স্থান দিয়াছিলেন! যেমন―কুস্তিগির পালোয়ানকে আয়ত্ত করিতে হ’লে কুস্তিগির পালোয়ানের প্রয়োজন, তেমনি এই লোক দ্বারাও তিনি তার উপযুক্ত কাজ করাইবার জন্য রাখিয়াছেন।

 এর পরও তিনি জেদ ছাড়িলেন না, বলিলেন “এ যে বিশ্বাসঘাতক”―সেই প্রমাণ বোধ হয় দেশবন্ধু পান নাই। এখন তার মুক্তি বাহির হইয়া গিয়াছে―মহারাজা ক্ষৌণিশের কাছে গোপনে দলের খবর এ লোকটাই দিত।...তারা দিদির প্রণয়ীর এ অপমানটাতে আমার মনটা যেন কেমন হইয়া গেল―প্রকাশ্যে বলিলাম―আচ্ছা আপনারা শ্লীলতার বাহিরে যান কেন? বিশেষতঃ পদ্মবাবুর অসাক্ষাতে বলা কি ভাল! তার কথা না জানে কে, তাকে ত লোকে ঐ চক্ষুতেই দেখে। আজ যে পার্টিতে তাকে বলি নাই, কারণ, তাকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে জানিলে হয়ত অনেক বিশিষ্ট লোক নাও আসিতে পারেন।

 এই ভদ্রলোকটী আবার বলিতে লাগিলেন―‘বীরেন শাসমল, জিতেন বানার্জ্জি এবং হেমন্ত সরকার কেন চলিয়া গিয়াছে্ন―তাহা কি আপনারা জানেন?’ আমি তাকে আর বাড়্‌তে না দিয়া কোন প্রকারে থামাইয়া রাখিলাম।

 মি. ঘোষ, ব্যারিষ্টার সাহেবের সঙ্গে অন্য ঘরে যাইয়া একটু টনিক খাইয়া আবার আসিলেন। তিনি বলিলেন―মিস মুখার্জ্জি কিছু মনে করবেন না। সেদিন ঢাকার কাগজে দেখা গেল―কোন মেয়ে-বোর্ডিংএ আবর্জ্জনার স্তূপে এক মৃত ভ্রূণ পাওয়া গিয়াছে। ইহা লইয়া ঢাকায় মহা হুলস্থূল। আজকাল যে প্রকার অবাধ মেলামেশা চলিতেছে―ইহারই ফলে এ ভ্রূণ হত্যা নহে কি? ঢাকার এক ভদ্রলোক বলিলেন, একটা নহে অনেক।

 আমি বলিলাম―অবাধ মেলামেশা দোষের নহে―নিজকে বাঁচিয়ে চল্‌তে হয়। এই যে মেয়েগুলি আজকাল ছেলেদের সঙ্গে এক কলেজে পড়্ছে‌―দেখুন তাদের কেমন সুন্দর চাল চল্‌তি, যেন ঠিক ভাই বোন। প্রকৃতির যা নিয়ম―ভাই বোন এক সঙ্গে―এরা ঠিক তাই। আমি শিক্ষিতা উদার মিস্ মুখার্জ্জি, ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমাকে অবাধ মেলামেশা সমর্থন করিতে হইল। নইলে আমার মান থাকে কোথায়! অবাধ মেলামেশার জন্যই আজ আমি পতিতা।  মি. ঘোষ তখন বলিলেন―আপনি কি বলিতে চান যে―ঐ সব কলেজের ছেলেগুলি সব ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির! পূর্ণাঙ্গী মহিলাদের কাছে সমস্ত দিন ঘুরে ফিরেও এদের কোন ভাবান্তর উপস্থিত হয় না! আমি বলিলাম―সকলের কি আর এক রকম হ’তে পারে? উহাতে কাহারও যদি ভাবান্তর হয়―এবং তা’তে যদি একটা কিছু হয়ই―তবুও তেমন দোষ কি? স্বাধীন দেশে ত এমন কত হচ্ছে―তাতে কি আসে যায়!

 মিষ্টার ঘোষ তখন বলিলেন―“তবে কি আপনি এ দেশটাকে ইংলণ্ড ও আমেরিকার ন্যায় দেখ্‌তে চান?” ইহার উত্তর কি দিব তাহা ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছিলাম না। এমন সময় মি. ঘোষ আবার বলিলেন―রুচীবাগীশ হেরম্ব বাবু নাকি “থিয়েটারের বাড়ী দেখাইয়া দেওয়া” ও পাপ মনে করেন, কারণ উহাতে যে সকল স্ত্রী-পুরুষ যাইয়া থাকে তাহাদের নাকি মনোবৃত্তি ভাল নহে! আজ তাঁ’র কলেজে যে সকল যুবক যুবতী একসঙ্গে পড়ে, তা’দের মনোবৃত্তি কেমন, তাহা যদি তিনি ‘ব্যালটে’ পরীক্ষা করেন, তবেই বুঝিতে পারিবেন। হেরম্ববাবু কি অবাধ মেলামেশার ফলে ঢাকার দুইটি ব্রাহ্ম পরিবারের বিবাহের ফল এবং তজ্জন্য এক পরিবারের পুনরায় হিন্দুধর্ম্ম গ্রহণের বিষয় অবগত নহেন? রমলা গুপ্তা, লীলাবতী প্রভৃতি মোকদ্দমার বিষয় কি তিনি শুনেন না? রমলা গুপ্তা ত তাঁহাদেরই সমাজের লোক!

 এ বিষয়ে আমি আর বাড়াবাড়ি পছন্দ করিতেছিলাম না―বিশেষতঃ রাত্রি অধিক হইয়াছিল। ক্রমে অনেকেই বিদায় গ্রহণ করিলেন, একটি খদ্দর পরিহিত যুবক রহিয়া গেলেন। ইনি এখন কৌমার্য্য ব্রত পালন করিতেছেন―এর ও বাজারে যথেষ্ট সুনাম আছে। ভাবিলাম, এদের মত কুমার এবং আমার মত কুমারীর সংখ্যা যদি এমন ভাবে বৃদ্ধি হয় তবে এদেশের কি শোচনীয় পরিণাম!

আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে জানান


সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে। 


চলবে.....

১৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন


লেখক সংক্ষেপ :
১৯০০ সালে কোলকাতার ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মানদা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বাবা ছিলেন শহরের নামকরা উকিল। মাত্র দশ বছর বয়সে মাকে হারান মানদা দেবী। এরপর তার বাবা কন্যাসম এক নারীকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন। এতে বাবার মনোযোগ হারান তিনি। 
ধনী পরিবারের কণ্যা হওয়া সত্ত্বেও জীবনের এক পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন মানদা। সেসব কথাই তুলে ধরেছেন ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’ নামের আত্মজীবনীকা মূলক গ্রন্থে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন