উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


১৪ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ১৫)


‘ও পারেতে বৃষ্টি এলো ঝাপসা গাছপালা
পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক-জ্বালা
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান-
বৃষ্টি এলো টাপুর-টুপুর নদে এলো বান।’
সাব্বিরের কলাবাগানের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতেই মিথির মাথায় উদয় হলো ছেলেবেলার কবিতা। সারাদিনের ঝুম বৃষ্টিতে সত্য সত্যই ঝাপসা হয়ে এসেছে গাছপালা। পুরোনো দু'তলা বাড়ির বিশাল লনে স্বচ্ছ পানি জমেছে। সেই পানিতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাসছে কচি ঘাসের ডগা। সাব্বির ব্যস্ত হাতে বাড়ির পুরোনো গেটটা খুলেই অপরাধী কণ্ঠে বলল,
‘ একটু বৃষ্টি হলেই বাড়ির সামনে পানি জমে বিচ্ছিরি একটা অবস্থা হয়। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
মিথির অবশ্য 'বিচ্ছিরি অবস্থা' ধরনের কিছু মনে হলো না। এমন স্বচ্ছ জলে খালি পায়ে হাঁটতে ভালো লাগবে। মিথি চট করে জুতো খুলে ফেলল। ছেলেবেলায় তাদের ময়মনসিংহের বাড়ির উঠোনে জল জমলেই বাচ্চারা হৈ-হৈ করে নেমে যেত সেই পানিতে। লম্ফঝম্পের সাথে সাথে শুরু হতো পিচ্ছিল পিচ্ছিল খেলা। মিথি তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখত। কখনও বৃষ্টিতে ভিজত না। খেলতও না। কেউ তাকে বিশেষ ডাকাডাকিও করত না। ভাই-বোনদের সাথে ছেলেবেলাতেই কীভাবে যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সবার সাথে স্বতঃস্ফূর্ত মেলামেশা মিথির সম্ভব হয়নি। মিথির মনে হলো, প্রকৃতি তাকে তার শৈশব ফিরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছে করছে, এই ঘাস-ভাসা স্বচ্ছ জলে বাচ্চাদের মতো লাফাতে। এই ইচ্ছে তার আগে কখনও হয়নি। আজ কেন হচ্ছে, কে জানে? মিথি জুতো হাতে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে একবার চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাল। দু'তলার বারান্দায় রূপবতী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে খুব মিষ্টি দেখতে একটা শিশু। সে খুব আগ্রহ নিয়ে মিথির দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত কিছুটা বিস্মিয়ও খেলা করছে তার চোখে। মিথি-সাব্বির ভেজা গায়ে এক তলার বারান্দায় উঠে আসতেই সেই মশলা গন্ধী মহিলার সাথে দেখা হয়ে গেল। মিথিকে দেখে সে বিস্ময়ের সাথে সাথে আনন্দিতও হলো। চিৎকার করে বলল,
‘ স্যার? এই আপাই তো আসছিল হেইদিন। আপনারে বলছিলাম না, পরির মতোন সুন্দর। এই তো সেই পরি আপা!’
সাব্বির আড়চোখে একবার মিথির দিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ হুম, বুঝতে পেরেছি।’
মশলাগন্ধী আগ্রহ নিয়ে শুধাল,
‘ স্যার, আপা আপনের কী লাগে? বন্ধু মানুষ?’
সাব্বির ‘হ্যাঁ’ বলে অভ্যাসবশত অল্প কথায় কথা সারতে গিয়েও থমকাল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না। এই ঝড়-বৃষ্টি সম্ভবত সারারাত চলবে। এমন হলে সমস্যা। মিথি বাড়ি ফিরতে পারবে না। সাব্বিরের কোনো মেয়েবন্ধু রাতে তার সাথে থাকছে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। সাব্বির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ না।’
মশলাগন্ধী অবাক হয়ে বলল,
‘ তাইলে?’
সাব্বির ঘরের তালা খুলতে খুলতে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আপনার এই আপার সাথে মাসখানেক আগে আমার বিয়ে হয়েছে বুয়া। ইনি আমার স্ত্রী।’
মশলাগন্ধী বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় চিৎকার করে বলল,
‘ স্যার আপনে বিয়া করছেন? আমারে তো কন নাই স্যার। নতুন বউয়ের আদর আপ্যায়নের দরকার আছে। আপনার ঘরে তো মানুষ নাই। আপা হেইদিন আইল। আমি আগে জানলে কী আপ্যায়ন করতাম না? আমি তো ভাবছিলাম, কোন না কোন ছেমড়ি। তবে স্যার, বউ কিন্তু মা-শা-আল্লাহ। আপনে ইস্টপ মানুষ হইলেও পছন্দ ভালা।’
সাব্বির দরজা খুলে মিথিকে ভেতরে যেতে বলে বুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ থেংকিউ বুয়া। আপনি কী চট করে দু'কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবেন? তুলশী পাতা দিয়ে চা বানাবেন। আপনার আপা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছেন। ওনার চা খাওয়া দরকার। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’
মিথি ভেতর থেকে বলল,
‘ চা আমিই বানাব। আপনি ভেতরে আসুন তো।’
সাব্বির ভেতরে ঢুকল। বুয়াও অতি আনন্দে পেছন পেছন গেল। মিথি কিছু বলতে গিয়েও বুয়ার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। সাব্বির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
‘ বুয়া, আপনি একটু রান্নাঘরে যান। চুলায় চায়ের পানি বসান। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।’
সাব্বিরের মতো গাছ প্রজাতির মানুষ বউয়ের সাথে ঠিক কী রকম কথাবার্তা বলে তা শোনার প্রবল আকাঙ্খাতেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল বুয়া। সাব্বিরের হুকুমে অতি অনাগ্রহে রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে হলো। মিথি বলল,
‘ চায়ের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো পোশাক। আমার পোশাক বদলানো দরকার। আপনার বাসায় নিশ্চয় মেয়েলি পোশাক নেই?’
সাব্বিরের এতোক্ষণে আজকের সবথেকে বড় সমস্যার কথা মনে পড়ল। ঘরে মেয়েলি কোনো পোশাক নেই অথচ মিথির জামা বদলানো দরকার। সাব্বির চিন্তিত মুখে মিথির দিকে তাকাতেই দেখল, মিথি ইতোমধ্যে ভেজা স্কার্ফটা খুলে ফেলেছে। স্বচ্ছ, ভেজা শার্ট পরিহিতা মিথির দিকে দুই সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকা অসম্ভব। সাব্বির চোখ সরিয়ে নিল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আপনি কিছুক্ষণের জন্য আমার কোনো টি-শার্ট ব্যবহার করতে পারেন। আমি আপনার জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করছি।’
মিথি তার কাঁধ ছাপিয়ে কিছুদূর নেমে যাওয়া চুলগুলো একপাশে নিয়ে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে শুধাল,
‘ আপনি অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছেন কেন?’
সাব্বির সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
‘ এই মুহূর্তে আপনি কী ধরনের পোশাক পরতে পছন্দ করবেন?’
মিথি বলল,
‘ কেন? আলাদিনের চেরাগের দৈত্যটির মতো যা চাইব তাই এনে দিবেন?’
সাব্বির এবার মিথির দিকে তাকাল। মিথির উচ্চতা বেশ ভালো। ছিপছিপে পাতলা দেহ অনায়াসে সাব্বিরের কাঁধ পর্যন্ত উঠে এসেছে। মিথির ঈষৎ বাদামি চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে সাব্বির দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ চেষ্টা করব।’
সেই কণ্ঠে কী ছিল কে জানে! মিথি চোখ ফেরাতে পারল না। শ্যামকান্ত সাধারণ একটা মুখ সাব্বিরের। বৃষ্টিতে ভিজে বড় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। দারুণ উচ্চতা আর আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠবের জন্য পাত্রের বাজারে সে বেশ ভালো রকম দর পাবে। কিন্তু তাকে অতি সুদর্শন বলা যায় না। প্রথম দেখায় থমকে যাওয়ার মতো রূপ তার নয়। তারপরও মিথির মনে হলো, এমন রূপবান পুরুষ সে অনেক বছর দেখেনি। এই বিশেষত্বহীন পুরুষের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তাকে চুম্বকের মতো টানছে। মিথি যন্ত্রের মতো বলল,
‘ শাড়ি।’
সাব্বির মৃদু মাথা নাড়ল। আলমারি থেকে নিজের একটা টি-শার্ট আর টাউজার বের করে মিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আপাতত এটা পরে নিন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসব।’
তারপর কী মনে করে বলল,
‘ পোশাক না পাল্টে ঘর থেকে বেরুবেন না। বুয়ার সামনেও যাবেন না, প্লিজ।’
মিথি প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে। এখন টিপটিপ ঝরছে। সাব্বির সেই টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে গেল। বুয়া ছুটে এসে শুধাল,
‘ স্যার এই বিষ্টির মইধ্যে কই গেল আপা?’
মিথি তখন সাব্বিরের টি-শার্ট টাউজারটা বিছানায় রেখে একটা তোয়ালের তালাশ করছে। বুয়া কথা বলতে বলতেই মিথিকে দেখে থমকাল। নিজে নারী হয়েও আশ্চর্য এক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল মিথির সর্বাঙ্গে। সৃষ্টিকর্তা যেন মেপে মেপে তৈরি করেছে তার প্রতিটি বাঁক। মসৃণ উদর। সুগভীর নাভিকোমল। স্বচ্ছ জামা ভেদ করে চোখে পড়ছে তার অন্তরীয়। সেদিকে তাকালে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বুঝি এইখানেই পুরে দিয়েছেন পৃথিবীর তাবৎ রহস্য। বুয়া অতো সাহিত্যিক কথা জানে না। সাব্বির জানে। সে জানে বলেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বুয়া চোখ ফেরাল না। অবাক বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আপা আপনে মানুষ না পরি?’
নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে অসতর্ক মিথি সাব্বিরের দৃষ্টি লক্ষ্য করেনি। বুয়ার বিস্ময়ও বুঝল না। সে ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
‘ কেন?’
‘ কী সুন্দর আপনে! এমন সুন্দর মাইয়া মানুষ আমি আগে কোনোদিন দেখি নাই। স্যারে আপনেরে পাইল কই?’
মিথি উত্তর দিল না। বুয়া নিজে থেকেই বলল,
‘ পুরুষ মানুষের অবস্থা দেখছেন আপা? সারাডা জনম স্যাররে দেখলাম বইয়ের মইধ্যে ডুইবা থাকতে। প্রথম যহন কাম করতে আইলাম, তখন হইল কী? এক মাস কাম করার পর একদিন স্যারের লগে দেহা হইল রাস্তায়। আমার ইমার্জেন্সি গেরামে যাওন দরকার। ছুটি চাওনের সময় নাই। স্যাররে রাস্তার মইধ্যেই ডাকলাম, ছুটি চামু। আমি ডাকতেই স্যার চশমা চোখে অবাক হইয়া আমার দিকে চাইয়া রইল। আমারে চিনতে পারে নাই। চিন্তা কইরা দেহেন, এক মাস ধইরা কামে আছি স্যারে আমার মুখ ভালা কইরা দেহে নাই। সেই স্যারে কিনা বই থাইকা মুখ তুইল্যাই ধইরা ফেলাইছি একেবারে পরি। সাধে কী আর কয় মুনীদের ধ্যান ভাঙে অপ্সরার রূপে। নইলে, ওই উকিল সাহেবের শাল্যিকাও তো কম চেষ্টা করল না। আমাদের স্যার কঠিন মানুষ; গলাইতে পারে নাই।’
মিথির কান খাড়া হলো এবার। কপাল কুঁচকে তাকাল। বলল,
‘ উকিল সাহেবের শাল্যিকা?’
বুয়া গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘ হ। উকিল সাহেবের ইস্তিরির ছোড বোন, বৃষ্টি আপা। ইনিভারসিটিতে পরিক্ষা দেওনের সময় উকিল সাহেবের কথায় স্যার তারে পড়াইছে মাস খানেক। তবে পড়াইছে উপর তলায় যাইয়া৷ স্যার পরিষ্কার মানুষ, কোনো সাতেপাঁচে নাই। স্পষ্ট বলে দেছেন, তার ঘরে বাহিরের মানুষ আসার অনুমতি নাই। বৃষ্টি আপা যে স্যাররে মনে মনে চায় হেই কতা কী আর আমি বুঝি না ভাবছেন? কমলার মা কঠিন জিনিস। তার চোখ ফাঁকি দেওনের সিস্টেম নাই।’
মিথির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। বুয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আরও উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ একটা গোপন কথা কই আপা, উকিলের বউ তো স্যারের সঙ্গে তার বোনের বিয়া দেওনের জন্য প্রস্তাবও দিব ভাবছিল। তার মধ্যে স্যার কী কামডা করল দেহেন? আপনেরে বিয়া কইরালাইছে।’
তথ্যটা দিয়ে খিকখিক করে হাসল বুয়া। মিথি থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ এই বিয়ের বিষয়ে আপনার স্যারের উৎসাহ কেমন?’
বুয়া বলল,
‘ আল্লার কিরা আপা৷ স্যারের কোনো উৎসাহ নাই। উকিলের বউয়ের কুটিল চিন্তা তো স্যারের মতোন সহজ-সরল মানুষের বুঝার কতা না। আমাদের স্যার হইল, টলটলে পানির নাহাল। আর আপনের সামনে ওই মাইয়ার খাওয়া আছেনি? আপনে পরি, ওই মাইয়া কালি পেত্নী।’
আজকে বিকালে দেখা মেয়েটির ছবি স্মরণে এনে তাকে ঠিক কালি পেত্নী মনে হলো না মিথির। বেশ মিষ্টি চেহারা। চোখে-মুখে ঢেউ খেলছে নব যৌবনের লাবণ্য। সে হিসেবে নিজেকে তেমন একটা সুন্দরী মনে হয়নি মিথির। এমন অসুস্থ, টিপিক্যাল চিন্তায় মনে মনে বিরক্ত হলো মিথি। সাব্বির ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে দেখল মিথি তার টি-শার্ট আর টাউজার পরে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে আছে। চোখ-মুখ থমথমে। যেন একটু খোঁচালেই টর্নেডো বয়ে যাবে। সাব্বির হঠাৎ তার এই মেজাজ পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারল না। তবে খুবই অসহায়বোধ করল। মিথিকে শাড়ির প্যাকেটটা দিতেই মিথি শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ এই শাড়ি আমি কী করে পরব? ব্লাউজ পেটিকোট ছাড়া শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা তো আমার নেই।’
সাব্বির যেন ঘোর বিপদে পড়ল। শাড়ির সাথে যে ব্লাউজ পেটিকোট প্রয়োজন হয় সে তথ্য তার মাথাতেই ছিল না। অথচ মিথির সাথে যখন প্রথম দেখা হয় তখন মিথির গায়ে ছিল ব্লাউজ আর পেটিকোট। সাব্বিরই বোধহয় প্রথম পুরুষ যার বউয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতে নববধূ পরেছিল খুবই অশ্লীল দুটো পোশাক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মিথিকে সেই পোশাকে একদমই অশ্লীল দেখাচ্ছিল না। মিথির সাথে অশ্লীল ব্যাপারটা যায় না। সে যা করে সবই সুশীল। সাব্বির ব্লাউজ পেটিকোটের সমাধানে কী বলবে বুঝতে পারল না। শাড়ি না এনে ব্লাউজ পেটিকোট আনলে সুবিধা হতো। মিথি এমনিতেও রাতে শাড়ি পরে ঘুমাতে পারে না। বুয়া বলল,
‘ স্যার, উকিলের বউয়ের থাইকা আইন্যা দিতাম ছায়া বেলাউজ? উকিলের বউয়ের যে থলথলা শরীর! আপার একটু ঢোলা হইলেও পিন্দন যাইব।’
সাব্বির অস্থিরবোধ করল। বুয়ার সামনে ব্লাউজ পেটিকোট নিয়ে কথা বলতে তার ভয়ংকর লজ্জা লাগছে। মিথি থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ কেন? বৃষ্টির থেকে আনা যায় না? সেও বোধহয় শাড়ি পরে।’
বুয়া তৎক্ষনাৎ বলল,
‘ ওই ছেড়ির বেলাউজ আপনার হইব না আপা। তার হইল ফেছকুল্লার ছাউয়ের মতো সাইজ। আপনে লম্বা, চওড়া মানুষ।’
সাব্বির প্রচন্ড বিব্রত হলো। তার সামনে দু'জন প্রাপ্ত বয়স্ক রমণী আলোচনা করছে অন্য এক রমণীর শারীরিক গঠন নিয়ে। চিন্তা করা যায়! সাব্বির বুয়ার দিকে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ বুয়া আপনি রান্নাঘরে যান। কাজ শেষ করুন। কারো থেকে কিছু আনতে যেতে হবে না আপনাকে। যান।’
বুয়া চলে যেতেই সাব্বির মিথির দিকে তাকাল। মিথির মুখ তখনও থমথমে। তার আর বুঝতে বাকি রইল না এই ঝড়ো হাওয়ার কারণ। একটু বোধহয় অসহায়ও বোধ করল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ বুয়ার অযথা কথা বলার রোগ আছে। তার কথা নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করবেন না। আমি ব্লাউজ-পেটিকোটের ব্যবস্থা করছি। যদিও এইসব কোন দোকানে পাওয়া যায় সে বিষয়ে আমার কোনো আইডিয়া নেই। তবুও আমি দেখছি।’
মিথি কোনো উত্তর দিল না। সাব্বির উঠে যেতে নিতেই থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ আমার মাপ জানেন? মাপ না জেনে ব্লাউজ কিনবেন কী করে?’
সাব্বিরের কান আবারও ঝাঁঝাঁ করে উঠল। কোনোরকমে বলল,
‘ মাপ বলুন।’
মিথি থমথমে মুখে বলল,
‘ আমিও জানি না। বাসায় মেজারমেন্ট টেপ আছে না? নিয়ে আসুন। মেপে দেখুন।’
মুহূর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গেল সাব্বিরের মুখ। গলায় খাবার আটকে যাওয়ার মতো কেশে উঠল। বুয়া নবদম্পত্তির কথোপকথন শোনার জন্য অনেকক্ষণ যাবৎ উঁকিঝু্ঁকি দিচ্ছিল। সাব্বিরের কাশি শুনে ছুটে এলো। আগ্রহ নিয়ে শুধাল,
‘ কী হইছে স্যার?’
সাব্বিরের ইচ্ছে হলো একটা ধমক দিতে। রাগ সংবরণ করে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ কিছু হয়নি। আপনাকে না ডাকলে এদিকে আসবেন না বুয়া। আপনি রান্নাঘরে যান।’
বুয়া তীব্র অনাগ্রহ নিয়ে সরে গেল। মিথি সাব্বিরের এই বিপন্ন মুখ দেখে আর ঘাটাল না। থমথমে মুখে নিজের মাপ বলে দিল। ভেবেছিল, সাব্বির শাড়ি নিয়ে ফিরে এলে তাকে জানাবে তার কাছে এক্সট্রা পোশাক আছে। ব্যস্ত হবার দরকার নেই। মিথি বেশিরভাগ সময়ই নিজের সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখে। কিন্তু বুয়ার মুখে বৃষ্টির গুণকীর্তন শুনে আর বলতে ইচ্ছে হলো না। যদিও এই ধরনের ছেলেমানুষি বড় হাস্যকর। তারপরও মিথি প্রচণ্ড অভিমানে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল। মনে হলো, এই লোকের একটা শাস্তি হওয়া দরকার। সাব্বির স্ত্রীর শাস্তি মাথা পেতে নিল। মাপ জেনে ভেজা পোশাকে আবারও স্ত্রীর সমস্যা সমাধানে ছুটল। জানালা দিয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দ্রবীভূত হয়ে এলো মিথির মন। মনে হলো, লোকটা বড় সরল! এই সরল লোকটির জন্য অন্যরকম এক মায়ায় ভরে গেল মিথির হৃদয়। সিদ্ধান্ত নিল সাব্বির ফেরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। এই জীবনে সে কারো জন্য অপেক্ষা করেনি। অপেক্ষা করার মতো কেউ ছিলও না তার জীবনে। আজ প্রথম কাউকে পাওয়া গেল। যে লোকটি তাকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য অকারণ ছুটছে। তার জন্য বোধহয় অপেক্ষা করা যায়৷ মিথি বারান্দার গ্রিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার ধারে লনের ঘাস-ঝোপের মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটা মাধবীলতা গাছ। তার কিছু লতানো ডাল এসে পড়েছে সাব্বিরের বারান্দার কাছে। মিথি অপেক্ষা করতে করতে এক গোছা ফুল ছিঁড়ে চুলে গুঁজল। এই ফুল গুঁজার ইতিহাসটাও তার জীবনে ঘটল প্রথমবার। একজন নারী হয়েও কখনও দুটো ফুল ছিঁড়ে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছে হয়নি ভেবে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল মিথি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। মিথি দেখল, এই প্রবল বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেটের ভেতরে ঢুকছে সাব্বির। বোকা লোকটা যাওয়ার সময় ছাতা নিতে ভুলে গিয়েছে। মিথির বোকা মানুষ পছন্দ না। তবুও এই লোকটিকে মিথির মন কী তীব্রভাবেই না ভালোবেসে ফেলল যখন দেখল তার হাতে এক গুচ্ছ কদম। সাব্বিরের সাথে সাথে কদমগুলোও আনন্দ নিয়ে ভিজছে। সাব্বিরের চুল বেয়ে টপাটপ জল গড়াচ্ছে। জল গড়াচ্ছে কদমের রেণু বেয়েও। সাব্বির আনমনে হেঁটে আসতে আসতে বারান্দার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। দরজার দিকে না গিয়ে একটু সরে বারন্দার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির জলে আবারও ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তার চশমা। সেই ঝপসা চশমা চোখেই চমৎকার হাসল সে। মিথিকে শুধাল,
‘ এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে?’
মিথি নিঃসংকোচে বলল,
‘ আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
সাব্বির হাসল। মিথি বলল,
‘ আমার কাছে এক্সট্রা পোশাক ছিল। আপনাকে অযথা হয়রানি করালাম। কিন্তু সেজন্য আমি একটুও দুঃখিত নই।’
সাব্বির সে কথার বিপরীতে হাতের কদম ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ একটা বাচ্চা মেয়ে বিক্রি করছিল। এগুলো আপনার জন্য।’
মিথি মৃদু হেসে কদমগুলো নিলো। সাব্বির দেখল, কানে মাধবীলতা গুঁজে মাধবীলতার থেকেও রূপবতী একটি মেয়ে সামান্য কদমফুলের দিকে কী মুগ্ধ হয়েই না তাকিয়ে আছে! আর তার দিকে তাকিয়ে আছে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সেই সাথে তাকিয়ে আছে খুব সাধারণ এক পুরুষ। সেই পুরুষের চোখ থেকে মুগ্ধতারা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে।
____________
ঢাকা শহরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মঈনুল রিকশা থেকে নেমে খুব বিপদে পড়ে গেল। রিকশাওশালা ভীষণ ত্যাঁদড়। কিছুতেই সে আর এক ইঞ্চিও এগোবে না। মৌনির বাসার সামনে অগাধ জল। মঈনুলকে যেতে হবে এই নোংরা জল পেরিয়ে। মঈনুল চাইলেই গাড়ি নিয়ে চলে আসতে পারত। কিন্তু মেয়ের সাথে দেখা করতে এলে তিনি যথাসম্ভব গাড়ি এড়িয়ে চলেন। তার মেয়ে নিজে রোজগার করে একটা কঠিন জীবন যাপন করছে। সেখানে তার এই বিলাসিতা মঈনুলের বুক পোড়ায়। মঈনুল এই নোংরা জল পেরিয়েই ভেতরে ঢুকল। আকাশে ধূসর রঙ ধরেছে। বৃষ্টির জন্য সেই রঙ দেখাচ্ছে আরও গাঢ়। সন্ধ্যা না বিকেল ঘড়ি না দেখলে বুঝার উপায় নেই। মৌনি থাকে ছয় তলার একটা অ্যাপার্টমেন্টে। তার সাথে আরও দুটো মেয়ে আর একটা দম্পতি থাকে। মঈনুলের এখানে আসতে খুবই অস্বস্তি লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। এক মাসের বেশি মেয়েকে দেখা ছাড়া থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। মঈনুল যুবক বয়সে দুর্ধর্ষ আর্মি অফিসার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হিসেবে। এখন দাপিয়ে ব্যবসা করছেন। শরীর এবং মনের উপর তার অস্বাভাবিক সংযম আছে। শুধু একমাত্র মেয়ের ব্যাপারে তাকে বড় ক্লান্ত লাগে। প্রতিবার দেশের বাইরে কোনো কাজে গেলে ফিরেই আগে মেয়ের কাছে ছুটে আসেন। এই মেয়ে তার বড় আরাধ্য। মৌনি এই অসময়ে বাবাকে দেখে খুব চমকে যাওয়ার চেষ্টা করল। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব আহ্লাদ নিয়ে বলল,
‘ বাবা! বাবা! বাবা! তুমি কেমন আছ বাবা?’
আর্মি অফিসারের দৃঢ় সংযম ভেঙে মঈনুলের চোখে জল এলো। তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা একটু ভিন্ন রকম। এদের ছোট থেকে এমন করে তৈরি করা হয় যে আহ্লাদ ব্যাপারটা থেকে তারা মুক্ত। বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তার গাঢ় প্রকাশ নেই। সেখানে মৌনি আলাদা। তার ভেতরকার আহ্লাদ সে একটুও হারিয়ে যেতে দেয়নি। বাড়িতে গেলে সকলের সামনে সে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও লজ্জা পায় না। তারপর নিরন্তর বলে চলে,
‘ বাবা! বাবা! বাবা! কতদিন তোমাকে দেখি না বাবা।’
মঈনুলের হৃদয় তখন আবেগ আর গর্বে ভরে উঠে। ইচ্ছে করে মেয়ের কপালে গাঢ় করে চুমু খেতে কিন্তু লজ্জায় পারেন না। মঈনুল মেয়ের অগোচরে তার চুলের ভাঁজে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বললেন,
‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছ, মা?’
মৌনি হাসল। আজকে মিষ্টির মৌনির সাথে থেকে যাবার কথা ছিল। কিন্তু মৌনির বাবাকে দেখে খুশি মনে বিদায় নিল। এই বাবা-মেয়ের একান্তে সময় কাটানো জরুরি। বাবাকে পেয়েই মৌনি আবদার করল,
‘ বাবা আজ কী রান্না করে খাওয়াবে বলো।’
মঈনুল হেসে ফেললেন। মৌনির কাছে এলেই তিনি খুব আয়োজন করে রান্না করতে বসেন। তিনি যে দারুণ রান্না করেন সেটা মৌনি ছাড়া কেউ জানে না। এমন অনেক গোপন কথাই মৌনি জানে। মঈনুলের গাম্ভীর্য কেবল মেয়ের কাছে এসেই খসে খসে পড়ে। মঈনুল বললেন,
‘ এখন তোর উচিত আমাকে রান্না করে খাওয়ানো। বাবা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি না?’
মৌনি বলল,
‘ বুড়ো হচ্ছ আর তুমি? কী যে বলো বাবা! ইউ আর দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম ম্যান আই হ্যাভ এভার সীন। তুমি কীভাবে এমন মেইনটেইন করো বলো তো? কেউ দেখলে বলতেই পারবে না তুমি অলমোস্ট সিক্সটি। তোমার এতো বড় একটা মেয়ে আছে। সম্ভব হলে আমি ঠিক তোমার মতো একটা ছেলেকে বর হিসেবে চাইতাম। মেয়েরা যে নিজের জীবন সঙ্গীর ভেতর বাবার ছায়া দেখতে চায় তা কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণিত।’
মঈনুল হাসলেন। বললেন,
‘ তুই ডিফেন্সের কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে চাস? চাইলে বল। আমার পরিচিত অনেক ইয়াং এন্ড হ্যান্ডসাম অফিসার আছে। যারা চোখ বন্ধ করে আমার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে।’
মৌনি মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ এইতো একটা অপমানজনক কথা বলে ফেললে বাবা। তোমার মেয়ে বলে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে ফেলবে নয়তো করবে না ব্যাপারটা আমার জন্য অপমানজনক। আমি জীবনে কোনো ক্ষেত্রেই বাবার ক্ষমতার প্রয়োগ করিনি। বাবার পয়সা খরচ করিনি। আমার নিজের যোগ্যতা আছে। আমাকে কেন কেউ চোখ বন্ধ করে বিয়ে করবে? যে ছেলে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড না দেখে কেবল আমাকে দেখে বিয়ে করতে চাইবে আমি তাকে বিয়ে করব। আমার বাবাকে দেখে বিয়ে করলে তো হবে না। সংসার সে আমার সাথে করবে। আমার বাবার সাথে না।’
মঈনুল মুখ কালো করে বললেন,
‘ সরি। তুই বোধহয় রেগে যাচ্ছিস।’
মৌনি শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ না বাবা। রেগে যাচ্ছি না। উল্টো তুমি মন খারাপ করছ। প্লিজ আমার কথায় মন খারাপ করো না। মনের কথা বলে ফেলতে না পারলে আমার পেট ব্যথা হয়। তোমাকে কথাগুলো বলতে না পারলে ব্যাপারটা মনে থেকে যেত। মন খারাপ হত। নিজেকে কষ্ট দিতে আমি খুবই অপছন্দ করি।’
মঈনুল কিছু বললেন না। মৌনি বলল,
‘ কেন অপছন্দ করি জিজ্ঞেস করো বাবা?’
মঈনুল বেতের চেয়ারে আরাম করে বসে শুধালেন,
‘ কেন অপছন্দ করিস?’
‘ কারণ ভবিষ্যতে আমি খুব বড় কোনো দুঃখ পেতে চলেছি বাবা। প্রকৃতি কাউকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুখী করে পৃথিবীতে পাঠায় না। মানুষ হয়ে জন্মালে তার দুঃখ থাকবেই। আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি অসম্ভব রূপবতী। তুমি বোধহয় জানো না, রূপ ছাড়াও আমার গানের গলা চমৎকার। আমি কখনও গান গাই না। কিন্তু চাইলেই দারুণ গান গেয়ে যে কাউকে চমকে দিতে পারি। দারুণ ছবি আঁকতে পারি৷ আমার কবিতা আবৃত্তি শুনে বিস্মিত হতে হয়। আমার মাত্র একটা উপন্যাস আর দুটো ছোটগল্প বেরিয়েছে পত্রিকায় তাতেই সাহিত্যপাড়ায় একটা হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। তারমানে আমি ভালো লিখি। আমার রান্নার হাতও চমৎকার। পৃথিবীর যেকোনো বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মতো জ্ঞান আমার আছে। অর্থাৎ আমি বুদ্ধিমতী। সবথেকে মজার ব্যাপার কী জানো? আমি দারুণ সুন্দর করে কথা বলতে পারি। আমি কথা বললে শ্রোতাকে মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। এখন তুমি যেমন শুনছ। কেবল কথা বলেই যে কাউকে মুগ্ধ করে ফেলার ক্ষমতা আমার আছে। এইযে আমার এতো গুণ? তার মধ্যে বেশির ভাগই আমি লুকিয়ে রাখি। কারণ আমি সাধারণ হয়ে থাকতে চাই। আমি চাই আমার জীবনটা সাধারণভাবে কেটে যাক। কিন্তু আমি জানি, তা হবে না। প্রকৃতি শোধে আসলে সব ফিরিয়ে নেবে। একদিন আমার প্রচণ্ড দুঃখের দিন আসবে। দুঃখের বোঝায় রাতের পর রাত আমার ঘুম হবে না। তাই এখন আমি সময় পেলেই ঘুমিয়ে নেই বাবা। একদিন আমি খুব কষ্ট পাব বলেই এখন নিজেকে আগলে রাখি। আদর করি।’
মঈনুল থমথমে মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন,
‘ এসব স্রেফ তোমার কল্পনা। আমি বেঁচে থাকতে এই পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই তোমাকে কষ্ট দেওয়ার। যদি আমি মারাও যাই তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। তুমি যেন সারাজীবন সুখে কাটাতে পারো তার সকল ব্যবস্থা আমি আর তোমার মা করে যাব।’
মৌনি হেসে ফেলল,
‘ তুমি আমার জীবনের আরেকটা প্লাস পয়েন্ট বাবা৷ তোমার প্রচুর ক্ষমতা আমি জানি। তারপরও আমার কষ্ট আটকানো যাবে না। টাকা-পয়সা ক্ষমতা দিয়ে এই কষ্ট আটকানো কঠিন। আমি ভীষণ নরম মনের মানুষ। আমার কষ্ট হবে তীব্র মানসিক কষ্ট। খুব সম্ভবত আমার কষ্টটা শুরু হবে দাদাজানের মধ্য দিয়ে। তুমি বললে না, আমি ডিফেন্সের ছেলে পছন্দ করি কিনা? সেই সুযোগ আসলে আমাকে দেওয়া হবে না। আমাকে এমন একজনকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে যে কখনও আমাকে ভালোবাসবে না। আমাকে অসংখ্য মানুষ ভালোবাসে। কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা, যার কেবল আমাকে ভালোবাসার কথা সে ভালোবাসবে অন্য কাউকে। প্রিন্সেস ডায়নার মতো আমাকে বলতে হবে,
‘ আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে ছাড়া পুরো পৃথিবী আমাকে ভালোবেসেছিল।’
কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল মৌনি। মঈনুল মেয়ের দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার একমাত্র মেয়ের সাথে এমন কিছু হলে তিনি বাবাকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবেন না। অথচ বাবার সাথে তার রাগ করারই অধিকার নেই। ক্ষমা তো বহু দূরের সংলাপ। মঈনুল বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমার দাদাজান কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নেন না মৌনি। কখনও না।’
মৌনি প্রত্যুত্তরে হাসল। তাদের জীবনটা বড় আনপ্রেডিক্টেবল। এই কাহিনি রচনার কলম কী সত্যিই দাদাজানের হাতে? নাকি এক মহান লেখক দাদাজানকে দিয়ে স্রেফ লিখিয়ে নিচ্ছেন? কী লিখবেন দাদাজান এর পরের পৃষ্ঠায়? মন ভালো? নাকি মন খারাপ?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

১৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন