উপন্যাস        :         নিবেদিতা
লেখিকা        :          মুন্নি আক্তার প্রিয়া
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১০ই মে, ২০২৪ ইং

লেখিকা মুন্নি আক্তার প্রিয়ার “নিবেদিতা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ১০ই মে থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
নিবেদিতা || মুন্নি আক্তার প্রিয়া
নিবেদিতা || মুন্নি আক্তার প্রিয়া

১৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

নিবেদিতা || মুন্নি আক্তার প্রিয়া (পর্ব - ১৯)

নিবেদিতা বড়ো বড়ো কদম ফেলে হাঁটছে। চোখের পানিতে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখলেও সে এক মুহূর্তও কোথাও থামছে না। পেছন থেকে ভেসে আসা নির্ণয়ের ডাক শুনতে পেয়েও উপেক্ষা করে হাঁটছে। নির্ণয় দৌঁড়ে এসে নিবেদিতার সামনে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে সে। নিবেদিতা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আবারও সামনে দাঁড়াল পথরোধ করে। কোনো কথা না বলে দুহাতে চোখের পানি মুছে আবারও পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল নিবেদিতা। তবে পারল না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই নির্ণয় ওর হাত চেপে ধরেছে। এখনো হাঁপাচ্ছে সে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
"আমার কথা শোনো প্লিজ!"
নিবেদিতা তাকাল না। তার দুচোখ অশ্রুতে টইটুম্বুর হয়ে আছে। সে অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,
"আমার হাত ছাড়ুন।"
"প্লিজ! নিবেদিতা। এমন কোরো না। আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশে কথাগুলো বলিনি।"
নিবেদিতা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিল না ঠিকমতো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
"কে বলল আমি কষ্ট পেয়েছি? খুব আনন্দ পেয়েছি আমি কথাগুলো শুনে।"
"তুমি যেভাবে কথাগুলো ধরে নিয়েছ আমি সত্যিই তেমন কিছু মিন করে বলিনি। তুমি তো জানোই আমি কেমন? আমি হয়তো তোমাকে গুছিয়ে বলতে পারিনি কথাগুলো।"
নিবেদিতা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
"আমি কোনো এক্সপ্লেইন শুনতে চাইনি। আপনি আমার হাত ছাড়ুন।"
"আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো দাও?"
"আমি আপনার কোনো কথাই শুনতে চাই না। দয়া করে আমার হাত ছাড়ুন।"
নির্ণয়ের হাত ছাড়তে হলো না। নিবেদিতা নিজেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল এবং কিছুটা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
"দয়া করে আমাকে ফলো করবেন না!"
নাকউঁচু স্বভাবের ও আত্মসম্মানের প্রাচীরে ঘেরা নির্ণয়ের জন্য এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল। ভালোবাসলে নাকি বেহায়া হতে হয়, আর কতটা বেহায়া হওয়া উচিত?
____
বাড়িতে ফিরে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়ল নিবেদিতা। নির্ণয়ের বলা কথাগুলো যেন তীরের মতো বিঁধছে বুকে। মানুষটা তাকে এতটা ছোটো ভাবে? এভাবে অপমানও করা যায়? নিজের প্রতি তার রাগ, জেদ হচ্ছে এখন। সে না মানুষটাকে ভালোবাসত আর না তাকে প্রতিটা পদে পদে এভাবে পুড়তে হতো।
চোখের পানি মুছে সে উঠে পড়ার টেবিলের কাছে গেল। টেবিলের ওপর তার সেই পুরনো ডায়ারি। একমাত্র এই ডায়ারিটাই নিবেদিতার ভালোবাসার সাক্ষী। ডায়ারিটা কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল সে। চোখের পানি মুছে ডায়ারি খুলল। প্রথম পেইজগুলোর লেখা খুবই এলোমেলো ও অগোছালো। হওয়ারই কথা অবশ্য। তার ভালোলাগা অনুভবটা শুরু হয় যখন সে ক্লাস এইটে পড়ে। যদিও এই সময়টা ভালোবাসার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। অবশ্য তখন সে ভালোবাসা কী সেটা বুঝতও না। শুধু জানত, নির্ণয়কে তার ভীষণ ভালো লাগে ভীষণ! এই ভালো লাগার সূচনা হয় কু'রবানির ইদে। রোজার ইদে বড়ো খালারা গ্রামে এলেও নির্ণয় তেমন আসত না। সে তার বন্ধুদের সাথে শহরেই ইদ করত। কিন্তু কুর'বানির সময় তাকে বাধ্য হয়ে হলেও আসতে হতো। মূলত নিবেদিতার ভালোলাগার সূচনা ঘটে কুর'বানির ইদের পরেরদিন। ইদের দিন গোরু কাটা'কাটি ও বিলি করে সারাদিন পার হয়ে যাওয়াতে বাড়ির ছেলেদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ইদের পরেরদিন বাড়ির সবাই একসাথে ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করল। সবাই রেডি হয়ে উঠানে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু নির্ণয় এখনো আসেনি। বড়ো খালা নিবেদিতাকে পাঠালেন নির্ণয়কে ডাকার জন্য। নিবেদিতা দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। নির্ণয় যে রুমে ছিল সেই রুমে গিয়ে দেখল কালো শার্ট পরা একটা ছেলে বিছানায় উবু হয়ে বসে জুতার ফিতা বাঁধছিল। সন্দেহ ছিল না যে, এটা নির্ণয়-ই। যখনই নিবেদিতা বলতে যাচ্ছিল, 'ভাইয়া, তোমাকে ডা...' তখনই জুতার ফিতা বেঁধে মুখ উঁচু করে তাকাল নির্ণয়। সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অদৃশ্য বৈদ্যুতিক শকড্ খেল নিবেদিতা। সে হা করে নির্ণয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ণয়ের এলোমেলো কিছু চুল কপালের কাছে পড়ে ছিল। ফ্যানের বাতাসে মৃদু নড়ছিল। কালো শার্টের টপ দুটো বোতাম খুলে রাখা ছিল তাই খুব সহজেই নির্ণয়ের লোমশ ফরসা বুক কিছুটা দৃশ্যমান ছিল। বাম হাতে ছিল একটা ঘড়ি। সেই হাত দিয়ে নির্ণয় যখন শার্টের কলার টেনে একটু পেছনের দিকে নিচ্ছিল তখন নিবেদিতার মনে হচ্ছিল এখনই সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। একটা মানুষ কি এতটাও সুন্দর হয়? যদি তা-ই হয় তাহলে সে আগে কেন দেখেনি? কেন নির্ণয়ের সৌন্দর্য তার চোখে পড়েনি? এই কেনর উত্তর সে সেদিন পায়নি। কিন্তু এর পরের সময়গুলো কাটতে লাগল স্বপ্নের মতো। নির্ণয়কে দেখলেই অকারণেই সে লজ্জা পেত। নির্ণয় অবশ্য এসব লক্ষ করত না। লক্ষ আর কী করবে? সে তো ভুলেও মুখ ফিরে একটু তাকাত না। প্রথম প্রথম এজন্য নিবেদিতার একটু রাগ হতো, জেদ হতো। অভিমানও হতো। কিন্তু পরে যখন ভেবে দেখল যে, নির্ণয় তাকায় না বলেই সে একটু শান্তিমতো চোখ ভরে নির্ণয়কে দেখতে পারে তখন থেকে তার সমস্ত রাগ, জেদ, অভিমান কর্পূরের ন্যায় উবে গিয়েছিল। এই ভালোলাগা যে কবে, কীভাবে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল নিবেদিতা একদমই টের পায়নি। সময়ের সাথে সাথে সে উপলব্ধি করছিল সে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে তার ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপান্তর হয়েছে। নির্ণয়কে দেখার জন্য, একটু কথা বলার জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকত কবে ইদ আসবে অথবা কবে নানার বাড়িতে কোনো উৎসব হবে।
অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল নিবেদিতার। সে ডায়ারি বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বন্ধ করল। মন বলছে, অপ্রকাশিত ভালোবাসাটাই হয়তো তার জন্য ঠিক ছিল। দুচোখের কোনা বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিবেদিতার।
_______
রাগে, জিদ্দে নির্ণয় কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই প্রথমবার তার নিজের কাছেই নিজের চাপা স্বভাবটা বিরক্ত লাগছে। কেন সে অন্যদের মতো মন খুলে কথা বলতে পারে না? কেন সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না? কেনই বা তার কথা এত রুড! সে তো চায়নি নিবেদিতাকে কষ্ট দিতে। কাঁদাতে। অথচ না চেয়েও বারংবার সে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে। এতদূরে এসেও, এত কাছে পেয়েও সে তার মনের কথাগুলো বলতে পারছে না।নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। উলটো দিনকে দিন সে নিবেদিতাকে কষ্ট দিচ্ছে।
সে আত্মসম্মানের পরোয়া না করে নিবেদিতাকে কল দিল, ম্যাসেজ দিল। কিন্তু নিবেদিতা কোনোটারই কোনো রেসপন্স করল না। এক সময় ফোন বন্ধও পেল। নির্ণয় খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যে, সে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে নিবেদিতাকে। নিজের প্রতি রাগে থরথর করে কাঁপছে শরীর। হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মারল সে দেয়ালে। বিছানার চাদর, বালিশ ছুড়ে ফেলে ও টি-টেবিলের ওপর থাকা ফুলদানিটা ভেঙেও তার রাগ কমল না। তার মনে হতে লাগল ডেনমার্কে আসা তার উচিত হয়নি। এখানে না এলে নিবেদিতাকেও এত কষ্ট পেতে হতো না। দেয়ালে পরপর পাঁচটা ঘুষি দিয়ে সে আহাজারি করে বলে উঠল,
"আ'ম সরি নিবেদিতা!"
.
.
ঘুম ভাঙল নিবেদিতার সকাল নয়টায়। আজ সে ক্লাসে যাবে না। বেকারিতেও যাবে না। কিছুটা সময় সে একা থাকতে চায়। হঠাৎ করেই তার মিদহাদের কথা মনে পড়ল। গতকাল যে সে মিদহাদকে কফিশপে আসতে বলল এরপর কী মিদহাদ এসেছিল? নিশ্চয়ই এসেছিল। আর এসে তো নির্ণয় কিংবা নিবেদিতা কাউকেই পায়নি। বেচারাকে সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল। নির্ণয়কে দেখে নিশ্চয়ই মিদহাদ সারপ্রাইজড্ হতো? আর উলটো নির্ণয়ই তাকে সারপ্রাইজ করে দিল। নিবেদিতা আনমনেই হাসল। বিষাদের হাসি! বিছানার ওপর থেকে ফোন নিয়ে দেখল ফোন বন্ধ। বিরক্তিতে বলে উঠল,
''শীট!"
রাগে যে সে গতকাল ফোন বন্ধ করে রেখেছিল, মিদহাদ তো তাকে কল করেও পায়নি। ফোন অন করে সে মিদহাদকে কল করল। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ করল মিদহাদ। আগে কখনো কলে কথা হলেই মিদহাদ প্রাণোচ্ছল স্বরে বলত,
"হ্যালো, প্রাণ?"
কিন্তু আজ সে চুপ করে রইল। একটু অবাকই হলো নিবেদিতা। নিজেই আগে কথা বলল,
"হ্যালো?"
ওপাশ থেকে মিদহাদ বলল,
"বলো। শুনছি।"
নিবেদিতা সংকোচের সাথে বলল,
"সরি! কাল দেখা করার কথা বলে দেখা করতে পারলাম না।"
"ইট'স ওকে।"
কারণও জানতে চাইল না মিদহাদ। এতে করে আবারও অবাক হলো নিবেদিতা। জিজ্ঞেস করল,
"আপনি এখন কোথায়?"
"এয়ারপোর্টে আছি।"
নিবেদিতা অবাক হয়ে বলল,
"কেন? চলে যাচ্ছেন?"
"হুম। ইমার্জেন্সি দরকার আছে অফিসে। তোমাকে কল দিয়েছিলাম গতকাল এটা বলতেই। ফোন বন্ধ ছিল।"
"ওহ। হ্যাঁ, ফোনও অফ ছিল"
মিদহাদ আর কথা না বাড়িয়ে বলল,
"নিজের খেয়াল রেখো। ইমিগ্রেশন পার হবো এখন।"
নিবেদিতা বলল,
"সাবধানে যাবেন।"
মিদহাদ মৃদু হাসল। সেই হাসি অবশ্য দৃষ্টিগোচর হলো না নিবেদিতার। ভাগ্যিস হয়নি! তা না হলে হাসির সঙ্গে তার চোখে-মুখে থাকা বিষাদের ছাপও নিবেদিতা দেখে ফেলত। কল কেটে ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে মিদহাদ স্বগতোক্তি করে বলল,
"সরি নিবেদিতা!"

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২০ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
“মুন্নি আক্তার প্রিয়া” বাল্যকাল থেকেই কল্পনা ও সাহিত্য বিলাসী। লেখা লেখিটা মূলত শখের বশে শুরু করলেও, পরবর্তীতে তা একসময় নেশায় পরিণত হয় তার। লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ফেসবুকের ফলোয়ারদের থেকে। তাদের ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণাই তাকে সাহিত্য জগতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে অদম্য সাহস ও ইচ্ছে শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এইভাবেই সাহিত্য জগতে তার প্রথম “সাঁঝের কন্যা” বইটি প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমেই প্রকাশণা জগতে পদার্পন। 
তার লেখা প্রথম বইটি ব্যাপক সাড়া ও সফলতার ধারাবাহিকতায় তার দ্বিতীয় বইটি “চক্ষে আমার তৃষ্ণা” প্রকাশিত হয়। সফলতার পথে অগ্রসর হওয়া এই লেখিকার জন্ম শরিয়তপুর জেলায়, কিন্তু বেড়ে ওঠা ও সপরিবারে বাস করেন গাজীপুরে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন