উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


২৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ২৪)


আষাঢ়িয়া সন্ধ্যা। আকাশে ধূসর মেঘের ছাউনি। পাড়াগাঁয়ের পথে এই সন্ধ্যাতেই নেমে এসেছে গহীন রাতের আঁধার। মাথার উপর ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেটে পথের হরদম ঝাঁকুনি সহ্য করে একটা ভ্যান এসে থামল দাদাজানের বিশাল বাংলোর সম্মুখে। সাথে সাথেই ভেতর থেকে ছাতা হাতে ছুটে এলো বাড়ির চৌকিদার মনসুর। তার পেছনে চাকর শ্রেণীর তদারক, মোহন চাচা। মনসুর ত্রস্ত হাতে আগুন্তকের মাথায় ছাতা ধরল। রাতের অন্ধকারকে আলো দিয়ে শান্ত মুখে ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়াল মিথি। কাঁধের ব্যাগ খুলে ভাড়া মেটানোর উদযোগ করতেই ভ্যানওয়ালা জিভ কামড়ে বলল,
‘ আপনেরতে টেহা নিব? মাতা খারাফ! হাজী সাবের নাতনীর থিকা টেহা নেওনের মতো পাপ এই গেরামের কেউ করব না। এই চিন্তা করনেও দোজখ।’
মোহন চাচা ভ্যান থেকে মিথির ব্যাগ নামাতে নামাতে বললেন,
‘ ওর ভাড়া মিটানো হবো আম্মা। এরা নিজেদের লোক। আপনারে দিতে হবো না। আপনে ঘরে যান। আপনের বাকি ভাই-বোন হাইঞ্জা লাগনের আগেই উপস্থিত। আপনেরা সব একদিন আগে আইস্যা পড়ছেন দেইখা বাস ইস্ট্যান্ডে কাউরে পাঠাইতে পারি নাই।’
মিথি প্রত্যুত্তর করল না। দাদাজানের গাম্ভীর্যের কিছুটা বোধহয় উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রতিস্থাপিত হয়েছে তার সুন্দর মুখশ্রীতে। সে দাদার মতোই গম্ভীর মুখ তুলে একবার মোহন চাচার দিকে তাকাল। তারপর এক হাতে শাড়ির কুঁচি সামলে জলদগম্ভীর পায়ে গেইটের ভেতরে ঢুকে গেল। চৌকিদার মনসুর ছাতা হাতে হাঁটছে তার পিছু পিছু। এদিকে ভালো বৃষ্টি হয়েছে। উঠোন পিচ্ছল হয়ে আছে। মিথিকে হাঁটতে হচ্ছে কাদা বাঁচিয়ে। সাফাতের দাওয়াতটা রক্ষা করল বলেই এমন রাত নামল। নয়তো পরিকল্পনা মোতাবেক তারও পৌঁছে যাওয়ার কথা রৌদ্রতপ্ত দুপুরে। মিথি দীর্ঘ উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই বসার ঘরের সিঁড়ির অভিমুখে চঞ্চল মৌনিকে দেখা গেল। একটা ওভারসাইজ টাউজার আর কুর্তি তার পরনে। মা'বুদ জানেন এই টাউজার সে কার থেকে উদ্ধার করেছে। ঘন ধূসর চুলগুলো চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। তার অর্ধেকই এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে এসেছে কপোলের আশেপাশে। কানে হেডফোন লাগিয়ে নিজের মনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। হাতে একটা আধখাওয়া পেয়ারা। মিথি কাজের ছেলের এনে দেওয়া পানিতে পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকতেই মৌনির নজর পড়ল তার ওপর। তড়িৎ হাতে হেডফোন খোলে মিথির দিকে আনন্দিত চোখে তাকাল। ঠোঁটের কোণে ধাঁধা লাগানো হাসি ঝুলিয়ে টেনে টেনে বলল,
‘ ওহহো! মিথ্থি আপা? শাড়ি পরেছ দেখি। বর্ষায় বসন্ত এলে অবশ্য শাড়ি পরতে হয়, গুড ৷ ভেরি গুড। হেভি লাগছে।’
চেহারায় দুষ্টুমির ছাপ নিয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ টিপে হেভি লাগার পরিমাণও বুঝিয়ে দিল মৌনি। মিথি মনে মনে কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল। সাব্বির এখানে আছে বলেই যে তার বসন্ত, এ কথা আর অক্ষর ধরে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মিথি বুঝেছে। আর বুঝেছে বলেই বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে দীর্ঘশ্বাস। নিজের প্রতি তীব্র এক বিতৃষ্ণাও ঝিমঝিম করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা গা জুড়ে। একজন মানুষ তাকে চায় না জেনেও তাকে ভেবে সাজ-শিঙ্গার করা নিজের প্রতি নিজের অপমান। মৌনি সাধারণ কৌতুক করলেও মিথির মন জানে এই শাড়ির আমেজটুকু সে সাব্বিরের জন্যই করেছে। সকাল থেকে যে আশ্চর্য খুশি তাকে ঘিরে রেখেছে সে-ও কেবল সাব্বিরকে দেখতে পাবে বলেই। নিজের প্রতি নিজের অপমানের ভয়ে এই বাস্তব সত্যটুকু এতক্ষণ নিজের মনেই অস্বীকার করে এসেছে। মৌনি কৌতুকের সাঁড়াশি দিয়ে আচমকা টেনে খুলে ফেলেছে সেই পর্দা। জোরপূর্বক অন্ধ হয়ে থাকতে চাওয়া মিথিকে দেখিয়ে দিয়েছে তার নির্লজ্জতার ছবি। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজেকে বেহেয়াপনার চরম প্রান্তে রিক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিতৃষ্ণা বোধ করল। বুঝে পেল না, এতোকিছুর পরও কোন বিবেকে সে এমন উন্মুখ হয়ে ছুটে এলো? নিজের প্রতি কেন এতো অবিচার তার? মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ অসভ্যর মতো সিঁড়ি আগলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সরে দাঁড়া। সবসময় যত ফালতু কথা!’
অন্যান্য সময়ে মৌনির আত্মসম্মান বোধ খুব টনটনে। কারো কোনো ধমক সে বরদাস্ত করে না। কোন কথাতে যে সে অপমানিত হয়ে বসে থাকবে, সেও বলা মুশকিল। তবে মিথির কথায় তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ হলো বলে মনে হলো না। পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েও মিটিমিটি হাসতে লাগল। মিথি তাকে পাশ কাটিয়ে মোড় ঘুরে গেলেও মৌনি ঘাড় বাড়িয়ে কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিল। গলা ছেড়ে দুষ্ট কণ্ঠে গাইল,
‘ ওহে শ্যাম..
তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিব।
অন্য কাউরে না আমি চাহিতে দিব।
ওহে শ্যাম…!’
মিথি এক মুহূর্তের জন্য থমকাল। তারপর আবারও এগিয়ে গেল ক্লান্ত পায়ে। মৌনির ইঙ্গিতপূর্ণ গানে স্বাভাবিক দাম্পত্যে লজ্জা আসার কথা অথচ মিথিকে দিয়ে গেল বিষ কামড়ের মতোন ব্যথা। বুক বেয়ে উঠে এলো দীর্ঘশ্বাস। মনে পড়ে গেল, সাব্বির তার কেউ না। তার জন্য অস্থির হওয়া তার সাজে না। তাকে নজরবন্ধী করে রাখার অধিকার তার নেই। কেউ তাকে চাইলে অভিমানী বধূর মতো স্বামীকে আঁচলে বেঁধে ফেলার মতো আধিপত্য তাকে দেওয়া হয়নি। রাস্তায় হাঁটাচলা করা নিতান্ত অপরিচিত, অধিকারহীনারও একটা অধিকার থাকে। মিথির স্থান তার থেকেও নিচে। মিথির আঁচল তার থেকেও শূন্য, রিক্ত, মলিন।
মৌনির উঁকিঝুঁকির মাঝেই খাবার ঘর থেকে এক বাটি নুডলস হাতে বেরিয়ে এলো ঋতি। মৌনির পাশে দাঁড়িয়ে মুখ ভরা নুডলস নিয়ে কোনোরকমে জানাল,
‘ মৌপু? নাহিদ ভাইয়া তোমাকে খুঁজছে। তুমি যেখানেই থাকো এক্ষুনি যেতে বলেছে। কুইক।’
মৌনি দু'তলার সিঁড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে ঋতির দিকে তাকাল। নুডুলসের বাটি ইশারা করে বলল,
‘ উইদ চিকেন? কোথায় পেলি? আমাকে কেউ দিল না তো। আমি কী এই বাড়ির মেয়ে না? ভেসে এসেছি? আমিও খাব। দে।’
মৌনি হাত বাড়াতেই ঋতি তড়িৎ হাতে নিজের বাটি সরিয়ে ফেলে বলল,
‘ খবরদার, আমার ভাগে হামলা করবে না। খাবার টেবিলে আছে। ওখান থেকে নাও।’
মৌনি বিষদৃষ্টিতে ঋতির দিকে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ আমাকে ‘খবরদার’ বলিস? তুই জানিস আমি তোর থেকে কত বছরের বড়? আদব-লেহাজ নেই কোনো? বড়দের প্রতি কোনো রেস্পেক্ট নেই। জীবনে তো এক ফোঁটা রেস্পেক্ট করতে দেখলাম না আমাকে। এইযে এই ব্যবহারটা করলি? এই স্মৃতি আমি ভুলে যাব ভেবেছিস? সব একেবারে কড়া ইস্ত্রি করে আলমারিতে তুলে রাখব। আসিস আবার মৌপু মৌপু করে!’
মৌনির বিশাল ভাষণে ঋতি অসহায় চোখে তাকাল। নিজের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা, যাও। নাও।’
মৌনি তীব্র চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা নাও, মানে কী? তুই আমাকে ভিক্ষা দিচ্ছিস? আমি ভিক্ষা নিব? যখন চাইলাম তখন তো দিসনি। তোর কোনো জিনিস আমি মৌনি আর ছুঁয়েও দেখব না। ফুট!’
ঋতির দৃষ্টির অসহায়ত্ব এবার আরও এক ধাপ বেড়ে গেল। এর মধ্যেই নাহিদ এলো। মৌনিকে ডেকে বলল,
‘ ওই, তোকে আমি কখন থেকে খুঁজছি।’
মৌনি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তুই আমাকে খুঁজিস কেন? খুঁজবি না। এদিকে আমার অধিকার হরণ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তো কারো খেয়াল নেই। এই বাড়িতে নুডলস রান্না করা হলো, দুনিয়ার তাবৎ মানুষ পেলো। অথচ আমি পেলাম না। হুয়াই!’
নাহিদ ঋতির হাতের দিকে তাকাল। ওর হাত থেকে নুডলসের বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে চামচটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল,
‘ তোদের যা স্বভাব। থুতু মাখিয়ে রাখিসনি তো আবার?’
ঋতি ব্যথিত চোখে তাকাল৷ রাগ করে বলল,
‘ খালি থুতু না। বমি মাখিয়ে রেখেছি। তুমি আমার বাটি ফেরত দাও। দাও।’
নাহিদ বাটি ফেরত দিল না। আয়েশ করে এক চামচ মুখে দিয়ে মৌনিকে বলল,
‘ এই নুডলসের জন্য তুই কাঁদছিস? এই নুডলসের জন্য? এটা তো নুডলসের ‘ন'-ও হয়নি। তোকে আমি ঢাকায় ফিরে ফাইভ স্টার হোটেলে নুডলস খাওয়াব। জীবনে সাততারায় গিয়েছিলি? মনে হয় না। এই সুযোগে ঘুরে এলি। আমি আবার সাততারা ছাড়া খেতে পারি না। কোথাও খেতে বেরুলেই সাততারা।’
মৌনি আগুন চোখে নাহিদের দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ খবরদার নাহিদ! আমার সামনে টাকার ফুটানি দেখাবি না। ওরে আমার সাততারা রে? জীবনে একটা লজেন্স খাইয়েছিলি? আবার সাততারা! ফুট সামনে থেকে।’
নাহিদ অবাক হয়ে বলল,
‘ খাওয়াইনি? আচ্ছা যা, আজ খাওয়াব। এখানে তো আর সাততারা পাওয়া যাবে না। বড়ো জোর আইসক্রিম, কোক পাওয়া যেতে পারে। আয়, দেখি দোকানে কী পাওয়া যায়।’
মৌনি মুখ ভেঙিয়ে বলল,
‘ তোরটা তুই খা। তোর মতো বড়লোকদের থেকে কিছু খাওয়ার শখ আমার নেই।’
নাহিদ বলল,
‘ আরে আয় না। এতো ভাব নিচ্ছিস কেন বাপ!’
মৌনি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ কোথায় যাব? বাড়ির আশেপাশে কোনো দোকান পর্যন্ত নেই।’
নাহিদ বলল,
‘ সামনের মোড় পর্যন্ত যাব। ওখানে করিম ভাইয়ের দোকান আছে না?’
মৌনি আঁতকে উঠে বলল,
‘ এই রাতের বেলা অতদূর যাব? তাও এই বৃষ্টির মধ্যে?’
নাহিদ পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘ বৃষ্টি কই! টিপটিপ বৃষ্টিও তো হচ্ছে না। হাঁটা যাবে। আয়।’
মৌনি ঋতির গা থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়ে চাদরের মতো জড়িয়ে নিল নিজের গায়ে। ঋতি আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব হয়ে মৌনির দিকে তাকিয়ে রইল। মৌনি যে এমন কিছু করবে তার কিঞ্চিৎ ধারণা নাহিদের ছিল বলেই হয়ত সে আগেই অন্যদিকে ফিরে মোবাইলে মনোযোগ দিয়েছে; ঋতির দিকে তাকায়নি । মৌনি নিজের গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে বলল,
‘ যদি পিছলা পড়ি তাহলে তোর খবর আছে।’
নাহিদ বসার ঘর হয়ে বাড়ির টানা বারান্দা থেকে উঠোনে নামতে নামতে বলল,
‘ ধুর! পড়বি না।’
স্যাঁতস্যাঁতে উঠোন পেরিয়ে মাটির রাস্তায় নামতেই ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালাল নাহিদ। কিছুদূর নীরবে হেঁটে গেল দু'জন। বৃষ্টির পাতলা ছাঁট, ঠান্ডা হাওয়া আর আলো আলো ধূসর আকাশ অদ্ভুত এক স্বস্তি দিয়ে গেল তাদের মনে। অনেকটা পথ নিশ্চুপ হেঁটে নাহিদ বলল,
‘ আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে। শুনেছিস?’
মৌনি পথের পাশের একটা বাঁশের চাঙে পা ঝুলিয়ে বসল। বলল,
‘ আর এগুব না। এখানেই বসি।’
নাহিদ প্রতিবাদ করল না। একটা গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মৌনি বলল,
‘ মিষ্টি বলেছে সেদিন। তোদের মতো আশ্চর্য ব্রেকাপ আমি আর কোথাও দেখিনি।’
নাহিদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে আকাশ-পাতাল ভাবল। তারপর কণ্ঠে একটু বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ জানিস? আমি একদিন ভরা বৃষ্টিতে মহাখালী মিষ্টির জন্য চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর আসার কথা ছিল, ও এলো না। একটা ফোন পর্যন্ত করল না। আমি আগের রাত থেকে উপোস। তারমধ্যে মিষ্টির কোনো খোঁজ না পেয়ে আমার পাগল পাগল লাগছিল। আমি এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মহাখালী থেকে ফার্মগেইট গেলাম। মিষ্টি আমাকে ফোন করল পরেরদিন সকাল দশটায়। জানাল, ও ওর মামার সাথে ময়মনসিংহ চলে গিয়েছে।’
মৌনি একদৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কিছু পরোয়া না করা। সর্বক্ষণ হাসি-মজা-ফাজলামো করতে থাকা ছেলেটির বুকে এই ঘটনাটি যে কত প্রগাঢ়ভাবে গেঁথে আছে। এই ছেলেটির অনুভূতিতেও যে এতো প্রগাঢ়তা আছে। নিজস্ব ভাবনা আছে, ভেবেই কিছুটা আশ্চর্য হলো মৌনি। কিছুটা ব্যথিতও হলো। কোমল কণ্ঠে শুধাল,
‘ তুই যে আমাকে ফোন করলি, এটা কী সেই দিনের ঘটনা?’
নাহিদ সে কথার উত্তর দিল না। বলল,
‘ ও ময়মনসিংহ চলে গিয়েছে না জানলে সেদিন সারারাত ভর ওকে খুঁজতাম আমি। পুরো শহর উলোটপালোট করে ফেলতাম। অথচ ও আমাকে একটা ফোন করার প্রয়োজন মনে করল না!’
কথাটা বলতে বলতে নাহিদের ঠোঁটে যে ম্লান হাসি খেলে গেল সেই হাসি মৌনিকে বুঝিয়ে গেল ছেলেটার সমস্ত অভিযোগ। হতাশা। মৌনি একবার মিষ্টির পক্ষ নিয়ে, একবার নাহিদের হয়ে অনেক কথা বলে গেল। নাহিদ শুনে গেল চুপচাপ। মৌনি উত্তেজিত হয়ে দুই একটা বেসামাল কথা বলে ফেললেও নাহিদ মিষ্টি সম্পর্কে একটা কটু কথাও বলল না। কোনো অভিযোগও জানাল না। মৌনি কথা বলে গেল একা একা। কিছুক্ষণ চাঙের উপর বসে থেকে ওরা বাড়ির পথ ধরল। হাঁটতে হাঁটতেও চলতে থাকল মৌনির যুক্তিখণ্ডন। একসময় ক্লান্ত হয়ে বলল,
‘ সব আসলে ভোগাস। আসল কথা হলো, চুমু৷ তুই একটা চুমু খেলেই এতো কাহিনি হতো না। বেদ্দব ছ্যাড়া! প্রেম করতে পারছ অথচ চুমু খেতে পারিস না? এতো এতো মেয়ের সাথে তোর ইটিস পিটিস থেকে তাহলে লাভ কী হলো বল? তুই তো পুরুষ জাতের কলঙ্ক।’
নাহিদ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। শুধাল,
‘ কেন? তোর বান্ধবী তোকে এমন কিছু বলেছে নাকি? আমি তাকে চুমু খাইনি বলে ব্রেকাপ?’
মৌনি খুব ভাব না বলল,
‘ হাহ্! এসব আবার বলতে হয় নাকি? মুখ দেখলেই বুঝা যায়। চুমুই যদি না খায় তাহলে এতো হ্যান্ডসাম প্রেমিক জুটিয়ে কী লাভ?’
নাহিদ হেসে ফেলল। বলল,
‘ আমি সত্যিই বুঝিনি তোরা সব সময় এতো হর্ণি হয়ে থাকিস।’
মৌনি তীব্র চোখে নাহিদকে পরখ করল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ তুই একটা বেয়াদব! ভালোবাসার প্রদর্শনে চুমু খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। তার সাথে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধরনের ফাউল শব্দ ইউজ করার আগে তোর মাথায় রাখা উচিত, আমি তোর বোন হই৷ বোনের সামনে এসব কথা বলতে তোর লজ্জা লাগা উচিত। রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বল নাহিইদ্যাআ।’
নাহিদ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ ওরে আমার নিষ্পাপ বোন রে। পা বাড়া। সালাম করে রেস্পেক্ট দেই।’
প্রত্যুত্তরে নাহিদের বাহুতে একটা শক্ত ধাক্কা দিল মৌনি। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
‘ এই বৃষ্টির রাতেও আকাশে কী চমৎকার চাঁদ উঠেছে দেখ! আমি মাঝে মাঝে ভাবি, চাঁদের মতো করে পৃথিবীর সকল মানুষও কেন হতাশার মেঘ কেটে এভাবে বেরিয়ে আসতে পারে না?’
নাহিদ মৌনির কথায় মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল। সাথে সাথেই চারদিক সচকিত করে বেজে উঠল মৌনির কিণ্ণরী কণ্ঠ। উদাত্ত কণ্ঠ সে আবৃত্তি করল,
‘ ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে।
মাথায় বৈশাখ মেঘ - শাদা শাদা যেন কড়ি- শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে।
কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর রূপের কথা মনে হবে।
এই আম-জামের ছায়াতে কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি,
কবে যেন রাখিয়াছি হাতে হাত।
কবে যেন তারপর শ্মশানচিতায় তার হাড় ঝরে গেছে,
কবে যেন ; এই জনমে নয় যেন
এই পাড়াগাঁর পথে তবু তিনশো বছর আগে হয়তো বা – আমি তার সাথে কাটায়েছি…’
নাহিদ পুরোটা সময় নীরবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে মৌনির মতো কাব্য নেই। চাঁদ নিয়ে অতো কাব্যিক ভাবনা তার আসে না। চাঁদকে তার স্রেফ চাঁদ বলেই মনে হয়। তারপরও দীর্ঘক্ষণ আনমনে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, এমন এক রাত্তিরে আসলেই তার কাকে যেন খুব ভালোবাসবার কথা ছিল!
____________
বৃষ্টি নেই। খোলে রাখা জানালা দিয়ে আসছে ফুরফুরে উত্তুরে হাওয়া। রাতের সূচনালগ্ন অথচ চারদিকে ঝিমঝিম এক রব তুলেছে জোনাকিদের দল৷ মাঝে মধ্যে কাছের কোনো ডোবা থেকে সমস্বরে ডেকে উঠছে বর্ষার ব্যাঙ। সাব্বির সেই বাহারি রবে আনমনা হয়ে বসেছিল। হাতে জীবনান্দের বই। বইটা তাকে দিয়েছে মৌনি। মেয়েটা সম্পর্কে তার শাল্যিকা। মেয়েদের প্রতি সাব্বিরের আগ্রহ কিছু কম। ভাবি-শালি ধরনের সম্পর্কগুলোকে সে ভালো চোখে দেখে না। এই সম্পর্কগুলোতে সূক্ষ্ম অশ্লীলতার ছোঁয়া আছে বলে মনে হয়। কিন্তু মৌনি মেয়েটা অন্যরকম৷ তার ব্যবহার শাল্যিকাদের মতো হয়েও ঠিক তাদের মতো না। অদ্ভুত, চঞ্চল, ছটফটে। বাড়িতে ফিরেই সে সরাসরি সাব্বিরের ঘরে এসে হাজির। সাব্বির যে তাকে দেখে স্তব্ধ, হতভম্ব, হতচকিত। সে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সে তার মতো হুমকি ধামকি দিয়ে বলল,
‘ সাব্বির ভাই, আপনি যে খুব স্বার্থপর ধরনের মানুষ সেটা কী আপনি জানেন? এইযে বিয়ে করলেন? শুধু বউটাকেই দেখলেন আশেপাশে আর তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না। আমি হলফ করে বলতে পারব, আপনি এখনও আপনার শাল্যিকাদের সঠিক সংখ্যা জানেন না। অথচ শাল্যিকারা ঠিকই আপনাকে তাদের ঘর উপহার দিয়ে বসে আছে। একটা মেয়ের জন্য তার ঘর ছেড়ে দেওয়া কতটা মর্মান্তিক আপনি জানেন?’
কথা বলতে বলতেই সে বিছানার উপর এসে বসল। তাকে বসতে দেখেই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাব্বির। মৌনি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
‘ ইছা মাছের মতো লাফ মারলেন কেন? বসুন।’
সাব্বির কী করবে বুঝতে না পেরে আবার বসল। শুধাল,
‘ ইছা মাছ?’
দেখা গেল, সাব্বির ইছা মাছ চিনে না দেখে মৌনি ভীষণ পুলকিত। সে খুশি হয়ে বলল,
‘ ইছা মাছ চিনেন না? গুড, ভেরি গুড। আপনি চিন্তা করবেন না যাওয়ার আগে আমি আপনাকে ইছা মাছ চিনিয়ে দিয়ে যাব। তার আগে বলুন, আমার নাম কী? যদি না বলতে পারেন তাহলে আমি মনে মনে খুবই অপমানিত বোধ করব। আমি অপমানিত বোধ করলে সমস্যা আছে। বাড়িতে একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। দেখা গেল, রাগ করে আপনার ঘরে আমি আগুন টাগুন ধরিয়ে দিলাম। পরে অবশ্য সরি বলব। কিন্তু খুন করার পর সরি বললে তো আর লাভ নেই বলুন?’
সাব্বির প্রত্যুত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে বলল,
‘ আপনি মৌনি।’
সাব্বির মৌনিকে চিনতে পারায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল মৌনি। কিছুক্ষণ আয়েশ করে গল্প করল। সাব্বির ভেবেছিল, এই মেয়ে তাকে আরও অসংখ্যবার জ্বালাতন করবে। কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে মৌনি আর একবারের জন্যও এদিকের পথ মাড়াল না। বুয়াকে দিয়ে কিছু বই পাঠিয়ে দিল সাব্বিরের ঘরে। সাথে একটা চিরকুট। তাতে কঠিন সাবধান বাণী,
‘ আমার বইয়ের কোথাও ছিঁড়লে, দাগ পড়লে অথবা নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আপনার বউয়ের চুল কেটে দেওয়া হবে। আপনার চুলের থেকে বউয়ের চুল কাটলে আপনার আফসোস বেশি হবে, জানি। এজন্যই এই ব্যবস্থা। হ্যাপি রিডিং।’
সাব্বির সেই বইগুলোর মধ্যে থেকেই একটি উল্টেপাল্টে দেখছিল। জীবনানন্দ তার পছন্দের কবি। তাঁর অনেক কবিতাই অবসরে বসে মুখস্থ করেছে সাব্বির। আবৃত্তি করেছে একা একা। সাব্বির পৃষ্ঠা উল্টে একটা কবিতার দুটো লাইন পড়তেই দরজায় কাছে পড়ল একটি মানব ছায়া। সাব্বির মুখ তুলে দরজার দিকে তাকিয়েই থমকে গেল। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নারীমূর্তিটিকে দেখে স্বয়ংক্রিয় পুতুলের মতো বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। মাথায় বেজে উঠল জীবনানন্দের মুখস্থ পঙক্তি -
চুল তার কবেকার অন্ধকার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;
বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
সাব্বিরের বনলতার প্রশ্নটা অবশ্য একটু অন্যরকম হলো। সেই দিঘি চোখা নারী তার দিঘি দিঘি চোখে চেয়ে শুধাল,
‘ কী অবস্থা আপনার? এখন কেমন আছেন?’
সাব্বির হঠাৎ করে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। যার নামেই তার হৃদয়ে উষ্ণতা বয়ে যায় সেই মানুষটির সশরীরে উপস্থিতি কেমন নিশ্চল করে দিল তার দেহ। মিথি হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ভুরু কুঁচকে সাব্বিরের দিকে তাকাল। তাকে একটু পরখ করে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?’
সাব্বির একটু দম নেওয়ার চেষ্টা করল। শুকিয়ে যাওয়া আড়ষ্ট জিভ নাড়িয়ে বলল,
‘ ভালো। ভালো আছি।’
মিথি বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল৷ বলল,
‘ গুড! দাদাজানের কাছে থাকলে অবশ্য ভালো না থেকে উপায় নেই।’
সাব্বির প্রত্যুত্তর করার মতো কিছু খুঁজে পেল না। মিথির এহেন স্বাভাবিক ব্যবহার তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। সেই রাতের দূর্ঘটনাটির লেশমাত্র নেই তার চোখে। মনে হচ্ছে, সেই রাত তাদের জীবনে কখনও আসেনি। ওমন কোনো ঘটনা কভু ঘটেনি। মিথি অপমানে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু সাব্বির জানে, সেই আঘাত কত গভীর ছিল। এই নারীর প্রখর ব্যক্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে সাব্বির কী করে সেই আঘাতের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছাবে? কী করে বলবে, বৃথা তোমার ক্রন্দন প্রিয়া। চেয়ে দেখো আমায়। তোমাকে অপমান করব এমনই কী আমার সাধ্য?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

২৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন