উপন্যাস : আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা : নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা |
১৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ১৯)
রাতভর আষাঢ়িয়া বৃষ্টিতে ভিজে স্নান পরবর্তী শিশুর মতোন কোমল দেখাচ্ছে প্রকৃতি। ছাদের মেঝেতে এখনও গত রাতের বর্ষণের ছাপ। জল জমে আছে এখানে সেখানে। মিথি ছাদের মাঝামাঝি, অপেক্ষাকৃত শুকনো জায়গায় শতরঞ্চি পেতেছে। আকাশে এখনও উষার দেখা মেলেনি। তবে যেকোনো সময় আঁধার ছাপিয়ে বেরিয়ে আসবে বলেই হয়ত চারদিকে একটা আলো আলো ভাব।
মিথি শতরঞ্চিতে বাবু হয়ে বসে দুই হাতের উপর সমস্ত ভর ছেড়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আকাশ পানে। চোখদুটোতে ছলছল করে অদ্ভুত এক প্রতিশোধস্পৃহা। এই প্রতিশোধ কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়। এই প্রতিশোধ সর্বজনীন। এই বিদ্রোহ পৃথিবীর প্রতিটি জীব, কৌতুকপ্রিয় ভাগ্য এবং কিছুটা হয়ত সৃষ্টিকর্তার প্রতিও। তারা সকলে মিলে মিথিকে ভেঙে ফেলার যে পাঁয়তারা করছে তার বিরুদ্ধে মিথি নিবে এক সুমধুর প্রতিশোধ।
অনেকটাক্ষণ ভূতের মতো একলা বসে থেকে ঈশানকোণে কুসুমপেলব আলো ছড়াতেই গা-ছাড়া ভাব কাটিয়ে পদ্মাসন করে বসল মিথি।
দীর্ঘকাল পর আজ সে যোগব্যায়ামে মনঃসংযোগ করবে। তারা যখন ময়মনসিংহের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যায়, মৌনির যোগব্যায়াম আর ‘সেল্ফ লাভ’-এর বক্তৃতা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হতে হয় মিথিকে। মেয়েটা নিজেকে মহাজ্ঞানী মনে করে। তার ধারণা, এই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান সৃষ্টিকর্তা কেবল তাকেই দিয়েছেন। মন চাইলেই সে সকলকে জ্ঞান বিতরণ করতে বসে। বলা বাহুল্য, এই মেয়েটিকে মিথির অসহ্য লাগে। সবার উপর ছড়ি ঘুরানোর প্রবণতা আর ন্যাকা ন্যাকা ব্যবহারের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে অসহনীয় ঠেকে। তারপরও মৌনির একটা কথা বড় মনে পড়ছে আজ। ছুটিতে বাড়ি গেলেই মৌনির উদ্ভট কার্যকলাপ চোখে পড়ে। অধিকাংশ সময়ই সে বেহুশের মতো ঘুমায়। তার যদি ইচ্ছে হয় ছাদে ঝুলে থাকবে, থাকে। তার যদি ইচ্ছে হয় বাড়ির সকলের মাথা চিবিয়ে খাবে, খায়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কেউ ঠেস দিয়ে কিছু শুধালেই মুখ টিপে হেসে কবিতার মতো আবৃত্তি করে,
‘এই একটি জীবন নাহয় আমি
বিলিয়ে দিলাম নিজের তরে।
প্রিয় বসুন্ধরা?
রাগ করো না,
লক্ষ্মী সোনা।
তোমায় ভালোবাসবে বলে
এই ধরণীতে আরও অনেক মানুষ রইল পড়ে।’
মিথি চিন্তা করে দেখেছে, কবিতার মূলভাবটা খুব খারাপ না। অনেক তো হলো এই বসুন্ধরার সাথে সখ্যতা করার চেষ্টা। ভাগ্যকে সমীহ করে চলা। এবার নাহয় শত্রুতা হোক। পৃথিবী তার প্রতি যতটা নিষ্ঠুর, সেও পৃথিবীর প্রতি ততটাই নিষ্ঠুর হোক। তবেই না হবে জমজমাট খেলা? উষার আলোর সাথে মিথির হালকা বাদামি চোখদুটো জ্বলতে থাকে অনির্বাপিত, নিষ্ঠুর ক্রোধের মতো। সেই ক্রোধ দেখে সৃষ্টিকর্তা হাসছেন নাকি ক্রুদ্ধ হচ্ছেন সে কথা বলবার ক্ষমতা আমাদের নেই। কে জানে কী করে নির্বাপিত হবে এই দুঃখী কন্যার রোষ? নাকি জনম জনম জ্বলতে থাকবে? পুড়ে যাবে বাদবাকি সমস্ত সুখ?
বেলা পড়েছে। সিজারিয়ান সেকশনে রুটিন ভিজিটে যাওয়ার পথে একটা ওয়ার্ডে চোখ আটকে গেল ইশতিয়াকের। পুরুষ ওয়ার্ডের একটা বিছানায় নিষ্প্রাণ মুখে শুয়ে আছে একটি যুবক। গলা অব্দি চাদর টানা। ইশতিয়াকের মনে হলো, যুবকটি তার চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছে, মনে করা যাচ্ছে না৷ ইশতিয়াক ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কপালের ভাঁজে মনে করবার প্রচেষ্টা নিয়েই এগিয়ে গেল মহিলা ওয়ার্ডের দিকে। সারাটাক্ষণ মস্তিষ্ক হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল, কোথায় দেখেছি ছেলেটিকে? কোথায়? তার কোনো রোগী হওয়ার সম্ভবনা কী আছে? মস্তিষ্ক তৎক্ষনাৎ নাকচ করল। রোগী নয় অন্য কোথাও, অন্য কোনোভাবে দেখা হয়েছিল তাদের। কিন্তু কোথায়? ইশতিয়াক ভিজিট শেষে চিন্তিত মুখেই ফিরে গেল নিজের চেম্বারে। প্রশ্নটা মাথায় এঁটেই প্রাত্যহিক কর্তব্য সারল। নয়টার পর সে আউটডোরে রোগী দেখতে বসে। পরপর কয়েকজন রোগী দেখার পর একজন মহিলা এলেন। সঙ্গে একজন পুরুষ। মেয়েটি লজ্জা লজ্জা মুখে যতটা বলল আর ইশতিয়াক যতটা পরীক্ষা করল তাতে তার সন্দেহ হলো, মেয়েটির ব্রেস্টে খুব সম্ভব টিউমারের উপস্থিতি আছে। ইশতিয়াক প্রেসক্রিপশনে বায়োপসি টেস্টের কথা লিখে ছেলেটিকে শুধাল,
‘ আপনি ওনার হাজবেন্ড?’
ছেলেটি অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘ জি না। ও আমার বোন। বোন জামাই দেশের বাহিরে থাকে। তাই..’
‘বোন জামাই’ কথাটা শুনেই ইশতিয়াকের চট করে মনে পড়ে গেল সেই পুরুষ ওয়ার্ডের নিষ্প্রাণ ছেলেটাকে সে দেখেছিল তাদের গ্রামের বাড়ি। খুব সম্ভবত এই ছেলেটাই মিথির বর। সামনের রোগীটিকে বিদেয় করে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ল ইশতিয়াক। ছেলেটার খবর নিতে হবে। সে যদি সত্যিই মিথির বর হয়ে থাকে তবে? পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে নিষ্প্রাণ ছেলেটার একটা ফটো তুলল ইশতিয়াক। ছবিটা মিথিকে পাঠিয়ে দিয়ে শুধাল,
‘ এটা তোর বর না?’
মিথি তখন বাইরে বেরুনোর প্রস্তুতি নিয়ে মাত্রই নাস্তা করতে বসেছে। রুটির টুকরো মুখে পুরতে পুরতে নির্বিকার মুখে ইশতিয়াকের পাঠানো ছবিটা দেখল। অন্য সময় হলে সাব্বিরের এহেন দশায় হয়ত চমকে উঠত বুক কিন্তু আজ এই করুণ স্থিরচিত্র তাকে স্পর্শ করতে পারল না। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ হতে পারে। আমি ঠিক করে চিনি না।’
ইশতিয়াক বিস্মিত হলো৷ সে বোধহয় জানে না, আত্মসম্মানে তীব্র আঘাতে রমণী হৃদয়ও পাথর হয়ে যায়৷ ভুলে যায় সম্পর্ক, টান, মায়া, স্পন্দন। তাই সে অবাক হয়ে বলল,
‘ চিনিস না মানে কী? নিজের বরকে চিনবি না? আশ্চর্য!’
মিথি লিখল,
‘ না। চিনব না। বর হলেই চিনতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই ইশতিয়াক ভাই।’
উত্তরটা দিয়েই ইশতিয়াকের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন অফ করে রাখল মিথি। সাব্বির জনিত কোনো খবর সে শুনতে চায় না। সাব্বির তার জীবনের একটা কালো অধ্যায়। অপমানের অধ্যায়। যে অধ্যায় মনে পড়লে নিজের প্রতি অসহ্য ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে মিথির। মনে পড়ে যায়, সে কত জঘন্য। সে কত অস্পৃশ্য। সাব্বিরের দোষ সে দেয় না। নাই থাকতে পারে তার সম্মতি ৷ কিন্তু মিথি কী করে নিজে থেকে ওমন হামলে পড়তে পারল? ছিঃ! এতো নির্লজ্জ সে? সেই রাতের কল্পনা তাকে যেন টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনতে চাইল প্রস্টিটিউটের সমপর্যায়। মিথি মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল৷ তার মস্তিষ্ক থেকে সাব্বির সম্পর্কিত সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করল। মনেপ্রাণে ভাবতে চেষ্টা করল, ‘সাব্বির বলে এই পৃথিবীতে কেউ নেই৷ ছিলো না কখনও। ছিলো না কখনও। ছিলো না কখনও।’
মিথি যত গভীর ভাবে সাব্বিরকে সরিয়ে দিতে চাইছিল তার মস্তিষ্কের অলিগলি সর্বত্র থেকে। জ্বরের ঘোরে ডুবে সাব্বিরের মস্তিষ্কে যেন ততই প্রকট হয়ে উঠছিল মিথি। জ্বরে অচেতন হয়ে সে কেবল দেখছে, শাড়ি পরিহিতা মিথিকে। কেউ কাছে এসে দাঁড়ালেই ঘুমন্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে জানতে চাইছে,
‘ মিথি?’
ইশতিয়াক যখন সাব্বিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল তখনও মৃদু নড়ে উঠল সাব্বিরের ঠোঁট। ডাকল,
‘ মিথি?’
সাব্বিরের মুখে মিথির নাম শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল ইশতিয়াকের। সাব্বির মিথিকে চিনে অথচ মিথি সাব্বিরকে জানে না এ-ও হওয়া সম্ভব? ইশতিয়াক বুঝল, এদের দু'জনের মধ্যে নিশ্চয় কোনো জটিলতা চলছে। ইশতিয়াক সেদিকে ঘাটাঘাটির চেষ্টা করল না। তাদের ভাই-বোনদের মধ্যে কেউই কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। ইশতিয়াকের জায়গায় অন্যকেউ হলে বোধহয় সাব্বিরকে দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখারও প্রয়োজন বোধ করত না। কিন্তু ইশতিয়াকের পক্ষে তা সম্ভব না। সে এদের বড়। ভাই-বোনদের আগলে রাখার একটা সহজাত প্রবৃত্তি তার মধ্যে আছে। ইশতিয়াক দায়িত্বরত নার্সের থেকে সাব্বিরে মেডিকেল হিস্ট্রি ও যাবতীয় তথ্যাদি জেনে নিয়ে সর্বপ্রথম তাকে কেবিনে শিফট করার ব্যবস্থা করল। সাব্বিরকে গতকাল যে ডাক্তার দেখেছেন তার সাথে কথা বলল। ইশতিয়াকের পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা দ্রুত এবং বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে কেবিনে শিফট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বিরের অবস্থা ভয়ংকর খারাপের দিকে গেল। দুপুরের মধ্যে তাকে ভর্তি করা হলো আইসিইউতে। নিজের সমস্ত কাজ ফেলে সাব্বিরের পেছনে লেগে থাকা ইশতিয়াকের জন্য কঠিন। বিকেলেই তার পরপর দুটো ওটি আছে। এদিকে ছেলেটার কোনো আত্মীয়-স্বজনও আসেনি। নার্স জানিয়েছে গতকাল একজন মহিলা তাকে এখানে ভর্তি করে রেখে গিয়েছে তারপর থেকে পরিজনহীন, একলা পড়ে আছে সাব্বির। সেই মহিলাটির সাথে যোগাযোগ করারও কোনো রকম ব্যবস্থা রেখে যায়নি। এই অবস্থায় ছেলেটিকে একা ফেলে রাখাও অমানবিক। যদিও আইসিইউতে ঢুকে বসে থাকার উপায় নেই। তারপরও একটা ভরসার হাত থাকলে শেষ সময়ে একটু স্বস্তি পেত ছেলেটা। ইশতিয়াকের দৃঢ় ধারণা, সাব্বির শেষ পর্যন্ত সার্ভাইব করতে পারবে না। একটা মানুষ অসহায়ের মতো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে ভাবতেই খারাপ লাগে। ইশতিয়াকের প্রচণ্ড মন খারাপ হচ্ছে৷ সে একসময় বাধ্য হয়েই মিথিকে ম্যাসেজ পাঠাল,
‘ তোর বরের অবস্থা খুব একটা ভালো না মিথি। ছেলেটার পাশে আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। অসহায়ের মতো পড়ে আছে। তোর বোধহয় আসা উচিত।’
ইশতিয়াক জানল না, মিথি কখনও এই ম্যাসেজ দেখবে না। কোনো ম্যাসেজ নোটিফিকেশ ছাড়া মিথি মাসেও ইনবক্সে ঢু দেওয়ার সময় করতে পারে না।
_____________
মেঘের আঁচল ভেদ করে ভূখণ্ডে নেমে এসেছে ঝুরঝুরে সোনালি রোদ। জানালার পর্দাকে ফাঁকি দিয়ে সে রোদ একেবারে চেপে বসেছে মিষ্টির বিছানায়। মাখামাখি হচ্ছে তার শীর্ণ অথচ লাবণ্যময় গালে। জানালার পর্দাটা আচমকা হাওয়ায় একটু সরে যেতেই রোদের কন্যারা চিবুক ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিষ্টির বন্ধ চোখের ওপর। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ফুলের মুকুল ফোটবার মতো ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল মিষ্টি। কাল ভোর রাতে বিষম ঝড় হওয়ায় সমস্ত মুখে তার দীর্ঘ ঘুমের ছাপ৷ ঠোঁটের কোণে মিঠে মিঠে হাসি। সারা গা জুড়ে আরামদায়ক আলস্য। জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় ঝরঝরে লাগছে মন। মিষ্টি ঘুম ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে ফোনের পাওয়ার অন করল। কাল দুপুরে অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর ওপেন করার চেষ্টা করা হয়নি। পঞ্চাশ পার্সেন্ট চার্জ থাকা সত্ত্বেও ওভাবে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভেবেছিল, ফোনটাই বুঝি গেলো। কিন্তু মিষ্টিকে অবাক করে দিয়ে একটু চেষ্টাতেই পাওয়ার অন হল। ফোন তার স্বাভাবিক স্থিরতা ফিরে পেতেই ম্যাসেজ এলো মৌনির।
‘ নাহিদ আমাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। ওকে একটা কল দিস তো মিষু।’
ম্যাসেজটা দেখেই মিঠে মিঠে আবহ, আরামদায়ক আলস্য কাটিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল মিষ্টি। মনে পড়ল, নাহিদ তার জন্য অপেক্ষা করছিল মহাখালী। তারপর মামুর ফোন এলো। ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। বাসে উঠেই এতো জ্বর বাড়ল যে নাহিদের কথাটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেল। মিষ্টি তড়িৎ হাতে নাহিদের নাম্বারে ডায়াল করল। নাহিদকে সে কী বলবে, কী এক্সপ্লেনেশন দিবে ভেবেই অস্বস্তিতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। দু'বার ডায়াল হওয়ার পর ফোন রিসিভ করল নাহিদ। ঘুম স্বরে বলল,
‘ হ্যালো।’
মিষ্টি কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল,
‘ তুমি এখন কোথায় আছ নাহিদ?’
নাহিদ কান থেকে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাল। মিষ্টির নাম্বার। নাহিদ ঘুম কাটিয়ে উঠে বসে মৃদু হেসে বলল,
‘ আমার কোথায় থাকার কথা মিষ্টি?’
মিষ্টি অপরাধী কণ্ঠে বলল,
‘ আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি নাহিদ। কাল আমি তোমার কাছেই আসছিলাম। মহাখালীতে যাওয়ার পথে আম্মুর ফোন এলো। বলল, মামু আমার জন্য মহাখালী দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন। ঠিক তখনই আমি মহাখালী গিয়ে পৌঁছাই। রিকশাও থামে একেবারে মামুর সামনে গিয়ে। তুমি তো জানো মামু কত স্ট্রিক্ট? তার সামনে তোমাকে কল করা অসম্ভব ছিল। তোমাকে টেক্সট করতাম কিন্তু মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেল। বাসে উঠার পর জ্বর এতো বাড়ল যে আমি আর কিছু ভাবতেই পারিনি।’
বাসে অচেতন থাকার পরও মৌনির সাথে তার যোগাযোগ ছিল সে কথা আর মনে করিয়ে দিল না নাহিদ। ভালোবাসা ও গুরুত্বের কথা কাউকে মনে করিয়ে দিতে নেই। সহজ কণ্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা।’
নাহিদের এতো সহজ কণ্ঠ যেন আরও পীড়া দিল মিষ্টিকে। তীব্র অনুশোচনা হলো। ম্লান কণ্ঠে ছোট্ট একটা মিথ্যা বলার চেষ্টা করল,
‘ বাড়ি ফিরে ফোন চার্জ করে সর্বপ্রথম তোমাকেই কল করেছিলাম আমি। কিন্তু কোনোভাবেই কানেক্ট হলো না। বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছিল। আই এ্যাম সরি নাহিদ। আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।’
নাহিদ কোনো প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করল না। ফোন তার সত্যিই বন্ধ ছিল রাতে। ফার্মগেইট থেকে নিজের বাসায় না গিয়ে মহাখালী ইশতিয়াকের বাসায় এসে উঠেছে সে। রাতে যদি সৌধ ফোন দিয়ে শুধায়, সে আজ ময়মনসিংহে থাকবে কি-না? কখন পৌঁছাল? তাহলে বেশ মুশকিলে পড়তে হতো। নাহিদ চায় না সৌধ জানুক মিষ্টি তাকে ফেলে গিয়েছে মহাখালীর রাস্তায়। একলা, আবর্জনার মতো। এতে মিষ্টির প্রতি সৌধর ক্রোধ বাড়ত। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হয়ত অশ্রদ্ধা পুষে রাখত। সৌধ যেমন তার প্রিয় বন্ধু। মিষ্টির সম্মান রক্ষাও তার দায়িত্ব। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সর্বদা চাপাবাজি করে বেড়ালেও মিষ্টি-সৌধ কারো সাথেই কখনও মিথ্যা বলে অভ্যস্ত নয় সে। এজন্যই বোধকরি মিষ্টি মিথ্যা বলছে বুঝতে পেরে একটু ম্লান হলো তার মুখ। বলল,
‘ ইট'স ওকে। তোমার জ্বর কেমন এখন?’
মিষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ তার দৃঢ় ধারণা, নাহিদ তার মিথ্যাটা ধরে ফেলেছে। নাহিদ মিথ্যা ধরে ফেলেছে বুঝতে পেরে অনুশোচনাটা আরও তীব্র হলো তার। অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। মস্তিষ্ক শুধাল,
‘ সত্যিই কী সে ভালোবাসে নাহিদকে? ভালোবাসলে কী ভুলে থাকা যায় এভাবে?’
মিষ্টির সাথে কথা শেষে কিছুক্ষণ নীরব বসে রইল নাহিদ। দরজায় বেলের আওয়াজে সংবিৎ ফিরে অলস হাতে একটা সিগারেট ধরাল। ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত শলাকা নিয়ে হেলেদুলে গেল দরজা খুলতে। নাহিদ ভেবেছিল ইশতিয়াক ফিরেছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখল প্রভার উৎসাহী মুখ। সাধারণ একটা কামিজ গায়েও চমৎকার লাগছে মেয়েটিকে। চুল আগলা। হাতে একটা ছোট বাটি। আচমকা দু'জন দু'জনের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল দু'জনেই। নাহিদ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চট করে সরিয়ে ফেলল ঠোঁটের সিগারেট। প্রভাকে দরজায় দেখে খুব আনন্দিত হয়েছে এমন ভঙ্গিমা করে দরজার ফ্রেমে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। দুষ্ট স্বরে বলল,
‘ ওহহো, আপনি! আমার টানে চলে এসেছেন তাই না? ইশ! আমাদের দু'জনের মধ্যে টেলিপ্যাথি পাওয়ার কেমন মারাত্মক চিন্তা করে দেখেছেন? নয়তো ওবেলায় আমি এলাম। এবেলায় আপনি হাজির।’
প্রভাও ততক্ষণে অপ্রস্তুত ভাব হটিয়ে সহজ হয়ে এসেছে। নাহিদের কথায় মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ আপনাকে কে বলল আমি আপনার জন্য এসেছি?’
‘ আমার জন্য আসেননি?’
এবারে চোখ বড় বড় করে তাকাল নাহিদ। মাথা এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘ তবে কী বড় ভাইয়ের প্রতি বিশেষ নজর?’
প্রভা করুণ মুখে মাথা নাড়ল। নাহিদ মাথা নেড়ে হতাশা জ্ঞাপন করে বলল,
‘ রূপবতীরা যে বোকা হয় তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আপনি।’
প্রভা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ কেন?’
‘ ডাক্তাররা কী রকম আনরোমান্টিক হয় জানেন? এদের মাথায় কেবল ঔষধ ঘুরে। আপনি ভুগবেন প্রেমজ্বরে। সে আপনাকে চুমু না দিয়ে দিবে প্যারাসিটামল।’
নাহিদের কথায় হেসে ফেলল প্রভা। নাহিদ মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ হাসবেন না। বিষয়টা সিরিয়াস। এইট্টি পার্সেন্ট ডাক্তাররা ডাক্তার বিয়ে করার কারণ কী জানেন? কারণ তারা জানে তাদের পক্ষে যথেষ্ট রোমান্টিক হওয়া সম্ভব না। তাই তারা বেছে নেয় তাদের মতোই আনরোমান্টিক মেয়েদের। যে বিশ পার্সেন্ট সাধারণ অনুভূতিশীল মেয়েদের বিয়ে করে তাদের অধিকাংশই থাকে ভয়ংকর ডিপ্রেসড।’
প্রভা ছদ্ম রাগ নিয়ে বলল,
‘ যত্তসব বাজে কথা। আমার বাবা ডাক্তার। মা গৃহিণী। কই, মা তো হতাশ নন।’
নাহিদ গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘ আপনারা কয় ভাই-বোন বলুন তো?’
প্রভা নাহিদের এমন ফিসফাসে ভড়কে গিয়ে বলল,
‘ আমিই একমাত্র। কেন?’
নাহিদ অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলল,
‘ ইশতিয়াক ভাইয়েরা পাঁচ ভাই। আর আমাদের বড় মামা হলেন ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বুঝতে পারছেন?’
শেষ কথাটা বলে ভ্রু নাচাল নাহিদ। প্রভা এ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বোকা স্বরে বলল,
‘ কী বুঝব?’
‘ ডাক্তার ভার্সেস জেনারেলের মধ্যে রোমান্সের মাত্রাটা। মানুষ কী আর হতাশার কথা মুখে বলে? এসব উদাহরণ দেখে বুঝে নিতে হয়। কথায় আছে না? বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট?’
প্রভা এবার শব্দ করে হাসল। সহজ কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি তো ভারি দুষ্টু। তা, আপনি কী করেন? রোমান্টিক পেশায় নাকি আনরোমান্টিক?’
নাহিদ বলল,
‘ আমি সুপার রোমান্টিক। আমার কোনো কর্ম নেই। খুবই ফালতু ধরনের ছেলে। ঘুরিং, খাইং, এন্ড ঘুমাইং আমার কাজ। এই ধরনের ছেলেরা রোমান্টিকতার দিক থেকে পিএইচডি ডিগ্রির সমপর্যায়ে। কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েরা এদের সাথে প্রেম করতে রাজি হলেও বিবাহ করতে রাজি হয় না। মেয়েরা বিবাহিত জীবনে স্বামী নিয়ে হতাশ থাকতে ভালোবাসে। খেয়াল করে দেখুন, নাইন্টি পার্সেন্ট প্রেমিক ভ্যাবাগন্ড। যারা শেষ পর্যন্ত প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারে না।’
কথা শেষ করে প্রভার হাতের বাটিটির দিকে তাকাল নাহিদ। আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘ রান্নাবান্না করে এনেছেন নাকি? সর্বনাশ! এতো দেখি একেবারে থার্ড ডিগ্রি প্রেম। বড় ভাই বাসায় নেই। আমাকে দেন, আমি খাই। আপনি আমার প্রেমে পড়েননি এই দুঃখে ক্ষুধারা পেটে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে।’
প্রভা হেসে ফেলল। হাতের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পৃথিবীর আর কোনো ভ্যাবাগন্ড প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে না পারলেও আপনি পারবেন। আপনাকে ছেড়ে যাবে এমন মেয়ে এই পৃথিবীতে দুষ্প্রাপ্য।’
নাহিদ ততক্ষণে বাটির মুখ খুলে ফেলেছে। প্রভা বাটিতে করে এনেছে ভুনা খিচুরি আর মচমচে ইলিশ ভাজা। নাহিদ সাথে থাকা চামচে অল্প একটু খাবার তুলে খুব চমৎকার হাসি হাসল। প্রভা বুঝল না, বর্ষা ভেজা সকাল বেলায় এই হাসি যে কত বিষণ্ণ!
____________
মধ্যাহ্নের আকাশে ধূসর মেঘের আস্তরণ। আবহাওয়া ঠান্ডা। একটা শীতল বাতাস শহরের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সংবাদপত্রের অফিস থেকে বেরিয়ে মৌনির মনে হলো তার কিছুটা শীত শীত করছে। এক কাপ গরম গরম চা কী সে খাবে? টং দোকান থেকে কড়া করে এক কাপ চা, একটা বনরুটি খেয়ে বাস ধরে চলে যাবে নীলক্ষেত। রিকশায় যাওয়া যাবে না। ওতে ভাড়া পড়বে বেশি। এই মাস শেষ হতে আর মাত্র দশদিন বাকি। এই দশদিনের মধ্যে মৌনির দরকার আরও পনেরো হাজার টাকা। এছাড়াও সাড়ে চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া। বাজার করার সাহস আপাতত তার হচ্ছে না। দু'দিন যাবৎ কেবল চাল-ডালের খিচুড়ি হচ্ছে বাসায়। তিনবেলা একই খাবার। তারপরও যদি কিছু খরচা কমানো যায়! মৌনির মনে মনে কষা হিসেবের মধ্যেই আঙুল ঢুকাল মস্তিষ্ক। কড়া কণ্ঠে বলল,
‘ এতোই যখন হিসেব করছিস তবে নীলক্ষেতে যাওয়ার কী দরকার? সোজা বাড়ির পথে হাঁট।’
মৌনি স্তিমিত কণ্ঠে বলল,
‘ কোনো বই টই কিনব না। শুধু একটু উল্টেপাল্টে দেখব। কতদিন যাই না।’
মস্তিষ্কের কঠিন স্বর,
‘ ক-তো-দি-ন? মিথ্যুক। সামনের সপ্তাহেই গিয়েছিলি তুই। আর হাজার দুয়েকের বই কিনে আরও দুই হাজার টাকার ঘাটতি ঘটিয়ে এসেছিস। ওগুলো থাকলে বাসা ভাড়া নিয়ে এতোটাও দুশ্চিন্তা করতে হতো না।’
মৌনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আজ আর কিনব না দেখিস? প্রতিদিন তো মানুষ একই ভুল করে না।’
মস্তিষ্ক কড়া চোখে চেয়ে বলল,
‘ তুই আগের সপ্তাহেও একই কথা বলেছিলি।’
মৌনির আত্ম সমালোচনার মাঝেই পেছন থেকে ভেসে এলো একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর।
‘ আরে, মৌনি না?’
মৌনি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, রিকশা থেকে নামছেন ভৌমিক দা। মৌনিকে দেখে ভাড়া মিটিয়ে ঝটপট এগিয়ে এলেন এদিকে৷ কাছে এসে মৃদু হেসে বললেন,
‘ অফিসে এসেছিলে নাকি? এদিকে আমি তোমাকে খুঁজে হয়রান। পত্রিকায় যে লেখা দিয়েছিলে তার সামান্য সম্মানি দিয়ে এখনও তোমাকে সম্মানিত করা হয়নি। চেকটা সেই কবে থেকে পকেটে নিয়ে ঘুরছি। যখন দেখা হয় তখন একদম মনে থাকে না।’
কথা বলতে বলতে পকেট থেকে একটা চেক বের করে মৌনির দিকে এগিয়ে দিল ভৌমিক। মৌনি চেকটা হাতে নিয়ে দেখল, সম্মানীর অঙ্ক খুবই সামান্য। সামান্য হলেও এই অপ্রত্যাশিত সংস্থানে খুশি হয়ে উঠল তার মন। এই লেখাটার কথা তো তার মাথাতেই ছিল না, আশ্চর্য! ভৌমিক মৌনির উজ্জ্বল চেহারা দেখে বলল,
‘ চলো, এক কাপ চা খাওয়া যাক। আমার এক প্রকাশক বন্ধু খুব ধরেছে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। তোমার একটা লেখা তার চাইই চাই। তোমার লেখায় সম্ভবনা আছে। এই বছরের মাঝামাঝিতে একটা বই নিয়ে আসো না?’
কাজের কথা শুনেই আরামপ্রিয় মৌনি ছাড়া পাওয়ার জন্য হাসফাস করে উঠল। তারওপর করতে হবে নাকি লেখালেখি! মৌনি লিখে ঠিক। ভালোওবাসে। কিন্তু ওমন টাইমটেবল ঠিক করে লিখতে বসা তার জন্য অসম্ভব। মৌনি তাড়া দিয়ে বলল,
‘ এই বিষয়ে অন্য কোনোদিন কথা হবে ভৌমিক দা। আজ একটু তাড়া আছে।’
ভৌমিক বলল,
‘ সে নাহয় হলো। তোমার লেখা সাহিত্য সমাজে যে ঝড় তুলেছে জনপ্রিয়তার আতিশয্যে আমাদের ভুলে যাবে না তো? প্রথম বইটা কিন্তু আমাদের প্রকাশনী থেকেই এনো। আমার বন্ধুর কাজ চমৎকার।’
মৌনি ক্লান্ত হয়ে বলল,
‘ আমি চাইলেই লিখতে পারি না ভৌমিক দা। জোর করে লিখলে সেই বারুদটা আর থাকবে না।’
ভৌমিক বলল,
‘ আহা! নতুন লেখা নাহয় তুমি সময় নিয়ে লিখো। পত্রিকায় তোমার যে ধারাবাহিক উপন্যাসটা চলছে সেটাকে কাটছাঁট করে…’
সেই প্রস্তাব ঝুলিয়ে রেখে একরকম পালিয়েই বাড়ির পথ ধরল মৌনি। ভৌমিক দা গোটা মেজাজটাই নষ্ট করে দিয়েছে। আজ আর নীলক্ষেত যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার থেকে বরং বাড়ি ফেরা যাক। আগামী দশদিনে তার অনেক কাজ। তিনটা প্রচ্ছদ, দুটো খবরের কাগজে কার্টুন, একটা কাগজের ফিচার। এর মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে শুরু হবে পরীক্ষা। সে আরেক যন্ত্রণা। ক্লাসের হাজিরা রেজিস্টারে সে খুব সম্ভবত ডিসকলেজিয়েট৷ সেভেন্টি ফাইভ পার্সেন্ট উপস্থিতি তার নেই। স্যারদের গলিয়ে কোনোভাবে পরীক্ষায় বসে যেতে পারলে অবশ্য মিষ্টির নোট মুখস্থ করে পাশটাশ করে ফেলবে মৌনি। কিন্তু পরীক্ষায় বসতে পারার ব্যবস্থা করাটাই তো মুশকিল! মৌনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে আর দুশ্চিন্তা করবে না সে। আজ হবে তার ‘ অতি নিশ্চিন্ত দিন’। আগামী দশদিন নিজেকে গাধার খাটুনি খাটানোর পুরষ্কার স্বরূপ আজ নিজেকে ট্রিট দিবে মৌনি।
বাড়ি ফিরে কুসুম গরম পানিতে গোসল নিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিবে। ফুডপাণ্ডায় মাটন বিরিয়ানি অর্ডার করে পেট ফুলিয়ে খাবে। চমৎকার একটা বই পড়বে। ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখ কেটে দিয়ে লেখা হবে মৌনির নাম। মৌনি শিষ বাজাতে বাজাতে একটা রিকশার সন্ধান করল। আজ সে নিজেকে আরামে রাখবে। বাসের ধাক্কাধাক্কি তার কোমল শরীরের জন্য আজ বরদাস্ত করা হবে না।
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে এখন লাঞ্চের সময় চলছে। খাওয়ার সময় ছুরি, কাঁটা চামচ দিয়ে প্লেটের সঙ্গে কোনোরূপ টুংটাং আওয়াজ নিষেধ। শাওন ছুরি, কাঁটা, চামচ সামলে নিঃশব্দে খাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হচ্ছে না। মাঝেমাঝেই টুংটাং আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে। যতবার আওয়াজ হচ্ছে ততবারই তার বিমর্ষ মুখ আরও বিমর্ষ হয়ে ওঠছে। সামান্য ছুরি-কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া শিখতেই যেখানে ঘাম ছুটে যাচ্ছে সেখানে এতো কঠিন কঠিন ট্রেনিং! হাড় মাংসে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তার থেকেও বড় সমস্যা এখানে আর মন টিকছে না শাওনের। কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে পারছে না। প্রায় প্রতিদিনই সিনিয়র অফিসারদের থেকে বিশ্রী রকম র্যাগিংয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যার পর তাদের ঘরে দু'জন সিনিয়র র্যাগ দিতে আসতেই কথায় কথায় শাওনের উদাস থাকার কারণ বলে দিয়েছে বেয়াদব ইমাদ। শাওনের একপাক্ষিক প্রেমের গল্প শুনে তারা খুবই আমোদিত হয়েছে। মৌনি দেখতে কেমন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে সেই আমোদ আরও বাড়ানোর নির্দেশ এসেছে শাওনের ওপর। শাওন প্রথমে সে নির্দেশ পালন না করায় যে ভয়ংকর এবং বিশ্রী অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে কথা মনে হলে, শাওনের ইচ্ছে হয় এক্ষুনি এই জেলখানা থেকে বেরিয়ে যায়। শাওনকে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করল ইমাদ,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
শাওন ইমাদের দিকে একবার কড়া চোখে তাকাল। উত্তর দিল না। সেই র্যাগের ঘটনার পর দু'দিন হলো ইমাদের সাথে সে কথাবার্তা বলে না। ইমাদ আর ঘাটাল না। খাওয়া শেষে ডাইনিং থেকে বেরিয়ে অ্যান্টি রুমে এসে খবরের কাগজের পাতা উল্টাতেই সিন্দাবাদের ভূতের মতো আবারও এসে হাজির হলো সে। শাওনের মুখোমুখি বসে বলল,
‘ ওহ ম্যান, এখনও রেগে আছ তুমি? আই টোল্ড ইউ সরি আ হান্ড্রেন্ড টাইমস্।’
শাওন উত্তর দিল না। খবরের কাগজের সাহিত্য পাতায় হঠাৎ গাঢ় হয়ে এলো তার দৃষ্টি। শাওন কখনও এসব উপন্যাস, ছোটগল্পের প্রতি আগ্রহ পায় না। আজ যেন চম্বুকের মতো চোখ বুলিয়ে গেল প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অক্ষরে। ইমাদ তার এই গাঢ় মনোযোগ দেখে সাহিত্য পাতার উপর উঁকি দিয়ে আগ্রহ নিয়ে শুধাল,
‘ হোয়াট আর ইউ রিডিং? ইজ ইট ভেরি ইন্টারেস্টিং?’
শাওন আনমনা হয়ে বলল,
‘ এটা মৌনির লেখা ছোটগল্প।’
ইমাদ চোখ বড়বড় করে তাকাল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘ মৌনি! ইউ মিন, দ্যাট গার্ল? ইজ শী আ রাইটার?’
‘ ইয়াহ। সে একই সাথে লেখক আর চিত্রকার।’
ইমাদ হর্ষধ্বনি করে উঠল। তার বিস্ময় চিৎকার এতোটাই জোরালো হলো যে আশপাশ থেকে অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাল। একজন সিনিয়র গলা বাড়িয়ে শুধাল,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড ইমাদ?’
পেট পাতলা ইমাদ খবরের কাগজটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে প্রায় ঘোষণা দেওয়ার মতো করে বলল,
‘ শাওন যে মেয়েটিকে ভালোবাসে তার লেখা বেরিয়েছে কাগজে। শী ইজ আ রাইটার।’
শাওন হতাশ চোখে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটির জন্য সবসময় বিপদে পড়তে হয় তাকে। সেদিন ওমন ভয়ংকর র্যাগ খেল। প্রায় পুরো একাডেমিতে তার নাম ছড়িয়ে গেল ‘রোমিও’। আর আজ আবার এই সংবাদপত্র সমাচার! শাওন ভেবেছিল সবাই মিলে এই নিয়েও খুব তামাশা করবে। কিন্তু শেষমেশ সেরকম কিছু হলো না। সবাই খুব হৈ-চৈ করে মৌনির লেখা পড়ল এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা করল। একজন দারুণ ঔপন্যাসিক তার জীবনসঙ্গী হতে চলেছে এই সুবাদে এক সিনিয়র ঘোষণা দিলেন, শাওনকে দুই মিনিটের জন্য তার প্রেমিকার সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তিনি করবেন। মিলিটারি একাডেমির কাঠখোট্টা রুলস আর ট্রেনিংয়ের মধ্যে দীর্ঘদিন পর একটা আমোদের বিষয় পেয়ে হৈহৈ করে উঠল সবাই। শাওনকে যখন সত্যিই এই সুযোগটা করে দেওয়া হলো। একটা সরকারী মোবাইল ফোন তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, কল হার। তখনও শাওন যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারল না। দুইদিন পর এমনিতেও দুই মিনিটের জন্য বাড়িতে কল করার সুযোগ সে পেতো। কিন্তু সেই সুযোগ এতো দ্রুত চলে আসায় হৃৎস্পন্দনের গতি পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল তার। সবার থেকে একটু আড়ালে গিয়ে মৌনির নাম্বারে ডায়াল করল সে। একবার, দু'বার, তিনবারেও মৌনিকে ফোনে পাওয়া গেল না। সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার হতাশায় মুখ কালো হয়ে গেল শাওনের। অন্যান্য সময় শাওন মৌনির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে। কিন্তু আজ যে সময় বাঁধা। দুই মিনিটের মধ্যে এক মিনিট ইতোমধ্যে অতীত। শাওনের গলা শুকিয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘প্লিজ মন, পিক আপ দ্য কল। প্লিজ!’ চারবারের চেষ্টায় অবশেষে ওপাশ থেকে রিনরিনে কণ্ঠটা ভেসে এলো। কণ্ঠে এক টুকরো গাম্ভীর্য নিয়ে শুধাল,
‘ হ্যালো। কে বলছেন?’
পৃথিবীর কাছে এ এক সাধারণ কণ্ঠ। কিন্তু শাওনের কাছে মনে হলো সুর। যে সুর শুনবে বলে
শুকিয়ে গিয়েছিল তার বুক। নিজেকে সামলে উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হলো শাওনের। তার মধ্যেই ওপাশ থেকে দমবন্ধকর প্রশ্ন এলো,
‘ শাওন?’
মৌনি তাকে চিনে ফেলেছে এই সুখে আদ্র হয়ে এলো শাওনের মন। আবেগ না লুকিয়ে বলল,
‘ তোমাকে কতক্ষণ দেখি না, জানো মন?’
মৌনি থমকাল। শাওনের আবেগে চুবানো কাতর স্বর তার বুকের ভেতর অব্দি ভিজিয়ে দিয়ে গেল। এতোদূর একলা পড়ে থাকা ছেলেটির মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে হলো না। শাওনের কথার প্রত্যুত্তর না করে উচ্ছল কণ্ঠে ডাকল,
‘ শাওন! শাওন! শাওন!’
শাওনের চোখ টলমল করে ওঠল। মৌনি এভাবে আবদার ঢেলে ডাকলেই অনুভূতির আতিশয্যে মরে যেতে সাধ হয় তার। শাওন মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘ বলো মন।’
‘ তোমাকে একটা গান শোনাই শাওন?’
মৌনি গান গাইতে পারে এই খবর শাওনের জন্য নতুন। সে বলল,
‘ শোনাও।’
সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো মৌনির দরদ ঢালা কিণ্ণর কণ্ঠ,
‘ আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি।
তোমায়-
দেখতে আমি পাইনি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয় মাঝে চাইনি।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে
তোমায় দেখতে আমি পাইনি…’
মৌনি এতো চমৎকার গান গায়! এই গানে পর। এই উপচে পড়া সুরের পর শাওনের বলতে ইচ্ছে হলো, ‘আই লাভ ইউ মন। আই লাভ ইউ।’ কিন্তু বলতে হলো,
‘ এবার রাখতে হবে মন।’
মৌনির হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে বলল,
‘ বাট আই স্টিল মিস ইউ শাওন।’
শাওন কিছু না বলে ফোন কাটল। তার চোখ ভার, মন ভার। এখানে তার একদম ভালো লাগছে না। কবে শেষ হবে এসব? কবে যাবে সে মায়ের কাছে, মৌনির কাছে? ফোন জমা দিয়ে দেওয়ার পর তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল ইমাদ। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ কী সাংঘাতিক! তুমি কী কেঁদে টেদে ফেলবে নাকি শাওন?’
শাওন উত্তর দিল না। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই বলেই চোখের ব্যারিগেড ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারছে না অশ্রুরা। শাওন আকাশের দিকে স্থির চেয়ে রইল। ইমাদ আলতো করে তার কাঁধ চাপড়ে দিল। শাওন শুধাল,
‘ ইমাদ? তুমি কী জানো? প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলার তৃষ্ণা কখনও কখনও পানির তৃষ্ণাকেও ছাড়িয়ে যায়?’
ইমাদ মাথা নেড়ে বলল,
‘ এই ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই শাওন। তবে মৌনির প্রতি তোমার তৃষ্ণা পানির তৃষ্ণাকে ছাপিয়ে গেলেও আমি আশ্চর্য হব না। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ ভালোবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তুমি সেই ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। ইউ আর অবসেসড উইদ হার।’
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
২০তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন