উপন্যাস : যতনে রাখিলাম যাতনা
লেখিকা : মম সাহা
প্রকাশনা :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ৭ জুলাই, ২০২৪ ইং
লেখিকা মম সাহার “যতনে রাখিলাম যাতনা” নামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। এটি মূলত লেখিকার ‘প্রেমোত্তাপ’ উপন্যাসের ২য় খন্ড। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ৭ জুলাই লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
যতনে রাখিলাম যাতনা || মম সাহা |
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
যতনে রাখিলাম যাতনা || মম সাহা (পর্ব - ৩)
জেনেভের এই ভিনদেশী শহরে একটি বাংলা বুটিক হাউস রয়েছে যেটা একমাত্র চাঁদনীর শান্তির জায়গা। বুটিক হাউসটি টুইংকেলের বাবার। টুইংকেলের বাবা বাংলাদেশী ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে চলে এসে এই সুইজারল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হন। এখানেই বুটিক হাউস খুলেন। বাঙালিয়ানার পোশাক গুলো বেশ পছন্দ করাতে তার বুটিক হাউস প্রসার বিস্তার করে।
‘লুসেফ, চলো বাংলাদেশ যাওয়া যাক। যাবে?’
টুইংকেলের কথায় ধ্যান ভাঙলো চাঁদনীর। অবাক কণ্ঠে বলল,
‘তুমি বাংলাদেশ যাবে?’
টুইংকেল সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। ভাবছি তো! তবে তোমার সাথে যাবো। তুমি যেদিন যাও। বাংলাদেশ আমার পছন্দের।’
নিজের দেশের কথা মনে পড়তেই চাঁদনীর মন খারাপ হয়ে গেল। বড়ো মনে পড়লো বাড়ির কথা, বোনেদের কথা, মা-বাবার কথা আর….
আর যার কথা মনে পড়েছে তার নাম ভুলেও যে মন উচ্চারণ করতে চায় না। তবুও, তবুও প্রেম যে কোথাও একটা ফাঁক ফোঁকরে উঁকি দেয়। কে যেন চেঁচিয়ে বারংবার সেই নামটি ডাকতে থাকে। কে ডাকে? হৃদপিণ্ড? সেই নামটি কি হৃদয়ের এতই প্রিয়?
‘আমিও যাবো টবে ভাঙলাদেশ।’
লুসেফের ভুল উচ্চারিত বাংলায় কটমট করে উঠল টুইংকেল। রাগান্বিত স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, তোমার টবে করেই যাওয়া উচিত। উড়োজাহাজ তোমাকে নিবে না। বাংলাকে বার বার ভাঙলা বলে আমাদের ইমোশনে আঘাত করবে না।’
লুসেফ অপরাধীর মতন হাসল। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সরি সরি। আমি কী করব। ভলতে তো চাই কিন্থু আসে না।’
‘কিন্থু! ভলতে! এগুলো কী ধরণের বাংলা উচ্চারণ?’
‘তুমি রাগ করছো? রাগ করো না। আমি ঠিক শিখে যাভো।’
‘তোমার আর শিখতে হবে না। যাও সরো।’
চাঁদনী হাসিখুশি মুখে তাকিয়ে রইল এই দুজনের ঝগড়ার দিকে। কী অদ্ভুত ভাবে ওরা ঝগড়া করে! লুসেফেরও বা কী এমন দরকার বাংলা শেখার? টুইংকেল তো জন্মগত ভাবেই এই দেশেরই। এই দেশের ভাষা ওর কাছে দুধভাত লুসেফের সাথে ওর কথোপকথন এ দেশের ভাষাতেই দিব্যি হবে। তবুও বাংলা শিখতে হবে কেন ছেলেটাকে?
চাঁদনীর নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকার মাঝেই উপস্থিত হলো একটি ছোটো আট-নয় বছরের বাচ্চা। সাদা ধবধবে, কোঁকড়া চুলের বাচ্চাটি এসেই একটি সাদা কাগজের টুকরো এগিয়ে ধরল তার দিকে। ওদের ভাষায় বলল, ‘এটা তোমার।’
ছেলেটির হাতের কাগজটা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো চাঁদনীর। কপালে খানিক ভাঁজ ফেলে বলল,
‘আমার! কে দিয়েছে?’
‘একটি লোক। তোমায় দিতে বলল।’
চাঁদনী হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো স্নেহময় ভাবে। ছেলেটি যেমন ছুটে এসেছিল তেমন করেই চলে গেল। টুইংকেলদের ঝগড়াও থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। বড়ো বড়ো চোখ করে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে মেয়েটা বলল,
‘আপা, কে দিয়েছে এটা? কী লিখা আছে?’
চাঁদনী ঠোঁট উল্টালো। যার অর্থ, সে জানে না।
লুসেফ বলল, ‘তুমি বিউটিফুল। তোমাকে দিতেই পারে।’
টুইংকেল আবার লুসেফের উপর হামলে পড়ল। খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলল,
‘বিউটিফুল বলার সময় তো ঠিকই ‘ব'-টা উচ্চারণ হয় আর আমাদের দেশের নাম বলতে গেলেই তোমার ঠোঁটে, মুখে বাজে? ইতর।’
গেঁড়াকলে পড়ে গেল যেন লুসেফ। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনীর দিকে। সেই দৃষ্টির ভাষা চাঁদনীর কাছে স্বচ্ছ। চাঁদনী লুসেফের দৃষ্টির ভাষা বুঝেই টুইংকেলকে বলল,
‘ছাড়ো। ওকে এত বকছো কেন? ও যে আগ্রহ নিয়ে আমাদের দেশ, দশ, ভাষা সম্পর্কে জানছে, শিখছে তা-ও কম কীসে? ওর মনটা ভেঙো না। বেচারা অনেক শখ করেই তো শিখছে তাই না?’
‘তাই বলে বেছে বেছে আমাদের দেশটার নামই উচ্চারণ করতে পারবে না? এত ভণ্ড কেন হবে?’
‘সবাই কি সবটা পারে? রাগ দেখিও না। ও ঠিক একদিন উচ্চারণ করতে পারবে।’
‘ছাঁই পারবে। আর পারলেও সেটা দেখার সৌভাগ্য আমার নেই হয়তো।’
চাঁদনী চোখ রাঙাল টুইংকেলের কথায়,
‘এসব কী বলো! এসব বলো না।’
‘সরি আপা। কিন্তু আমার কষ্ট হয় ভুল নামটা শুনলে।’
চাঁদনী এবার হাত বুলিয়ে দিল টুইংকেলের মাথায়। মুচকি হেসে বলল,
‘যেই দেশটারে কখনো দেখলাই না তার প্রতি তোমার এত মায়া কেন? এত টান কেন?’
এতক্ষণ পরে টুইংকেলের রাগী রাগী চোখ-মুখ শীতল হয়ে এলো। প্রশান্তি ভরা দুই নয়ন মেলে বলল,
‘ ঐ দেশটা যে আমার বাবার। আমার বাবার শৈশব ঐ দেশে, আমার বাবার স্বপ্ন ঐ দেশে। আমার টান থাকবে না তো কার টান থাকবে? আমার বাবা যে বড়ো ভালোবাসেন দেশটাকে। মনেহয় তার বুকের মণি খুলে রেখে এসেছেন দেশটায়। মৃত্যুর আগে বাবা দেখতে চান একবার সেই দেশ। কতটা টান থাকলে একজন মানুষ এমনটা চায় বলো তো!’
টুইংকেলের ভাষ্যমতের স্বপ্নের দেশটা যে চাঁদনীর শান্তির নীড়! সে মুগ্ধ হয় মেয়েটার এমন সহজ-সরল প্রশংসায়। আশ্বাস দেয়, ‘যাবো একদিন সবাই মিলে। তোমাকে অন্তত আমি এটা দেখাতে চাই, তোমার কল্পনার দেশটা তোমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর।’
টুইংকেল খুশি হয়ে যায়। জাপ্টে ধরে চাঁদনীকে। তন্মধ্যেই ডাক আসে টুইংকেলের। সে উঠে যায়। বসে থাকে চাঁদনী আর লুসেফ।
চাঁদনী হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটার ভাঁজ খুলে। অসুন্দর হাতের লেখা ভেসে উঠে তবে সেগুলো বাংলায় লিখা। গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট বিবৃতি,
‘ডুবিয়া মরিলাম, মরিয়া ডুবিলাম,
তোমারই প্রেমে পড়িয়া।’
ব্যস্, ছোটো ছোটো কয়েকটা শব্দ কিংবা বলা যায় গানের লাইন দিয়ে রাখা কাগজটায়৷ চাঁদনী কিছুটা চমকায়। গানটা স্পষ্ট মনে না পড়লেও বার বার মনে হচ্ছে এই গানটা তোর পুরো চেনা। কানে বাজছে পরিচিত একটি কণ্ঠ বেশ সুর তুলেছে। কানের পাশটায় বার বার দু'টো লাইন গেয়ে যাচ্ছে। চাঁদনী চোখ বন্ধ করে ফেলল গানটা পরিষ্কার মনে করতে। কিন্তু কোনো মতেই মনে পড়ল না। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার! একটা গানকে সে এত দ্রুত ভুলে গেল?
পাশ থেকে লুসেফ শুধাল,
‘কী লিখা এতে?’
চাঁদনী আচ্ছন্ন স্বরে বলল, ‘তেমন কিছু না।’
লুসেফও মেনে নিল সে-ই কথা। আরেকটু কৌতূহল বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না। চাঁদনীর কাছে এদেশের এই ব্যাপারটা ভালো লাগে। সবাই কেমন নিজের নিজের জায়গায় ব্যস্ত! কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই অন্যের ব্যাপারে। অথচ বাংলাদেশের কেউ এখানে থাকলে আজ এই কাগজে কী লিখা আছে, কেন লিখা আছে, কে লিখেছে তা তিল থেকে তাল বানিয়ে প্রচার করে ফেলত।
বরফের দেশের হিমশীতল বাতাসে কাঁপল শরীরটা। চাঁদনী অন্যমনস্ক হলো। কোথা থেকে যেন বাতাসের সাথে সাথে গানও ভেসে এলো। ঠিক এই লাইন গুলোই বাজছে। শব্দ স্পষ্ট নয় তবে মনে হলো এই গানটাই। চাঁদনী বসা থেকে উঠে গেল। হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো বাহিরে। এত পরিচিত গানটা একই মুহূর্তে দু দু'টো জায়গায় কেন দেখা দিল? এটা কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছেকৃত?
•
পান্তুমাই ঝর্ণার কাছাকাছি একটা জায়গায় কাঠের বিল্ডিং আছে। রিসোর্ট বলা যায় তবে সেটা কাঠের তৈরি। কী সুন্দর দেখতে! শান্ত, শীতল পরিবেশ। বরাবরের মতনই ওরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই সুন্দর জায়গাটা বের করেছে। কেবল সুন্দর বললে ভুল হবে। অসাধারণ জায়গাটা বের করেছে। কোহিনূর মেয়েটা ফটোশুট করে দারুণ। এবং এই সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করার দায়িত্বটা ওর উপরই বরাবর ন্যস্ত হয়। কারণ ও নিজের ছবির প্রয়োজনে সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করে।
নূর এবং অহি সারা ভোর ঘোরাঘুরি করে এসে শুয়েছিল যে আর খবর নেই। দুপুর বারোটায় তাদের ঘুম ভাঙলো। তা-ও নুজাইফার ডাকে। নুজাইফা মেয়েটা একটা ট্রে-তে করে তিন কাপ চা নিয়ে এসেছে। এসেই ঘুম থেকে ডেকে তুলল বাকি দু'জনকে।
নূরের ঘুম কাটে না সহজে। আজও তা-ই হলো। ঘুম জড়ানো স্বরে বলল, ‘তুই চা এনেছিস কেন নুজাইফা? কে বলেছে চা আনতে?’
নুজাইফা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো নূরকে। তারপর দিল অহিকে। এরপর নিজের কাপটা হাতে তুলে নিতে নিতে বলল,
‘চা না খেলে ঘুম ভাঙবে না-কি তোদের!’
অহি চুপচাপ চায়ে চুমুক দিল। নূর বসে রইল ঠাঁই,
‘বেশি গার্ডিয়ান হয়ে গেছিস না?’
‘হ্যাঁ তা-ই। চুপ করে চা খা।’
‘চা খাবো? চিবিয়ে না কামড়িয়ে?’ নূরের কথায় তিনজনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পর পরই হাসির শব্দে মুখরিত হলো ঘরটা।
অহি ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই বলল, ‘তোমরাও না!’
‘আমরাও না কী, বেবি?’ নূরের ইঙ্গিতে আবারও হেসে দিল। তখনই অহির ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিণে ভেসে উঠেছে ‘মা’ লিখাটা। অহি মুচকি হেসে ফোনটা তুলে নিল। রিসিভ করে খাট থেকে নামতে নামতেই বলল,
‘ভালো আছো মা?’
নূর, নুজাইফা দু'জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অহি বারান্দায় যেতেই নূর বলল, ‘এই অহির ব্যাপারটা কী রে, ইফা? যেই দু-একবার ওর মায়ের সামনে আমাদের দেখা হলো সে-ই দু-একবার তো দেখলাম ওর মায়ের সাথে ওর সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। ভালো রকমের যুদ্ধ চলে। কিন্তু কলে তো দেখি আরেক রকম। সামনে আপনি বলে কলে তুমি বলে। কী ব্যাপার!”
নুজাইফা নূরের কথাটা বাড়তে দিল না। বলা যায় আশকারা দিল না। বরং কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘বাদ দে তো। সবার ব্যক্তিগত জীবন আছে। এগুলো নিয়ে পেছনে কথা বলতে নেই। চল অন্য কথা বলি।’
নুজাইফার এই কথা ঘুরানোর ধরণটা অপছন্দ হলো নূরের। বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘অন্য কী কথা বলবি? বাসর ঘরের কথা?’
‘বললাম না-হয়। তুই শুরু করবি নাকি আমি করব , বল।’
এবার নূর আর বিরক্তি ধরে রাখতে পারল না। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে এমন অবস্থা হলো। অহি বারান্দায় ফোনে ব্যস্ত। অবনী বেগম মেয়েকে দেখতে চাওয়ার উতলা প্রকাশ করছেন। বাড়ির হালচাল বলছেন। চিত্রার কথা বলতে বলতে কণ্ঠ ভারি হচ্ছে উনার। সবটাই নিরিবিলি ভাবে শুনছে অহি। মন খারাপও হচ্ছে তার অনেক। স্বাধ জাগে ছুটে যাবার কিন্তু ছুটে গিয়ে পুরোনো বাড়িটাকে আগের মতন দেখতে পাবে না বলে আর যায় না। তাছাড়া ঐ শহরে যে.......
এখানেই অহির ভাবনা থেমে যায়। প্রতিটা মানুষই হয়তো কখনো না কখনো এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়ায় যে তাদের নিজেদের ভাবনার চারপাশেও সীমারেখা টানতে হয়। নয়তো দুঃখ বেড়ে যায়। যন্ত্রণা বেড়ে যায়।
অহি কথা বলা শেষ করে ঘরে ঢুকতেই নূরদের কথা থেমে যায়। কী যেন একটি ঝলমলে আড্ডায় ভাঁটা পড়ে। অহি খুব ভালো ভাবে সেই ব্যাপারটা খেয়াল করে। কিন্তু জানতে চায় না কিছুই। যদি তার সামনে বলার হতো তাহলে নিশ্চয় মেয়েগুলো বলতো। চুপ করে যেতে না নিশ্চয়! কিছু কিছু সময় কিছু কিছু কৌতূহল না দেখানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতি কম তৈরি হয় এবং সম্পর্ক ভালো থাকে। তাছাড়া নূর আর নুজাইফা অনেক আগের বন্ধু। সে-তো ওদের জীবনে এসেছে বড়োজোর এক বছর কিংবা দেড় বছর হবে। তাই যে কথাটা ওদের দু'জনের ব্যক্তিগত সে কথাটা হয়তো ও অব্দি না আসাটাই সুন্দর!
•
আজ নিরু, চিত্রা, তুহিন, চেরি ঘুরতে বেড়িয়েছে। চিত্রা আসতে চায়নি তাকে এক প্রকার জোর করে আনা হয়েছে। মেয়েটির জীবনের আঙিনায় যেমন করে রোজ দু-বেলা দুঃখ ঝরতে থাকে তেমন করে যে একটা জীবন চালানো যায় না। এই একটা জীবনের তিলে তিলে হওয়া ধ্বংস যে তার কাছের মানুষদের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা দিচ্ছে তা-ও অস্বীকার করার জো নেই। তাই অনেক দিন পরই তাকে গৃহবন্দী জীবন থেকে বের করা হয়েছে। এর আগে হয়তো অনার্স প্রথম বর্ষের ইনকোর্স দিতে বের হয়েছিল তিন মাস আগে। সেটাই শেষ বের হওয়া ছিল। তিন মাসে আর একবারও বের হয়নি।
জুনের সময়টা মাত্রাতিরিক্ত গরম থাকার সময়। আজ সারাবেলা সে-ই গরমই পড়েছিল কিন্তু বিকাল চারটা থেকে অম্বরের তেজ নিভে গিয়েছে। অদূরে মেঘেদের আনাগোনা, সমাবেশ হচ্ছে। অন্ধকার, মুখ ফুলোনো কিশোরী মেঘেদের দলেরা আজ হয়তো কান্নার গল্পের ওঁৎ পেতেছে। বৃষ্টি হবে ধরায়। মেঘেদের মন খারাপ দেখে নিঃসন্দেহে আঁচ করা যায় আজ তুমুল বৃষ্টি হবে৷
ওরা বসে আছে একটি পার্কে। চেরি পার্কের দোলনায় দুলছে আনন্দ সহকারে। চিত্রা বসা তার পাশেই কিছুটা দূরত্ব রেখে বসেছে নিরু। তুহিন ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের ভাব-গতি দেখে নিজে নিজেই বলল,
‘বৃষ্টি হবে না-কি? কেমন অন্ধকার লাগছে না আকাশটা?’
নিরু চিত্রার পাশেই পা ঝুলাতে ঝুলাতে বলল, ‘না। তেমন অন্ধকারতো হয়নি। আর এ সময় বৃষ্টি এলেও তেমন বেশি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
নিরুর ভবিষ্যৎ বাণীতে হাসল চিত্রা। হেলান দিয়ে বসেই আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘বৃষ্টি অনেক জোরেই আসবে, ভাইজান।’
তুহিন বোনের দিকে তাকাল। অর্ধ মৃত বোন তার। চোখের নিচে শতসহস্র বছরের বৈরাগ্য লেপটানো। চুল গুলো ঘাড় অব্দি। ডান গালে চলে যাওয়া ব্রণের দু-চারটে দাগ উজ্জ্বল হয়ে আছে। গলার কাছটায় কালো কালো দাগ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে জর্জেটের ওড়না দিয়ে শক্ত বাঁধন এঁটেছিল। তুহিন সেদিক থেমে মন ঘুরাতে বলল,
‘তুই কীভাবে জানলি আজ অনেক বৃষ্টি হবে? আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে তো তেমন কিছু বলেনি।’
চিত্রা আকাশের দিকে তাকানো অবস্থাতেই মৃদু মৃদু মাথা কাঁপাল।
‘যে যত দুঃখ দেখায় তার তত দুঃখ আসলে থাকে না। কিন্তু যে তেমন দুঃখ দেখায় না প্রকৃতপক্ষে তারই জগতের সমস্ত দুঃখ আলিঙ্গন করে থাকে। মেঘেদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। যখন ঘন কালো মেঘে আকাশ ভরে যাবে, ভয়াল থাবা হবে বাতাসের তখন দেখবে বৃষ্টি তেমন ভয়ঙ্কর হচ্ছে না। কিছুক্ষণ হয়েই কালো মেঘ দূরে দূরে সরে গিয়ে সুন্দরের আনাগোনা হয়। অথচ যখন দেখবে আধো অন্ধকার আধো আলো, মেঘেদের মন খারাপের ধারণা তেমন আঁচ করা যায় না বৃষ্টিটা তখনই ভয়ঙ্কর হয়। কারণ যারা দুঃখ লুকাতে জানে তারা যখন কাঁদতে শুরু করে কিংবা দুঃখ দেখাতে শুরু করে তখন আশেপাশে কেবল দেখবে দুঃখের ঢল। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বলবে— এত দুঃখ ছিল চাপা! আসলে দুঃখ-কষ্ট ব্যাপারটাই এমন। লুকিয়ে রাখলে কেউ দেখবে না কিন্তু বাঁধ ভাঙলে পরিমাপ করেও কূল পাবে না।’
কথা শেষ হয়। থেমে যায় চিত্রার কণ্ঠনালি। তুহিন, নিরু তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কী আশ্চর্য! এতটুকু কথা বলতেই হাঁপিয়ে গেল ও? আগে যে সারাদিন কথা বলেও ক্লান্ত হতো না তবে আজ কেন?
তুহিনের বড়ো মায়া হলো এবং মায়াটা এত বাড়াবাড়ি রকমেরই হলো যে সে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে বোনের সামনে হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়ল। খোলা পার্ক কিংবা জনস্রোত তার মায়ার কাছে হয়ে গেল অদৃশ্য। চিত্রার চোখ তখনও আকাশের দিকে। নিরু থতমত খেয়ে গেল।
তুহিন চিত্রার ডান হাতটা টেনে ধরল। আহত কণ্ঠে বলল,
‘কী লাগবে তোর একটাবার বলবি, মনা? আমি তোর জন্য সব করতে পারব। সব এনে দিবো। কী চাস তুই বল। গোটা দুনিয়া এনে দিব।’
চিত্রা নড়েচড়ে বসল না। ঠাঁই বসে থেকেই বলল,
‘গোটা দুনিয়া হয়ত তুমি এনে দিতে পারবে, ভাইজান। কিন্তু আমি যার ভেতর গোটা দুনিয়া দেখেছি তাকে এনে দিতে পারবে না যে!’
‘কে সে? একটাবার বল।’
ভাইজানের বাচ্চামোতে হাসল চিত্রা,
‘মুখ ফুটে বলার আগেই যে তুমি তাকে তছনছ করে খুঁজে ফেলেছ, ভাইজান। তাহলে কেন এত আনুষ্ঠানিকতা করে জিজ্ঞেস করছ?’
এবার ভালো রকমের চমকে গেল তুহিন। কেবল তুহিন নয় সাথে নিরুও।
চিত্রা এবার আকাশ ছেড়ে দৃষ্টি রাখল ভাইজানের দিকে। ঠোঁটে তার চাপা হাসি। তুহিন তপ্ত শ্বাস ফেলল। বোনের কাছে হার স্বীকার করল। অতঃপর বলল,
‘জানিসই যেহেতু সেহেতু কীসের অপেক্ষা করছিস? যে ফিরবে না তার জন্য কেন অপেক্ষা?’
‘অপেক্ষার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই যে ভাইজান। মানুষ অপেক্ষা করতে পছন্দ করে না কিন্তু বারে বারে প্রতিটা মানুষ অপেক্ষাতেই কাটায়। যেমন আমি অপেক্ষা করছি কারো ফিরে আসার, তুমি অপেক্ষা করছ আমার ফিরে আসার। পথের ধারে ভিক্ষুকটি অপেক্ষা করছে কিছু টাকা পাওয়ার। আর নিরু আপু অপেক্ষা করছে তোমাকে পাওয়ার। এই যে প্রতিটা মানুষই অপেক্ষায় কাটাচ্ছে। কারো অপেক্ষা স্থায়ী কারোটা স্বল্পকালীন। কিন্তু অপেক্ষা শব্দটা সবার জীবনেই পার্মানেন্ট। মানুষের এই জগতে অপেক্ষা কখনো শেষ হবে না। কেউ না কেউ, কিছু না কিছুর অপেক্ষা করছেই, করবেই। তোমার আমার কথায় যে কিচ্ছু বদলাবে না।’
‘কিন্তু তুই তো বদলে গেলি। একটা কয়েক বছরের পরিচিত সামান্য মানুষটা তোর কাছে এত বড়ো হয়ে গেল?’
‘ভাইজান, আমাদের তফাতটাই যে এখানে। তোমার কাছে যেটা সামান্য আমার কাছে সেটা পুরো পৃথিবী। সেজন্যতো তুমি সামান্য বলে অবজ্ঞা করে আমার দুঃখকে হেলা করতে পারো কিন্তু আমি যে সেটা পারি না। পৃথিবীর মতন অসামান্য মানুষটাকে হারিয়ে আমি যে কাঙ্গাল, ভাইজান। ও ভাইজান, বেঁচে থাকা এত যন্ত্রণার কেন?’
এবার চিত্রার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তার মন বড়ো উতলা হচ্ছে আজ। কোথায় যেন আগমনীর সুর বাজছে। মনে হচ্ছে প্রস্থানের পথ ধরে পুরোনো সেই গুনগুন গান, সেই সিগারেট পোড়া ঠোঁটের মানুষটি ফিরে আসছে। এত আনচান আনচান কেছে কেন মনটা?
চিত্রা তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,
‘যারে বুকে রাখলাম সে-ই আমাদের বুক ব্যথার কারণ কেন হয়, ভাইজান?’
★
পরিচিত শহরের অপরিচিত টঙ দোকানটায় বসে সিগারেট টানতে থাকা ছেলেটাকে দেখে কয়েকজন বয়স্ক লোক চোখ-মুখ কুঁচকালেন। একজনতো রেগেই বলে উঠলেন,
‘এভাবে অভদ্রের মতন নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছ কেন?’
সিগারেটে ঠোঁট চেপে রাখা ছেলেটা জবাব দিল, ‘আমি অভদ্র, তাই।
‘কী দিন কাল এলো! ছেলে-ছোঁকড়ার ভেতর কোনো সভ্যতা নেই।’
‘সভ্যতার ইতিহাস ভেঙে পড়েছে সেই কবেই। উনিশশো কটকটি সালে বোধহয়।’
ভদ্রলোকেরা ছেলেটার এমন একরোখামিতে বিরক্ত হলেন। চায়ের কাপে বিরক্ত ঢেলে বললেন,
‘অসভ্য।’
ছেলেটা সিগারেটে ফুঁক দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘সভ্য কারা? আপনারা? তাই বুঝি চায়ের দোকানে বসে চা-ওয়ালির বুক-কোমড় নিয়ে কথা বলছেন?’
এবার থমকে গেলো সেই দু'জন ব্যক্তি। চা দেওয়া মহিলাটাও চমকে গেল। বি স্ফো র ণ ঘটানো ছেলেটা জ্বলন্ত সিগারেটটা নিয়ে লাগিয়ে দিল এক ভদ্রলোকের ঠোঁটে। সাথে সাথে লোকটার গগণ ফাঁটানো চিৎকার। ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল,
‘এরপরের বার কারো শরীর মাপার আগে তোর পাপ মাপিস। সভ্যতা দেখবি হেঁটে হেঁটে চলে আসবে।’
জনসমাগম বাড়ল। সেই সমাগমের মাঝে বিলীন হয়ে গেল চিত্রার কাঙ্ক্ষিত সেই পোড়া ঠোঁটের মানুষটি।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
মম সাহা’র গল্প ও উপন্যাস:
- যতনে রাখিলাম যাতনা
- প্রেমোত্তাপ
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা মম সাহা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
part 4
উত্তরমুছুনNext part
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন