উপন্যাস : কেয়া পাতার নৌকা
লেখিকা : রাজিয়া রহমান
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ২২ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ইং
লেখিকা রাজিয়া রহমানের “কেয়া পাতার নৌকা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ২২ই ফেব্রুয়ারী থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান |
৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান (পর্ব - ৪)
রাবেয়া সকাল সকাল উঠে সারা বাড়ি ঝাড়ু দিলো।রান্নাঘরে আটা সিদ্ধ করার জন্য পানি বসিয়েছে। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। রাবেয়ার মন ভালো নেই।আজকে তরুর বাবার জন্মদিন। মানুষটা নেই অথচ তার সব স্মৃতি রাবেয়ার কাছে সযত্নে রাখা আছে।প্রতি মুহূর্তে রাবেয়ার মনে পড়ে সেসব কথা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো রাবেয়ার।ভালো পাত্র,টাকা পয়সা আছে দেখে বাবা মা ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
তারপর পরের বছরেই তরুর জন্ম হলো।আকবর বিয়েএ তিন মাস পরে বিদেশে চলে যায় আবারও। তরুর ৫ বছর বয়সের সময় একবার ছুটিতে দেশে আসে ২ মাসের জন্য।
১০ বছরের বিবাহিত জীবনে রাবেয়া স্বামীকে কাছে পেয়েছে সর্বমোট ৫ মাস।৫ মাস মানে ১৫০ দিন।
আহা জীবন!
যার সাথে সারাজীবনের জন্য বাঁধা পড়লো তারেই কি-না কাছে পেলো মাত্র ১৫০ দিন গুনে গুনে!
রাবেয়ার বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালাপোড়া অনুভূতি হয়। কাউজে বুঝাতে পারে না রাবেয়া।
শরীরের কষ্টের চাইতে মনের কষ্ট বেশি।সেই মানুষটা যাওয়ার পর থেকে রাবেয়া আর রাবেয়া নেই।সে যেনো অন্য কেউ হয়ে গেছে।
রাবেয়ার দুই চোখ টলমল করে সেসব ভাবতে ভাবতে।
রুটি বানানোর জন্য আটা মেখে নিচ্ছিলো।দুই চোখের পানি টুপটাপ করে আটায় পড়ছে।
রাবেয়ার মনে হচ্ছে তরুর বাবা বেঁচে থাকলে এতো দিনে তাদের আরেকটা সন্তান থাকতো।
রাবেয়ার এই যে রান্নাবান্না করার সময়টা আকবরের সাথে মোবাইলে ভিডিও কল বা অডিও কলে কথা বলে কাটাতে পারতো।
রাবেয়ার জা কে দেখে প্রায় সারাক্ষণই আলমগীরের সাথে কথা বলতে।
রাবেয়া সেসব নিয়ে হিংসা করতে চায় না।তবে বুকের ভেতর কেমন কাঁটার মতো বিঁধে এসে। তার মানুষটা বেঁচে থাকলে সে ও তো কথা বলতে পারতো এরকম!
তরু স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।দুই চোখে সুন্দর করে কাজল দিলো।সাজগোজের মধ্যে তরু কাজলটাই ব্যবহার করে সবসময়। তরুর চোখের কাজল কখনোই লেপ্টে যায় না।
রাবেয়া নিজের আর মেয়ের নাশতা নিয়ে গেলো মেয়ের জন্য। প্রতিদিন খাবারের সময়টা রাবেয়ার কেমন অস্বস্তি লাগে।সব কাজ সে করে অথচ খাওয়ার জন্য আমেনার অপেক্ষা করতে হয়।আমেনা দিলে রাবেয়া নিজে খেতে পারে,মেয়েকে দিতে পারে।
তরুকে রুটি আর ডাল খাইয়ে দিচ্ছিলো রাবেয়া।সেই মুহূর্তে রাবেয়ার বড় ভাই রাজীবের কল আসে।
রাবেয়া এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে তাকায়।
ভাইজানের সাথে এখন কথা বলা যাবে না।তরু স্কুলে গেলে কথা বলবে।
তরু এতো কিছু খেয়াল করে নি।তৈরি হয়ে সোজা বের হয়ে গেলো।
তরু যাওয়ার পর রাবেয়া ভাইকে কল দিলো।
রাজীব একটা এনজিওতে চাকরি করে। রাবেয়া কল দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করার পর রাজীব বললো, "তারপর বল,কি ভাবলি?"
রাবেয়া হতবাক হয়ে বললো, "কি বলেন ভাইজান?আমি তো যা বলার বলে দিছি।আমার তরু এখনো ছোট। ওর একটা ব্যবস্থা না করে আমার পক্ষে নিজেকে নিয়ে ভাবা সম্ভব না। এই কথাগুলো আপনারা আর বলিয়েন না আমার সাথে। তরু জানতে পারলে কষ্ট পাবে।"
রাবেয়া ফোন রেখে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। আজ আবার লতার নানার বাড়ি থেকে ওর মামা,মামী,খালা আসবে।আজকে অনেক রান্নাবান্না আছে।
তরু স্কুল ছুটির পর বের হয়ে দেখে তরুর বড় মামা আর ছোট খালা স্কুলের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বেশ অবাক হলো তরু।মামারা সাধারণত আসে না কেউ তরুদের বাড়িতে।অবশ্য এখন তরুদের বাড়ি না।তরুদের পরিস্থিতি সবাই বুঝতে পারছে বলে কেউই আসে না।বছরে এক দুই বার নানার বাড়ি যাওয়া হয় তরুদের। মামা এগিয়ে এসে তরুকে জড়িয়ে ধরলেন।
লতা তরুর মামা খালাকে দেখে আর দাঁড়ায় নি।একা চলে গেছে। দেরি করলে প্রাইভেটের দেরি হয়ে যাবে।প্রাইভেট কিছুতেই মিস দিতে চায় না লতা।
স্কুলের সামনে একটা হোটেলে বসলো তিনজন। তরুর মামা সিংগারা, সমুচা অর্ডার দিলেন।খেতে খেতে মামা জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে ওদের অবস্থা কি।
মামারা যেহেতু সবাই সব জানেন তরু তাই দ্বিধা করলো না সব বলতে।
রাজীব নাহারকে ইশারা করলো।নাহার তরুর চিবুকে হাত দিয়ে বললো, "তরু মা,তোর মায়ের এতো কষ্ট তোর সহ্য হয়?তোর ইচ্ছে করে না মায়েরে সুখী দেখতে?
এই যে কাজের লোকের মতো জীবন কাটাচ্ছে তোর মা,এই জীবন কি তোর মায়ের পাওনা ছিলো বল?তোর বাপ থাকলে কি তোর মায়ের জীবন এরকম হতো? "
তরু মাথা নাড়ায়।চোখ টলমল করে তরুর।তরুর ইচ্ছে করে মা'কে এক আকাশ সুখ এনে দিতে। তরুর ছোট্ট বুকে অনেক যন্ত্রণা। মা'য়ের গোপন কান্না তরু বুঝতে পারে। তরুর চোখে পানি দেখে নাহার বলে, "জানিস তরু,তোর বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা সবাই চেয়েছি তোর মা কে আরেকটা বিয়ে দিতে।তোর মায়ের বয়স কতোই হইছে?সবে ৩০-৩১ বছর। এই বয়সে অনেক মেয়ে বিয়ে ও করে না নিজেরা পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে। আমরা গ্রামের মানুষ হওয়ায় বাবা মা ছোট ছোট মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়।
জীবনে স্বামী না থাকলে জীবন অনেক কঠিন হয়ে যায় মা।তোর চাচা আছে বলে দেখছিস না তোর চাচীর জীবন কেমন?
তোর বাবা নেই বলে দেখ তোর মায়ের জীবন কতো কষ্ট! তুই এখন বড় হয়েছিস মা।নিজের ভালো মন্দ নিশ্চয় বুঝতে পারছিস তুই।
তোর বড় মামা তোর মায়ের বিয়ের জন্য একটা সম্বন্ধ এনেছে।"
তরু চমকে উঠে মায়ের বিয়ের কথা শুনে। এক মুহূর্তের জন্য তরুর মনে হয় কেউ বুঝি তার কলিজায় হাজারটা তীর মারলো।বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠলো মুহূর্তে।
নাহার তরুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, "তরু,তোর মা তোর মুখের দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার সব সুখ ত্যাগ করতে পারে। করছে ও।তোর বাবা মারা গেছে আরো ৫ বছর আগে। অথচ দেখ,তোর মা তোকে বুকে নিয়ে সব কষ্ট সহ্য করে পড়ে আছে নিজের ঘরে তোর মা দাসীর মতো থাকে।
অথচ তোর মা হতো রাজ রানী। তোর কি ইচ্ছে করে না মা'কে সুখী দেখতে?
তোর মায়ের একটা বিয়ে হলে তোর মা এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।নিজের জীবন আবারও গুছিয়ে নিতে পারবে।
তুই একবার ভেবে দেখ মা।তোর বয়সী কতো মেয়েরা হোস্টেলে থেকে একা লেখাপড়া করে না বল?
এখন তুই আছিস,কিন্তু তোর বিয়ে হয়ে গেলে তখন তোর মা কি করবে?
তখন কাকে নিয়ে থাকবে?
তাছাড়া এখন যেমন ভালো পাত্র পাওয়া গেছে,তখন কি এরকম পাওয়া যাবে?
তাছাড়া তখন তোর মায়ের বয়স ও হয়ে যাবে।এখন যেই সময় তোর মায়ের নিসঃঙ্গতায় কাটছে,এর ক্ষতিপূরণ কি কখনো কেউ দিতে পারবে?
তোর মা তোর কথা ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না।আমাদের ও নিষেধ করে। তুই ভেবে দেখ মা।
তাছাড়া যার সাথে তোর মায়ের বিয়ের কথা হচ্ছে, তার ও একটা মেয়ে আছে তোর বয়সী। তুই তোর মায়ের সাথে ওখানেই থাকতে পারবি।তুই যদি হ্যাঁ বলিস তবে তোর মা আবারও সুখী হতে পারবে।ভেবে দেখ মা।নিজের মা'কে আর কতো কষ্ট পেতে দেখবি সেটা তোর সিদ্ধান্ত। "
মামা তরুকে একটা রিকশায় তুলে দিলো।
রিকশায় বসে তরুর মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো।
কি বলে গেলো খালামনি এসব?
মা'র বিয়ে!
তরুর কখনো ভাবনাতেও ছিলো না এই কথা। এখন মনে হচ্ছে আসলেও তো।
মা কি তবে সারাজীবন এরকম চাচীর কাজ করে জীবন শেষ করবে?
তরু এখন বড় হয়ে গিয়েছে। এতো দিন কেনো ওর মাথায় এই ভাবনা এলো না!
সবসময় মায়ের কথা ভেবেছে অথচ এটাই কি-না ভুলে বসে আছে!
বাড়ি এসে তরু যখন খেতে বসলো রাবেয়া মেয়েকে খাবার বেড়ে দিলো তরু মা'কে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
মা'কে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। মায়ের চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল।
হাত পা কেমন খসখসে।
মাথার চুল এলোমেলো। অথচ মা কতো সুন্দরী ছিলো!
তরুর আবার ভয় ও করছে।মা'কে ছেড়ে তরু কিভাবে থাকবে!
মা নেই ভাবলেই তো তরুর চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসে।
খাওয়া শেষ করে তরু ছাদে চলে গেলো। ছাদে তরুর কয়েকটা গাছ আছে।তরু কামিনী গাছটির পাশে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো বুঝতে পারছে না। একেকবার মনে হচ্ছে মা'কে ছাড়া সে ম//রে যাবে।আবার মনে হচ্ছে নিজের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে মা'য়ের জীবন সে নষ্ট করে ফেলছে।
ফাইজান জানালা দিয়ে দেখলো স্কুল ড্রেস পরা একটা মেয়ে মাথা নিচু করে বসে কাঁদছে। লতা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে থাকতে পারে এটা ফাইজানের ভাবনায় ছিলো না।
কিছুক্ষণ দেখার পর যখন দেখলো মেয়েটা এখনো কাঁদছে ফাইজান উঠে এলো।
মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো?"
তরু পুরুষ মানুষের গলা শুনে চমকে উঠলো। পেছনে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। লতার বদলে অন্য একটা মেয়েকে দেখে ফাইজান অবাক হলো। সে তো ভেবেছে লতা।মেয়েটা কি মনে করবে এবার!
তরু কি বলবে ভেবে পেলো না। এই লোকটা কে!
ফাইজান তরুর কাজল দেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখের কাজল কি ওয়াটার প্রুফ না-কি!
একটুও লেপ্টে যায় নি কাজল।কাজল দেওয়া কান্নাভেজা চোখ কি মায়াবী লাগছে!
ফাইজানের বুকটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো। তরু হুঁশ ফিরে পেতেই তিন চার লাফ দিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।
হেসে ফেললো ফাইজান মেয়েটার কান্ড দেখে। মেয়েটা তো ভারী অদ্ভুত!
তরু চলে গেলো, অথচ ফাইজানের চোখে তখনও তরুর কাজল দেওয়া দুই চোখের ছবি ভাসতে লাগলো।
মানুষের চোখ এতটা মায়াবী হবে কেনো!
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৫ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা রাজিয়া রহমান বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তিনি। তরুণ এই লেখিকা বৈবাহিক সূত্রে লক্ষ্মীপুরেই বসবাস করছেন। বর্তমানে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জননী। পেশাগতভাবে তিনি গৃহিনী হলেও লেখালেখির প্রতি তার ভিষন ঝোক। আর তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও শখের বশে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। ২০২২ সালের মধ্যদিকে গর্ভকালিন সময়ে লেখিকা হিসেবে হাতেখড়ি নিলেও এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন “তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর” ও “শালুক ফুলের লাঁজ নাই” -এর মতো বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন