উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


১৯ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ২০ )


বর্ষার নির্জীব ছাই রং হটিয়ে মুঠো মুঠো রোদ্দুর নামছে ভূখণ্ডে। দীর্ঘ অবসন্নতার পর রোদের ছোঁয়ায় চনমনে হয়ে উঠেছে শহর। বাসের অ্যালুমিনিয়ামের গায়ে খেলা করছে ঝুরঝুরে সোনালি রোদ্দুর। মিথি লোকাল বাসের সীটে গা এলিয়ে উদাসমুখে ভোরের শহর দেখছে। চোখের কোলে জমে আছে গাঢ় এক বিষণ্ণতা। সকালের শুরুতে যে আত্মপ্রত্যয়ে ঝকমক করছিল তার চোখ হঠাৎ করেই সেই প্রত্যয়ে মেঘ জমেছে। আষাঢ়িয়া দিনের মতোন ধূসর দেখাচ্ছে মুখ।
মিথি প্রাণপণে নিজের এই বিষণ্ণতা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। চেষ্টা খুব একটা সফল হচ্ছে বলে মনে হয় না। বিষণ্ণতার বদলে বুক হাহাকার করা এক হতাশা ঝাপটে ধরছে তার চারপাশ। জীবনের সবকিছু থামিয়ে দিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত দেশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। স্বপ্ন, লক্ষ্য, আত্মসম্মান, মায়া সবকিছু থেকে দূরে বহুদূরে।
বুঝদার হওয়ার পর থেকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনো আবদার রেখেছে বলে মনে পড়ে না মিথির। এই পঁচিশ বছরের জীবনের সর্বদায় স্রষ্টার প্রতি একটা নীরব অভিমান বয়ে বেরিয়েছে সে। কক্ষনও মহান পরাক্রমশালীর কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে ইচ্ছে হয়নি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছে। ভাগ্য সহায় না হলে নীরব অভিমানটা আরও একটু গাঢ় হয়েছে। মাঝেমাঝে মিথির মনে হয়, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বোধকরি অভিমানের। জন্মের পর থেকে বকুল ফুলের মতো একটি একটি করে অভিমান জমাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা সেই অভিমানের ঝুড়ি নেড়েচেড়ে দেখছেন, শোনছেন কিন্তু কখনও আঙুলের ছোঁয়ায় সেগুলোকে বাষ্প করে দিচ্ছেন না। কে জানে? হয়তো এই পৃথিবীতে অভিমানের ঝুড়ি বয়ে বেড়ানোই মিথির একমাত্র কাজ।
মিথির ভাবনার মাঝেই দীর্ঘ জ্যাম পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাল বাস। বুকের ভেতর একটা পরিকল্পনা, কিছুটা বৈরাগ্য, অল্প একটু আসন্ন স্বাধীনতার আনন্দ আর অসীম বিষণ্ণতা নিয়ে মিথি যখন এফডিসিতে পৌঁছাল তখন বেশ বেলা হয়েছে। ছয় নম্বর ফ্লোরে জোরেসোরে শুটিংয়ের কাজ চলছে। মোখলেসুর সাহেব বরাবরের মতোই ক্যামেরার পেছনে আসীন। মেজাজ তার সবসময়ের মতোই তপ্ত। কারণে অকারণে একে-ওকে ধমকাচ্ছেন। মিথি যখন পাশে গিয়ে দাঁড়াল তখন তিনি একটা শট নিচ্ছেন। দৃশ্যে নায়িকা উদাসমুখে বসে থাকবে। ক্যামেরা তার মুখের দিকে ফোকাস। এই মুহূর্তে তার একমাত্র কাজ দূরে কোথাও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিষণ্ণ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলার আগে তার পলক পড়বে। ফ্যানের বাতাসে দু-তিনটে চুল উড়ে এসে পড়বে গাল আর ঠোঁটের মাঝামাঝি। কিন্তু ফ্যানের বাতাস বেশি হওয়ায় দু-তিনটের বদলে মাথার প্রায় অর্ধেক চুলই উড়ে এলো। মোখলেসুর সাহেব ভয়ংকর চটে গেলেন,
‘ সেটে একেকটা ছাগল পুষে রেখেছি আমি। আল-আমিন কোন ছাগলকে ফ্যান ছাড়ার দায়িত্ব দিয়েছ তাকে ধরে আনো। তার মুখে কাঁঠাল পাতা গুঁজে দিয়ে এক্ষণ তাকে এফডিসি থেকে বিদেয় করো। ছাগলের কাজ কাঁঠাল পাতা খাওয়া, ফ্যান ছাড়া না।’
আল-আমিন নামক ছেলেটি তটস্থ হয়ে ফ্যান দেখতে ছুটে গেল। মোখলেসুর আলমের দৃষ্টি তখন গিয়ে পড়ল মিথির ওপর। মিথিকে দেখেই তার মেজাজের পারদ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ঠাণ্ডা স্বরে বললেন,
‘ তুমি এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই ফ্লোরে এই মুহূর্তে তো তোমার কোনো কাজ নেই। আমি এখানে কোনো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করিনি যে তোমার সুন্দর মুখ দেখে মানুষ হাততালি দেবে। এটা কোনো পর্যটনকেন্দ্রও না। হুয়াই ডিড ইউ কাম হেয়ার?’
মিথি অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ সরি স্যার। জ্যামের কারণে…’
মোখলেসুর আলম ধমকে উঠলেন,
‘ জ্যাম ছিল! তোমার জ্যামের জন্য আমি শুটিং আটকে বসে থাকব? তোমার কাজ নয়টার মধ্যে সেটে এসে উপস্থিত থাকা। এখন বাজে নয়টা পঁয়তাল্লিশ। নায়ক-নায়িকা সবাই সেটে উপস্থিত। কিন্তু তোমার জ্যাম কাটে না। ফাজলামো করো তুমি আমার সাথে? নাটক শুরু করছ? এমন জিরো রেসপন্সিবিলিটি সেন্স নিয়ে তুমি আমার এসিস্ট্যান্ট হতে এসেছ? ইডিয়ট।’
অন্যসময় হলে মিথি একটু ম্লান হতো। আজ মনের মধ্যে অন্যরকম পরিকল্পনা আছে বলেই সে বিনীত কণ্ঠে বলল,
‘ দেরি হওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আই উইল মেইক শিওর, এমনটা যেন আর না হয়। আপনি অনুমতি দিলে, সাফাত ভাইয়ার সাথে আমার একটু দরকারি কথা ছিল। ওনার সাথে কথা বলে তারপর আপনার সাথে কথা বলি? আপনি কী একটু অপেক্ষা করবেন?’
মিথির এহেন দুঃসাহসে মোখলেসুর সাহেব হিংস্র চোখে তাকালেন। কিছুক্ষণ লাল চোখে তাকিয়ে থেকে ফস করে একটা সিগারেট ধরালেন। একবার ভাবলেন, মেয়েটাকে এই মুহূর্তে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এফডিসি থেকে বের করে দিবেন৷ পরমুহূর্তেই সাফাতের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা আগ্রহ বোধ করলেন। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিরক্ত চোখে মিথির দিকে তাকালেন একবার। এর আগেও দুটো কাজে মিথি তার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। মেয়েটার অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্যমে মোখলেসুর আলম মোটামুটি মুগ্ধ ছিলেন। মেয়েটার মধ্যে একটা সম্ভবনা আছে। সেজন্যই বোধকরি মিথির প্রতি তার কিছুটা শিষ্যসুলভ মমতা আছে। কিন্তু এবার মেয়েটার মধ্যে বড় কোনো গন্ডগোল টের পাচ্ছেন। শুটিংয়ের শুরু থেকেই এই মেয়ের এসব উদ্ভট কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। শুটিং সেটে এই মেয়ে যে নাটক শুরু করেছে তার সামনে এই গোটা নাটকের শুটিংও দুগ্ধপুষ্য শিশু। মোখলেসুর আলম বিরক্তমুখে সিগারেটে টান দিয়ে হাতের ইশারায় মিথিকে বিদেয় হতে বললেন। মিথি সেখান থেকে সরে গিয়ে সাফাতের খোঁজ লাগাল। সাফাতকে পাওয়া গেল মেকআপ রুমে। মনের সুখে মেকআপ নিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। মিথিকে দেখেই তার গান থেমে গেল। চোখ-মুখে ফুটে উঠল সুস্পষ্ট বিরক্তি। মিথি সেই বিরক্তি লক্ষ্য করেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বলল,
‘ ভাইয়া, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।’
সাফাত বিরক্তিতে থমথমে মুখে চুপ করে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ কী কথা?’
‘ কিছুটা ব্যক্তিগত কথা।’
সাফাত আয়নার ভেতর দিয়ে একবার মিথির দিকে তাকাল। হাতের ইশারায় ঘরের সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলে কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত কথা থাকার কথা না। তারপরও, তোমাকে দুই মিনিট সময় দেওয়া হচ্ছে। দুই মিনিটের মধ্যে বলে বিদায় হও। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী ইউর ফেইস এগেইন।’
মিথি হেসে বলল,
‘ নিশ্চয় ভাইয়া। থেংকিউ ইউ ভেরি মাচ। আমি দুই মিনিটের মধ্যেই বিদায় হচ্ছি।’
আয়নার ভেতর দিয়ে মিথির হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বিরক্তি কিছু কমে এলো সাফাতের। দৃষ্টিতে ফুটল কিঞ্চিৎ আগ্রহ। মিথি ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে হাসি হাসি মুখে বলল,
‘ আমি আসলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আজ এখানে আমার শেষ দিন। আমি জানি না, আপনি কেন আমার প্রতি এতো বিরক্ত হচ্ছেন। সেইদিনের সেই জুস ইন্সিডেন্ট নিয়ে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিরি ঘটনা অবশ্য বিরক্তি তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে যদি আপনি আমার উপর বিরক্ত হয়ে থাকেন তাহলে আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই নির্বেবাদী মানুষ। আমি কারো ভালো করার চেষ্টা যেমন করি না, তেমনই কারো বিরক্তির কারণও সাধারণত হই না। আমার এই পঁচিশ বছরের জীবনে কেউ আমার প্রতি খুব বিরক্ত হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। আপনি হচ্ছেন, ব্যাপারটা আমার জন্য পীড়াদায়ক। আমি মোখলেসুর স্যারের এসিস্ট্যান্টশিপ থেকে স্বইচ্ছায় এবং খুশি মনে সরে যাচ্ছি। চলে যাওয়ার আগে আপনার কাছে ছোট্ট একটি রিকুয়েষ্ট, আপনি দয়া করে আমার প্রতি বিরক্তি পুষে রাখবেন না। পৃথিবীর কোনো এক কোণায় কেউ একজন আমার অস্তিত্বে মনেপ্রাণে বিরক্ত ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগবে না।’
সাফাত একদৃষ্টিতে মিথির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যুত্তর করল না। মিথি হাসিমুখে বিদায় নিয়ে মেক-আপ রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ করতেই নীরবতা ভেঙে কথা বলল সাফাত। আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
‘ আই এ্যাম সরি টু, মিথি।’
মিথি দরজার কাছ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে সাফাতও ফিরে তাকাল এবার। মিথির চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ আপনার প্রতি এতোটা ক্ষুব্ধ হওয়া বোধহয় আমার উচিত হয়নি। ভালো লাগা, মন্দ লাগা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু তার এমন উৎকট প্রকাশ দৃষ্টিকটু। আমি হয়ত আমার ক্ষমতার বলে এই রুচিহীন ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার ঘটিয়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আমি খুবই দুঃখিত।’
মিথি উত্তরে মিষ্টি করে হাসল। সেই হাসিতে সিনেমার পর্দার মতো সাফাতের মনে পড়ে গেল সেই বিকেলটির কথা। সেই বিষণ্ণ মিথির কথা। ভাবহীন, অকপট অথচ বিষণ্ণ মিষ্টিতা ল্যাপটে ছিল যার সারা মুখে। ধীরে ধীরে একটা স্বস্তি ফিরে এলো সাফাতের বুকে। তার কেন যেন মনে হলো, এই আশ্চর্য কর্মঠ মেয়েটি আদতে ভীষণ নিঃসঙ্গ। তার ভেতরকার সেই রবীন্দ্রীয় মেয়েটির খোঁজ সম্পর্কে অবচেতন সে নিজে। বাস্তবতার ইন্দ্রজাল পুষ্পের মতোন পরিস্ফুট হতে দিচ্ছে না তাকে৷ সুরভিত করতে দিচ্ছে না চারপাশ। সেই প্রাণটিকে খুঁড়ে এনে পৃথিবীকে চমকে দিতে এই মেয়েটির প্রয়োজন একটি নিঃস্বার্থ বন্ধু। যে হবে আয়নার মতো স্বচ্ছ। যার কাছে খোলে ফেলা যাবে সমস্ত গাম্ভীর্যের মুখোশ। সাফাত অনুরোধের কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি দয়া করে কাজটা ছেড়ে দিবেন না মিথি।’
মিথি ফের হাসল। মাপা মাপা অথচ চমৎকার হাসি,
‘ ভয় নেই। আমার আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু মাফ করবেন, আমার সিদ্ধান্তটা আমি নিয়ে ফেলেছি।’
সাফাত ঠোঁট কামড়ে এই দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মেয়েটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ আপনি কাজটা ছেড়ে দিলে সারাজীবন আমার মনে হবে, আমি কাউকে তার স্বপ্ন হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করেছি। আমি আপনার প্রতি সমস্ত বিরক্তি ভুলে আপনাকে দায়মুক্ত করছি। আপনি আমাকে দায়মুক্ত করবেন না মিথি?’
___________
সোনালু রোদ ঢেকে দিয়ে আকাশে আবারও ধূসর মেঘ জমতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যেই শুরু হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। আবার কোথাও জাদুর মতো নেমে আসছে মুঠো মুঠো রোদ্দুর। নাহিদের মনে রোদ-বৃষ্টির মতোই খেলা করছে দুটো লাইন,
‘ রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে
খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’
ছেলেবেলায় এই ছড়াটা ছিল বহুল পরিচিত। নাহিদের ছেলেবেলাটা কেটেছে নানাজানের বাড়িতে। নাহিদের বেশ মনে আছে, রোদ-বৃষ্টির খেলা শুরু হলেই নানাজানের বিরাট বাড়ির বিশাল উঠোনে দল বেঁধে এই ছড়া কাটত তারা। উদোম গায়ে ভেজা উঠোনে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে তারা ছুটতো পুকুরের দিকে। তারপর দীর্ঘ সময় পুকুরের জলে অবগাহন। নানাজান কঠোর হলেও নানাবাড়িতে নাহিদের ছেলেবেলা ছিল স্বপ্নের মতো। রিফাটা সেই স্বপ্নময় ছেলেবেলা থেকে বঞ্চিত। বাবার আদরের বিধায় রিফাকে বড় হতে হয়েছে বাবা-মায়ের সাথে। ফুলের কলির মতো আদরে, আহ্লাদে। একমাত্র ছোটবোনকে নাহিদ নিজেও ফুলের মতো গোপন আদর করলেও মাঝেমধ্যে মনে হয় রিফারও নানাবাড়িতেই বড় হওয়ার দরকার ছিল৷ আর কিছু হোক না হোক, কঠিন হয়ে বড় হতো। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা রিকশা ডেকে উঠে বসল। ইশতিয়াকের বাসা থেকে সে ঘন্টা দুই আগে বেরিয়েছে। নিজের বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েও কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইশতিয়াকের হাসপাতালে একবার ঢু দিয়ে আসবে। ইশতিয়াকের বাসা থেকে বেরুনোর আগে মর্নিং নিউজের মালিক আদিব হোসেনের টেলিফোন পেয়েছে নাহিদ। তিনি নাহিদকে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবটা অনেকটা লটারি কাটার মতো। লেগে গেলে বিশাল অঙ্ক, হেরে গেলে সময়-পরিশ্রম সবকিছুই ফুস। নাহিদের যদিও নিজের উপর বাড়াবাড়ি রকম আত্মবিশ্বাস। তারপরও এই ধরনের কাজে সে নতুন। নাহিদকে এই প্রস্তাবটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। নাহিদকে ভাবতে হয় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায়। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে ভাবনা-চিন্তা তার পোষায় না। নাহিদ মহাখালীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে মনে মনে নানান সমীকরণ কষছে। সমীকরণ কষা শেষ হলে ব্যাপারটা সে জানাবে সৌধকে। তার আগে যাবে ইশতিয়াকের হাসপাতালে। ঘরের চাবিটা ইশতিয়াককে হ্যান্ডওভার করে দিয়ে আসা দরকার। তাছাড়া শেষবার টেলিফোনে ইশতিয়াক খুব চিন্তিত গলায় বলল,
‘ লোকটা বোধহয় মরে যাবে বুঝলি? ডাক্তাররা কোনো আশা দেখছে না। অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেই। ব্লাড প্রেসার রেকর্ড করা যাচ্ছে না। সাথে কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। কী বিপদে পড়লাম বল তো?’
লোকটা কে? নাহিদ জিজ্ঞেস করেনি। ইশতিয়াকের কোনো রোগী হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। নাহিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতালে গিয়ে লোকটিকে দেখে আসবে। লোকটির নাকি কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। নাহিদ কী কিছু ফলমূল কিনে নিয়ে যাবে? অযথা ঘুরে বেড়ানোর থেকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞাত কোন ব্যক্তির আত্মীয় বনে যেতে ক্ষতি কী?
_____________
বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। মিথি বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তার ধারে ফোন হাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। শুটিং জলদি প্যাকাপ হওয়ায় বিকেল গড়ানোর আগেই ছুটি পেয়ে গিয়েছে সে। এফডিসি থেকে বেরিয়ে তার সবসময়ই বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। আজ সর্বপ্রথম তার মনে পড়েছে, ইশতিয়াকের কথা। সকালে ঘুম ভেঙে নিজের মানসিক কষ্টের কারণগুলো কাগজে লিখে ফেলেছিল মিথি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবার কেবল ক্যারিয়ার নয় নিজের কথাও ভাববে। যা তার কষ্টের কারণ হচ্ছে সব কারণগুলোকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে জীবনটাকে নতুন করে গোছাবে। সেই লিস্টে এক নম্বরে ছিল সাব্বিরকে স্মৃতি মুছে ফেলার ওয়াদা৷ অথচ বাড়ি থেকে বেরুবার আগে তার খবরই এলো সর্বপ্রথম। তারপর থেকে অদৃশ্য এক অস্থিরতা। কাজের জায়গায় মোটামুটি একটা মীমাংসা হয়ে গেলেও সারাটা দিন অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা তাড়া করে বেড়িয়েছে তাকে। বিবেকের আর্তনাদে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মন। অবশেষে মন ও মস্তিষ্ক একটি সিদ্ধান্তে এসে স্থির হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইশতিয়াককে টেলিফোন করে সাব্বিরের ব্যাপারে জানতে চাইবে। একটা মানুষ অসুস্থ, তার সম্পর্কে সাধারণ খোঁজখবর নেওয়া মানবিকতা। এতোটুকু মানবিক মিথির হওয়া উচিত। মিথি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে ইশতিয়াকের নাম্বারে ডায়াল করল। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল, রিসিভ হলো না। মিথি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল। দেখা গেল, ফলাফল একই। মিথি হতাশ হলো। কিছুটা বিরক্তও। ফোনের নাম্বারটির দিকে তাকিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পেছন থেকে আসা বেপরোয়া এক বাইকের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল পাশে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল মিথি। যতক্ষণে সংবিৎ ফিরল ততক্ষণে আশেপাশে থেকে দৌঁড়ে এসেছে বেশ কয়েকজন পথচারী। একজন তরুণ তার দিকে ঝুঁকে শুধাল,
‘ ঠিক আছেন আপনি?’
মিথি উত্তর দিল না। কনুই চেপে উঠে বসে চারদিকে চোখ বুলাল। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ আমার ফোন?’
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন এদিক-ওদিক খুঁজে বেশ দূর থেকে কুড়িয়ে এনে দিল তার মোবাইল। মিথি ফোন হাতে নিয়েই দেখল, ডিসপ্লের অবস্থা কাহিল। স্ক্রিনজুড়ে ধূসর অন্ধকার। সার্ভিসিং ছাড়া এই মোবাইল ব্যবহার অসম্ভব। নিজের ভাগ্যের প্রতি বিরক্তিতে দমবন্ধ হয়ে এলো মিথির। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ভয়ংকর কিছু গালি দিয়ে থমথমে মুখে বসে রইল। আপাতদৃষ্টিতে তাকে বড় নির্লিপ্ত দেখালেও মিথি বুঝল তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। স্বাভাবিক ঘোরটা কেটে যাওয়ার পর দূর্ঘটনা পরবর্তী অস্বস্তিটা শরীর-মন জুড়ে বসে শরীরটাকে করে তুলছে ক্লান্ত, অস্থির। মিথিকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে আগের সেই যুবকটিই ঝুঁকে এসে বলল,
‘ আপু? আপনার কনুইয়ের কাছটা বেশ ছড়ে গিয়েছে। হাতের তালু আর হাঁটুতেও একই অবস্থা। ড্রেসিং করালে ভালো হতো। সামনে একটা ফার্মেসী আছে। আপনি কী উঠে ফার্মেসী পর্যন্ত যেতে পারবেন? নাকি আমি সাহায্য করব?’
মিথি চোখ ফিরিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা ভাবছে সে কিন্তু কী ভাবছে, তা যেন নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। ছেলেটি নির্দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমি সাহায্য করছি, আসুন।’
মিথি যেন কিছুই উপলব্ধি করতে পারছে না এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বাধ্য শিশুর মতো ছেলেটির হাত ধরল। ছেলেটি তাকে টেনে তুলেই চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ নিশ্চয় খুব ভয় পেয়েছেন? আপনার হাতটা খুব কাঁপছে। এক্সিডেন্টগুলোতে মাঝে মাঝে এমন ট্রমাটিক ব্যাপার ঘটে। অনেকে সাডেন শকে স্ট্রোকও করে বসে। আপনি প্লিজ একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করুন।’
মিথি আগের মতোই থমথমে মুখে হাঁটতে লাগল। ছেলেটির কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অস্থিরতা ধীরে ধীরে তার সীমা ছাড়াচ্ছে। কানের দু'পাশে ভো ভো শব্দ করছে। চারপাশের কোনোকিছুই অর্থবহ মনে হচ্ছে না। মিথির স্থির মস্তিষ্ক এই বিপদের মধ্যেও শরীর ও মনকে শান্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিপদের কথা, শরীর ও মন কেউই তাকে সঙ্গ দিচ্ছে না। ফার্মেসীতে বসে কনুই আর হাঁটুর ক্ষত পরিষ্কার করে ঔষধ দিয়ে দিলেন ডাক্তার। মিথির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট। আপনার প্রেশারের অবস্থাও তো খারাপ।’
মিথি প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তখনও যেন সে গভীর কোনো ভাবনায় মগ্ন। ডাক্তার বলল,
‘ বাড়ি গিয়ে ঔষধগুলো খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেন ম্যাডাম। হালকা একটা ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। এই ট্রমাটিক সিচুয়েশন থেকে বেরুনোর জন্য একটা গভীর ঘুম আপনার প্রয়োজন।’
সাথের ছেলেটি নিজেই ঔষধের পয়সা মিটিয়ে ঔষধের প্যাকেটটা নিজের পকেটে রেখে মিথিকে সাবধানে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ চলুন আপু। আমি আপনাকে বাসা অব্দি পৌঁছে দিব।’
মিথি এক পা’ও এগোল না। মিথির মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ দেখে ছেলেটি দ্রুত বলল,
‘ আপু, আমি সৌধ। আপনার কাজিন নাহিদের বন্ধু। নাহিদ একদিন মীরপুরের রাস্তায় আপনাকে দেখিয়ে বলেছিল, আপনি ওর বড় বোন। আপনি প্লিজ অপ্রস্তুত হবেন না। নাহিদের বোন তো আমারও বোন।’
মিথি কিছু বলল না। তবে পরিচিত নামে পূর্ণদৃষ্টিতে একবার সৌধর দিকে তাকাল। চিন্তিত কণ্ঠে শুধাল,
‘ তুমি নাহিদের বন্ধু?’
সৌধ মাথা নাড়ল,
‘ জি আপু।’
‘ কেমন বন্ধু? খুব ভালো বন্ধু?’
‘ জি, খুব ভালো বন্ধু।’
মিথি সৌধর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ নাহিদ কেমন আছে?’
‘ নাহিদ ভালো আছে আপু।’
মিথি অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ আমার খুব অস্থির লাগছে বুঝলে? মনে হচ্ছে, কোথাও একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানতে পারছি না। আমার বোধহয় অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোথায়, মনে করতে পারছি না। তুমি মনে করতে পারছ?’
সৌধ মিথির দিকে সমবেদনার চোখে তাকাল। কোমল কণ্ঠে বলল,
‘ আপনার এখন নিজের ঘরে থাকার কথা আপু। ডাক্তার কী বলল শোনেননি? আপনার একটা গাঢ় ঘুম দরকার। ঘুম থেকে উঠেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আর অস্থির লাগছে না।’
মিথি অবুঝ শিশুর মতো বিশ্বাস করে নিল সৌধর কথা। বাড়ি ফিরে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত অদ্ভুত এক অশান্তি পাথরের মতো চেপে রইল তার বুকের ওপর। কিছুতেই ঘুমোতে ইচ্ছে হলো না। তারপরও ঔষধের তাড়নায় ভারী হয়ে এলো চোখের পাতা। ঠিক কী কারণে এই অস্বস্তি তা মস্তিষ্ক ধরে ফেলার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল শরীর।
________________
আজ পরপর দুটো সার্জারি শিডিউল থাকায় লম্বা একটা সময় ওটিতে থাকতে হয়েছে ইশতিয়াককে। ওটি থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলে নিজের চেম্বারে ফিরে একটু বিশ্রাম নিবে এমনই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু চেম্বারে ফিরে অভ্যাসবশত মোবাইলটা চেইক করতেই ঝট করে মনে পড়ে গেল অসুস্থ সাব্বিরের কথা। ইয়া মা’বুদ! অসুস্থ ছেলেটার কথা তো প্রায় ভুলেই বসেছিল সে। কল হিস্ট্রিতে মিথির মিসডকলগুলো না দেখলে বোধহয় ফোন বন্ধ করে নিশ্চিন্ত একটা ঘুম দিয়ে বসত সে। ইশতিয়াক মিথিকে কল ব্যাক করতে করতেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। দেখা গেল, মিথির ফোন বন্ধ। ইশতিয়াক পর পর কয়েকবার চেষ্টা করতেই একজন নার্স এসে জানাল,
‘ স্যার, আপনার রোগীর অবস্থা ভালো না। আপনি ওটি থেকে বেরুলেই হাসান স্যার আপনাকে খবর পাঠাতে বলেছেন।’
ইশতিয়াক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাব্বিরের ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেল। সাব্বিরকে যিনি পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি একসময় ইশতিয়াকদের পড়াতেন। ইশতিয়াককে দেখেই বললেন,
‘ খবর তো ভালো না ইশতিয়াক। পেশেন্টের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে দুপুর থেকে ব্লিডিং শুরু হয়েছে। রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। সেটা কোনো সমস্যা না। প্লাটিলেট দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। কিন্তু সবথেকে বড় সমস্যা পেশেন্টের রক্তচাপের কোনো রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল খুবই কম। ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সবথেকে দুঃখজনক সংবাদ, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মনে হচ্ছে, কোনো চিকিৎসাই তার কাজে লাগছে না। তার অবস্থা যত দ্রুত খারাপ হচ্ছে, আমাদের চেষ্টা তত দ্রুত ফাইট করতে পারছে না।’
ইশতিয়াক প্রত্যুত্তরে ক্লান্ত মুখে বসে রইল। ডাক্তার বললেন,
‘ যদিও সে সেন্সে নেই। গভীর ঘুমে আছে। কাল থেকে এখন পর্যন্ত তার ঘুম ভেঙেছে মোটে দুইবার। ঘুম ভাঙলেও সে একটা ঘোরে থাকছে। আমাদের ধারণা, প্লাজমা লিকেজ হয়ে অতিরিক্ত রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী একটা শকে চলে গিয়েছে। তারপরও তুমি তার সাথে একবার দেখা করো। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব হবে না। রোগী খুব লেইট করে হসপিটালে এসেছে। আরও দুইদিন আগে এলে কোনো সুবিধা করা যেত। এই সময় প্রিয় মানুষদের কাছে থাকা ভালো। এই সুন্দর পৃথিবী থেকে কারো চলে যাওয়া তার প্রিয় মানুষের হাত ধরেই হওয়া উচিত।’
ইশতিয়াক বিষণ্ণমুখে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। বিদায় শব্দটা কষ্টের৷ প্রিয় মানুষের ছোঁয়ায় সেই কষ্টের বিষয়টাকে আমরা সহজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সাব্বিরের কষ্টটা কী করে সহজ করা যেতে পারে ইশতিয়াক বুঝতে পারছে না। সে তার প্রিয় মানুষ না। সেদিন সকালে, গ্রামের বাড়িতে তাদের এক ঝলক দেখা হয়েছিল। ইশতিয়াক সাব্বিরের সাথে হ্যান্ডশেক করে কুশল জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর নিজের কাছে বেরিয়ে গিয়েছে। এতটুকু আলাপে কারো চেহারাই ঠিক করে মনে রাখা যায় না৷ ইশতিয়াকও প্রায় ভুলতে বসেছিল। অথচ প্রকৃতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইশতিয়াকের হাতের কাছেই ফিরিয়ে আনল তাকে। সৃষ্টিকর্তা কী চাইছে তাদের মধ্যে আরেকবার করমর্দন হোক? সাব্বির কী আর করমর্দন করার মতো অবস্থায় আছে? ইশতিয়াক বিষণ্ণমুখে আইসিইউ-এর দিকে গেল। ঘুমন্ত সাব্বিরকে কী করে একটু স্বস্তি এনে দিবে সে? এই দুঃখী ছেলেটির জন্য কিছু একটা করে ফেলার ইচ্ছায় বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল তার।
__________
সারা গায়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা নিয়ে চেতনা ফিরে পেল সাব্বির। জ্বরের ঘোর কাটিয়ে প্রথমবারের মতো সচেতন হয়ে তাকাল। বুঝল, আইসিইউতে শুয়ে আছে সে। শ্বাসের টান, শরীরের যন্ত্রণা থেকে তার ডাক্তার মস্তিষ্ক আন্দাজ করে নিল, অতিশীঘ্রই চূড়ান্ত ঘটনাটা ঘটে যাবে। ত্রিশ বছরের দীর্ঘ জীবনটার অন্তিম পর্দাটা নেমে আসবে এক্ষুনি। দুইদিনের অচেতন অবস্থা থেকে অকস্মাৎ এই উত্তোরণ মঞ্চ নাটক সাঙ্গ করার আগে সৃষ্টিকর্তার একটি সুন্দর পরিকল্পনা। তিনি চাইছেন, সাব্বির শেষ বারের মতো এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখে নিক। তার জন্য আপন জনের চোখের পানি দেখুক। স্বস্তি পাক। কিন্তু কী আশ্চর্য! তার জন্য চোখের জল ফেলবে এমন আপনজন দিতেই তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। উঁহু, ভাবনায় ভুল আছে। মহান সৃষ্টিকর্তা কখনও কিছু ভুলে যান না। এটাও বোধহয় তাঁর অন্যকোনো পরিকল্পনার অংশ। সাব্বির মাথা নাড়িয়ে আশেপাশে তাকাল। বদ্ধ, শীতল একটা কক্ষ। সৃষ্টিকর্তা সুযোগ দিলেও এই বদ্ধ ঘর থেকে পৃথিবী দেখার সুযোগ নেই। এখন নিশ্চয় কেউ তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে আকাশ দেখাবে না? বলবে না, সাব্বির? নাও, শেষবারের মতো চোখ ভরে আকাশ দেখে নাও। সাব্বিরের বুকের ভেতরটা অজানা এক কষ্টে হাহাকার করে ওঠল। কোনো প্রিয় মানুষ না থাকার কষ্ট ছিল তার আজন্ম। একটি সন্ধ্যার কয়েকটি ঘন্টা দিয়ে মিথি সেই কষ্টটা বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে বহুগুণ। সাব্বিরের চোখ টলমল করে ওঠল, যদি একবার মিথির সাথে দেখা করা যেত! মিথি বোধহয় এখনও তাকে ঘৃণা করছে, সত্যটা জানলে ঘৃণা তাতে আর কতটা বাড়বে? সময় তো শেষই, মিথিকে যদি একবার তার সত্যটা বলে যাওয়া যেত? সময় শেষ, আর দেখা হবে না ভেবেই মিথিকে দেখার তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে এলো তার। মনে হলো, মিথির চোখের দিকে তাকালেই সে দেখতে পাবে আস্ত একটা আকাশ। সে মিথিকে বলবে, ‘মিথি মৃত্যুর আগে আমার খুব আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছিল। তুমি আমাকে আকাশ দেখালে। তোমাকে ধন্যবাদ।’ সাব্বির অনুভব করল, তারা সারা শরীরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র এক জ্বালাভাব। শ্বাসের টান বাড়ছে। হাত-পা, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ অবশ হয়ে আসছে। মৃত্যুতে এতো কষ্ট, আহ! সাব্বির চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আবছা চোখে দেখল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটি সুদর্শন যুবক। ছেলেটির চোখে সাব্বিরের জন্য গভীর মায়া। সে খুব স্নেহ নিয়ে সাব্বিরের একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে শুধাল,
‘ কাউকে দেখতে চান আপনি? নাম বলুন, আমি তাকে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
সাব্বির ইশতিয়াকের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে জলপূর্ণ হয়ে উঠল সেই দৃষ্টি। চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ার পরমুহূর্তেই সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ মিথি।’
যে ছেলেটির জন্য কাঁদবে বলে পৃথিবীতে একটি আপন মানুষও তৈরি করেননি বিধাতা। সেই ছেলেটির জন্য টলমল করে উঠল ইশতিয়াকের চোখ। বুকের ভেতর হুহু কান্না নিয়ে সে বলল,
‘ মিথি আসবে। নিশ্চয় আসবে। তুমি একটু বেঁচে থাকার চেষ্টা করো সাব্বির। আমার এই বোনটির ভাগ্য তোমার সাথে জুড়ে গিয়েছে। বোনটা আমার জন্ম থেকে হেরে আসছে। তুমি এইবার তাকে জিতিয়ে দাও। প্লিজ!’
সাব্বির সে কথা শুনতে পেল কি-না বুঝা গেল না। তার আগেই তার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে হাঁপরের মতো উঠানামা করছে বুক। বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে নেমে এসেছে চিকন এক অশ্রুধারা। এই অসহায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দুনিয়া ভেঙে কান্না পেল ইশতিয়াকের। আইসিইউ থেকে বেরিয়ে অবচেতন মনের একমাত্র ভরসার জায়গায় আনমনেই টেলিফোন করে বসল। ওপাশে রিসিভ হতেই ইশতিয়াক শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
‘ ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদাজান…’

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন