উপন্যাস        :         রোদ শুভ্রর প্রেমকথন
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ নভেম্বর, ২০২০ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “রোদ শুভ্রর প্রেমকথন” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


৫৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

রোদ শুভ্রর প্রেমকথন || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ৫৬)


'বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে,
বসন্ত এসে গেছে.....'
আমার ছোট্ট সাবলেট ফ্ল্যাটটিতে গুনগুনিয়ে বাজছে অপরিচিত এক শিল্পীর রিনরিনে কন্ঠস্বর। কাঁচের বিশাল জানালাটা ঠা করে খোলা। নীলচে পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই স্বচ্ছ রোদে ভরে উঠল অগোছালো বিছানার মসৃণ গা। আমি কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে মৃদু হাসলাম। নীলা আপু চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখতেই ঘুমু ঘুমু ফোলা চোখে উঠে বসলাম। কোমর অব্দি নেমে আসা এলোমেলো চুলগুলো হাতখোপা করতেই কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা চুলগুলো আছড়ে পড়লো ফুলো ফুলো, কোমল গালের পাশটায়। নীলা আপু আমার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলেন। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন,
' আজ ফাল্গুন। পহেলা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা, পিচ্চি। আরও একটি বিশেষ দিন আজকে। সেই বিশেষ দিনের শুভেচ্ছা তোমায় অন্যকেউ দিবে। সে ছাড়া অন্যকারো নাকি সেই শুভেচ্ছা জানানোর অধিকার নেই?'
আমি হাসলাম। হাত বাড়িয়ে নিজের কাপটা টেনে নিয়ে বাসী মুখেই চুমুক দিলাম কাপে। নীলা আপুর মূর্তির মতো সুন্দর মুখ। কোঁকড়ানো লম্বা চুলে ঝিলিক দিয়ে উঠলো সোনালি সূর্যের কিরণ। ঝকঝকে হেসে বললেন,
' আজ আবার তুমি ব্রাশ করলে না রোদু!'
আমি হেসে ফেললাম। খোলা জানালার বাইরে হাত পাঁচেক ছোট্ট বারান্দার ঝকঝকে রেলিঙটায় বসে থাকা এক জোড়া শালিকের দিকে চেয়ে আপনমনেই বললাম,
' আজকের সকালটা সুন্দর নীলা আপু। বহুদিন আমি এতো সুন্দর সকাল দেখিনি।'
নীলা আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার মুখের দিকে চেয়ে বেদনার্ত কন্ঠে বললেন,
' কিছু কিছু মানুষকে বিষণ্ণ দেখলে ভয়াবহ বিষণ্ণতায় ডুবে যায় মন। তুমি তেমনই একটি মেয়ে। আমি কখনো হাসতে দেখিনি তোমায় অথচ কেউ একজন বলেছিল, তোমার হাসি নাকি বসন্তের সকালের চেয়েও সুন্দর?'
আমি হেসে ফেললাম। বহুদিন পর। বহু মাস পর আবেগের আতিথেয়তায় বোজে এলো চোখ। মনে পড়ে গেল আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগের সেই রাতটির কথা। কারো চূড়ান্ত পাগলামোর কথা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। মাত্র পনেরোয় পা দেওয়া ছোট্ট রোদপাখি। আর তার ভয়াবহ ডেস্পারেট শুভ্র ভাই। সবকিছুকে তুচ্ছ করে দেশের অপর প্রান্ত থেকে ছুটে এসে ঠিক মাঝ রাত্তিরটিতে বলা, 'ভালোবাসি'। আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। অনেকদিন পর তাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো। আমার সকল অন্যায় আবদারগুলো চোখ বন্ধ করে মেনে নেওয়া ওই পুরুষটিকে প্রচন্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো। শুধুমাত্র তার জন্যই হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো রৌদ্রজ্বল বসন্ত। গায়ে বাসন্তী শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, চোখে কাজল মেখে আলতা টানতে ইচ্ছে করল পায়ে। এক গাদা সতেজ ফুল দিয়ে সাজতে ইচ্ছে হলো ঋতুরাজের গর্বিত মহারাণী। কিন্তু সব ইচ্ছে কী পূরণ হয়? হয় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নীলা আপু চা শেষে উঠে যেতেই ডায়েরিটা টেনে নিলাম কোলের উপর। পাঠকদের জন্য যে বিশাল বিশাল অভিমান, অভিযোগ আর বিচ্ছেদের গল্প জমিয়ে রেখেছিলাম? সেই গল্পগুলো আর লিখতে ইচ্ছে হলো না। সেপ্টেম্বরের শেষ আর জানুয়ারির শুরুর অন্ধকার গল্পটুকু মিথ্যে করে দিতে ইচ্ছে হলো মিষ্টি কোনো জাদু বলে। বাস্তব সত্যটুকু ভুলে গিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে হলো কল্পনায়। কিন্তু তাই কী হয়? সেই দীর্ঘ বিষণ্ণতার সূচনাটা কী মনের ভুলেও ভুলে যাওয়া যায়?
এই রৌদ্রজ্জ্বল বসন্তের সকালে, ছোট্ট সাবলেট ফ্ল্যাটটিতে একদম একা বসে থেকে কেমন কেঁপে উঠলাম আমি। চার তলার খোলা জানালা থেকে ধূ ধূ নীলাভ আকাশের দিকে চেয়ে নিজেও যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না, এই সদা চঞ্চল, হাসতে থাকা মেয়েটাও কখনো আত্মহননের ভাবনা ভেবেছিলো। চূড়ান্ত বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে ভয়াবহ পাগলামো করেছিলো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ছোট্ট ঘরটিতে দোর দিয়ে বসেছিল। যার থেকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল, কাগজ কাটার কাঁচি, ঔষধের বোতল এমনকি কাচের ফুলদানি পর্যন্ত! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। অসাড় হওয়া হাতে কলমটা আর চলল না। আবারও এক গুমোট বিষণ্ণতা ঝাপটে ধরলো মন। ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম নিষ্ঠুর রাতগুলোর সূচনা পর্বের দিকে.....।
আগস্টের সেই রাতে, শুভ্র ভাই আমার উপর দিয়ে সেই ভয়াবহ ঝড়খানি বইয়ে দেওয়ার পর কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। ঠিক সেই মুহূর্তে কী করা উচিত? কী ভাবা উচিত? কিচ্ছু ভাবতে ইচ্ছে হলো না। সবই যেন তালগোল পাকিয়ে হয়ে গেল সমাধানহীন অলীক কল্পনা। আমি ছাদের রেলিঙে ভর দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কোমল গালদুটো কাশ্মীরী আপেলের মতোই লাল হয়ে আছে প্রচন্ড বিষ ব্যথায়। ফোলে উঠা বামহাতের পেশীগুলোতে রক্ত ছুটলো। অবশ হয়ে এলো গোটা হাত। আমার থেকে হাত খানেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নাহিদ ভাইয়ের অনর্গল ছুটে চলা মুখটির দিকে বোবার মতো চেয়ে রইলাম। নাহিদ ভাইয়া আমার লাল হয়ে যাওয়া গালের দিকে চেয়ে আঁৎকে উঠলেন। আচমকা আমার গালে আলতো হাত রেখে বললেন,
' কী সাংঘাতিক! শুভ্র তোমায় মেরেছে?'
নাহিদ ভাইয়ার কথা আমার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখাল শরীর। চোখের পলকে সরে দাঁড়িয়ে আপনাআপনিই ডান হাতটা গালে ঘঁষতে ঘঁষতে মুছে ফেলার চেষ্টা করল নাহিদ ভাইয়ার বেখেয়ালি স্পর্শ। মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল প্রচন্ড তেজে। আমার এমন অদ্ভুত ব্যবহারে মুষড়ে পড়লেন নাহিদ ভাই। কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। তাড়াহুড়ো করে বললেন,
' আই এ্যাম সরি, রোদ। তোমার গালে ওমন আঘাত দেখে...... ঠিক খেয়াল ছিল না। প্লিজ কিছু মনে করো না। আই এ্যাম সো সরি। ব্যাপারটা ইনটেনশনাল ছিল না। সরি।'
তারপর একটু থেমে ফ্যাকাশে হেসে বললেন,
' আমার হাতে কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই, রোদ।'
এবার আমার চৈতন্য ফিরলো। গাল থেকে ঝট করে হাত নামিয়ে নিয়ে অপ্রস্তুত চোখে চাইলাম। সেই প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম, শুভ্র ভাইয়ের প্রতি আমার শরীরের কী তীব্র আসক্তি! ভয়াবহ আনুগত্য! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমার দেহে আমি নই। সুতীব্র, একচ্ছত্র আধিপত্যের নাম কেবলই শুভ্র ভাই। যে বয়সটাতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ হয়? সেই বয়সের শুরুতেই আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শুভ্র ভাই। আমি তাকে ভেদ করে পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষের দিকে চোখ তুলে চাওয়ার সময়, সুযোগ বা সাহস জোটাতে পারিনি। বিস্ময় পুরুষদের উপর আকর্ষণ তৈরির আগেই একদম জোরপূর্বক সকল আকর্ষণ শুষে নিয়ে অন্যদের প্রতি আমায় করে দিলেন অনুভূতিহীন। গম্ভীর। আমার চট করেই মনে পড়ে গেল, আমার এই বিশ বছরের জীবনে শুভ্র ভাই ভিন্ন অন্য কোনো পুরুষালি হাত আমার আঙুলটি পর্যন্ত ছুঁয়ে যেতে পারেনি। নিজের দেহের এমন নির্মম বিশ্বাসঘাতকতায় হতাশ হলাম আমি। নাহিদ ভাইয়ার প্রতি দগদগে একটা রাগ নিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,
' তেমন কিছু না ভাইয়া। এটা অটোমেটিক রিয়েকশন ছিলো। ইনটেনশনাল নয়। আমি সাধারণত ছেলেদের সাথে কথা বলি না। দূরত্ব রাখতে পছন্দ করি। সরি।'
নাহিদ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ম্লান হেসে বললেন,
' ইট'স ওকে। আমারই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। সরি।'
আমি উত্তর দিলাম না। মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
' আপনি থাকুন। শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বরং নিচে যাই।'
কথাটা শেষ করে নাহিদ ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলাম আমি। মাথায় ওড়না টেনে ফোলে উঠা বামহাতটা ওড়নার আড়ালে ঢাকার চেষ্টা করতেই ভ্রু কুঁচকে চাইলেন নাহিদ ভাই। আমার হাতের দিকে স্থির চেয়ে থেকে পিছু ডাকলেন,
' আঘাতটা ঢাকছো কেন? শুভ্রর সাথে ঘনিষ্ঠ না হলেও ওকে আমি বেশ ছোট থেকেই চিনি। যতটুকু জানি তাতে ও মেয়েদের সাথে খুবই নম্র। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, ভুল জানতাম। শুভ্র অত্যন্ত হিংস্র একটা ছেলে। তুমি জেনেশুনে ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ কেন? আড়াল করতে চাইছ কেন বারবার?'
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মানসিক টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও নাহিদ ভাইয়ার বারবার একই কথা টেনে আনায় রক্তাক্ত হচ্ছিল তীব্র আত্মসম্মান। শুভ্র ভাইয়ের প্রতি রাগ যেমন হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল নাহিদ ভাইয়ার উপরও। শুভ্র ভাই কতটা হিংস্র হতে পারেন সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েও শুভ্র ভাইয়ের পক্ষ টানলাম আমি। বিরক্তিতে মুখ গুঁজ করে বললাম,
' ভুল ভাবছেন। উনি ইচ্ছে করে করেননি। এক্সিডেন্টলি....'
নাহিদ ভাইয়া আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। অবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
' এরপরও? এতোকিছুর পরও, কেন?'
আমি সর্বদায় মুক্তমনা মানুষ। নিজের বা নিজের সম্পর্কে অযথা কৈফিয়ত টানা আমার চরিত্রে মানায় না। এতো কৈফিয়ত, এতো নিয়মের বেঁড়াজালে আমি বাঁচতে পারি না। দমবন্ধ লাগে। বিদ্রোহী হয়ে উঠে মন। এবারও তাই হলো। মাথার ভেতর বিরক্তির পোকাটা দিগদিগ করে জেগে উঠল। আমি তীব্র চোখে চাইলাম। মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ হেসে বললাম,
' কেন নয়?'
নাহিদ ভাইয়া স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি পেরুতেই দ্রুত পায়ে সঙ্গ দিলেন আমায়। বার কয়েক ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখলেন। তারপর বললেন,
' সরি ফর ইন্টারফেয়ারেন্স। আমার বোধহয় অনাধিকারচর্চা করা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু তোমার উচিত এটলিস্ট তোমার মাকে জানানো। উনি বুদ্ধিমান মহিলা। হয়তো...'
আমি উত্তর দিলাম না। শুভ্র ভাই সম্পর্কে নাহিদ ভাইয়ার এই কাঁচা ধারণায় বড়ো মায়া হলো। যে পুরুষ মাথা নোয়ানোর থেকে মৃত্যুদন্ডেও সন্তুষ্ট। যার জেদের কাছে তার জন্মদাত্রী মাও পরাজিত। সেই পুরুষকে শাস্তি দেবে আমার মা? হাস্যকর। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গিয়ে নাহিদ ভাইয়া নরম কন্ঠে বললেন,
' পেইন কিলার খেয়ে নিও। আঘাতটা রাতে খুব ভোগাবে তোমায়।'
আমি চমকে চাইলাম। নাহিদ ভাইয়ার গলায় সহজাত চিন্তা থাকলেও চোখদুটোতে বয়ে গেল শুদ্ধ কোনো অনুভূতির ফোয়ারা। পরিচিত বিষণ্ণতা। যেমনটা থাকে শুভ্র ভাইয়ের চোখে, দিবারাত্র। নাহিদ ভাইয়া আবারও একই কথা বলতেই সচেতন চোখে চাইলাম আমি। ঘোর কেটে অন্য একটা ঘোরে আটকে পড়লাম। অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে সরে এলাম। খোঁজলাম কিছু নীরবতার খোঁজ। কোলাহলপূর্ণ এই রাতটা কেমন অভিশপ্ত মনে হলো। বিছানার এক কোণায় কম্বলে হাত-মুখ ঢেকে পড়ে থাকতে থাকতে নাহিদ ভাইয়ার কথাটাই ভীষণ সত্যি হলো। রাত বাড়ার সাথে সাথেই ভোগান্তি বাড়ল। কিন্তু সেই ভোগান্তি শারীরিক নয়, দমবন্ধ করা মানসিক। নাহিদ ভাইয়ার চোখে সেই সমবেদনাটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। পনেরো বছরের রোদ তখন বড় হয়েছে। বড় হয়েছে তার আত্মসম্মানবোধ। নাহিদ ভাইয়ার সেই সমবেদনা আমার আত্মসম্মানবোধে কাঁটার মতো ফুটতে লাগল। শুভ্র ভাইয়ের প্রতি প্রচন্ড রাগ, জেদে জ্বলে উঠল শরীর। এই প্রথমবার মনে হলো, শুভ্র ভাইয়ের সাহস কী করে হয় আমার গায়ে হাত দেওয়ার? হোক তা অনিচ্ছাকৃত! হাও ডেয়ার হিম! সেদিন রাতে আমি ঠিক ছিলাম কি-না ভুল জানি না। তবে সারাটা রাত আমার আর ঘুম হলো না। সকালবেলা প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো। কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। রাগটাও কিছুটা থিতিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই রাগে ড্রাম সমান ঘি ঢাললেন আম্মু। ঘুম ভেঙেই বুঝতে পারলাম, কোনো একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। আম্মু আমার সাথে কথা বলছেন না। প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছেন না। সারারাতের এই ভোগান্তির পর আম্মুর এই নতুন নাটক আর সহ্য হলো না। বিরক্তিতে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো আমার। রান্নাঘরে গিয়ে গলা তুলেই বললাম,
' সমস্যাটা কী তোমার? কথা বললে উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না? কখন থেকে একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করছি। উত্তর দিচ্ছ না কেন? অন্যকারো রাগ আমার উপর ঝাড়ার চেষ্টাও করবে না বলে দিলাম!'
বাড়িতে তখন ছোট ফুপ্পিরা ছিলেন। এতো মানুষের সামনে আম্মুর সাথে যে এভাবে কথা বলতে নেই তা সেই অন্ধ রাগের মাথায় খেয়াল রইলো না। আর যতক্ষণে খেয়াল হলো ততক্ষণে অনেক দেরী। আম্মু আমার লাল হয়ে থাকা গালটাতেই সটান একটা চড় বসিয়ে দিয়ে একটানে বন্ধ করে দিলেন রান্না ঘরের দরজা। রাগে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে নিচু কন্ঠে হিসহিসিয়ে বললেন,
' আর কত জ্বালাবি? লজ্জা তো নেই, না? মানা করেছিলাম না নাহিদের সাথে কথা বলতে? কাল আবার ওর সাথে একা ছাদে ছিলি তুই। ঘরে বসে হিহি করেছিস। এতোই গুণ আমার মেয়ের অন্যের মুখে নিজের মেয়ের গুণকীর্তন শুনতে হয়। এতো গুণ নিয়ে মরে যেতে পারিস না?'
আমার চট করে রেগে যাওয়া স্বভাব। কাল রাত থেকে পরপর ঘটে যাওয়া এতো ঘটনায় রাগ, অভিমান, অপমানে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতোই বিস্ফোরিত হলো মন। 'অন্যের মুখে' শব্দটা শুনেই শুভ্র ভাইয়ের কথা মাথায় এলো প্রথম। মাথা ছেঁড়া রাগ নিয়ে রান্নাঘরের দরজাটা খুলে নিজের ঘরে গিয়েই শান্ত কন্ঠে বললাম,
' আপু, বাইরে যাও।'
আমার লাল হয়ে যাওয়া টলমলে চোখের দিকে চেয়ে চমকে উঠলো রাফিয়া। আপুর দিকে একবার চেয়ে আমার দিকে চাইল,
' কী হয়েছে রোদু?'
এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
' যেতে বলছি না আমি?'
রাফিয়া যেন কেঁপে উঠল এবার। আপু কোনো রকম প্রশ্ন না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তার পেছন পেছন এক রকম ছুটে বেরিয়ে গেল রাফিয়া। আমি প্রচন্ড শব্দ করে দরজা লাগালাম। এক মুহূর্তের জন্য যেন কেঁপে উঠলো গোটা বাড়ি। ঝুপ করে নিস্তব্ধতায় ডুবে গেল বাড়ির প্রতিটি ঘর, মানুষ। কোথাও, কেউ 'টু' শব্দটি পর্যন্ত করল না। ঠিক সেইদিন থেকেই বুঝি সমস্যাটা শুরু হলো আমার। এতোগুলো মানুষের সামনে অপমান, কাল রাতের অপমান সব মিলিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ছুঁড়ে ফেললাম সামনে যা পেলাম সব। এই প্রথমবারের মতো! বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা শান্ত হয়ে শুভ্র ভাইকে ফোন লাগালাম আমি। শুভ্র ভাই যে শুধু ফোন তুললেন না তা নয় টুপ করে কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখলেন ফোন। আমার রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। একের পর এক অপমানের ধাক্কা, আত্মসম্মানের ব্যথায় অন্ধ প্রায় হয়ে গেলাম আমি। প্রচন্ড জেদ নিয়ে মামানিকে ফোন লাগালাম। মামানি দ্বিতীয়বারে ফোন রিসিভ করলেন। স্বভাবজাত আদুরে কন্ঠে বললেন,
' হ্যালো, রোদু? ভালো করেছিস ফোন করেছিস। আমি তোর মামুর সাথে নতুন বাজার এসেছি একটু। সেদিন না কী ফলের কথা বললি? ড্রাগন না কী নাম? নামটা সুন্দর করে বল তো কিনে নিয়ে যাই।'
আমি ঝুপ করে শান্ত হয়ে গেলাম। ঢিলে পড়ে গেল মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন। নরম কন্ঠে বলল,
' ড্রাগন, মামানি।'
' আচ্ছা। আজ বিকেলে এসে পড়িস। আগে ফাঁকি দিয়ে শুভ্র আর তোর মামুকে খাওয়াব। ওরা যদি ভালো রিভিউ দেয় তাহলে আমরা খাবো নয়তো মুখ নষ্ট করার দরকার নেই।'
মামানির সরল কথায় রাগ ধরে রাখতে না পেরে হেসে ফেললাম আমি। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই একটা মামানির জন্য হাজারটা বেয়াদব শুভ্রকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় শুধুমাত্র এই মায়াময় রমণীর পুত্র হওয়ার শর্তে। আমি সাবধানে শুধালাম,
' মামানি তোমার ছেলে কই?'
' শুভ্র? ওকে তো বাসায়ই রেখে এলাম।'
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মৃদু কন্ঠে বললাম,
' আচ্ছা। রাখছি।'
মামানি মন খারাপ করা কন্ঠে বললেন,
' আবার ঝগড়া করেছিস না? ফাজিলটার মুখ দেখেই বুঝেছি। শোন না, মা? আজ বেশি বকিস না, হ্যাঁ? মুড ঠিক নেই মনে হলো। সকাল থেকে ফোলে আছে। আমি ওকে বকে দিব। শুধু বকে দিব কী? এক চড়ে দাঁত ফেলে দিব।'
আমি হেসে ফেলে বললাম,
' আচ্ছা।'
মামানি খুশি মনে ফোন রাখতেই থম ধরে বসে রইলাম আমি। মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় আগের সেই তেজ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলাম। বুঝতে পারলাম, শুভ্র ভাইয়ের সাথে কঠিন একটা বোঝাপড়া না করে মামানিকে ফোন দেওয়া উচিত হয়নি। এই রমণীর সাথে কথা বলে কিছুতেই রাগ ধরে রাখা যায় না। আমি কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খোললাম। বাসায় তখন পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমি স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এসে মূল দরজার দিকে এগুতে এগুতে তার থেকেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,
' মামানির কাছে যাচ্ছি আম্মু। মামানি ফোন দিয়েছিল। একঘন্টার মধ্যেই চলে আসব।'
আম্মু কিছু বললেন না। ছোট ফুপ্পীর তীক্ষ্ণ চাহনি পিছনে ফেলে চুপচাপ বেরিয়ে এলাম আমি। মামুদের বাসায় এসে সিঁড়িতে পা রাখতেই মনোবল ভেঙে যেতে লাগল আমার। বুক ধুকপুক করতে লাগল। কেন এসেছি, কী বলতে এসেছি সবই যেন গুলিয়ে গেল। আমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় কলিংবেল চাপলাম। একবার, দু'বার, তিনবারের সময় খুঁট করে দরজা খুললো। আমার হৃদযন্ত্রটা যেন ক্ষনিকের জন্য থেমে গিয়ে আবারও চলতে শুরু করলো দুর্দমনীয় তেজে। শুভ্র ভাই দরজাটা একটু খুলে, ডানহাতটা দরজায় রেখে দরজা আগলে দাঁড়ালেন। উনার গায়ে তখন ছাই রঙা টি-শার্ট। কালো থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট। মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল। গালে অযত্নে বেড়ে উঠা ছোট ছোট দাঁড়ি। আমি কী বলব বুঝে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। শুভ্র ভাই আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলেন। ভ্রুতে মৃদু ভাঁজ। গম্ভীর কন্ঠে একদম অপরিচিতের মতো বললেন,
' আম্মু বাসায় নেই।'
আমি ভ্রু উঁচিয়ে চাইলাম। ধীরে ধীরে নিজের সত্তায় ফিরে এসে বললাম,
' তো?'
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,
' আমি আপনার আম্মুর সাথে দেখা করতে আসিনি। আপনার সাথে কথা আছে। সরুন।'
শুভ্র ভাই হালকা সরে দাঁড়ালেন। আমি হালকা তেজ নিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। শুভ্র ভাই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চাইলেন। দরজা বন্ধ করলেন না। আমি চোখ বন্ধ করে গোটা ব্যাপারটা মনে করে রেগে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চেষ্টা সফল হলো না। এই মুহূর্তে রেগে যাওয়া যাচ্ছে না। শুভ্র ভাইকে গভীরভাবে আঘাত দিতে চাওয়া প্রতিশোধস্পৃহা মনটা যেন হতাশ হলো। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
' আপনি আম্মুকে কী বলেছেন?'
শুভ্র ভাই জবাব না দিয়ে একভাবে চেয়ে রইলেন আমার গালে। যেখানটাতে আম্মুর পাঁচ আঙুলের ছাপ অঙ্কিত হয়ে থাকার কথা স্বগর্বে, ঠিক সেখানটাতে। আমি উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
' কী বলেছেন?'
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। আমার কথা তার শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা বুঝা গেল না। তিনি একদৃষ্টে আমার গালের দিকে চেয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠল পেশী। কপালের অদৃশ্য রগটা ধপ করে জ্বলে উঠল উত্তেজনায়। চোয়াল শক্ত করে আমার হালকা ফোলা চোখের দিকে চাইলেন। গমগমে কন্ঠে বললেন,
' কেন মারল?'
আমার দপদপে রাগ ফিরে এলো মৃদু মৃদু। ঘৃণাভরে বললাম,
' কেন মারল! জানেন না কেন মারল? এখন খুশি আপনি? আপনার মানসিকতা এতো নিচু কী করে হয় শুভ্র ভাই? ছি! লজ্জা করে না আপনার?'
শুভ্র ভাই উত্তর না দিয়ে একভাবে চেয়ে রইলেন। গম্ভীর, শান্ত কন্ঠে বললেন,
' ভাষা ঠিক কর। রাগের মাথায় এমন কিছু বলে ফেলিস না যার জন্য পরে পস্তাতে হয়।'
আমার ভাষা ঠিক হলো না। রাগে লাল হয়ে বললাম,
' পস্তাতে হয়? পস্তানোর কিছু বাকি আছে নাকি আমার জীবনে? আপনি নিজেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় রিগ্রেট, শুভ্র ভাই। কখনো আপনার কোনো ক্ষতি করেছিলাম বলে তো মনে পড়ে না। তাহলে আমার সাথেই এতো জেদ কেন? উঠতে বসতে অপদস্ত করে চলেছেন গত ছয়টা বছর ধরে। শারীরিক আঘাতের কথা নাহয় বাদই দিলাম। জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। সমস্যাটা কী আপনার?'
শুভ্র ভাই স্থির চেয়ে রইলেন। দরজাটা আরেকটু খুলে শান্ত কন্ঠে বললেন,
' বাসায় যা।'
আমি জেদ নিয়ে বললাম,
' অবশ্যই যাব। আপনার বাসায় থাকতে আসিনি আমি। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন? কোনো রাগ টাগ নেই। আপনি লিট্যারেলি একজন সাইকো। ম্যান্টালি ডিস্টার্ভড। মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলা। তাদের জীবনটাকে নরক করে দিয়ে। শান্তি শেষ করে দিয়ে আনন্দ লাগে আপনার। হু নোজ, কবে রোদ নামক পুতুলেও মন ভরে যাবে আপনার?'
শুভ্র ভাই স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। একটুও রেগে না গিয়ে সাধারণ ঠান্ডা কন্ঠে শুধালেন,
' ''মেয়েদের''? ঠিক বুঝলাম না। কয়টা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি আমি?'
' আমি, তাসনিম আপু। আমাদের চোখে পড়ছে না? নিজের বিবেককে জিগ্যেস করুন তো, তাসনিম আপুর সাথে যা করেছেন তা কী ঠিক করেছেন আপনি? মেয়েটাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছেন আপনি। আমি হাজার ভেবেও তার কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। একটা মেয়ে কতটা ভেঙে পড়লে বারবার সুইসাইড করতে যায় শুধু একটা মানুষের জন্য? এই বয়সে এসেও এতো পাগলামো করে? এসবের জন্য আপনি দায়ী নন?'
শুভ্র ভাই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন,
' তোর তো দেখি খুব মায়া। আমি বলেছিলাম তাসনিমকে সুইসাইড এট্যাম্প করতে?'
এই দীর্ঘদেহী নিষ্ঠুর পুরুষের হৃদয়হীনতায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। অবিশ্বাস নিয়ে বললাম,
' আপনার একটুও রিগ্রেট হচ্ছে না? শী লাভস্ ইউ!'
শুভ্র ভাইয়ের স্পষ্ট জবাব,
' বাট আই ডোন্ট।'
আমি হতাশ চোখে চাইলাম। ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
' কখনো তো বাসতেন?'
' কখনোই না। ইট ওয়াজ জাস্ট আ ফ্যান্টাসি।'
অতিরিক্ত উত্তেজনায় দপদপ করে উঠল মাথার রগ। নেতিয়ে এলো শরীর। ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
' আপনার ফ্যান্টাসিতে একটা মেয়ে তার স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে শুভ্র ভাই। অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে। আমার ভাবতেই কান্না পায়, মেয়েটা বুঝি রোজ রোজ মারা যাচ্ছে। সবাইকে লুকিয়ে রাতের পর রাত কাঁদছে। আমাকে দোষারোপ করছে। আমার মৃত্যু কামনা করছে। এসব ভাবলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে শুভ্র ভাই। নিজেকে দোষী মনে হয়। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না। তাকে জানাতে ইচ্ছে করে, আমিও তার মতোই একজন। গুরুত্বহীন! এক্সপায়ার্ড! আপনি আমাকে তাসনিম আপুর মতোই ভেঙে দিতে চাইছেন তাই না? তারপর নতুন কেউ? ছি! ছি! আপনাকে আমার আর সহ্য হচ্ছে না।'
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। দরজার হাতল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি দপ করে বসে পড়লাম সোফায়। শুভ্র ভাই একভাবে চেয়ে রইলেন আমার মুখে। কোনো উত্তেজনা নয়। কোনো রাগ নয়। আগের শুভ্র ভাইয়ের লেশমাত্র নয়। খুবই অপরিচিত মানুষ হয়ে, বহু দূর থেকে বললেন,
' দেন ডিভোর্স মি।'
আমি চমকে উঠলাম। স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললাম,
' মানে?'
শুভ্র ভাই ম্লান হাসলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন। চোখের দিকে চেয়ে বললেন,
' তুই ঠিক বলেছিস। আই এ্যাম আ সাইকো হাঙ্ক। তোর সাথে খেলা শেষ। দ্য গেইম ইজ ওভার। নাউ গেট লস্ট ফ্রম মাই লাইফ।'
আমি স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। মাথাটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল হঠাৎ। আশেপাশের কোনো কিছুই যেন বোধগম্য হচ্ছে না। শুভ্র ভাই অপলক চেয়ে থেকে বললেন,
' কনগ্রাচুলেশনস্ ফর ইউর আপকামিং ফ্রীডম।'
আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। খুব চেনা মানুষটির অচেনা রূপে পৃথিবী দোলে উঠল আমার। শুভ্র ভাই উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
' গেট লস্ট।'
অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে রইলাম উনার চোখে। শুভ্র ভাই চোখ সরিয়ে নিলেন।
' ইউ আর আস্কিং মি ফর ডিভোর্স? আপনি আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন? কাল থেকে তাসনিম আপুর মতো আমিও আপনার একটা ফ্যান্টাসী হয়ে যাব? কী করে পারলেন!'
শুভ্র ভাই চোখ ফিরিয়ে রেখেই ম্লান হাসলেন,
' ছেড়ে দিচ্ছি না। আমায় ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। নিজেকে কারো কাছে রিজেক্টেড হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। যা গত ছয় বছরে দিইনি, আজ দিলাম। যদি মুক্তি মানে ভালোবাসা হয়, তবে তাই হোক গল্পের সমাপ্তি। আমাদের গল্পের সমাপ্তি এখানেই রোদপাখি। আমার খেলাটাও শেষ এখানেই। তোকে আর আমার চাই না। তাসনিম যেমন আমার টাইপ ছিল না। তেমনই ইউ আর নট মাই টাইপ।'
একটু থেমে আমার বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে শুষ্ক হাসলেন। দরজাটা আরেকটু খোলে দিয়ে বললেন,
' এই ছয় বছরে তোর জীবন নষ্ট করে ফেলার জন্য, নরক বানিয়ে দেওয়ার জন্য এক্সট্রেমলি সরি। এই মুহূর্ত থেকে তোর জীবনের কোথাও শুভ্র নামের ছায়া থাকবে না। হাজবেন্ডের মতো বিহেভ কখনো করেছি কিনা জানিনা। তবুও ওটাও...।'
আবার থেমে গেলেন শুভ্র ভাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন,
' প্রয়োজনে ওটাও মিটিয়ে নিস। শুভ্রহীন জীবন সুন্দর হোক। নাউ... নাউ গেট লস্ট।'
সেদিন শুভ্র ভাইয়ের বাসা থেকে কী করে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি জানি না। সেই বিকেলটিতে আমার সাথে কী ঘটেছিল। চারপাশে কী ঘটছিল আজ আর বলতে পারি না। সবকিছু ধোঁয়াশা কিন্তু কী তীব্র কষ্টের! আমি এখনও সেই কষ্ট উপলব্ধি করি। টের পাই। একলা ঘরে থাকলে আমার বুক কাঁপে। চোখ জ্বলে। মনে মনে বুঝতে পারি, সব মুক্তি সুখের হয় না। কিছু কিছু মুক্তি কত অসহয়নীয়! কত ব্যথার! মুক্তি মানে আনন্দ। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় মুক্তিটি পেয়েও কোথাও একটা তীব্র ভাঙনে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। যে যায় বলুক। যা ইচ্ছে শোনাক পৃথিবী। সমালোচকরা হাসুক। কিন্তু সেই তীব্র কষ্ট। পৃথিবী ভাঙা কান্না আমি আটকে রাখতে পারিনি। অথচ সেদিন আমি অসহায়। মুখ ঢেকে কাঁদার মতো একটি বিশ্বস্ত কাঁধের কী অভাব৷ এতো চঞ্চল, এতো ছটফটে আমিটা যে এতো মুখচোরা তা সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি আমি। বুঝতে পারি আরও একটি তীব্র সত্য, মন খারাপ শেয়ার করতে না পারা আমার মন খারাপটা বুঝে নিতে পারতো শুধু একজন। শুধুমাত্র একজন। কেবলমাত্র আমার মন ভালো করার জন্য করতে পারতো হাজারও যুদ্ধ জয়। পাড়ি দিতো হাজার মাইল দূরত্ব। এই তীব্র সত্যগুলো বুকে কেমন তোলপাড় করছিল আমার। শুভ্রহীন এই পৃথিবীটা যে কী নিষ্ঠুর লেগেছিল সেদিন, সেটা কী আদৌ লিখে প্রকাশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তবে আমি কেন পারছি না? বুকের সব কষ্টটুকু এই কাগজের পাতায় ঢেলে দিতে পারছি না কেন? আত্মসম্মানের দায়ে পড়ে শুভ্র ভাইকে কেন বলতে পারছি না, ' শুভ্রহীন পৃথিবী সুন্দর নয়। সুন্দর হবে না কখনো। শুভ্রহীন ভয়ানক পৃথিবীটাতে তার রোদপাখির গা ছমছমে ভয়।' শুভ্র ভাই কেন আর একবার ডাকলেন না আমায়? জোর করলেন না? ধমক দিলেন না? ছাদ থেকে ফেলে দেখার ভয় দেখালেন না? আমি অতোটাও বড়ো হইনি নিশ্চয়? আমার এই কষ্টটা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আমি এই কষ্টটুকু কাউকে বলতে পারছি না। মাকে নয়, বাবাকে নয়, আপুকে নয়, ভাইয়াকে নয়, প্রিয় কোনো বন্ধুকে নয়। আমার একদম নিজস্ব এই কষ্টটা শুভ্র ছাড়া কারো বুঝার নয়। ঠিক সেদিন থেকে সমস্যাটা শুরু হলো আমার। পৃথিবীটা শুভ্রহীন হতেই। তার প্রশ্রয়ের বাঁধ, আগলে রাখা হাত সরে যেতেই একের পর এক জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমি। শুরু হলো, বিষণ্ণতার দীর্ঘ কাল। মনে পড়ে গেল তাসনিম আপুর তীব্র সত্য কথা, ' শুভ্র একটা বিষ রোদেলা। আমি সেই বিষ স্বেচ্ছায় সেবন করেছিলাম। তুমি করেছ জোরপূর্বক। শুভ্র নামক বিষে কেউ ভালো থাকতে পারে না। তুমিও ভালো থাকবে না। আমাদের পরিণতি এক। এবার কেবল সময়ের অপেক্ষা।'

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৫৭ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


নৌশিন আহমেদ রোদেলা’র গল্প ও উপন্যাস:

লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন