উপন্যাস : আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা : নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা |
১৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ১৬)
ছবির মতো সুন্দর একটি রাত। দিন-রাত একাকার করে বৃষ্টি ঝরছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। আসমান থেকে কে যেন মনের খেয়ালে ঝরাচ্ছে মুক্তো দানার মতো জল। দীর্ঘ বর্ষণে আগলা মাটি থেকে ভেসে আসছে সোঁদা গন্ধ। থেকে থেকে তীব্র শব্দে বাজ পড়ছে। বৃষ্টিটা একটুখানি সবুর করলেই শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝি আর কুনোব্যাঙের ডাক ৷ এই ইট পাথরের শহরে কুনোব্যাঙ কোথা থেকে এলো সে রহস্য উদঘাটনের রাত আজ নয়। আজকের রাতটা একটু অন্যরকম।
সাদা জমিনের উপর নীল ফুল তোলা শাড়ি আজ মিথির গায়ে। সুতি, সাধারণ শাড়ি। সঙ্গে গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ। শাড়িটা গোধূলি বেলায় কিনে এনেছে সাব্বির। কী মনে করে সে নববধূর জন্য সাদা শাড়ি কিনেছে সে কথা বলা মুশকিল হলেও শাড়িটাতে যে মিথিকে ভারি মানিয়েছে সে কথা হলফ করে বলতে হয়। গায়ের খোলতাই রঙের সঙ্গে শাড়ির রঙটা মিলেমিশে মিথিকে যেন আরও বেশি পরিচিত, আরও আটপৌরে, আরও বেশি কাব্যিক করে তুলেছে। ঘাড়ের উপর আগলা খোঁপা, সকালের বাসী কাজল তার দুধের মতো ফরসা মুখে এনে দিয়েছে একটা গৃহিণী গৃহিণী ভাব। ইলেক্ট্রিসিটির অভাব মেটাতে রান্নাঘরের কোণে একটা চার্জার বাতি জ্বালিয়েছে সাব্বির। সেই অল্প আলোয় মিথি যখন তরকারিতে দক্ষ হাতে ফোড়ন দেয় আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য গভীর চোখে অবলোকন করে তার গুণমুগ্ধ স্বামী, তখন সেই চিত্রটিতে ভেসে বেড়ায় বহুকালের অভ্যস্ত সংসার সংসার সুবাস। মিথি জিহ্বায় আঙুলের ডগা ছুঁইয়ে তরকারির নুন পরীক্ষা করতে করতে শুধাল,
‘ দাদাজানের সাথে আপনার পরিচয় কী করে?’
সাব্বির রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মিথির প্রশ্নে এগিয়ে এসে কেবিনেটের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। দুই হাত ভাঁজ করে চশমায় ঢাকা দৃষ্টিখানা বড় অবহেলায় জ্বলন্ত চুলার দিকে ফেলে রেখে বলল,
‘ আগে থেকে পরিচয় ছিল না। সেদিনই প্রথম দেখা।’
মিথি অবাক হয়ে বলল,
‘ কী সর্বনাশ! প্রথম দেখাতেই বিবাহের চক্করে পড়ে গেলেন? মৌনি থাকলে এক্ষুনি চিৎকার করে উঠে বলত, সাব্বির ভাই? আপনার সাথে দাদাজানের লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়েছিল বোধহয়।’
সাব্বির মৃদু হাসল।
‘ মৌনি! হ্যাঁ, ওনার সাথে দেখা হয়েছিল আপনাদের বাড়িতে। ভীষণ ছটফটে। আমাকে যে কী রকম বোকা বানিয়েছিল!’
মিথি বলল,
‘ দাদাজানের সাথে আপনার দেখা হলো কোথায়? রাস্তাঘাটে?’
চুলার আঁচ কমিয়ে সাব্বিরের মুখোমুখো সিঙ্কের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল মিথি৷ সাব্বির বলল,
‘ ঠিক রাস্তাঘাটে নয়। আমি আপনার দাদাজানের এতিমখানায় গিয়েছিলাম৷ সেখানেই দেখা। টুকটাক পরিচয়।’
মিথি অবাক হয়ে বলল,
‘ এতিমখানায় তো কত মানুষই যায়৷ আপনিই কী করে এই চক্করে পড়ে গেলেন?’
‘ সে কথার উত্তর তো আমার জানা নেই। হয়তো এমনটাই ছিল ভবিতব্য?’
মিথি শুধাল,
‘ সব রেখে এতিমখানায় কেন গিয়েছিলেন? ময়মনসিংহে কোনো আত্মীয়া আছে? বেড়াতে গিয়েছিলেন সেদিকে?’
সাব্বির হেসে বলল,
‘ নাহ্। ওদিকে আমার কোনো আত্মীয়া নেই। ময়মনসিংহে আমি গিয়েছিই সেই প্রথম। আমি প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন জেলার এতিমখানাগুলোতে যাই। এইবার নসিবের টানেই গেলাম আপনার দাদাজানের এতিমখানায়।’
মিথি সরল কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি কী দেশীয় এতিমখানার উপর কোনো রিসার্চ করছেন নাকি? প্রতি মাসে নতুন নতুন এতিমখানায় গিয়ে ডাটা কালেক্ট করার মতো ব্যাপার?’
মিথির প্রশ্নে হেসে ফেলল সাব্বির। বলল,
‘ ডাটা নয়। বাচ্চাদের কোনো হেল্থ ইস্যু আছে কি-না। তারা কোনো ভয়ংকর রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে কিনা। অনেকটা বিনামূল্যে রেগুলার চেকআপের মতো।’
মিথি সরু চোখে চাইল। নিজের বরের পেশা না জানার অজ্ঞতায় সে বিব্রত। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি?’
‘ আমি একজন ডাক্তার। চাইল্ড কার্ডিওলজি এন্ড নিউট্রিশন স্পেশালিষ্ট।’
হতভম্ব হয়ে গেল মিথি। সাব্বিরকে সে ঠিক ডাক্তার বলে চিন্তা করতে পারেনি। মাথার ভেতর প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে উঠল মৌনি,
‘ দাদাজান তো একেবারে রাঘব বোয়াল ধরে ফেলেছে রে মিথিইইই আপা!’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বড় খালামণির কথায় প্রভাবিত হয়ে সে বোধহয় সাব্বিরকে নিয়ে একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিল। নয়তো প্রথমেই ধারণা করে ফেলত, দাদাজান লাভ ছাড়া ক্ষতির হিসেব কখনও করেন না। মিথিকে গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে সাব্বির বলল,
‘ আমার বাচ্চাদের প্রতি দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে এতিম ছেলে-মেয়েদের প্রতি। সেজন্যই ময়মনসিংহে যাওয়া। তিনদিন ওখানে ছিলাম। শেষদিনটাতে যাই আপনাদের গ্রামে। এতিমখানার মালিক মানে আপনার দাদাজানের সাথে পরিচিত হয়ে ভীষণ মুগ্ধ হই। এমন ব্যক্তিত্ববান মানুষ এখন খুব কম দেখা যায়।’
‘ তারপর মুগ্ধতার ঠেলা সামলাতে কিডন্যাপ হয়ে গেলেন, তাই তো?’
কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল মিথি। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই হাসি নুপুরের ঝংকারের মতো বাজতে লাগল। নিজের হাসিতে নিজেই যেন চমকে উঠল মিথি। এর আগে, ঠিক কত বছর আগে সে এইভাবে হেসেছিল? ভাবতে গিয়ে স্মৃতির সকল রশদ ফুরিয়ে ফেলেও মনে করতে পারল না মিথি। সাব্বিরের কানেও সেই হাসি বাজল যেন সুরের মতো। ভাবতে চেষ্টা করল, এর আগে এই বাড়িতে এমন করে আর কী কোনো যুবতী হেসেছিল? মিথি টেবিলে খাবার সাজানোর তোড়জোড় করতেই আগ্রহ নিয়ে চেয়ার টেনে বসল সাব্বির। চিবুকে হাত ঠেকিয়ে মিথির কাজকর্ম দেখতে দেখতে বলল,
‘ না। আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত আমি স্ব-ইচ্ছাতেই গিয়েছিলাম।’
‘ স্ব-ইচ্ছায়?’
রান্না ঘরের ভেতর থেকে অবাক কণ্ঠ ভেসে আসে মিথির। সাব্বির বলল,
‘ হ্যাঁ। বাচ্চাদের দেখার সময় আপনার দাদাজান খুব বিনয়ের সাথে মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত দিলেন। গ্রামের ওমন মান্যিগন্যি মানুষ। তাঁর নিমন্ত্রণ কী আর অগ্রাহ্য করা যায়? নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পর আপনার দাদাজানের এসিস্ট্যান্ট খুব আদবের সঙ্গে জানালেন, আপনার জন্য ঘর খুলে দেওয়া হয়েছে। গিয়ে বিশ্রাম নিন। রাত আটটা বিশ মিনিটে আপনার বিবাহ।’
সাব্বিরের বলার ভঙ্গিতে আবারও খিলখিল করে হেসে উঠল মিথি। সাব্বিরও হেসে ফেলে বলল,
‘ আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার সাথে বাজে রকম ঠাট্টা করা হচ্ছে। তারপর যখন ফোন বাজেয়াপ্ত করে একটা ঘরে বন্দী করে দিল তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমি ভয়ানক বিপদে পড়েছি। এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য পালানো ছাড়া গতি নেই। কিন্তু আপনার দাদাজান অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। চারদিকে তার দৃষ্টি। আপনাদের বাড়ি থেকে পালানো যত সহজ ততটাই কঠিন। দুশ্চিন্তায় আমার ভয়াবহ মাথাব্যথা শুরু হলো। তখন আপনার দাদাজান এসে বললেন, তাঁর নাতনী অতিশয় চমৎকার। এমন চমৎকার মেয়ে ত্রিভুবনে নেই। সুতরাং আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁর কথা আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছিলাম, আমাকে বোধহয় কোনো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা এই ধরনের কারো সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নাতনী যদি চমৎকারই হয় তাহলে নিশ্চয় এমন ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না?’
মিথি অভ্যস্ত হাতে প্লেট গোছাতে গোছাতে মৃদু হাসল। বলল,
‘ আমাকেও শুটিং স্পট থেকে এক রকম তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকে যেভাবে বিয়ের কথা জানানো হয়েছে আমি ভেবেছিলাম আপনি হবেন বোধহয় কোনো গলির আওয়ারা টাইপ ছেলে।’
সাব্বির মিথির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,
‘ শুটিং স্পট! আপনি কী কোনোভাবে কোনো ফিল্মস্টার? দুঃখিত, আমার বাসায় টেলিভিশন নেই। আমি বিনোদন জগৎ সম্পর্কে খুব একটা জানি না। আপনার কোনো কাজ আমার দেখা হয়নি।’
সাব্বিরের কথায় হেসে ফেলল মিথি,
‘ আমাকে দেখে ফিল্মস্টার মনে হয়? এই চেহারায় ফিল্মস্টার হওয়া যায়?’
বিস্ফারিত চোখে মিথির দিকে তাকাল সাব্বির। মুখ ফসকে বলে ফেলল,
‘ এই চেহারা মানে? আপনি জানেন আপনি কত সুন্দর?’
মিথির ব্যস্ত হাত থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকাল৷ মিথির গাল, কপালে পড়ে থাকা খুচরো চুল, আটপৌরে শাড়ি, ক্লান্ত মুখ মিথিকে নামিয়ে আনল সাব্বিরের কতোই না আপনজনের আসনে। মনে হলো, এইভাবেই আরও বহু বছর ধরে মিথির কপালে, চিবুকে খুচরো চুলের ভিড় হচ্ছে। এমন আটপৌরে শাড়ি পরে, ঠিক এভাবেই আরও কত সহস্রবার মিথি কাজ থামিয়ে আচমকা সাব্বিরের দিকে তাকিয়েছে। এ যেন অভ্যস্ত দিনরাত্রির খেলা। নতুন কিছু নয়। সাব্বির মিথির সেই হালকা বাদামি চোখে অনেকটাক্ষণ তাকিয়ে থেকে যেন চোখে চোখেই বলে গেল,
‘ আপনার দাদাজান সেদিন সত্যি বলেছিলেন। আপনার মতো চমৎকার মেয়ে বোধহয় এই ত্রিভুবনে আর হয় না।’
তাদের এই চোখে চোখে খেলার মাঝেই অকস্মাৎ
দরজায় ঘন্টী বাজল। নিস্তব্ধ রাতে হঠাৎ এই আচমকা আওয়াজে চমকে উঠল দু'জনই। এতো রাতে কে এলো বাড়িতে!
_______________
বসার ঘরের সোফায় খুব সহজ ভঙ্গিতে বসে আছে রূপবতী এক মহিলা। মহিলার কোলে একটি শিশু। তারপাশে নবযৌবনের সবটা দেহে চাপিয়ে বসে আছে আঠারো, উনিশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির চোখ-মুখের অবস্থা গম্ভীর। মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। এই কান্না কান্না চোখদুটোর তেরছা দৃষ্টি দিয়ে আসছে থেকে নিরক্ষণ করছে মিথিকে। মিথি চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই উকিলের বউ নামক রূপবতী মহিলাটি মিষ্টি করে হাসলেন। আন্তরিক কণ্ঠে বললেন,
‘ এই রাতের বেলা এলাম বলে তো আবার রাগ করেননি ভাবি? আসলে কমলার মার কাছে আপনার এতো এতো প্রশংসা শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না। ভাবলাম গিয়ে পরিচিত হয়ে আসি। আপনার বর তো আর আমাদের সাথে যেচে গিয়ে পরিচয় করাবেন না। সাব্বির ভাই একটু অন্যরকম মানুষ।’
মিথি প্রত্যুত্তরে হাসার চেষ্টা করল। জীবনের প্রথম ‘ভাবি’ সম্বোধনে সে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছে। উকিলের বউ সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন,
‘ আপনি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী ভাবি। ঘরের পোশাকেও কী ভালো দেখাচ্ছে! এই আমাকে দেখুন, আপনার সাথে দেখা করতেও মুখে পাউডার মেখে এসেছি।’
নিজের পাউডার মাখার ব্যাপার বলে মহিলা খুব আমোদ নিয়ে হাসলেন। তার হাসি, আমোদ, আন্তরিকতা কোনোটা দেখেই মনে হলো না তিনি তার বোনের জন্য ঠিক করা পাত্রের বউয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। মিথি বিপন্ন বোধ করল। একবার চোখ ফিরিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকাল। দু’জন অন্তর্মুখী মানুষ একে-অপরের সঙ্গে সহজ হয়ে গেলেও এই সহজ পরিস্থিতি তাদের জন্য বিষম কঠিন হয়ে দাঁড়াল। উকিলের বউকে দেখে মনে হলো, তিনি গল্পের জাহাজ নিয়ে এসেছেন। এতো সহজে উঠবেন না। অন্যদিকে বৃষ্টি নামের মেয়েটি সেই কখন থেকে মিথির দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উকিল বউ সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সাব্বির ভাই, আপনি চা নিলেন না?’
সাব্বির কিছু বলার আগেই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিল মিথি। হাসিমুখে বলল,
‘ ও এখন আর চা খাবে না ভাবি। আমি কেবলই টেবিলে খাবার দিয়েছি। এখন চা খেলে রুচি নষ্ট হবে। আপনারা খান।’
সাব্বির আড়চোখে একবার বউয়ের দিকে তাকাল। বিয়ের দিন থেকে পরবর্তী সময়গুলো বিয়েটা নিয়ে তার নানা দ্বিধা ও বিরক্তি কাজ করলেও এই মুহূর্তে এই পারিবারিক আবহ তার ভালো লাগছে। বুকের ভেতর চাপা একটা আনন্দ থেকে থেকেই হুল্লোড় তুলছে৷ উকিল বউ বলল,
‘ সেকি! এখনও খাননি? খাননি যখন তখন থাকুক। আজ নবদম্পতি আমাদের বাসায় দাওয়াত গ্রহণ করুন৷ আমাদের বাসায় আমি রাঁধি। এই কমলার মায়ের রান্না একেবারে খাওয়ার যোগ্য না। এতো তেল-মশলা দেয়! আপনার বরকে কত বলি আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করুন। একটা দিন নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন না।’
মিথি হাসল। অল্প কথায় বলল,
‘ ও একটু ইন্ট্রোভার্ট।’
‘ তা আর বলতে! ভাবি চলেন আজ আমাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবেন। এসব খাবার আজ থাকুক। প্রথমবার বরের বাসায় এসেছেন কমলার মায়ের রান্না খেয়ে রুচি নষ্ট করার দরকার নেই।’
মিথি জানাল,
‘ সমস্যা নেই ভাবি। রান্না আমি নিজেই করেছি।’
উকিলের বউ যেন খুব অবাক হলেন,
‘ সেকি! আপনি রাঁধতেও জানেন নাকি? আজকালের মেয়েরা আবার রান্নাবান্নায় কাঁচা। আপনি তো দেখি রূপেগুণে অন্নপূর্ণা! এই তাহলে আমাদের সন্ন্যাসীর ধ্যানভঙ্গের কারণ! সাব্বির ভাই? সবসময় তো মাটিতে চোখ দিয়ে হাঁটেন। মাটিতে আকাশের পরি খুঁজে পেলেন কী করে বলুন তো? রমনীজ্ঞান তো দেখি আপনার বেশ টনটনে।’
সাব্বির কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করল। কাজের বাইরে সে কথা বলে কম। রমণীদের সাথে উঠাবসা তার আরও কম। তারওপর ভাবি জাতির এই উৎকট রসিকতা তার কাছে খুবই অসুস্থ ঠেকে। সে এই আক্রমণের বিপরীতে মৃদু হাসার চেষ্টা করল কেবল। মিথি বলল,
‘ চলুন ভাবি। এসেছেনই যখন আজ আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করুন৷’
খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গ আসতেই বিদায়ের প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন ভদ্রমহিলা। যাওয়ার সময় বারবার করে বলে গেলেন, কাল সকালের নাস্তার দাওয়াত তার বাসায়। এবার নিমন্ত্রণ রক্ষা না করলে তিনি ভয়ংকর মন খারাপ করবেন। ভদ্রমহিলা চলে যেতেই আয়োজন করে খেতে বসল মিথি-সাব্বির। চার্জার বাতির আলো কমে এসেছে যেকোনো সময় মুমূর্ষু রোগীর মতোন চেতনা হারাবে। সাব্বির একলা মানুষ। ইলেক্ট্রিসিটি গেলে প্রায় সময়ই ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। অতো মোম, চার্জার তার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আজ সেই প্রয়োজন যেন অনিবার্য হয়ে দেখা দিল। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে টেবিল গুছিয়ে চায়ের পানি বসালো মিথি। তারপর সারাঘর সার্চ করে খুঁজে বের করে আনল একটা অর্ধেক মোম। সেটা জ্বালিয়ে দিয়ে গর্বের একটা হাসি হাসল মিথি। অর্ধ মোম আর চায়ের কাপ নিয়ে তারা গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। ঝিঁঝি পোকা, কুনোব্যাঙ, আলো আলো আকাশ আর বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে মিথিদের বারান্দায়। মেঘ, বৃষ্টি ভুলে এই টুকরো বারান্দায় যেন খেলা করছে গাঢ় জ্যোৎস্নার মেয়েরা। মিথি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকাতেই দেখল ইতোমধ্যে চোখ-মুখ লাল হয়ে এসেছে তার। মিথি আনমনেই চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনার কী শরীর খারাপ?’
সাব্বির একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ তেমন কিছু না। সামান্য একটু জ্বর।’
মিথি উদ্বেগ নিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে রইল। বিকেল বেলা লোকটাকে অযথা অতোটা ভেজানোর দায়ে মন খারাপ হচ্ছে। অবচেতনেই আলতো ধমক দিয়ে বলল,
‘ সেই বিকেলেই তো আমি বললাম, একটা নাপা খেয়ে নিন। শুনলেন না। একটা নাপা খেলেই দেখতেন জ্বর বাপ বাপ করে পালাচ্ছে। আচ্ছা, আমি আপনাকে তুলশীপাতা দিয়ে চা করে দিই। ঠান্ডায় এটা খুব কাজে দিবে।’
ডাক্তারের উপর ডাক্তারি করা যে কেবল ডাক্তারের বউদের পক্ষেই সম্ভব সে কথা ভেবে মৃদু হাসল সাব্বির। ঠোঁট টিপে হাসি চেপে বলল,
‘ আচ্ছা!’
ঝাপসা অন্ধকারে সাব্বিরের ঠোঁটের হাসি লক্ষ্য করল না মিথি। সংকোচিত কণ্ঠে বলল,
‘ জ্বর দেখি?’
সাব্বির এগিয়ে এসে মাথাটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ দেখুন।’
মিথি তার শীতল হাতটা তুলে উদ্বিগ্ন মুখে সাব্বিরের কপাল ছুঁলো। সাব্বিরের মনে হলো এক টুকরো বরফ খণ্ড উড়ে এসে পড়ল তার তপ্ত, খড়াময় কপালে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বোজে আবার তাকাল মিথির চোখে। আধো আলো আধো অন্ধকার দুজনের চোখে চোখ পড়তেই শারিরীক অসুস্থতা, উদ্বেগ সব ভুলে বসল তারা৷ মোমের হলদে আলোয় স্বপ্নময় ঠেকল একে অপরের মুখশ্রী। সাব্বিরের শ্যামলা মুখ। ঘন ভ্রুর নিচে শান্ত, দিঘির মতো দুটো চোখ। যে চোখে শুভ্র রাজহাঁসের মতো ভেসে বেড়ায় সরলতা। কাঁটা কাঁটা দাঁড়িতে বোঝাই রুক্ষ গাল। মানানসই নাসিকা। তার নিচেই ঈষৎ কালচে ওষ্ঠাধর। মিথির দৃষ্টি এসে থমকে গেল সাব্বিরের রুক্ষ, পুরুষালি ওষ্ঠদ্বয়ের ওপর। মস্তিষ্ক শুধাল, সাব্বির কী ধুমপায়ী? ভেতরের মন প্রশ্রয় দিয়ে বলল, ‘হোক ধূমপায়ী। পুরুষ মানুষ একটু ধূমপান না করলে কী আর হয়?’ মস্তিষ্ক সে কথার জবাব দেওয়ার ফুরসত পেল না। তার আগেই হরমোনের খেলায় হেরে গেল শরীর৷ এই শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়েও প্রচন্ড গরমে লাল হয়ে গেল মিথির গাল। এই অনুভূতি তার প্রথম অথচ বড় স্পষ্ট। মিথির শীতল হাত কপাল থেকে ধীরে ধীরে নেমে এলো সাব্বিরের গালের উপর, ঠোঁটের পাশে। তারপর একবার চোখ তুলে তাকাল সাব্বিরের চোখে। সাব্বির তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি গভীর। মিথি সাব্বিরের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে নিজের মধ্যে নানান পরিবর্তন দেখেছে। আজ সেই পরিবর্তনের শেষ সীমা অতিক্রম করে হাজার বছরের তৃষ্ণার্তের মতো সাব্বিরের ওষ্ঠরেখায় মিশিয়ে নিলো নিজেকে। সাব্বির বাঁধা দিল না। এক হাতে স্ত্রীর ক্ষীন কটি জড়িয়ে ধরে আকর্ষণ করল নিজের দিকে। প্রশ্রয় পেয়ে ধীরে ধীরে আগ্রাসী হয়ে উঠল মিথি৷ নবদম্পতির বাড়ন্ত হৃৎস্পন্দন যেন স্তব্ধ করে দিল রাতের ঝিঁঝির ডাক। কুনোব্যাঙের হাহাকার। অনুভূতির এই তীব্র আস্ফালনের সময় মিথির অকস্মাৎ মনে হলো সাব্বির তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হরমোনের অবিশ্রাম জ্বালাতনে সেই মৃদু প্রতিবাদ ততটা বিচলিত করল না মিথিকে। তারপর হঠাৎ , একদম আচমকা তীব্র এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মিথি। কোমল হাতটা বারান্দার গ্রিলের সাথে নিষ্ঠুরভাবে ধাক্কা খাওয়ায় মুহূর্তেই জায়গাটা টনটন করে উঠল। প্রথম কয়েকটি সেকেন্ড মিথি ঠিক বুঝতে পারল না, কী হচ্ছে? তারপর যখন বুঝল, চূড়ান্ত প্রত্যাখানের অপমানে সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠল তার। সাব্বির কয়েক সেকেন্ড তীব্র অপরাধবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অন্য ঘরে গিয়ে দোর দিল। আর বারান্দার এক কোণে পরিত্যক্তের মতো পড়ে থেকে মিথির একদিনের সংসার সংসার খেলা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল তার সারা গায়ে। সেই দুঃস্বপ্নে মিথি কেবলই খুঁজে পেল তীব্র অপমান। নিজেকে নিজের কাছে অসহ্য বলে বোধ হলো। একটা মিথ্যা স্বপ্নের ঘোর থেকে যেন ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো সে। চারদিক দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠল। তারপর নিজেকে আচমকাই যেন খুঁজে পেল নোংরা নর্দমায়। নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের আমিত্বের কী ভয়ংকর দুর্দশা ঘটিয়েছে সে! মিথি তো জানতো ভালোবাসা, মায়া, সম্পর্ক সব এক মিথ্যার জাল। তারপরও কেন নিজেকে এতো খেলো করল সে? এতোটাই নিচে নামাল যে চারদিকে কেবলই অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। এতোদিন সে একা ছিল। আত্মসম্মান আর আত্মগরিমার প্রতাপে বেঁচে থাকতে তার একটুও কষ্ট হয়নি। কিন্তু আজ যেন একেবারে নিঃস্ব হলো। নিজের কাছে নিজের হেরে যাওয়া যে কত ভয়ংকর। কত অপমানের তা উপলব্ধি করে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠল মিথির দেহ। এই পৃথিবীর প্রতি তীব্র ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে। দাদাজান, সাব্বির, এই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণা, নিজের প্রতিটি অঙ্গের প্রতি আলাদা আলাদা করে ঘৃণা জন্মাল তার। সেকি বিশ্রী, অসহনীয় অনুভব! উপলব্ধি করল, এই পৃথিবীতে আত্মসম্মানের থেকে বড় কিছু আর নেই। হতে নেই।
বারান্দা থেকে একটা ঘোরের মধ্যে ফিরে অন্ধকার ঘরেই থম ধরে বসেছিল সাব্বির। এর মধ্যে কতক্ষণ, কত ঘন্টা সময় পেরুল তার খোঁজ রাখেনি সাব্বির? তার এই গভীর ঘোর ভাঙল হঠাৎ ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলে উঠার কারণে। আলোয় আলোয় ঘর ভরে যেতেই আচমকা সৎবিৎ ফিরল তার। চট করে মাথায় খেলে গেল মিথির খেয়াল। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে একরকম দৌঁড়েই পাশের ঘরে গেল। ঘরে পা দিয়েই বুঝল, মিথি নেই। তার ঘর, তার জীবন কোথাও মিথি নেই। বিছানার উপর তার দেওয়া শাড়িটা যেমন আলগোছে ফেলে গিয়েছে। ঠিক তেমনই মিথি ফেলে গিয়েছে সাব্বিরকে। অবশ্য, তাই তো হওয়া উচিত। সাব্বির দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে মিথির শাড়ির পাশে বিছানায় গিয়ে বসল। দু'হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল অনেকক্ষণ। ছিন্ন ছিন্ন চিন্তার মতো ঘুরতে লাগল নানা চিন্তা। কেন মিথির সাথে দেখা হলো আজ বিকেলে? সাব্বির কেন রিকশা থামাল? কেন তাকে অনুরোধ করল বাড়ি আসতে? কেন এমন একটা সর্বনাশ ঘটে গেল? সাব্বিরের হঠাৎ খেয়াল হলো, বাইরে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। সাব্বির ভেতর ভেতর অস্থিরবোধ করতে লাগল। এই ঝড় বাদলার মধ্যে এতো রাতে একা কোথায় গেল মিথি? যদি ভয়ংকর কোনো বিপদ হয়? সাব্বির ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাইরের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তীব্র হৃদয় ব্যথায় টলমল করে উঠল তার চোখ। গাঢ় কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
‘ তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া উচিত হয়নি মিথি। রিকশা থামিয়ে আমার তোমার কাছে যাওয়া উচিত হয়নি। তোমাকে এই বাড়িতে আসার প্রস্তাব দেওয়া উচিত হয়নি। সরি মিথি। আই এ্যাম সরি ফর এভ্রিথিং।’
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
১৭ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন