উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


২২ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ২৩)


কাছে কোথাও ঘুঘু ডাকছে। শহুরে সাব্বির ঘুঘুর ডাক আগে কখনও শুনেছে কি-না মনে করতে পারছে না। এটা যে ঘুঘুরই ডাক এটাও সে জেনেছে এই বাড়ির বুয়ার থেকে। বুয়ার নাম, ফরিদা খালা। ফরিদা খালা ভয়ংকর বাচাল। সুযোগ পেলেই তিনি রাজ্যের গল্প নিয়ে বসেন। সদ্য জ্বর কাটিয়ে উঠা সাব্বিরের এইসকল গল্প শুনতে ভালো লাগে না। মাথার ভেতর ভোঁতা একটা ব্যথা নিয়ে নীরবে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। সাব্বির বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। বর্ষার মেঘ কেটে ঝুরঝুরে রোদ এসে পড়েছে জানালার কাছে। বাইরে জনা দশেক লোক মজুর খাটছে। গাড়ি থেকে বস্তায় বস্তায় কাঁচাবাজার, চাল-ডাল নামানো হচ্ছে। সাব্বির এই বাড়িতে থাকছে প্রায় দিন দশেক হলো। প্রথম কয়েকদিন তার কেটেছে অর্ধ-চেতন অবস্থায়। আবছা চেতনা ফিরলেই সে দেখেছে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক যুবক গম্ভীর মুখে তার দিকে ঝুঁকে আছে। যুবকটিকে সাব্বির চিনে না। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ছেলেটা হাসি হাসিমুখে জানিয়েছে, তার নাম আফজাল। দাদাজান গ্রামে একটা হোমপ্যাথি হাসপাতাল দেবেন বলে চিন্তা করছেন। আফজাল সেই হাসপাতালে হোমপ্যাথি প্রেকটিস করে। তার বর্তমান দায়িত্ব সাব্বিরকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখা। এই বাড়িতে এসে সাব্বির সবথেকে বেশি পেয়েছে যত্ন। সব সময় লোকারণ্যে ব্যস্ত এই বাড়িতে বিধাতা যেন ভালোবাসার এক সমুদ্দুর উপুড় করে দিয়েছেন। এই নিখাঁদ ভালোবাসা কুড়িয়ে বুক পকেটে রাখতে সাব্বিরের অস্বস্তির শেষ নেই। যার জন্য এই বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক সেই মেয়েটিকে মাঝরাত্তিরে ওমন অপমান করে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার পর তারই বাড়িতে বসে ঝিনুকের মতো সাদা সাদা ভালোবাসা কুড়ানো কী তার জন্য অপরাধ নয়? থেকে থেকে ভীষণ লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে সাব্বিরের। জীবনটা এখানেই শেষ। আর কখনও আকাশ দেখতে পাবে না, পৃথিবী দেখতে পাবে না, মিথির কাকচক্ষু চোখের দিকে তাকানোর সব পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিন্তা করে যে হৃদয় মিথিকে একটিবার দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। মৃত্যুর ফাঁদ কেটে যাওয়ার পর সেই হৃদয়ই চাইছে এই বাড়িতে, এই অবস্থায় মিথির সাথে তার দেখা না হোক। মিথি তাকে এতোটা লজ্জাহীন না ভাবুক। এই লজ্জা ছাড়া সাব্বিরের আর আছেই বা কী?
‘ জামাই বাবাজি, জুস লইয়াইছি। ফেরেশ ফলের জুস। ফল আইছে চন্দননগরের বাগান থাইকা। বড় ভাবির কড়া হুকুম। খাওনের লিস্টিতে কোনো হেরফের হওয়া যাইত না। খাওনের মধ্যেই সব চিকিৎসা।’
সাব্বির জবাব না দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ফরিদা খালার দিকে তাকাল। ফরিদা খালা ঠোঁটের কোণে রহস্য ঝুলিয়ে ফের বললেন,
‘ তয়, কাইল থাইক্যা আমার উপর হুকুম জারি বন্ধ। জুসের স্বাদ বাইড়া যাওনেরও সময় আইসা গেছে।’
সাব্বির এগিয়ে গিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। জুস না খাওয়া পর্যন্ত ফরিদা খালার অহেতুক গল্প চলবে এই ভয়ে গ্লাসটা তুলে নিল হাতে। কৌতূহল নিয়ে শুধাল,
‘ কেন? কাল থেকে কী স্পেশাল কোনো বাগান থেকে ফল আসবে খালা?’
ফরিদা খালা হেসে ফেললেন। বললেন,
‘ স্বাদ কী ফলে গো জামাই বাবাজি? সব স্বাদ হইল মোহাব্বতে। আপনে যত মোহাব্বত দিয়া খাওন বানাইবেন স্বাদ হইব তত বেশি। কাইল থাইক্যা পাবেন মোহাব্বতের হাতে খাওন। স্বাদ না বাইড়া যাইব কই?’
সাব্বির কথার অর্থোদ্বার করতে না পেরে সরল চোখে ফরিদা খালার দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদা খালা ব্যাপার বুঝতে পেরে বললেন,
‘ কাইল তো মিথি আপা গো আওনের দিন। গুরুপে দাদাজানের ইস্ট্যাটাস দেখেন নাই? দাদাজান তাগো হগ্গলরে আওনের আদেশ জারি করছেন। দাদাজানের এক ইস্ট্যাটাসে দেখবেন সব হাজির।’
সাব্বির গ্রুপের ব্যাপারটা ধরতে পারল না। তবে মিথি আসছে এই বিষয়টা বুঝল। সাথে সাথেই বুকের ভেতর মিশ্র এক অনুভূতি হলো। এতোদিন ধরে যে প্রশ্নটি বুকে জমিয়ে রেখেছিল, লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসা করতে পারেনি। আজ সেই প্রশ্নটা মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো। শুধাল,
‘ মিথির পা ঠিক হয়েছে?’
ফরিদা খালা অবাক হয়ে বললেন,
‘ মিথি আপার ঠ্যাং মা-শা-আল্লাহ খুবই সুন্দর। তার ঠ্যাং-এ আবার ঠিক হওনের কী আছে গো জামাই?’
মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে চেতনে অবচেতনে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ ঘটনাই সাব্বিরের মনে নেই। কিন্তু দাদাজান নিঁখুত চিন্তা নিয়ে মিথির যে দুঃসংবাদটা তাকে দিয়েছিল সে কথা তার মস্তিষ্কে কাঁঠালের আঠার মতো জড়িয়ে আছে। এই কয়েকদিনে যে প্রশ্নটা তার মাথায় সবথেকে বেশি ঘুরপাক খেয়েছে তা হলো, মিথি এখন কেমন আছে? সে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ কিছুদিন আগে এক্সিডেন্টে মিথির পা ভেঙে যায়নি?’
ফরিদা খালা ততোধিক বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ তওবা তওবা। আমাগো ওমন সুন্দর মিথি আপারে কে এক্সিডেন্টু করব? আল্লায় তার হাতে কিড়া দিব না? আমাগো মিথি আপা আল্লায় দিলে খুবই ভালো আছেন। এন্দে-ওন্দে দৌঁড়ঝাপ পাইড়া নাটক বানাইতাছেন। নাটক বানানি তো মুখের কতা না। কঠিন পরিশ্রমের কাম। নাটকের নায়ক হইল সাফাত মামুদ। আমাগো আপার সঙ্গে তার সে কী খাতির! একবার ঢাকা শহরে গেছি, রাস্তায় সাফাত মামুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। গাড়ি থামাইয়া তরমুজ কিনতেছে। আমি তার কাছে গিয়া ভয়ে ভয়ে কইলাম, আমি মিথি আপার পরিচিত। শুইন্যা কতোই না আপ্যায়ন করল। আপনার লগে বিয়া না হইলে। মিথি আপার বিয়া হইত ফিলিম ইস্টারের সঙ্গে। আপা তো আমাগো নায়িকার থাইক্যা কম সুন্দর না।’
সাব্বিরের মুখে ফ্রেশ জুসের স্বাদ মুহূর্তেই বিস্বাদ হয়ে গেল। মিথির সৌন্দর্য যে কোনো চিত্র নায়িকার থেকে কম নয় সে কথা সাব্বিরের থেকে ভালো কেউ জানে না। এখনও চোখ বন্ধ করলে নিজের টি-শার্ট গায়ে লাজুক মিথিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে। হাতে তার স্নিগ্ধ কদম ফুল। এই দৃশ্য হৃদয় থমকে দেওয়া সিনেমা দৃশ্য থেকে কম কীসে? আশ্চর্য এক বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে চেপে ধরল তাকে। খুব একটা নাটক-সিনেমা না দেখা হলেও সাফাত মাহমুদকে সে চিনে। গুণবান চিত্র নায়কের সাথে সাথে গ্রীক দেবতাদের মতো সুন্দর তার দেহাবয়ব। হুট করে দেখলে, তুর্কী যুবক বলে বোধহয়। তার সামনে সাব্বির এক ছা-পোষা বাঙালি। অত্যন্ত সাধারণ, কুণ্ঠিত এক বাঙালি। একটা ডাক্তারি ডিগ্রি ছাড়া গুণ বলতে তার কিছুই নেই। ওমন সুদর্শন যুবকদের সাথে মেলামেশা করা মিথির তাকে ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। ওমন বিশ্রী অপমানের পর আবার তার দিকে ফিরে তাকানোরও কোনো হেতু নেই। গাঢ় এক হীনম্মন্যতা ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলে সাব্বিরের সমস্ত হৃদয়। চিন্তা করে, মিথি আসার আগেই কোনোভাবে এই বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়া যায় না?
______________
মৌনির অ্যাপার্টমেন্টে আজ উৎসব উৎসব মহল। রান্নার আয়োজন চমৎকার। গলদা চিংড়ির মালাইকারি, মুরগীর রোস্ট, ছোট মাছের চচ্চড়ি, নারকেলের চিংড়ি, খুলনার চুই ঝাল, সিলেটের সাতকড়া, বেশি করে রসুন দিয়ে হাঁসের মাংস, মাটন থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মেজবানী মাংসের প্রিপারেশন পর্যন্ত সে করেছে। পানীয় হিসেবে রেখেছে বরিশালের মলিদা। গায়ে তার কালচে খয়েরী জামদানী শাড়ি। চোখে টানা কাজল। ডানহাতে ছোট ডায়ালের ঘড়ি৷ মৌনি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকের দিনটা সে কাটাবে উৎসবের মতো করে। হঠাৎ করে সে উপলব্ধি করেছে, সে দারুণ একটা মেয়ে। এই দারুণ মেয়েটি একদিন পৃথিবী ব্যাপী খ্যাতি ছড়াবে। এই চমৎকার মেয়েটির সাথে একটা চমৎকার লাঞ্চ সে ডিজার্ভ করে। কিন্তু তার ইচ্ছা ব্যাহত হলো। লাঞ্চে বসার আগেই মিষ্টির কল এলো। মৌনি একবার ভাবল ফোন ধরবে না, বন্ধ করে রেখে দিবে। তারপর কী মনে করে উঠাল। ফোন রিসিভ হতেই মিষ্টি ওপাশ থেকে উদগ্রীব কণ্ঠে জানাল,
‘ তোকে একটা নিউজ না দিতে পেরে পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি নাহিদের সাথে ব্রেকাপ করে ফেলেছি মৌনি।’
আচমকা এতো বড় একটা খবরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থবির হয়ে গেল মৌনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিৎকার করে শুধাল,
‘ কবে? কেন!’
মিষ্টি ম্লান কণ্ঠে বলল,
‘ দিন দশেক আগে।’
‘ কিন্তু কেন?’
‘ এমনি। কোনো কারণ নেই।’
মৌনি নিজের বিস্ময়কে কাবুতে এনে সহজ গলায় বলল,
‘ এমনি এমনি কারো ব্রেকাপ হয়? কোনো কারণ ছাড়া? ম্যাচ্যুয়াল ব্রেকাপ?’
‘ অনেকটা সেরকমই। আমি ফোন দিয়ে বললাম, নাহিদ আমি ব্রেকাপ করতে চাই। নাহিদ বলল, ওকে।’
মৌনি সবিস্ময়ে বলল,
‘ ইউ ব্রোক আপ উইদ হিম ওভার দ্য ফোন! সিরিয়াসলি? ব্রেক আপ এতো সহজ? আর নাহিদও মেনে নিল এতো সহজে? সে কোনো কারণ জিজ্ঞেস করল না? আশ্চর্য!’
মিষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমিও আশ্চর্য হয়েছি ওর রিয়েকশনে। হয়তো সত্যিই ওর আমার প্রতি কোনো অনুভূতি ছিল না। নয়তো এই কয়েকদিনে একবারও কী একটা কল অথবা ম্যাসেজ করার প্রয়োজনবোধ করত না?’
মৌনি শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ এই ব্রেকাপটা কী ঈশানের জন্য?’
পরমুহূর্তেই দুষ্টুমি করে বলল,
‘ তুই কী ঈশানের সাথে রিলেশনশিপে গিয়েছিস নাকি? ওহহো! দুইদিনেই এতো প্রেম বন্ধুউউ!’
মিষ্টি খানিকটা ব্যথিত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি এক সপ্তাহ নাহিদের কলের অপেক্ষা করেছিলাম। নাহিদ একবার চেষ্টাও করল না…’
মৌনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মানে, উত্তরটা হ্যাঁ। দূরে কোথাও নদীর তীর ভাঙার মতো একটা সূক্ষ্ম ভাঙন টের পেল মৌনি নিজের বুকে। বলতে ইচ্ছে হলো, যে ভালোবাসা স্বেচ্ছায় বিক্রি হয়ে যায়। তাকে কী ফিরে চাইতে আছে? কিন্তু বলা হলো না। পাছে বন্ধু অপমানিত হয় এই চিন্তায় সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে শুধাল ঈশানের কথা। দেখা গেল, ঈশান সম্পর্কে কথা বলতে মিষ্টির অপরিসীম আগ্রহ। এতো আগ্রহ কখনও নাহিদের প্রতি ছিল না তার। নাহিদকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত আলোচনা তাদের মধ্যে কখনও হয়নি। মৌনি আশ্চর্য হলো এটা ভেবে, নাহিদের সাথে দেখা করতে যে মেয়েটা সমাজের ভয় পেত। কেউ দেখে ফেলার ভয়ে বারবার রিজেক্ট করত। সে মেয়েটা এই কয়েকদিনের প্রেমে ঈশানের হাতে হাত রেখে হেঁটেও ফেলেছে। মিষ্টি মৌনিকে জানাল, ঈশান ভীষণ রোমান্টিক। কেয়ারিং। মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট খুব ম্যানলি। মৌনি মৃদু হাসি নিয়ে বন্ধুর উচ্ছ্বাসে সঙ্গ দিলেও ধীরে ধীরে মন ভার হতে লাগল নাহিদের জন্য। পরমুহূর্তেই মনে হলো, হয়তো সত্যিই নাহিদের মিষ্টির প্রতি কোনো অনুভূতি ছিল না। এই বিচ্ছেদ তার মতো ভবগন্ড মানুষকে খুব একটা ব্যথিত করতে পারবে না। নাহিদ তো কাউকে প্রাণ উজার করে ভালোবাসার মতো ছেলে না। তার কাছে সবই মজা। প্রেম নিয়ে সে খুব সিরিয়াস হয়ে যাবে এমন ভাবনা ভাবাও বোকামো। মিষ্টি একটা সিরিয়াস প্রেমিক চেয়েছিল। নিজের খুশি খুঁজে নেওয়া তো অন্যায় নয়। পরমুহূর্তেই অন্য একটা মন ব্যথিত হয়ে যায় বিষণ্ণতায়। মনে পড়ে, নাহিদের এফোর্টের কথা। হয়তো সিরিয়াস ছিল না নাহিদ। কিন্তু মিষ্টিকে কখনও অসম্মান করেনি। তাকে সবসময়ই সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মনের অন্য অংশ শুধায়, প্রায়োরিটিই কী জীবনের সব? মৌনি হতাশ হয়, হয়তো নয়। কিন্তু আরেকটু রেসপেক্টফুল ব্রেকাপ কী ছেলেটা ডিজার্ভ করত না? মনের ভেতরকার এই যুদ্ধ যুদ্ধ তিক্ততা নিয়ে মৌনির লাঞ্চ আর জমল না। কপালের টিপ তুলে ফেলল। চুল খোঁপায় বাঁধল। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে সব খাবার তুলে রাখল ফ্রিজে। মধ্যাহ্নভোজ চম্পট করে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়। পতাকার মতো উড়ল তার রঙিন আঁচল। মোলায়েম চুল। শহরের বুকে নেমে আসা ধূসর গোধূলি তাকে জানাল, এই শহরে ভালোবাসার রঙ ধসূর। প্রেমের নাম বিষণ্ণতা।
_____________
মিথিদের নাটকের শুটিং শেষ হয়েছে দিন দুয়েক হলো। এতো জল্পনা-কল্পনা, রিউমার, নিউজ পোর্টালের পর অবশেষে সমাপ্তির দ্বার ছুঁতে পাওয়া নাটক নিয়ে দেখা গেল সাফাতের আবেগের শেষ নেই। সে শুটিং ক্লোজের আনন্দে শুটিং ক্রুয়ের সকলের জন্য ট্রিটের ব্যবস্থা করে ফেলল। ট্রিট হিসেবে সাততারা হোটেলে মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত। সেই দাওয়াতে মিথি এলো গোলাপি একটা শাড়ি পরে। মিথির মুখটাও আজ দেখাচ্ছে অন্যান্য দিনের থেকে উজ্জ্বল। সাফাত দূর থেকে মিথিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে এলো কাছে। মিথি সবসময়ই পশ্চিমা পোশাক পরে আজ ঘটা করে শাড়ি পরবে এতোটা আশা করেনি সাফাত। তার মনের কোথাও একটা পুলক অনুভব করল। এই মেয়েটির উজ্জ্বল মুখটি আরও একটু উজ্জ্বল, আরও একটু ঝলমলে করে তুলতে ইচ্ছে হলো। এই অকারণ ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কী জানি কেন সাফাত আজ গুরুত্ব দিল। ঠোঁটে মাপা হাসি নিয়ে বলল,
‘ হেই মিথি? হোয়াটস্ আপ? আপনার সাথে আমার একটা দরকারি কথা ছিল। এখনই না বলে ফেললে ভুলে যাব। বলি?’
সাফাতের এতো ভূমিকায় কিছুটা হকচকিয়ে গেল মিথি। অপ্রস্তুত হলেও সপ্রতিভ হেসে বলল,
‘ নিশ্চয়ই।’
মিথির হাসিটাতেও আজ অন্যরকম এক প্রাণ পেল সাফাত। খুশি হয়ে বলল,
‘ আমরা একটা ড্রিংকস্ নিয়ে কথা বলি? সিরিয়াস আলাপের সময় হাতে সবসময়ই থাকতে হয় কোমল পানীয়। ইট'স আ রোল। নয়তো আমার ঘুম চলে আসে। শ্যেল উই?’
মিথি ঠোঁটের কোণে ভদ্রতার হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ শিওর।’
মিথি শুটিং ক্রুর সকলকে কিছুটা বিস্মিত করে দিয়ে সাফাতের সাথে রেস্টুরেন্টের অন্য পাশে গিয়ে বসল। সাফাত ড্রিংক অর্ডার করে বলল,
‘ আচ্ছা, এবার ব্যাপারটা বলি। আমার কাছে একটা এডভারটাইজমেন্টের অফার আছে। আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু তার একটা প্রোডাক্ট নিয়ে এড করতে চাইছে। তার জন্য খুঁজছে তরুণ কিন্তু চৌকশ কাউকে। যে তার কাজে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ডেডিকেটেড হবে। তরুণদের মধ্যে এই ডেডিকেশনটা বেশি। সে আমার কাছে সাজেশন চেয়েছে। আমি আপনাকে রিকমেন্ড করতে চাইছি।’
মিথি এই ধরনের কোনো প্রস্তাব আশা করেনি বলেই হয়ত গভীর বিস্ময়ে সাফাতের দিকে তাকিয়ে রইল। সাফাত গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ মোটামুটি ভালো বাজেটের কাজ। নিজের মতো কাজ করার স্কোপ আপনি পাবেন। আপনি তো বোধহয় এখনও কোনো একক কাজ করেননি?’
মিথি স্বয়ংক্রিয় পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। সাফাত বলল,
‘ তাহলে এই সুযোগটা বিগিনিং হিসেবে খুব খারাপ হবে বলে মনে হয় না। আপনার কী মত?’
মিথি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
‘ আমারও ধারণা, এটা আমার জন্য বেস্ট অপরচুনিটি। তারপরও, আমি আপনাকে একটু ভেবে জানাই?’
সাফাত মাথা নেড়ে বলল,
‘ নিশ্চয়ই। তবে যদি রাজি হন তাহলে প্লিজ মাথায় রাখবেন এটা আমার মানসম্মানের ব্যাপার। আমি আপনাকে রিকমেন্ড করছি। দয়া করে সেখানে মশা গবেষণা শুরু করবেন না। সেজন্য আমরা আপনার জন্য আলাদা পার্টির ব্যবস্থা করব।’
সাফাতের কথায় হেসে ফেলল মিথি। সাফাতের মনে হলো, এই মেয়েটিকে এই প্রথম সে এতো আনন্দ নিয়ে হাসতে দেখছে। সে কী আদৌ জানে তার হাসি যে বর্ষার থেকেও সুন্দর? বোধহয় পদ্মফুলের থেকেও। সাফাতের হঠাৎ কী হলো কে জানে? তার আচমকা মনে হলো, কোনোভাবে, যেকোনো উপায়ে এই মেয়েটিকে পৃথিবীর সকল আনন্দ জড়ো করে উপহার দেওয়া যায় না? পৃথিবীর সকল বিস্ময় তার আঁচলে এনে দিলে কী সে চমকাবে? এই মেয়েটার চমকাতে এতো আপত্তি কেন? আনন্দের সাথে তার এতো কীসের কর?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২৪ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন