উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


১১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব -১২ )


বৈশাখ মাস। দ্বিপ্রহরের রোদে চারদিক ঝাঁ ঝাঁ করছে। মিষ্টি প্রেম চত্বরের একটা বেঞ্চিতে আপন মনে বসে আছে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে উদাস চোখে আকাশ দেখছে। একটু আগেই ঈশানের সাথে ঘন্টা পেরিয়ে কথা হয়েছে তার। এক ঘন্টা সময়! কম তো নয়? অথচ মিষ্টির কাছে মনে হলো যেন মোটে পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। কী নিয়ে এতো কথা হলো, মনে করতে পারল না মিষ্টি। কেবল জানে, কথা হলো। তারপর কল এলো নাহিদের। আচমকা যেন সম্বিত ফিরে পেল মিষ্টি। নাহিদ সবসময়ই ধীর, স্থির। দু'বার কল করে মিষ্টিকে ব্যস্ত পেয়ে অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে গেল সে। মিষ্টি কলব্যাক করতেই শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ কেমন আছো?’
কণ্ঠে তার রাগ নেই। অভিমান নেই৷ একটি বারও শুধাল না, কার সাথে কথা বলছিলে এতোক্ষণ ধরে? মিষ্টি নিজে থেকেই বলল,
‘ ঈশান কল করেছিল। তোমাকে বলেছিলাম না ঈশানের কথা? ছেলেটা মাঝে মাঝেই কল করে। খালামণির আত্মীয় বলে এড়িয়েও যেতে পারি না।’
নাহিদ সহজ কণ্ঠেই বলল,
‘ আচ্ছা! তা কী কথা হচ্ছিল?’
‘ দূর! তেমন কিছু না।’
কথাটা বলে থেমে গিয়েও আবার কী মনে করে ঈশানের সাথে আলোচনা করা প্রত্যেকটা বিষয় মনে করে করে নাহিদকে জানাল মিষ্টি। নাহিদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নাহিদের দেওয়া এই অবাধ স্বাধীনতায় মিষ্টির যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন নিক্বণের মতো বাজতে লাগল,
‘ প্রেম মানুষের জীবনে কতবার আসে? দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়া কী ভীষণ অন্যায়?’
সমস্ত হৃদয় হাতড়েও উত্তর পেল না মিষ্টি। উত্তরের বদলে ভারী হতে লাগল দীর্ঘশ্বাস। বুকের ভেতর নিজের অগোচরেই জন্মে যাওয়া সূক্ষ্ম অপরাধবোধে কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত ঠেকল মন।
নাহিদের সাথে তার প্রথম দেখাটা হয়েছিল বছর ছয়েক আগে। তখন তারা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিষ্টি চিরকালই শান্ত স্বভাবের মেয়ে। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ নিয়ে একটা ভীতি সর্বদা ল্যাপটে থাকে তার চোখের কোণে। এই ভয় ভয় চোখদুটো নিয়েই পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে মা তাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন শহরের একটা কোচিং সেন্টারে। লাজুক, শান্তমূর্তি মিষ্টি প্রথম দিন ক্লাসে গিয়েই টের পেল, ক্লাসের সমস্ত মনোযোগ ফল্গুর বালির মতো নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে বসে আছে একটি ছেলে। প্রতিটি ক্লাসে তাকে খুব আয়োজন করে দাঁড় করানো হচ্ছে। কখনও সে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে বলে দোষী। কখনও পরীক্ষার দিন উধাও হওয়ার জন্য। কখনও সে কোচিং সেন্টার সংলগ্ন সরকারি আপিসের বাগানে ঢুকে সমস্ত ফল হাপিশ করে দেওয়ার অপরাধে দণ্ডিত। এই সকল অভিযোগ যার মাথায় দুর্যোগের মতো নাচছে; তার ঠোঁটে কিনা মিটিমিটি লাজুক হাসি। যেন স্যারদের অতি প্রশংসায় সে অত্যাধিক লজ্জিত। টকটকে ফরসা আদুরে মুখ। বড় বড় ছলছলে দুটো চোখ। খাঁড়া নাকের নীচে বালকসুলভ গোলাপি ঠোঁট। যাকে প্রথম নজরেই দেবশিশু ভেবে আশ্চর্য হতে হয় সেই ছেলেকে একের পর এক অভিযোগের কাঠগড়ায় দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মিষ্টি। ভেবে নিয়েছিল, নিশ্চয় এখানে কোনো দুষ্ট ছেলের চক্র আছে। যারা সরল ছেলেটিকে বারবার বলির পাঠা বানিয়ে আপন আপন পিঠ বাঁচাচ্ছে। মিষ্টির নরম মন সরল ছেলেটির কাল্পনিক দুঃখের কথা ভেবে কতই না কাতর হয়েছিল! তবে দুইদিন ক্লাস করার পর মিষ্টির সেই মিঠে মিঠে কল্পনা ভেঙে গেল। Never judge a book by it's cover – কথাটি যে কতটুকু সত্য তা একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেল। আবিষ্কার করল, লাজুক হাসির মিষ্টি ছেলেটি ভয়ংকর দুষ্ট। দস্যি ছেলের দস্যিপনা জানার পরও ছেলেটির প্রতি মায়া কিছুমাত্র কমলো না মিষ্টির। বরং বাড়তে লাগল। খেয়াল করে দেখল, কেবল সে নয়। কোচিং-এর শিক্ষক থেকে শুরু করে নারীমহল, সকলের মধ্যেই তাকে আস্কারা দেওয়া নিয়ে অপরিসীম আগ্রহ। সুকোমল চেহারা আর দারুণ মেধার অপব্যয়ে স্যাররা তার প্রতি বড় কোমল। নারীমহলে জনপ্রিয় সে তার মিষ্টি ব্যবহারের জন্য। কিছুমাত্র সীমা লঙ্ঘন না করে কেবল মিষ্টি হাসি আর মধুর কথায় নারী মন ভুলিয়ে দেওয়ায় সে সিদ্ধহস্ত। ছেলেটি অনর্গল মিথ্যা প্রশংসা করে, কথায় কথায় চাপার জোর চালায় এসব জানার পরও নারীরা তার কথায় মুগ্ধ হয়। লজ্জায় গোলাপি হয়ে উঠা গালে বলে,
‘ যাহ! দুষ্টু!’
এই দুষ্টু মিষ্টি ছেলেটির সাথে প্রথম দুই সপ্তাহ কোনো কথাই হলো না মিষ্টির। তৃতীয় সপ্তাহে সে খেয়াল করল, ছেলেটি তাকে লক্ষ্য করছে। চতুর্থ সপ্তাহে তার বন্ধুরা মিষ্টিকে দেখলেই নাহিদের নাম ধরে হর্ষধ্বনি করতে লাগল। সেই কৈশোরে এই নিষ্পাপ দুষ্টুমিগুলো কী ভীষণ হুল্লোড় তুলেছিল মনে! কত উত্তেজনা, কত লজ্জা, কত বিস্ময়… ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলল মিষ্টি। নাহিদ তার সাথে কথা বলেছিল তারও অনেকদিন পর। কোচিং শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল মিষ্টি। তখন রাত্রির আটটা কী নয়টা বাজে। পিচ ঢালা রাস্তায় পিছলে পড়ছে সোডিয়ামের হলদে আলো। কোচিং-এর ছেলেমেয়েরা হৈ-হৈ করে বেরুচ্ছে। এর মধ্যে নাহিদের সাইকেলটা এসে থামল মিষ্টির সামনে। নাহিদকে মিষ্টির সামনে দাঁড়াতে দেখেই পেছন থেকে চিৎকার করতে লাগল বন্ধুরা। নাহিদ তাদের চেঁচামেচি উপেক্ষা করে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিল। সহজ কণ্ঠে শুধাল,
‘ আম্মুর জন্য অপেক্ষা করছ?’
নাহিদ তার সাথে কথা বলছে বুঝতে পেরেই বুকের ভেতর কী ভীষণ ঝড় উঠেছিল সেদিন! ভয় ভয় করছিল। লজ্জাও হচ্ছিল। বুকের ভেতর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বারবার শুধাচ্ছিল, নাহিদ তাকে প্রপোজ করে বসবে না তো? যদি করে? তবে কী উত্তর দিবে মিষ্টি? ভয়, লাজ, অস্বস্তিতে কাদা হয়ে কেবল একটু ঘাড় নাড়ল মিষ্টি। মিষ্টিকে এতো লজ্জা পেতে দেখে নাহিদ বলে বসল,
‘ মিষ্টি? আমার কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা লাগছে। হাত-পা কাঁপছে দেখো। তারপরও খুব সাহস নিয়ে কথা বলছি। তুমি এভাবে লজ্জা পেলে আমি আরও লজ্জা পেয়ে যাব।’
নাহিদের সহজ স্বীকারোক্তিতে লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেল মিষ্টির মুখ। নাহিদ শুধাল,
‘ তোমার ফোন নাম্বারটা দিবে, প্লিজ?’
তখন শীত ছিল নাকি গরম ভুলে গিয়েছে মিষ্টি। কেবল এতটুকু মনে আছে, নাহিদের আবদার শুনে ভয় আর উত্তেজনায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছিল মিষ্টির। হৃদকম্প এতো বেড়ে গিয়েছিল! মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি খাপ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। মিষ্টি নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ আমার তো নিজস্ব কোনো ফোন নেই।’
‘ তাহলে এমন কোনো নাম্বার দাও। যেখানে ফোন করলে সহজেই তোমাকে পাওয়া যাবে?’
মিষ্টি সেদিন দিদুনের নাম্বার দিয়েছিল নাহিদকে। নাম্বার দেওয়ার পর থেকে সেকি ভয়! নাহিদ যদি হঠাৎ ফোন দিয়ে বসে? দিদুন যদি ধরে ফেলে? উফ! উত্তেজনায়, অস্থিরতায় সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারেনি মিষ্টি। নাহিদ ফোন করেছিল, দ্বিতীয়দিন দুপুরবেলায়। সে সময়টাতে দিদুন আর মিষ্টি ছাড়া বাসায় আর কেউ থাকে না। তারপরও মিষ্টি মোবাইল নিয়ে চলে গিয়েছিল ছাদে। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে নাহিদের সাথে কথা বলতে বলতে তারা দু'জনেই কৈশোর জীবনে প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করেছিল, ‘প্রেম।’ তারপর কত কিছু প্রথমবারের মতো শিখেছে মিষ্টি। পড়ার নাম করে রাত জেগে জেগে ফোনালাপ করার দুঃসাহস মিষ্টির জীবনে তখনই প্রথম। এমনও সময় গিয়েছে টানা আট থেকে নয় ঘন্টা ফোনে কথা বলেছে তারা। একবার কথা হলো, দীর্ঘ এগারো ঘন্টা! এমন রাত-দিন ফোনে কথা বলেও নাহিদ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দূর্দান্ত রেজাল্ট করল। তারপরের সময়গুলো কেটে গেল, রুলার কোস্টারের মতো করে। ভর্তি পরীক্ষার পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এতোগুলো বছরে কোনো বদল হয়নি নাহিদের। দু'জন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তারপরও মিষ্টির ক্যাম্পাসে নাহিদের মেয়ে বন্ধুর শেষ নেই। মিষ্টি ক্যাম্পাসে এলেই প্রতিদিনই কেউ না কেউ তার খোঁজ করতে আসে। কাছে গিয়ে শুধায়,
‘ তুমি মিষ্টি? নাহিদের গার্লফ্রেন্ড? কিছু মনে করো না, তোমাকে দেখতে এলাম। নাহিদ তোমাকে নিয়ে এতো গল্প করে!’
নাহিদের এই এক দোষ। যেখানে যাবে সেখানেই নারী হৃদয় গলিয়ে সেখানে আবার সিলগালা করে জানিয়ে দিয়ে আসবে, মিষ্টি নামের একটি মেয়ে আছে। মিষ্টি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর। মিষ্টিকে সে ভালোবাসে। প্রথমদিকে নাহিদের এই পাগলামোতে অতিষ্ঠ হয়ে কটমট করে একে-অপরের দিকে তাকাতো মিষ্টি আর মৌনি। চিৎকার করে বলত,
‘ একে কী করা যায় বল তো?’
শেষ পর্যন্ত আর কিছু করা হয়ে উঠে না তাদের। মৌনি যতই গর্জাক নিজের ভাইয়ের পাগলামোতে মনে মনে খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠে। গর্ব করে বলে,
‘ একেই বলে প্রেমিক বুঝলি? রক্তে রক্তে লয়্যালিটি। এমন লয়াল প্রেমিক পৃথিবী চেলে আর দুটো বের করতে পারবি?’
মিষ্টি নিজের মনে হেসে ফেলল। কী মধুর সম্পর্ক তাদের। নিষেধাজ্ঞা, রেস্ট্রিকশন, মেইল ইগো, নোংরা চাহিদা কিছুই নেই নাহিদের। এই সম্পর্কে নাহিদের দেওয়া সবথেকে চমৎকার উপহার হলো স্বয়ং মৌনি। গোটা একটা জীবনে নিঃস্বার্থ, একেবারে নিজের একটি বন্ধু ছিল না মিষ্টির। নাহিদের কাছে সে বহুবার অভিযোগ করেছে, কেন তার একদম নিজের একটা বন্ধু নেই? কেন তার সকল বন্ধুর কাছে সে এমন গুরুত্বহীন? কেন তারা মিষ্টির পিঠপিছে তারই সমালোচনা করতে বসে? নাহিদ উত্তর দেয়নি। তবে তার জীবনে এনে দিয়েছে, মৌনির মতো চমৎকার এক বন্ধুকে। ভাবতে ভাবতে মিষ্টির কান্না পায়। নাহিদ এতো দারুণ একটা ছেলে। তারপরও…উদাস হয়ে যায় মিষ্টি। একটু পরই দ্রুত পায়ে এদিকে আসতে দেখা যায় মৌনিকে। হাতে আমড়া মাখা। ব্যাগটা ধুম করে বেঞ্চির উপর রেখে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ শালার গরম!’
ফোনের ওপাশে তখনও নাহিদের কথা শোনা যাচ্ছে। মিষ্টি মৃদু কণ্ঠে বলল,
‘ মৌনি চলে এসেছে। এখন রাখছি।’
নাহিদ বলল,
‘ জীবনে একটা উপন্যাসের বই'ই আমি কিনেছিলাম। এই মৌনি টৌনি সেটা মেরে দিয়েছে। তোমার প্রাণের সখীকে বলবে অতিশীঘ্রই আমার বই ফেরত দিতে নয়তো ওর খবর আছে।’
মিষ্টি মৃদু হেসে ফোন রাখল। মৌনি সাথে সাথেই মন্তব্য করল,
‘ ওহহো! কোয়ালিটি টাইম চলছিল। এই গরমেও তোদের প্রেমের কথা আসে? আশ্চর্য!’
মিষ্টি ঘাড় ফিরিয়ে মৌনির দিকে তাকাল৷ পানপাতার মতোন ঢলঢলে মুখ মৌনির। বড় বড় পদ্মলোচন চোখ। অধিকাংশ সময়ই সাজগোজের প্রতি উদাসীন। এখনও চুলগুলো বাঁধন খুলে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপাল, কপোল আর ঘাড়ে। তারপরও তাকে দেখলে মনে হয়, দূর্দান্ত ফ্যাশন সচেতন। এই ফ্যাশনেবল ব্যাপারটা বোধহয় তাদের বংশগত। মৌনির যে কয়জন ভাই-বোনকে সে দেখেছে সকলেই এমন। নাহিদও তার ব্যতিক্রম নয়। সবসময় একটা আভিজাত্য তার শরীরময় ঝলমল করে। মিষ্টি কিছুক্ষণ মৌনির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ মৌনি? তোর কাছে প্রেম মানে কী?’
মৌনি মনোযোগ দিয়ে আমড়া মাখা খাচ্ছিল। মিষ্টির প্রশ্নে অদ্ভুত চোখে তাকাল,
‘ প্রেমের অধ্যায় পড়ছিস তুই। আর প্রশ্ন করছিস আমাকে?’
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমার জীবনে কোনো প্রেমের সীন নেই। কিন্তু আজকাল আমি খুব প্রেমে পড়ার চেষ্টা করছি। প্রেম বিষয়টা ভালো করে জানার জন্য আমার একটা প্রেমে পড়া জরুরি।’
মিষ্টি সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘ যারা তোকে প্রপোজ করেছে। তাদের মধ্যে থেকে একজনকে সিলেক্ট করে নে। তাহলেই তো হয়।’
মৌনি মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ উঁহু। ওভাবে নয়। ফোর্সফুলি, প্রেম করতেই হবে তাই করছি এমন করে নয়। আমি এমন একটা প্রেমের অপেক্ষা করছি যে প্রেম আমাকে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিবে। যে আমার সামনে দাঁড়ালে আমি পৃথিবী ভুলে যাব। আমার সমস্ত শরীর, অনুভূতিরা বিদ্রোহ করে উঠবে। তাকে মুহূর্তের জন্য কাছে না পেলে পাগল পাগল লাগবে। আমার দাদাজান ভীষণ কঠিন মানুষ। আমাদের সব ভাই-বোনদের তিনি ছেড়ে দিয়েও কোথাও একটা হাতের মুঠোয় পুরে রেখেছেন। তার যেকোনো সিদ্ধান্ত আমরা মেনে চলি সম্মোহনের মতো। আমি চাই, আমার এমন একটা প্রেম হোক যে প্রেম আমার সকল সম্মোহন ভেঙে দিক। একটা অনুভূতির বিদ্রোহ হয়ে যাক। তাকে আমি না পেলেও চলবে। তাকে না পাওয়ার বিষম কষ্টে আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যথা হোক। অসহনীয় একটা ব্যথায় আমার হৃদয় পুড়ে যাক। এমন তুমুল, তীব্র একটা প্রেম নাহলে প্রেমের প্রতি আমার আগ্রহ নেই।’
মিষ্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ পাগল! ব্যথা পেতে প্রেম কে করতে চায়?’
উত্তরে মৌনি হাসল। ফিসফিস করে বলল,
‘ প্রেমের যন্ত্রণায় যদি ছিন্নভিন্নই না হয়ে যাই তবে সেটা কী আর প্রেম হয়?’
মিষ্টি কিছু বলতে চায়। কিন্তু মৌনির স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বলার সাহস জুগাতে পারে না। বুকের ভেতরের দ্বন্দ্বরা ধীরে ধীরে পাথরের মতো কঠিন হয়ে বসে। ঝকঝকে আকাশ হঠাৎ অন্ধকার করে আসে। উলোটপালোট ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। প্রকৃতির সাথে সাথে ঝড় উঠে মিষ্টির মনেও। নিজেকে বড় অসহায় লাগে। ভণ্ড লাগে। এই দো-টানার থেকে মিষ্টির মৃত্যুই কী শ্রেয় নয়?
______________
সুদূর চট্টগ্রাম। পাহাড় আর সমুদ্রবেষ্টিত ভাটিয়ারীতে বৈশাখের তান্ডব চলছে। লাঞ্চের পরপরই শুরু হয়েছে তুমুল বর্ষণ। ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে লম্বা লম্বা পা ফেলে ডরমেটরির বারান্দা পর্যন্ত আসতেই শুরু হলো আকাশের কান্নাকাটি। তার সাথে সুতীব্র বাতাস। শাওনের হাতে এখন ঘন্টাখানেকের অবসর। এই সময়টাতে তার সঙ্গের অনেকেই আয়েশ করে ধূমপান করে। শাওনের ধূমপানের অভ্যাস নেই। সে জানালার ধারে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অভিমানিনী আকাশের এই ঝমঝমে ক্রন্দন লীলা দেখে শাওনের চোখের সামনে কেবল একটি মুখই ভেসে উঠছে। সে হলো, মন। তার ঢলঢলে পানপাতা মুখখানি। পুরন্ত ঠোঁট। শাওনের বুকের ভেতর নিষিদ্ধ সব চাহিদা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। হাত-পা ঝিমঝিম করছে। বরফ ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়ার সামনেও মাথার ভেতরে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। শাওনের এই চাহিদা নতুন। আগে কখনও মৌনিকে নিয়ে এভাবে ভাবেনি সে। মৌনি তার কাছে বড় পবিত্র। কিন্তু আজ অকস্মাৎ সেই পবিত্র মূর্তির ভাবনা তাকে অস্থির করে তুলছে। মনে হচ্ছে, এই তুমুল বর্ষণে মৌনির পানপাতার মতো ঢলঢলে মুখখানা দু'হাতের মধ্যে নিয়ে একটু যদি আদর করা যেত তার ভেজা ঠোঁটে! শাওন গায়ের ইউনিফর্ম খুলে ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। ডরমিটরি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল খোলা আকাশের নিচে। মিনিটের মধ্যে শীতল জলের ঝাপটায় ভিজে গেল তার গা। ভেতর থেকে বুঝা যায়নি, ঝড়ের সাথে শিলা কণ্যারাও আনন্দ নিয়ে নামছে আকাশ ফুঁড়ে। দুটো টুকরো শাওনের গায়ের উপর এসেও পড়ল। তৃতীয় টুকরোটা আকারে শঙ্কাজনক। শাওনের মাথার কিছুটা বোধহয় থেতলে দিল সে। তবু শাওন নির্বিকার। কই? শীলের চোটও তো ভুলিয়ে দিতে পারছে না সেই মুখ। ওইতো একইরকম জেদ নিয়ে বসে আছে মানসপটে। শাওনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় চোরাবালির মতো। ঠিক কীসের বিনিময়ে এই নিষ্ঠুর রমণীকে পেতে পারে সে? একটা! একটা শর্ত দিক কেউ। শাওন সেই শর্ত পূরণ করতে ছুটে যাবে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পরপর কতগুলো শিলার আঘাত পড়ল শরীরে জানল না শাওন। তার কেবল অভিমান হলো। বাবার প্রতি অভিমান। পৃথিবীর সকলের বাবা আছে, তার নেই। বাবা থাকলে বোধহয় জীবনটা কিছু সহজ হতো। বাবার কাছে সে কোনোদিন কোনো আবদার করেনি। যদি এবার গিয়ে বলত,
‘ বাবা? মায়ের ওই ভাগ্নীটিকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারছি না। তুমি তাকে এনে দাও। নয়তো আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। আমি মাঝে মাঝেই নিঃশ্বাস নিতে পারি না।’
তাহলে কী বাবা ছেলের দুঃখ বুঝতেন না? নিশ্চয় বুঝতেন। শাওনের চোখ ভিজে এলো। ঠিক তখনই শক্ত একটা হাত তাকে টেনে নিল ডরমিটরির ভেতর। শাওন তাকিয়ে দেখল, তার রুমমেট ইমাদ। ইমাদ অবাক বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
‘ পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? শিলাবৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ। তোমার মাথার বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে।’
শাওন প্রত্যুত্তরে একটু হাসার চেষ্টা করল। ইমাদ তাকে রুমে নিয়ে ক্ষতস্থানে স্যাভলন লাগিয়ে দিতে দিতেই শাওন হাত বাড়িয়ে ল্যাপটপটা টেনে নিল কোলের ওপর। কিছুক্ষণ পরেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠল মিষ্টি একটা মুখ। একের পর এক ছবি পাল্টাতে লাগল। ইমাদ আড়চোখে কয়েকটি ছবি দেখে নিয়ে শুধাল,
‘ হু ইজ দিস ইনক্রেডিবল বিউটি?’
শাওন বিষাদ কণ্ঠে বলল,
‘ মাই লাভ।’
ইমাদ হর্ষধ্বনি করে উঠে বলল,
‘ ও মাই গড! ইউর লেডি? হোয়াট আ বিউটি শি ইজ! ইউ ডিডন'ট টেল মি ইউ হ্যাভ আ গার্লফ্রেন্ড।’
শাওন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ শি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। ইট ইজ ওয়ান সাইডেড লাভ।’
ইমাদ সমবেদনার চোখে তাকাল। শাওন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপের স্ক্রিনে মন দিল। তার কাছে মৌনির প্রায় হাজারখানেক ছবি আছে। সবগুলোই মৌনির ল্যাপটপ থেকে চুরি করে নেওয়া। অন্যের ছবি চুরি করা অন্যায় কিন্তু শাওনের কিছু করার নেই। হঠাৎ হঠাৎ মৌনিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ার যে ভয়ংকর রোগ তার আছে। সেই রোগ সরানোর এর থেকে ভালো কোনো ঔষধ তার জানা নেই। শাওন ল্যাপটপ খোলা রেখেই মৌনির হোয়াটসঅ্যাপে ঢু মারল। ভেতরের অস্থিরতা লুকাতে না পেরে লিখে বসল,
‘ মন? কোনো একদিন যদি আমি তোমায় ভুল করে চুমু খেয়ে ফেলি। তুমি কী খুব রাগ করবে? ধরো আমাকে খুন করার পরোয়ানা তোমার হাতে তুলে দিয়ে একটা চুমু খেতে চাইলাম, তাহলে? মৃত্যুর বদলে কিনে নিলাম একটা দীর্ঘ, তপ্ত চুমু। দিবে?’
_____________
দীর্ঘ ঝড়ের পর শহরের পথে খেলা করছে বিকেলের নরম আলো। বিস্তর ক্রন্দনের পরমুহূর্তে অভিমানী কিশোরী যেমন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। কপোলে শুকিয়ে আসে অশ্রুর দাগ। ঠিক তেমনই গায়ে ঝড়ের নিশান অঙ্কন করে কেমন স্তব্ধ, নীরব হয়ে আছে শহর। মিথি নীরবে বসে থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের শহর দেখছে। আজ শাহবাগের দিকে একটা শুট ছিল তাদের। শট শেষ না হতেই শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। অপেক্ষা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পর সাফাত জানাল, আজ আর কোনো শট সে দিতে পারবে না । তার শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় ফিরবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিশাল একটা ইস্যু হয়ে যাওয়ার পর মোখলেসুর আলম আর রিস্ক নিলেন না। শুটিং প্যাকাপ করে দিয়ে মিথিকে বললেন,
‘ তুমি সাফাতের গাড়ি করে চলে যাও। যেতে যেতে সাফাতকে স্ক্রিপ্ট আর বাদবাকি কাজের ডিটেইলসটা বুঝিয়ে দিবে। তাহলে কাজটা একটু এগিয়ে থাকবে।’
মোখলেসুর আলমের আবদারে স্তম্ভিত হয়ে গেল মিথি। স্ক্রিপ্ট, কাজের শিডিউল এগুলো বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব তার এসিস্ট্যান্টের। একটু সময় নিয়ে শিডিউলগুলো একবার করে চেইক দিয়ে গেলেই হয়৷ সেখানে মিথির কী দরকার? দরকার যাই'ই হোক সাফাতের তাড়ার মুখে প্রতিবাদ করতে পারল না মিথি। মোখলেসুর আলমের আদেশ মতো সাফাতের গাড়িতে উঠে বসতে হলো। একটা মানুষ তাকে দেখলেই বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলছে তার সাথে এক গাড়িতে এতটুকু পথ যেতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইল মিথির। তারপরও ধৈর্য ধরে সাফাতকে পুরো শিডিউল, স্ক্রিপ্ট, প্ল্যান একবার করে বলে গেল সে। সাফাতের এসিস্ট্যান্টকে সব বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ অস্বস্তি নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। ঢাকার পথে রোজ রোজ কত ধরনের মানুষ চোখে পড়ে। কত সঙ্গী, কত বিচ্ছেদ। মিথি দেখল, একটা সাহসী তরুণী পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে লাফিয়ে উঠে পড়ল এক যুবকের রিকশায়। এক হাতে তার ভাঁজ করা এপ্রোন। সম্ভবত মেয়েটি ভাবি ডাক্তার। মেয়েটির আকস্মিক কাণ্ডে রিকশায় আরোহন করে থাকা ব্যক্তিটি বোধহয় চমকাল। মেয়েটি তারদিকে তাকিয়ে কী একটা বলে বড় মধুর হাসি হাসল। ভদ্রলোক জবাবে কিছু বললেন না। চোখের ভারী চশমা ঠিক করে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। ঠিক তখনই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চমকে উঠল মিথি। সাব্বিরের চেহারা সে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু এই পুরুষটিকে দেখা মাত্র তার মনে পড়ে গেল,
‘ সাব্বির!’
কিন্তু তার সাথে এই মেয়েটি কে? মিথি ঝোঁকের বসে হুট করেই গাড়ি থামাতে বলে বসল। সাফাত তার পাশে বসেই ফোন ঘাঁটছিল। মিথির অস্থিরতা দেখে ভ্রু উঁচু করে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার?’
মিথি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি নিয়ে বলল,
‘ আমার এখানে একটু কাজ আছে। আমাকে প্লিজ নামিয়ে দিন।’
সাফাত যেন খুব বিরক্ত হল। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘ এখানে আবার কীসের কাজ?’
মিথি সে কথার উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ পার্সোনাল কাজ ভাইয়া।’
এরপর প্রশ্ন করতে গেলে বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যায় বলেই আর কোনো কথা বলল না সাফাত৷ বিরক্ত মুখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলতে বলতে ততোধিক বিরক্তি নিয়ে জানাল,
‘ ফারদার আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবেন না। আমি আপনার কোনো মামাতো ভাই না। কাজের জায়গায় আমি ফরমাল হতে পছন্দ করি।’
পুরো ঘটনায় মিথি নিজের দোষ খুঁজে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে বিস্মিত হলেও প্রত্ত্যুত্তর করল না৷ তার মন এখন অন্য এক ঘোরে আছে। সেই ঘোর কাটল সাফাতের গাড়ি তাকে রাস্তার ধারে নামিয়ে দেওয়ার পর। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তার সর্বপ্রথম মনে হলো, কেন সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল? সে কী সাব্বিরের মুখোমুখি হতে চায়? জানতে চায়, কে এই নারী? যার সাথে তার এতো সুখের রিকশা ভ্রমণ? পরমুহূর্তেই মিথির মনে পড়ল, তার পরনে আজ বিচ্ছিরি পোশাক। একটা লেডিস শার্ট আর জিন্স। গলায় পেঁচানো একটা ওড়না। মাথার উপর চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। সাব্বিরের মধ্যে একটা অন্যরকম সুবাস আছে। একটা উপন্যাস উপন্যাস গন্ধ আছে। তার সামনে এসব পোশাক ঠিক মানান সই না। মিথি যেন বিশাল এক দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়েই হাত দিয়ে টেনে খুলে ফেলল চুড়ো খোঁপা। আঙুল চালিয়ে চুলগুলো গোছাতে গোছাতে আনমনেই ভাবতে লাগল,
‘সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করে, এই পোশাকে সেই রূপবতী মেয়েকে টেক্কা দেওয়া সহজ কাজ হবে না।’
পরমুহূর্তেই চমকে উঠল মিথি। এসব কী ভাবছে সে? একটা নগণ্য পুরুষের জন্য অন্য এক রূপবতীর সাথে রূপের যুদ্ধে নামবে সে? এতো অধঃপতন তার হলো কবে? বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল মিথির। নিজের এমন ন্যাকা বাঙালি মেয়ের মতো ব্যবহারে বিরক্তিতে তেতো হয়ে গেল তার জিভ। সিদ্ধান্ত নিল, একটা বাস ধরে ফিরে যাবে। এখানে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নিজেকে বাসের গরমে ঠেলে দিয়ে যথোপযুক্ত একটা শাস্তি দেওয়া দরকার। নিজের এই উথাল-পাতাল ভাবনার মাঝেই পাশে তাকিয়ে দেখল রিকশাটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আর মিনিট দুই পরই পেরিয়ে যাবে তাকে। রিকশাটাকে কাছাকাছি আসতে দেখে আবারও এলোমেলো হয়ে গেল মিথির মস্তিষ্ক। নার্ভাস হয়ে পড়ল। বুঝে পেল না ঠিক কোনদিকে তাকিয়ে থাকবে? সে যে ইচ্ছে করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝে ফেলবে না তো? অপর মন বলল, আরে ধুর! তা কী করে হবে? এই লোক তো তোকে চিনতেই পারবে না বাপ। মৌনি কী বলেছিল মনে নেই? হি ডাজেন্ট রিমেম্বার ইউর ফেইস। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবার ভাবে, এই ছেলেটি কী সত্যিই সাব্বির? তারও তো সাব্বিরের চেহারা মনে ছিল না। কোনো ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? সাব্বিরকে দেখে মনে হয়নি সে কোনো রমণীর সাথে রিকশা ভ্রমণে বেরুতে পারে। মিথি দ্বিধান্বিত হয়ে আনমনেই ঘাড় ফিরিয়ে রিকশাটির দিকে তাকাল। সৃষ্টিকর্তার চমৎকার পরিকল্পনা বলেই হয়তো সেই মুহূর্তেই চোখে চোখ পড়ে গেল দু'জনার। কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। সাব্বিরের তাকে মনে নেই। তারপরও মিথির চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু নড়ে উঠল তার ঠোঁট। অবাক, বিস্ময়ে বলে উঠল,
‘ মিথি!’
সাব্বিরের ওই ঠোঁট নাড়ানো ছোট্ট শব্দটা ঠিক পড়ে ফেলতে পারল মিথি এবং ভয়ংকর চমকাল। মিথির চোখের চমক আর মুখের প্রতিক্রিয়ায় ওপাশের মানুষটিও পড়ে ফেলল তার উত্তর। খুব নীরবে দু'জনের কাছে দু'জনের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর কী করা যেতে পারে কেউই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। এই কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা প্রথমে কাটিয়ে উঠল সাব্বির। রিকশাটি মিথিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিল সে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রিকশায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি চলে যাও। আমার একটু কাজ আছে।’
মেয়েটা বড় নাছোড়বান্দা। শুধাল,
‘ এখানে কী কাজ?’
সাব্বির উত্তর না দিয়ে রিকশাওয়ালাকে চলে যেতে ইশারা করল। তারপর…? তারপর গোধূলি বেলার কনে দেখা আলোতে দু'জন অপরিচিত অথচ চির পরিচিত মানুষ প্রশস্ত রাস্তার দুই ধারে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল একে অপরের দিকে তাকিয়ে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি এই শুভদৃষ্টিতে মৃদু হাসলেন। একটা শীতল হাওয়া কোথা থেকে উড়ে এসে উড়িয়ে দিল মিথির খোলে রাখা চুল। গোধূলির আলোয় কী করে যেন ছড়িয়ে গেল এক চিমটি আদর। আলোরা হয়ে গেলো আরও নরম। গাড়ির হর্ণগুলো মিলিয়ে গেল শূন্যে। চিরন্তন হয়ে রইল শুধু দুই জোড়া দৃষ্টি।

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

১৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন