গল্প               :        ইফতার
লেখক          :         নাজিম উদ দৌলা
গ্রন্থ              :         
প্রকাশকাল    :         
রচনাকাল     :         ২রা মে, ২০২০ ইং

ইফতার || নাজিম উদ দৌলা
ইফতার || নাজিম উদ দৌলা
লেখক নাজিম উদ দৌলার “ইফতার” শিরোনামের এই গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য এটি হুবহু প্রকাশিত হল। লেখক অনবদ্য এ গল্পটি ২০২০ সালের ২রা মে লিখেছেন।

ইফতার || নাজিম উদ দৌলা

“আর বলবেন না ভাবি! ইফতার বানাতে বানাতে লাইফ শ্যাষ!” শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে ফোনে কথা বলছে জুঁই। ফোনে অপর প্রান্তে আছেন অন্তুর মা, মিসেস মোনা। অন্তু হচ্ছে জুঁইয়ের একমাত্র মেয়ে মিতুর সহপাঠী।
মিসেস মোনা বললেন, “আপনারা মানুষ তো মাত্র তিনজন, এত ইফতার কে খায়?”
“কে খায়?” জুঁইয়ের গলার আওয়াজ বেড়ে গেলো, “মিতুর আব্বু আছে না? সে একাই তো একশো!”
জুঁই বসে আছে খাটে। খাটের সাথে লাগোয়া পড়ার টেবিলে বসে অংক করছে মিতু। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। একটা সরল অংকে মেলাতে চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ যাবত। কিছুতেই মিলছে না। মনে মনে ভাবছে- যে এই অংকের নাম ‘সরল অংক’ রেখেছে, তারে হাতের কাছে পেলে...
জুঁই ফোনে বলে যাচ্ছে, “...আমরা যা খেতে না পেরে ফেলে দেই, সেগুলোও পারলে প্লেটে তুলে নেয়! কি যে ঘেন্না লাগে আমার!”
মিতু মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। বাবার সম্পর্কে মা এসব কথা আরেকজন মহিলাকে বলছে এটা তার ভালো লাগছে না। কিন্তু মেয়ের দিকে খেয়াল নেই জুঁইয়ের। সে ফোনে মিসেস মোনার কথা শোনায় ব্যস্ত।
মিতু আবার অংকে মনযোগী হওয়ার চেষ্টা করলো।
মিসের মোনা বলছেন, “ভাই তো হ্যাংলা-পাতলা মানুষ। দেখে মনে হয় না খুব একটা খান।”
জুঁই উত্তরে বললো, “সারা বছর তো ভালোই থাকে। শুধু এই রোজার মাস এলেই কি যেন হয় তার! এক্কেবারে রাক্ষস হয়ে যায়!”
মিতু হাত থেকে কলম রেখে ঝট করে ফিরে তাকালো মায়ের দিকে। প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “মা, প্লিজ তুমি বাবাকে রাক্ষস বলবা না!”
মিতুর কথা শুনে অবাক হলো জুঁই। “এক সেকেন্ড ভাবি…” বলে ফোনের মাউথ স্পিকারের যায়গাটা হাত দিয়ে ঢেকে রাগী কণ্ঠে মেয়েকে বললো, “অ্যাই! রাক্ষসকে রাক্ষস বলবো না তো কি বলবো?”
“বেশি খেলেই কেউ রাক্ষস হয়ে যায় না!” বলে মিতু বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
জুঁই দাঁতে দাঁত পিষে বললো, “একদম বাবার ভক্ত হইছে…”
***
“জুঁই! কই ইফতার নিয়ে এসো?” ডাইনিং টেবিলে বসে স্ত্রীকে ডাকছে অনীক। “আযানের সময় হয়ে এলো!”
“আরে আনতেছি রে বাবা!” রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে উত্তর দিলো জুঁই।
দুমিনিট বাদে রাগে ফুসতে ফুসতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো জুঁই। হাতের ট্রেতে সাজানো ঘরে বানানো বিভিন্ন ইফতার আইটেম। তাই দেখে অনীকের চোখে-মুখে আনন্দ, “বাহ! দারুণ গন্ধ আসছে।”
জুঁই বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকালো অনীকের দিকে। খাবারের ট্রে টেবিলে রাখার সময় ইচ্ছে করেই শব্দ করলো।
“মিতুউউউ?” মেয়েকে ডাক দিলো অনীক। “মামনি এসো, আযান পড়বে এখনই”।
মিতু দৌড়ে এলো বাবার ডাকে। তাই দেখে জুঁইয়ের রাগ আরো বাড়লো। সে কমপক্ষে ৫ বার ডাকার আগে মিতু উত্তর দেয় না। কিন্তু বাবার এক ডাকেই ছুটে আসে!
মিনিট পাঁচেক পর আযায় শুরু হলো। খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙলো অনীক। তারপর বিভিন্ন আইটেম গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো। অনীকের খাওয়া দেখে জুঁইয়ের খাওয়ার রুচি চলে যাচ্ছে জুঁইয়ের। ভেতর ভেতর রাগ বাড়ছে তার। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলো।
কিছুক্ষণ পর...
মিতু খাবারের প্লেট সামনে ঠেলে দিয়ে বললো, “আমি আর খেতে পারছি না!”
অনীক ঝট করে তাকায় মিতুর খাবারের প্লেটের দিকে। “এত খাবার নষ্ট করবে মা? আচ্ছা আমাকে দিয়ে দাও।”
মিতু প্লেটটা বাবার দিকে এগিয়ে দেয়। অনীক খুব আগ্রহ নিয়ে মিতুর প্লেট থেকে খাবারগুলো নিজের প্লেটে নিয়ে নিলো। তাই দেখে জুঁই তার খাবারের প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“কই যাও?” অনীক মুখ ভরা খাবার নিয়ে প্রশ্ন করলো।
“আমি বেডরুমে বসে খাচ্ছি।” বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললো জুঁই। “তোমার এসব কাণ্ড আর নেওয়া যাচ্ছে না!”
অনীক বোকার মতো হাসলো। স্ত্রীর কথাটা গায়ে মাখলো না।
জুঁই চলে গেলো ভেতরের রুমে। মিতুও উঠে চলে গেলো। কিন্তু অনীক একমনে খেয়ে যাচ্ছে, খাওয়া সামনে রেখে এসব দেখার সময় নাই।
***
সাড়ে ৭টা বাজে।
মাগরিবের ওয়াক্তের পর অনীককে দেখা গেলো বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক ঐ সময় তিন তালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মিতু আর জুঁই দেখছে তাকে।
“কি করছে তোর বাবা, মিতু?” জুঁই জিজ্ঞেস করলো।
মিতু বললো, “এখনই দেখতে পাবে।”
গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় মিতুর বয়সী একটা ছেলে। ছেঁড়া গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়নে। অনীক ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হেসে হেসে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে, ছেলেটা উত্তর দিচ্ছে।
“কে এই ছেলে?” জুঁইয়ের প্রশ্ন।
“ওর নাম সজিব, পাশের বস্তিতে থাকে।” মিতুর উত্তর দিলো। “ওদের বস্তিতে সবাই না খেয়ে থাকে মা! সবার কাজ বন্ধ, খাবার কেনার টাকা নেই। তাই বাবা প্রতিদিন ইফতারের খাবার দিয়ে দেয় সজীবের কাছে। সে বস্তিতে গিয়ে তার পরিবারের সবার সাথে মিলে খায়। দেখছো না বাবার হাতে ব্যাগটা? ওর ভেতরে ইফতার...”
“কিন্তু তোর বাবা ইফতার পায় কই?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে চমকে উঠলো জুঁই। কারণ উত্তরটা সে নিজেই বুঝে গেছে!
“বাবা ইফতার খায় না মা!” মিতু বললো, “ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝবে। বাবা আসলে খাওয়ার ভান করে। এক সময় লুকিয়ে সব খাবার ব্যাগে ভরে ফেলে। তারপর নিচে গিয়ে সজীবকে দিয়ে দেয়। আমি একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখেছি!”
জুঁই খুব রেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বললো, “ওহ! আমাকে না বলে এসব করে?”
“তুমি তো অনেক রাগী। এইজন্য বাবা তোমাকে বলতে ভয় পায়!” বলে মাথা নিচু করে ফেলে মিতু।
মিতুর কথা শুনে জুঁইয়ের রাগ আরও বেড়ে যায়।
***
সজীবের হাতে ইফতারের ব্যাগ ধরিয়ে দিলো অনীক, “বাসার সবাই মিলে খাবে, কেমন?”
“আইচ্ছা”। বলে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায় সজীব।
অনীক বুক পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করলো। সজীবের হাতে ধরিয়ে দিলো।
“যাও”।
সজীব চলে গেলো।
অনীক হাসিমুখে উল্টো ঘুরলো। তারপর ভীষণভাবে চমকে উঠলো। দেখলো তার স্ত্রী জুঁই দাঁড়িয়ে আছে। কোমড়ে হাত, চোখের দৃষ্টিতে আগুন। স্ত্রীর চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেলো অনীক। বুঝতে পারছে আজ একটা ভালো ঝামেলা বাঁধবে!
অনীককে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ জুঁইয়ের চোখের কোন বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু নেমে এলো। সে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললো, “আমার রাগটা একটু বেশি, কিন্তু আমি অমানুষ নই!”
অনীক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো স্ত্রীর দিকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
জুঁই দুই পা এগিয়ে এসে তার বুকে মাথা রাখলো। অস্ফুট কণ্ঠে বললো, “কাল থেকে আমি আরও বেশি করে ইফতার বানাবো।”
অনীকের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো।

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


....সমাপ্ত....


লেখক সংক্ষেপ:
নাজিম উদ দৌলার জন্ম ১৯৯০ সালের ৪ নভেম্বর নানাবাড়ি কেরানীগঞ্জে। পৈত্রিক নিবাস যশোর জেলায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকার আলো বাতাসের মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি ‘অ্যানালাইজেন’-এ কর্মরত আছেন। লেখালেখির চর্চা অনেক দিনের। দীর্ঘসময় ধরে লিখছেন ব্লগ, ফেসবুক সহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে। ২০১২ সালে প্রথম গল্প ‘কবি’ প্রকাশিত হয় কালান্তর সাহিত্য সাময়িকীতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-তে প্রকাশিত হয় তার প্রথম থ্রিলার উপন্যাস ‘ইনকারনেশন’। একই বছর আগস্টে প্রকাশিত হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার ‘ব্লাডস্টোন’ তাকে এনে দেয় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। এ পর্যন্ত ৬টি থ্রিলার উপন্যাস ও ১টি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখায় মনোনিবেশ করেছেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের কালজয়ী চরিত্র ‘মাসুদরানা’ নিয়ে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন তিনি। এছাড়াও ‘শান’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সহ বেশ কিছু বড় বাজেটের বাংলা চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। অবসর সময় কাটে বই পড়ে, মুভি দেখে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। সদালাপী, হাসি খুশি আর মিশুক স্বভাবের এই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর বাংলাদেশের, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ এক হয়ে দেশ গড়ার কাজে মন দেবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন