উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


২১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ২২)


‘আমার সারাটা দিন
মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।’
শ্রীকান্ত আচার্যের গানের সঙ্গে শ্যামলা গড়নের পুরুষটি মিলেমিশে গভীর এক মায়া বনে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ঘুম ছুটে গেল মিথির। ঘুম ভেঙে সে প্রথম শুনল গাঢ় বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টির কলতানের সাথে সুর মিলিয়ে গাইছে শ্রীকান্ত,
‘ আমার সারাটা দিন…’
মিথি ধীরে ধীরে উঠে বসল। দীর্ঘ ঘুমের পর মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে। বাদামি চোখদুটো ফুলে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে পিঠের ওপর। কয়েক গাছি চুল দুষ্টুমি করে নাচছে তার কপোলে। মিথি অলস চোখে তাকিয়ে আছে বৃষ্টিস্নাত জানালাটির অভিমুখে। বাইরের অবিরাম বৃষ্টি তাকে উড়ন্ত শিমুল তুলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে সেই অপমানজনক সন্ধ্যার তীরে। অপমানগুলো পাশ কাটিয়ে তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে একটা দীর্ঘকায় পুরুষ ছায়া। পুরুষটি ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তার চশমার কাচ। সেই ঝাপসা চশমায় ঢাকা চোখে হিজল ফুলের মতো ভাসছে মুগ্ধতা। মিথির বুকের ভেতরটা চনমন করে উঠে। হাত বাড়িয়ে একবার সেই সরল মুখখানাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। মিথি দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ। মান-অপমান, সম্পর্ক, বিচ্ছেদ সকল কিছুর বাইরে গিয়ে সে টের পায় নতুন অথচ তীব্র এক অনুভূতি। বুকের ভেতর কাউকে দেখতে চাওয়ার অসহ্য কষ্ট। সেই কষ্ট তাকে জানিয়ে দেয়, কত গভীরভাবেই না ভুল সময়ে ভুল এক মানুষের প্রেমে পড়েছে সে। জীবনে প্রথমবার একটি পুরুষের কথা ভেবে খা-খা করে উঠছে হৃদয়। তার বৃষ্টিস্নাত গালে হাত না রাখতে পারার তৃষ্ণায় ছটফট করছে বুক। অথচ সেই পুরুষের কাছে সে অনাহুত অতিথি মাত্র। যে অতিথি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলে তাকে আর ডাকতে ইচ্ছে হয় না। যার জন্য কভু মন কাঁদে না। কিন্তু যদি একবার মন কাঁদত? একবার যদি সে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মিথি বলে ডাকত? বিধাতা জানেন, বেশরমের মতো পুরো পৃথিবী একপাশে রেখে, মান-অভিমান তুচ্ছ করে মিথি ঠিক তার পানেই ছুটে ছুটে যেত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই কণ্টকময় জগতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে ডাকার মানুষ তার নেই। সে একলা। একলা চলতে হবে বলেই তার জন্ম। মিথি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতেই হাঁটু আর কনুইয়ের ব্যথার থেকেও তীব্র এক অনুভূতি টের পেল তার পুরন্ত ঠোঁটে। সেই রাতের সেই উষ্ণ স্মৃতি কাঁপিয়ে দিল তার প্রতিটি রোম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ঠোঁটের কোণে এখনও বুঝি লেগে আছে সেই আদরের লালিমা। মিথির খুব করে মনে আছে, সেইদিন সেই রাতের সেই ঘোর তার একলার ঘোর ছিল না। কিছু উষ্ণতা সাব্বিরেরও ছিল। ভীষণ কামনায় মিথিকে সে কাছে টেনেছিল। কিন্তু তারপর…! সাব্বির কী তবে অন্য কাউকে ভালোবাসে? কারো প্রগাঢ় অনুভূতির কাছে চাহিদারা হেরে গিয়েছিল বলেই কী সেই আকস্মিক প্রত্যাখান? মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এমন হলে সাব্বিরকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা সে নিশ্চয়ই করবে। নিজের নামের সাথে অকারণে কাউকে আটকে রাখার পক্ষপাতী সে নয়। মিথি দীর্ঘ একটা গোসল নিয়ে এফডিসিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। সকালের খাবার খেতে বসতেই কোথা থেকে উড়ে এলেন খালামণি। মিথির পাতে নরম খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘ তোর জামাইয়ের নাকি ভয়ংকর অসুখ?’
মিথি খাবার মুখে তুলতে গিয়েও এক সেকেন্ডের জন্য থামল। চট করে মনে পড়ল, সাব্বিরের অসুস্থতার কথা। ইশতিয়াক ফোন করেছিল গতকাল তারপর…। মিথি কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে খেতে লাগল। মুখটা নির্বিকার করে রাখলও মনে মনে সে সাব্বিরের খবর পেতে আগ্রহী। ভয়ংকর অসুখ মানে কী? কী হয়েছে তার? খালামণি কী কিছু জানেন? খালামণি অবশ্য সে উত্তর দিলেন না। তিনি ঝাঁঝ নিয়ে বললেন,
‘ তোর দাদার পুরো গোষ্ঠী নাকি এসেছিল হাসপাতালে জামাইকে দেখতে। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে ময়মনসিংহ। এই মীরপুরে আমার বাস অথচ কেউ আমাদের একবার খবর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না? তুই তার বউ, তোকে একবার কোনো খবর দিছে তোর দাদাজান? এই বুড়ার মনে কত বিষ দেখেছিস? ছোটবেলা তোকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়ে তোকে বুঝাল, আমরা তোর আপন কেউ না। তোর খেয়াল রাখতে পারি না। এখন জামাইকে আমাদের থেকে দূর করার চেষ্টা। বুড়া মানুষ বুড়া মানুষের মতো থাকবে। তার মনে এতো বিষ কেন?’
মিথি খাওয়া থামিয়ে খালামণির দিকে তাকাল। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,
‘ তোমরা তো আসলেই আমার খেয়াল রাখতে পারোনি খালামণি। তোমরা কেউ কখনও একটা ঘর দিতে পারোনি আমাকে। নিজের ঘর। আমি সবসময় ভেসে বেড়িয়েছি জলে ভাসা পদ্মর মতো। তোমাদের জামাই কোনো অমৃতের চিজ না যে দাদাজান তাকে তোমাদের থেকে দূরে নিলে দাদাজানের স্বার্থ হাসিল হবে। তাছাড়া ভদ্রলোকের অসুখের কথা আমি জানতাম।’
খালামণি মিথির কঠিন কঠিন বাক্যে ব্যথিত হলেও শেষ কথাটায় চমকে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন,
‘ জামাইয়ের অসুখের কথা তুই জানতি!’
খাবারের স্বাদ ঘেঁটে গিয়েছে মিথির। জ্বর জ্বর লাগছে, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তারপরও নির্বিকারমুখে খাওয়া শেষ করার চেষ্টা করল। মাথা নেড়ে বলল,
‘ হু, জানতাম।’
খালামণি বিস্মিত হয়ে বললেন,
‘ জানতি! জানতি তো ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমালি কেন? আমাকে একবার জানাতে পারতি। জামাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পড়ে আছে আর মেয়ে বাড়িতে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। এই মেয়েকে নিয়ে আমি করব কী! এভাবে তোর সংসার টিকবে?’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ সবার সংসারই যে টিকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই খালামণি। আমার এসব সংসার টংসারে মন নেই। আর এতো হৈ-চৈ করছ কেন? আমি বা তুমি না যাওয়ায় ভদ্রলোক নিশ্চয় মরে যাননি? ঠিকই দাদাজানের বাড়িতে আরাম আয়াশে দিন কাটাচ্ছে। তোমার আমার হৈ-চৈ এ তার কিচ্ছু আসবে যাবে না। অযথা চেঁচামেচি করবে না।’
সারদা হতাশ চোখে ভগ্নী-কন্যার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নরম স্বরে বললেন,
‘ জীবনে ক্যারিয়ার, টাকা-পয়সাই সব না রে মা। জীবনে সবথেকে বড় পাওয়া হলো, একটা মানুষ পাওয়া। এই যে তুই বললি তোর নিজের কোনো ঘর নেই। টাকা দিয়ে চার দেওয়ালে ঘেরা একটা বাসা কিনে ফেললেই সেটা ঘর হয় না। ছোটবেলায় তোকে একটা ঘর দিতে পারতেন তোর বাবা। আমরা ভুল করেছি, তোর আত্মভোলা বাবাকে সেই সুযোগই দেইনি আমরা। এখন তোকে একটা নিজের ঘর দিতে পারে হাসপাতালে শুয়ে থাকা ওই লোকটা। আমাদের মতো ভুল তুই করিস না। ছেলেটাকে সুযোগ দে। গ্রীষ্মের দাবদাহে চারা গাছের বেঁচে থাকা কঠিন। তাই বলে কী তাতে পানি দিয়ে একটু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাও করা যাবে না?’
মিথি আর খেতে পারল না। প্লেটটা সামনে থেকে সরিয়ে রেখে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল। খালামণির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বলল,
‘ আমাকে নিয়ে ভেবো না। কেউ আমাকে নিয়ে ভাবছে। এসব আমার পছন্দ না।’
অথচ তার মন বলল, গাছটাকে আমি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম খালামণি। সব গাছ বোধহয় সবার থেকে জল চায় না। আমি সেই অভাগা যার হাতের জল গাছের দুনিয়ায় অস্পৃশ্য। এই অস্পৃশ্য ভাগ্য নিয়ে কোথায় আমি ঘর খুঁজি বলো তো?
_______________
বাইরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টি বাদলার দিনে নাহিদের ঘুম ভালো হয়। কাঁথা মুড়ি দিয়ে টানা দশ বারো ঘন্টাও সে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ তার ঘুম ভালো হচ্ছে না। বিছানায় গিয়ে কিছুটা তন্দ্রাভাব এলেই বিছানার কাছে কাঠের টুলের উপর বসে থাকতে দেখছে একটা বাচ্চা ছেলেকে। ছেলেটির গায়ে লাল শার্ট, গাঢ় নীল হাফপ্যান্ট। চুলগুলো সুন্দর করে আচড়ানো। পায়ে ল্যাদার ম্যাকারুন জুতো। ফিটফাট, পলিশ চেহারা। চোয়ালে আভিজাত্যের অহংকারটা বোধহয় বংশগত। নাক, ঠোঁট, দেহাবয়বেও নাহিদের ছাপ স্পষ্ট। শুধু চোখদুটোর দিকে তাকালে নাহিদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কেবল মনে হয়, এই চোখদুটোর আসল মালিক যে তাকে নাহিদ কতোই না ভালোবাসে! কিন্তু কে সে? নাহিদ জানে না। ওই চোখদুটোর মায়াতেই ছেলেটাকে আচ্ছা করে ধমকে স্বপ্নে আসার সাধ মিটিয়ে দিতে পারে না। আজও চোখদুটো লেগে আসতেই ছেলেটা এসে উপস্থিত। ওই তো, জীবন্ত পুতুলের মতো পা ঝুলিয়ে বসে আছে টুলের ওপর। প্রতি দিনের মতোই তার মুখ ভার। নাহিদ তার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে ধমক দিল,
‘ কী সমস্যা তোর? তোকে কতবার বলেছি যে আমার কাছে আসবি না?’
ছেলেটি প্রত্যুত্তরে মুখ ভার করে বসে রইল। নাহিদের খানিক মায়া হলো। ছেলেটি যে তারই সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা কী রকম হয় সে সম্পর্কে ধারণা নেই নাহিদের। তারপরও এই ছেলেটির মন খারাপ দেখলে তার মন খারাপ হয়। বুকে নিয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছে হয়৷ ঘুম ভাঙলেও তার মন খারাপের ভারে কেমন খা-খা করে বুক৷ নাহিদ একটু নরম হয়ে বলল,
‘কীরে বাপ? মুখ ভার করে বসে আছিস কেন? তোর মা মেরেছে?’
লাল টুকটুকে শার্ট আর গাঢ় নীল রঙের হাফপ্যান্ট পরে বসে থাকা বছর চারেকের ছেলেটি নাহিদের দিকে মুখ ফুলিয়ে তাকাল৷ শান্ত, গৌরবর্ণ মুখখানা একেবারে নাহিদেরই অনুরূপ। টোপা টোপা কচি গালে অভিমান জনিত লালিমা। কপোলের টোল, চিবুকের তিল সব একেবারে জায়গা মতোন। শুধু বড় বড় ছলছলে চোখদুটো দেখলে মনে হয়, এই ছেলে মা বলতে অন্ধ। বাবুন অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘ মা আমাকে কখনও মারে না।’
নাহিদ ভ্রু কুঁচকাল। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ওহ, তোর মা তো আবার মহামানবী প্রজাতির প্রাণী। বাচ্চা-কাচ্চাকে ধরে কয়েকটা ঢলা না দিলে সে আবার মা হয় কী করে? নিজে একটা বেকুব। দিনদিন বানাচ্ছেও আরেকটা বেকুব।’
বাবুন বলল,
‘ মা বেকুব না। খুব বুদ্ধিমতী। মা বলে, আমি তোমার মতো হয়েছি। তোমারও অনেক বুদ্ধি। মা আমাকে কঠিন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তোমার ভালো ভালো গুণগুলো রেখে বাকিগুলো ছেঁটে ফেলে দেওয়ার প্রশিক্ষণ।’
নাহিদ বাবুনের মায়ের সম্পর্কে বিশেষভাবে আগ্রহী হলেও এইবার ক্ষেপে গেল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ কী! তোর মা আমাকে ছেঁটে ফেলে দিতে বলেছে? আমাকে! কত বড় সাহস! আর তুইও এই অবিচার নেচে নেচে মেনে নিচ্ছিস? কেমন ছেলে তুই? একজন তোর বাপের মানসম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে অথচ নো প্রতিবাদ? তুই তো ছেলে নামে কলঙ্ক। ’
বাবুন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি অযথা রেগে যাচ্ছ বাবা। মা তো আর ভুল কিছু বলেনি।’
নাহিদ আরও ক্ষেপে গেল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ তোর মা ভুল কিছু বলেনি? আর আমি যা বলি সব ভুল? মায়ের চামচা কোথাকার!'
বাবুন থমথমে মুখে বলল,
‘ সব ভুল না হলেও মোটামুটি ভুল। মা বলে, তুমি মানুষ হিসেবে দশে দশ। কিন্তু যে স্ত্রীকে কষ্ট দেয় তার সব নাম্বার জিরো। যার সব নাম্বার জিরো সে কী করে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক হয়?’
নাহিদ কিছুটা শান্ত হলো। গম্ভীরমুখে ছেলের দিকে তাকাল। শুধাল,
‘ আমি তোর মাকে কষ্ট দিই?’
বাবুন মাথা নাড়ল। নাহিদ শুধাল,
‘ কী করে কষ্ট দিই?’
বাবুন উত্তর দিল না। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ কাউকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই বাবুন। তোর মা মিছে কষ্ট পাচ্ছে।’
বাবুন এবার বড় বড় ছলছল চোখে নাহিদের দিকে তাকায়। কচি ঠোঁটদুটো টিপে কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করে শুধায়,
‘ তুমি মাকে ভালোবাসো না কেন, বাবা?’
সেই ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে নাহিদের বুক ভার হয়ে আসে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, বাবুন নয় বাবুনের মা’ই যেন কাঁদছে গাঢ় অভিমান নিয়ে। গভীর স্বপ্নের মধ্যেও নাহিদ তীব্রভাবে অনুভব করে, এই রমণীর চোখের জল সহ্য করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। সে কাঁদলে নাহিদের অস্থির লাগে। নাহিদ অস্থির হয়ে বলতে চাইল,
‘ বিশ্বাস কর বাবুন, তোর মাকে আমি পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসি।’
কিন্তু তার আগেই ফোনের তীব্র আওয়াজে খন্ড হলো স্বপ্নের সুর। মাথার ভেতর ভোঁতা একটা ব্যথা দিয়ে মিলিয়ে গেল বাবুন। নাহিদ ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশ হাতড়ে উদ্ধার করল মোবাইল ফোন। ফোনটা এখনও বাজছে। নাহিদ কিছুটা বিরক্ত হলো। স্ক্রিনে মিষ্টির নাম্বার দেখে একহাতে কপাল চেপে ধরে ফোন ওঠাল। চোখ বন্ধ রেখেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যালো জান।’
মিষ্টি একটু ইতস্তত করে শুধাল,
‘ কী করছ?’
‘ ঘুমুচ্ছি।’
‘ ওহ্! তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। তুমি ঘুম থেকে উঠে কল করো?’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
‘ আমার ঘুম এমনিতেও ভেঙে গিয়েছে। তুমি বলো কী বলবে?’
মিষ্টি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ নাহিদ আমি আর আমাদের সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে চাইছি না। আমাদের ভেতরে আসলে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই উচিত। ’
নাহিদ সহজ কণ্ঠে বলল,
‘ ওকে। আর কিছু?’
নাহিদকে এতো সহজে মেনে নিতে দেখে অবাক হলো মিষ্টি। অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ তুমি শুনেছ, আমি কী বলেছি?’
নাহিদ শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ, মিষ্টি। আমি শুনেছি। ইউ ওয়ান্ট টু ব্রেক আপ উইদ মি। তোমার কী আর কিছু বলার আছে মিষ্টি? আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি কী ফোন রেখে দিব?’
মিষ্টি মৃদু কণ্ঠে বলল,
‘ রেখে দাও।’
নাহিদ ফোন কেটে মাথার উপর বালিশ চেপে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল। বাবুনের মন খারাপের রেশটা কাটেনি বলেই কি-না কে জানে মিষ্টির এই প্রস্তাব নাহিদকে খুব একটা আন্দোলিত করতে পারল না৷ বোধশক্তিহীনের মতো শুয়ে রইল কেবল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো, চার বছরের দীর্ঘ একটি সম্পর্ক এভাবেও শেষ হয়ে যায়? মিষ্টিকে ঠিক কী দেয়নি সে? কীসের অভাব ছিল?
_____________
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে…
কিছুতে কেন যে মন লাগে না, লাগে না।’
বিছায়ায় উপুর হয়ে শুয়ে কণ্ঠে সুরের হুল্লোড় তুলে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে মৌনি। আজ তার মন ভালো। বৃষ্টির সাথে মৌনির মন ভালো থাকার প্রগাঢ় একটা সম্পর্ক আছে। বৃষ্টি যত গাঢ় হয় মৌনির মন ভালো তত মাত্রা ছাড়ায়। মন ভালোর দিনে তার কোনো বই টই পড়তে ইচ্ছে হয় না। সেদিন সে রঙ-তুলি নিয়ে বসে। আজ রঙ-তুলি নিয়েও বসতে ইচ্ছে করছে না। বুকের ভেতর অস্থির আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে কোথাও খুব ভালো কিছু হচ্ছে। সেই অজানা আনন্দের রেশে মৌনির কাউকে ঝাপটে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভয়ংকর সমস্যা, তার ঝাপটে ধরে চুমু খাওয়ার মানুষ নেই। মৌনি তৎক্ষণাৎ একটা বরের অভাববোধ করল। দাদাজান সবাইকে ধরে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয় কিন্তু যাদের আসলেই দরকার তাদেরকে বিয়ে দেওয়ার খোঁজ নেই। কেন, মৌনিকে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে না? মৌনির বিয়েতে আগ্রহ নেই ঠিক। কিন্তু ধরেবেঁধে দিয়ে দিলে তো আর মৌনির কিছু করার থাকবে না? তখন কী চমৎকার ব্যাপার হবে! চাইলেই চট করে কাউকে চুমু খেয়ে ফেলা যাবে। মৌনি বই খোলা রেখেই আনন্দ নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখতে বসল। এই স্বপ্ন মাথায় নিয়েই সে চা বানাল। গাঢ় নীল রঙের একটা জামদানি পরে চায়ের কাপ হাতে অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে আরও একবার বরের অভাববোধ করল। তবে এইবার বরের একটা ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে ফেলেছে, বরকে অবশ্যই খুব লম্বা হতে হবে। যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাইলেই হাত বাড়িয়ে পেরে ফেলতে পারবে গুচ্ছ গুচ্ছ কদম। গুঁজে দিবে মৌনির চুলে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা, কেউ তার বিয়েশাদির কথা চিন্তায় করছে না। বিপদ! বিপদ! মৌনি বিয়ে না হওয়ার মন খারাপে শাড়ি পাল্টে ঢু দিল নীল-সাদার দুনিয়ায়। কিছুক্ষণ স্ক্রল করতেই সামনে এলো নাহিদের পোস্ট। নাহিদ লিস্টে দুনিয়ার আত্মীয় স্বজন রেখে পোস্ট করেছে,
' ওয়েদার ডিমান্ডস্ থার্টি সিক্স-টোয়েন্টি ফোর-থার্টি সিক্স।'
কমেন্ট বক্সে নাহিদের বন্ধু বান্ধবের সাথে তার ভাইগণেরও সরব উপস্থিতি দেখা গেল। সবগুলোর অশ্লীল মন। ইশতিয়াক লিখেছে,
' বৃষ্টির দিন এলেই তোদের এই অঙ্ক গবেষণার বিষয়টা ভালো। দেশটা চির বর্ষাকাল হোক।'
আরিফ তার উত্তরে যা লিখেছে তা ভদ্রসমাজে প্রকাশযোগ্য না। দিব্য লিখেছে,
' ভাই, তোমার তো আপাতত অভাব হওয়ার কথা না। এই গরীবের দেশে ওয়াদারের ডিমান্ড পূরণ করার মতো বড়লোক একমাত্র তুমি। নিজে ভোগ করো, দরিদ্রদের দান করো। মাঝে মাঝে মহান হতে হয়।'
নাহিদ সেখানে 'হা হা' দিয়ে উত্তর দিয়েছে,
' এই তোর অঙ্ক করার বয়স হয়েছে? বাড়ি গিয়ে আদর্শলিপি পড়।'
' সেটাই তো পড়তে চাইছি। মানে আদর্শলিপি আরকি! কিন্তু পাচ্ছি না তো ভাই!'
এই ছেলেদের হল্লায় বেকুব ঋতি এসে মন্তব্য করেছে,
' থার্টি সিক্স-টোয়েন্টি ফোর-থার্টি সিক্স কী নাহিদ ভাই? আজকের ওয়েদারের আপডেট?'
ঋতির মন্তব্যে হা-হা'র বন্যা বয়ে গিয়েছে। নাহিদ লিখেছে,
' না বইন। এটা অঙ্ক। আমরা সবাই মিলে অঙ্ক করছি। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ধরনের অঙ্ক। আমাদের ষড়ঋতুর দেশ। এই তিনটা সংখ্যাকেই ছয় দিয়ে ভাগ করা যায়। মজার না?'
ঋতি অবাক হয়ে লিখেছে,
' এটা মজার কী হলো, আশ্চর্য!'
মৌনি হেসে ফেলল। বিয়ের অভাব কেবল সে একাই বোধ করছে না ভেবে স্বস্তি পেল। নাহিদের টাইমলাইন থেকে বেরিয়ে কিছুদূর স্ক্রল করতেই দেখা গেল দাদাজানের এসিস্ট্যান্ট মিস্টার জহিরুল্লাহ নাহিদের সেই পোস্ট শেয়ার করেছেন দাদাজানের 'আমার পরিবার' গ্রুপে। ক্যাপশনে দাদাজানকে ট্যাগ করে লিখেছেন,
'জি স্যার। হিসেব ঠিক আছে। এতিমখানা আর বাড়ি মিলিয়ে আজ ছয়ত্রিশ কেজি চাল, চব্বিশ কেজি আলু আর ছয়ত্রিশ কেজি ডাল কেনা দরকার।'
সেখানে ভাই-বোনেরা হা-হা'র বন্যা বইয়ে দিয়েছে। নাহিদ চোখ উল্টানো ইমুজি দিয়ে মন্তব্য করেছে,
'কামডা করছেন কী!'
আরিফ মন্তব্য করেছে,
' হিসেব একেবারে খাপে খাপ।'
ইশতিয়াক ভাই লিখেছেন,
' মিস্টার জহিরুল্লাহ হিসেবে সবসময় পাকা। কনগ্রাচুলেশনস্। আমরা আপনাকে পেয়ে গর্বিত।'
বাকি ভাইবোনেরা ইশতিয়াকের মন্তব্য কপি করে পরপর এক, দুই জুড়ে দিয়েছে। মিস্টার জহিরুল্লাহ তাদের প্রত্যেককে গভীর বিনয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মৌনি মন্তব্য করল বারো নাম্বারে। মন্তব্য করার পর সে খেয়াল করল ফাঁকা ঘরে সে একাই দৈত্যের মতো হাসছে। মনটাও ধীরে ধীরে ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে, বর, কদম, চুমু কোনো কিছু নিয়েই আর মন খারাপ হচ্ছে না। মৌনি ফুরফুরে মনে ইজেল-ক্যানভাস নিয়ে বসল। আজ একটা মন ভালো মন ভালো ছবি আঁকা দরকার। এই মন ভালো ছবিটির নাম হবে, আজ ওদের মন ভালো নেই। অথচ, ছবিতে তারা সকলেই হাসবে। আশ্চর্য না?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন