গল্প               :         আয়নার নিশান ভাই
লেখিকা        :         আভা ইসলাম রাত্রি
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১লা জানুয়ারী, ২০২৩ ইং

লেখিকা আভা ইসলাম রাত্রির “আয়নার নিশান ভাই” শিরোনামের এই গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য এটি হুবহু প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ গল্পটি ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারী লিখেছেন।
আয়নার নিশান ভাই || আভা ইসলাম রাত্রি Bangla Romantic Golpo - Kobiyal
আয়নার নিশান ভাই || আভা ইসলাম রাত্রি

আয়নার নিশান ভাই || আভা ইসলাম রাত্রি

প্রতিবছর যখন প্রকৃতি জুড়ে ঠকঠক করা শীত নামে, তখন আমাদের পুরো পরিবার ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে চলেন গ্রামের বাড়িতে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যদি কোনো ব্যতিক্রম কিছু হয়ে থাকে তবে তা হলো, এবার আমাদের সাথে যাচ্ছে নিশান ভাইয়া স্বয়ং! সকালে মেহেদী ভাইয়ার মুখে খবরটা পাওয়ার পরপরই আমার ফুরফুরে মেজাজটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। আমার জন্মের পর থেকে আমি নিশান ভাইয়াকে নিয়ে আমার গুণধর পরিবারের আদিখ্যেতা দেখে আসছি। যখনই নিশান ভাইয়া আমাদের বাসায় আসেন, আমার মা তো বোধহয় হাতে আকাশের সবচে উজ্জ্বল তারা পান। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, নিশান ভাইয়া বোধহয় মায়ের আপন ছেলে। আমি হয়তো কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে তার। না, না। হয়তো না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমি মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। 

আচ্ছা, এবার মূলকথায় আসা যাক। সেদিন ছিল শীতের এক ফুরফুরে সকাল। তখন কটা বাজে? সকাল সাত টা কিংবা আটটা? শীতের সকালে ঘুম যেনো কাটতেই চায়না। কম্বলের নিচে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা এই আমিকে মা বেশ বকেঝকে জাগালেন। অতঃপর, সক্কাল সক্কাল তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। 


তবে বিপত্তি সাধলো অন্যবেলায়। আমাদের নিজস্ব গাড়িতে আর একটুও জায়গা নেই। মা, বাবা, ফুপু তার দুটো পিচ্চি মেয়ে আর আমাদের কাজের মেয়েটা মিলেই গাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে। অতি বিরক্তিতে তখন আমার ভ্রূ-ট্রু কুঁচকে বেহাল অবস্থা। অতঃপর বাবা আর কোনো উপায় না পেয়ে আমাকে মেহেদী ভাইদের গাড়িতে তুলে দিলেন। নাও ঠেলা! যার কাছ থেকে পালাতে চাই, সেই বারবার চোখের সামনে এসে ধরা দেয়। গাড়ির সামনের সিটে নিশান ভাইয়াকে দেখে আমার বেশ রাগ হলো। সে কি বাসে করে যেতে পারেন নি? আমাদের সাথেই তাকে যেতে হবে? অভদ্র লোক! তবে, আমি হলাম অতীব ভদ্র মেয়ে! আর ভদ্র মেয়েরা বাড়ীর মেহমানদের সম্মান করে। তাই আমিও তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে গাড়ীর পেছনে উঠে বসলাম। 

কুয়াশা মোড়ানো এক শিরশির করা সকাল! সুয়েটার পড়ে থাকা সত্বেও ঠান্ডায় গা কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে গিয়ে এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা তৈরি হচ্ছে। এমন সময়ে নিশান ভাইয়া মেহেদী ভাইকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
-- এই মেহেদী, পেছনের কাঁচ উঠিয়ে দে। খুব ঠাণ্ডা বাইরে। "

মেহেদী ভাইয়া বরাবরই নিশান ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তারমতে, নিশান ভাই হলেন তার গুরু আর তিনি তার নামমাত্র শিষ্য! নিশান ভাই যদি বলেন সূর্যের আজ পূর্ব দিকে উঠতে মন চাচ্ছে না। হাওয়া বদল করতে সে আজ পশ্চিমে উঠেছে। তবে মেহেদী ভাইয়া হাসতে হাসতে তা বিশ্বাস করবেন। কারণ, ওই যে বললাম। গুরু শিষ্য ধরনের ব্যাপার শ্যাপার। তাই এবারও মেহেদী ভাইয়া কোনোরূপ দিরুক্তি না করে আমার দিকের দুইটা কাঁচ উঠিয়ে দিলেন। আমার বেশ রাগ হলো! আমি ভ্রু কুঁচকে জানালাম,
-" ভাই, কাঁচ নামাও। আমার গরম লাগছে!" 


মিথ্যা কথা বললাম। না বলেও উপায় ছিলো না। নাহলে বন্ধ গাড়িতে আটকে দমবন্ধ হয়ে আমি নিশ্চয়ই মরে যেতাম তখন। মেহেদী ভাইয়া কিছু বলার আগে নিশান ভাই নিজ বৈশিষ্ট্য ধারণপূর্বক আমায় ধমকে বললেন,
-"কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক। এখন শীতের সিজন। ঠাণ্ডা লাগল একমাসের আগে আপনাকে বিছানা ছাড়া লাগবে না। মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে বসে থাক এখন। "

আমি চেতে উঠলাম। এই অভদ্র লোকটাকে মন চাইলো, হাতে তুলে মস্ত এক আছাড় দিতে। কিন্তু তা সম্ভবপর হলো না। চুপ করে বসে রইলাম নিজ স্থানে। 

বাড়িতে পৌছালাম দুপুর একটায়। খুব ক্ষুধা লেগেছে তখন। পেটের মধ্যে গুড়ুমগুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আমি বাড়িতে এসেই দোকানে লোক পাঠালাম। চিপস আনার জন্যে। অতঃপর পাঁচটা চিজ পাপস নিয়ে আমি বিছানায় বসে কাজিনদের সাথে গল্প করছিলাম। হঠাৎ সেখানে আগমন ঘটলো আমার চাচাতো ভাই তাহসিন ভাইয়ের। তাহসিন ভাই শহরে থাকেন। শাহজালাল ভার্সিটির স্টুডেন্ট। দেখতে একদম সিনেমার নায়কদের মত। আমি ছোটবেলায় তাকে আমার হিরো বলতাম। অবশ্য এখন সে আমার হিরো না। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার এক নতুন হিরো জুটেছে। অন্যান্য হিরোদের মত আমার হিরো আমায় একটুও ভালোবাসে না। আমার হিরো শুধু একটাই কাজ পারে। আর সেটা হলো যখন তখন ধমকানো! বিরক্তিকর লোক একটা! কিন্তু কি আর করা যাবে! ভালোবাসা, সে তো অন্ধ হয়। আমিও নাহয় একটুখানি চোখে দেখলাম না।তাতে কি? দুনিয়ার সবকিছু চোখ খুলে দেখতে হবে, তেমন ত কোনো নিয়ম নেই! 


তাহসিন ভাই এসে আমাদের কাজিনমহলের মাঝখানে বসে পড়লেন। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
-" কি গল্প করা হচ্ছে এখানে? "
আমি বললাম,
-" তেমন কিছু না ভাইয়া। আমরা ওই কলেজের কথা গল্প করছিলাম। "
ভাইয়া ডাকটা বোধহয় তাহসিন ভাইয়ের পছন্দ হলো না। তার মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন,
-" ওহ, ভালো। আমি কি জয়েন করতে পারি তোমাদের এই আড্ডা আসরে? "

আমি কিছু বলার আগেই আমার অন্যান্য কাজিনমহল চিৎকার করে হ্যাঁ জানালো। আমার মুখ চুপসে গেল। না বলতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু সবাই যেহেতু হ্যাঁ বলেছে, সেহেতু আমার কি আর করার। তাই আমিও মিনমিনিয়ে হ্যাঁ-ই বলে দিলাম। অতঃপর শুরু হলো তাহসিন ভাইয়া আর আমাদের মধ্যকার আড্ডা। এক ঘণ্টায় আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল। আমি খুব এনজয় করছিলাম উনার সাথে গল্প করতে। বেশ রসিক ভাইয়াটা। 

হঠাৎ আমার ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠলো। আমি ফোন তুলে দেখলাম নিশান ভাইয়া লিখেছেন,
-" আয়না, দ্রুত পুকুর পাড়ে আয়। কথা আছে তোর সাথে। "

নিশান ভাইয়ার এমন আচমকা ডাক আমার বেশ খটকা লাগলো। আবার কি ধমক দিবে কে জানে! আমি পাল্টা উত্তর দিলাম,
-" পারবো না। "


সাথেসাথেই উত্তর এল,
-" যদি না আসিস, তাহলে আমি তোর মাকে বলছি, তুই সেদিন কোচিংয়ের হায়ার ম্যাথ টেস্ট দিস নি। তখন নাহয় আন্টিকে সামলাস। "

আমি পড়লাম মহা বিপাকে। আম্মু সবসময় আমার এক্সাম নিয়ে সিরিয়াস। এক্সাম রেগুলার দেওয়ার জন্যে আমাকে ধরেবেধে উদ্ভাসে ভর্তি করিয়েছে। সেদিন হায়ার ম্যাথ এক্সাম ছিল। আমি পরীক্ষার নাম করে আভার সাথে বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিশান ভাই সেটা কি করে জেনে গেলেন? জাদু টাদু জানে নাকি লোকটা? 

আমি আর কোনো উপায় না পেয়ে সবাইকে এক্সকিউজ করে পুকুর পাড়ে এলাম। 
ওইতো পুকুর পাড়ের বেঞ্চে বসে আছেন নিশান ভাইয়া। আমি এগিয়ে গেলাম।
-" বলুন, কি দরকার? "

আমার প্রশ্ন শুনে নিশান ভাইয়া তাকালেন। ওমা, তার চোখ এত লাল কেন? মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আমায় ভস্ম করে দিবেন। আমি বললাম,
-" আপনার কি জ্বর? চোখ এতো লাল কেন আপনার? "


নিশান ভাই এবার চট করে উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে চেপে ধরলেন গাছের সাথে। আমি বিস্ময়ে ডাগর ডাগর চোখে তার দিকে চেয়ে আছি। নিশান ভাইয়া  দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,
-" ছেলেটা কে আয়না? "

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-" কোন ছেলেটা? "
-" ন্যাকামি করবি না। তোর পাশে যে ছেলেটা বসা ছিল, কে সে? "
আমি বুঝলাম এবার কার কথা বলছেন তিনি। আমি হেসে বললাম,
-" আরে ও ত তাহসিন ভাই। দৌলত চাচাকে চিনেন না? উনার ছেলে। শাহজালাল পড়ে। "
নিশান ভাই আমাকে গাছের সাথে আরো একটু চেপে ধরে বললেন,
-" দৌলত ফৌলত কাউকে চেনার দরকার নেই আমায়। ছেলেটার সাথেও এত কিসের কথা তোর? " 

-" আরে উনি তো আমার ভাই লাগে। আমাকে বোনের নজরে…."
-" কিসের বোনের নজর? ও তোকে মোটেও বোনের নজরে দেখছিল না। আমি তার চোখে তোর জন্যে তৃষ্ণা দেখেছি। যে তৃষ্ণায় আমি প্রতিরাত ছটফট করি, সেই একই তৃষ্ণা আমি তার চোখে দেখেছি। "
-" তৃষ্ণা? কিসের তৃষ্ণা নিশান ভাই? "


আমি অবাক হয়ে বললাম! নিশান ভাই এবার আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমার দিকে আঙ্গুল উচুঁ করে সাবধান করলেন,
-' খবরদার আয়না, ছেলেটার কাছে ঘেঁষবি না। ছেলেটাকে আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না। রাবিশ ছেলে কোথাকার। "

আমি এবার হেসে ফেললাম। বললাম,
-" সহ্য না হওয়ার কারণ কি, নিশান ভাই? "

নিশান ভাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমার দিকে আরো একটু ঘন হয়ে দাঁড়াতেই আমি গাছের সাথে লেপ্টে গেলাম। তিনি আমার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে চোখে চোখ রাখলেন। বললেন,
-" তুই যা ভাবছিস, তাই সত্যিই। "


কথাটা বলে তিনি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলেন না। নিশান ভাইয়া চলে গেলেন। আমি এখনো হাসছি। মনেমনে বললাম,
-" jealousy is the best feelings, নিশান ভাই। "

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


....সমাপ্ত....


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা আভা ইসলাম রাত্রি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে। তবে তিনি তার ফেসবুক পেজে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, “গল্প লেখে সে, কলমের কালিতে কল্পনার চিত্র আঁকিবুকি করা তার নেশা! অক্ষরের ভাজে লুকায়িত এক কল্পপ্রেয়সী!”

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন