উপন্যাস        :        দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা        :         তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
Bangla Golpo দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা

৪০ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৪১)


(ক)

বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে সারারাত দোলা কেটে কাটিয়েছে৷ ফলস্বরূপ নিদ্রাহীন ফোলা ফাপা চোখের নিচে কালি জমেছে বেশ। ঘড়ির কাটায় বাজে ১১টা। অথচ এখনো দোলা বের হলোনা রুম থেকে। ব্যাপারটা পারভীন বেগমকে চিন্তায় ফেলে দিলো। তার মেয়ে সকাল সকাল উঠে পড়ার মানুষ। "আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ" প্রবাদটাকে ছোট থেকেই অনুসরণ করে মেয়েটা। ফলে, শিমুল ও কামিনির মতো অলস নয় ও। ঘুমোবে যেমন তাড়াতাড়ি আবার উঠবেও সকাল সকাল। সেই মেয়ের এমন বেলা করে উঠায় মায়ের মনে খটকা লাগলো! তার দোলনের শরীর খারাপ হয়নি তো?
চিন্তাগ্রস্ত পায়ে হেটে দোলাত রুমের দরজা খুলতে যেয়ে পারভীন বেগম দেখেন দরজা ভেতর থেকে লক করা। এবার তার আরেকটু খটকা লাগলো। দোলা সাধারণত কখনোই দরজা এভাবে লক করে ঘুমায়না। তবে আজকে এসব অদ্ভুত আচরণের মানে কি? হয়েছেটা কি ওর? একরাশ চিন্তা নিয়ে মেয়ের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কিয়ে নক করলেন তিনি।
দোলা মাটিতে বসে খাটে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো। মূলত ভোরের আলো ফোটার পর কাদতে কাদতে কখন যে ওভাবে ওখানে ঘুমিয়ে গেছে ও নিজেও বুঝেনি। আর ঘুমোতে সকাল হয়ে যাওয়ায় এখনো ও ঘুমে মগ্ন। এদিকে পারভীন বেগম একনাগাড়ে দরজা ধাক্কিয়েই যাচ্ছেন, ফলে কিছুক্ষণের মাঝেই দোলার কানে আওয়াজ এলো।
দোলা স্তম্ভিত ফিরে পেতেই নিজের অবস্থান দেখে চমকে উঠলো। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে পড়লো সমস্ত ঘটনা। এক ঝটকায় মাটি থেকে উঠে দাড়াতেই শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠলো। কিন্তু এখন কিছু করার নেই, মা সমানে ডেকেই চলছেন। দোলা ঘুম ভাংগা কণ্ঠে জবাব দিলো,
---দুই মিনিট দাও, মা। দরজা খুলছি!
এতক্ষণে মেয়ের আওয়াজ পেয়ে পারভীন বেগম কিছুটা শান্ত হলেন। ডাকাডাকি বন্ধ করে অপেক্ষা করলেন ওর জন্য। দোলা চটপট ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মুখে একনাগাড়ে পানি দিয়ে চোখমুখের বেহাল দশা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। খানিকবাদে বেরিয়ে দরজা খুলে মা-কে দেখে ইতস্তত হেসে রুমে ঢোকার জায়গা করে দিলো। পারভীন বেগম একবার মেয়ের দিকে তো একবার রুমের আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলেন। দোলার বিমুঢ় প্রাণহীন চেহারা দেখেই তার কলিজা শুকিয়ে এলো! অর্থাৎ, তার মনে এমনি এমনি কু ডাকেনি। কিছু একটা দুঃসংবাদ নিশ্চয়ই আছে। তাই তিনি আর দেরি না করে মেয়েকে নিয়ে খাটে বসলেন। দোলা মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে নিচু হয়ে আছে শুধু। এরই মাঝে পারভীন বেগমের যা অনুমান করার তিনি করে নিলেন। মেয়ের গালে হাত রেখে কণ্ঠ কোমল করে বললেন,
---কি হয়েছে আমার সোনা মেয়েটার? চোখমুখের এই অবস্থা কেন, মা?
ব্যস! মায়ের মধুর ডাকে এবার দোলনচাঁপার সংযমে ভাটা পড়লো। এতক্ষণ বুকের মাঝে চাপিয়ে রাখা কষ্ট বাধভাঙ্গা নদীর মতো কলকল করে বেরিয়ে এলো। হু হু করে কেদে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নীড়হাড়া পাখির মতোন আশ্রয় খুজলো মায়ের বুকে। পারভীন বেগম পরম মমতায় মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে নিরব সান্ত্বনা দিলেন। কেদে মন হালকা করার সুযোগ দিলেন। খানিকবাদে দোলা সামান্য থামতেই উনি সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলেন,
---নিশীথের পরিবার রাজি হয়নি, তাই না?
দোলা মায়ের বুকেই মাথা নেড়ে জানালো "না"। পারভীন বেগম নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনি মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিলেন দেখা গেলো শেষমেশ সেটাই হলো! তার ফুলের মতো মেয়েটার মন ভেঙে গেলো! তবু মায়ের মন, কি করে মেয়ের কষ্ট দেখেন? দোলার মন ভোলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
---নিশীথ আর কিছু বলেছে? যে ওর কোনো চিন্তাভাবনা আছে কিনা। নাকি সে-ও পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে?
দোলা এবার মাথা তুললো। সোজা হয়ে বসে হাত দিয়ে চোখ মুছে নাক টানতে টানতে বললো,
---উনি তো পাগল। বলছিলেন পালিয়ে বিয়ে করতে! যেন সবকিছু এতই সোজা?
কথাটা বলে দোলার একটু হাসি পেলো নিশীথের তখনকার অবস্থা মনে পড়ে! কিন্তু মায়ের সামনে ও নিজেকে হাসা থেকে বিরত লাগলো। এরই মাঝে পারভীন বেগম একটু হাসলেন। হেসে বললেন,
---ভালোই বলেছে তো। ভালোবাসার মানুষের সাথে পরিবার বিয়ে না দিলে সে বেচারাও আর কি-ই বা বলবে? তা কবে বিয়ে করছিস তোরা?
মায়ের কথায় দোলা প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো। এতটাই যে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলো মায়ের মুখপানে। বিস্ময়ের সাথে বললো,
---কিহ! ভালো বলেছে মানে? তুমি এ কথা বলছো, মা? আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা!
খানিকটা থেমে বললো,
---আর আমরা যদি পালিয়ে বিয়ে করি তবে কতকিছু হবে তুমি ভাবতে পারছো?
---কি হবে?
পারভীন বেগমের ভাবলেশহীন জবাব। দোলা ভড়কে যায়। থতমত খেয়ে মা-কে ওসব কথাই বলে যা ও নিশীথকে বলে এসেছে কাল রাতে। পারভীন বেগম মনোযোগ দিয়ে সব শুনেন। শুনে গম্ভীর হয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
---তোর কি নিশীথকে ভালো লাগে?
দোলা তাকাতেই উনি জোর গলায় বললেন,
---হ্যাঁ নাকি না? স্পষ্ট জবাব দিবি এবার আমাকে!
দোলা চুপচাপ হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ে। পারভীন বেগম প্রসন্ন হোন। কিছুক্ষণ কিসব ভেবে মেয়েকে বললেন,
---তোর একটা বিয়ে ভেঙে গেছে। সমাজে এমনিতেই মানুষ তোকে নিয়ে কম কথা বলছেনা। সেটা তুই নিজেও জানিস। রাকিবের দোষ থাকা সত্ত্বেও একটাবার তুই দেখেছিস কেউ ওকে দোষারোপ করেছে? উল্টো আমাদের আত্মীয়দের মাঝেই মানুষ তোকে নিয়ে খারাপ কথা বলছে। তাহলে নিশীথ যখন সাহস করে তোকে বিয়ে করে তোর দায়িত্ব নিতেই চাইছে তখন তুই এভাবে পিছপা হচ্ছিস কেন এ সম্পর্ক থেকে?
দোলা থমথমে মুখে শূন্যে চেয়ে রয়। মা যে নেহাৎ মিথ্যে কথা বলছেন তা-ও নয়। বরং নিশীথের সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও যাদের ওকে নিয়ে বাজে কথা বলার ওরা ঠিকি বলে যাবে। ওদের তো থামাতে পারবেনা। তবে কেন ওদের জন্য শুধু শুধু নিজের সুখ-শান্তি নষ্ট করবে ও? এরই মাঝে পারভীন বেগম আবারও বললেন,
---আমি তোকে পালিয়ে বিয়ে করতে উৎসাহ দিচ্ছি এমনটা ভাবিস না। আমি নিজেও কোনোদিন চাইনি আমার কোনো মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করুক। কিন্তু তোর পরিস্থিতি ভিন্ন৷ নিশীথ তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর আমি জানি মনে মনে তুই নিজেও নিশীথকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তাই তোদের পরিস্থিতিতে যদি একেবারেই কিছু সম্ভব না হয় তবে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই।
---উনার পুরো পরিবার রাজি, মা। শুধু তার বাবা ছাড়া। কিন্তু নিশীথ বললেন উনি আংকেলকে রাজি করাতে পারবেন না, তিনি নাকি সুবিধার না। তিনি অন্য মেয়ের সাথে নিশীথের বিয়ে ঠিক করতে চাইছেন। এজন্যই আমায় নিয়ে রাজি হচ্ছেন না!
---তাহলে দেখ কিছুদিন কি হয়। আমি তাড়াহুড়োর কথা বলছিনা। তবে এক্ষেত্রে আমি নিশীথের পক্ষে। আর আমার এসব বলার পেছনে যথাযথ কারণও আছে৷ শোন দোলা, নিশীথ যতই তোকে ভালোবাসুক না কেন দিনশেষে ও কিন্তু একটা ছেলেমানুষ। তুই যদি এখন পাত্তা না দিস বা সম্পর্ক ভেঙে দিস তবে তুই হয়তো সহজে ওকে ভুলতে পারবিনা। কিন্তু নিশীথ যদি একবার বাপের কথায় বিয়ে করে নেয় তবে ওর মুভ অন করতে সময় লাগবেনা। তোর কি সেটা ভালো লাগবে? ভেবে বল তো!
এবার দোলার টনক নড়লো। মনে মনে নিশীথের সাথে অন্য মেয়েকে কল্পনা করতেই ওর প্রেমিকা মনে মেয়েলি হিংসা জাগ্রত হলো তীব্রভাবে। কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতেই দোলার চোখমুখ শক্ত হলো, ফর্সা নাকের ডগা লাল হলো। সে তো এভাবে ভাবেইনি? নিশীথ অন্য কারও হলে কি ও সইতে পারবে? একদম পারবেনা। এবার মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দোলা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।
মস্তিষ্ক বলছে, এভাবে বিয়েটা করা উচিত হবেনা। পাছে লোকে কি বলবে?
অন্যদিকে মন বলছে, নিজের মানুষকে কাছে পেয়ে যদি একটু কটু কথা শুনতেই হয় তবে ক্ষতি কোথায়?

(খ)

নিশীথ বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। দোলার বারবার প্রত্যাখ্যানের ফলে রাগ ও জি'দের বশে ও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরো পরিবার নিশীথের সিদ্ধান্তে অবাক হলেও এ মুহুর্তে সবচেয়ে খুশি একটাই মানুষ- আয়মান তালুকদার। উনার বহু আকাংক্ষিত ইচ্ছা যে অবশেষে পূরণ হতে চলেছে! তাই এ শুভকাজে আর দেরি করা উচিত নয় বলে তিনি মনে করছেন। যদি পরে নিশীথের মন পাল্টে যায় তবে? এজন্যই ঘরোয়া আয়োজনে কাল দুপুরে বাদ জুমা নিশীথ লিরার বিয়ে পড়ানো হবে! শুধুমাত্র দুই পরিবারের লোকজনদের নিয়ে হতে চলা ঘরোয়া এ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানলোনা তেমন কেউ। তবু খবর পেয়ে গেলো নিশীথের বন্ধুমহল। ওরা যেমন অবাক হলো, একিসাথে নিশীথের জি'দ এর কাছে হেরে ওকে কোনোকিছু বুঝাতে ব্যর্থ হলো। সবচেয়ে চমকে গেলো তূর্য, কেননা নিশীথ ও দোলার প্রণয়ের অনেকটাই সে নিজ চোখে দেখেছে। কতো সময় তো ও নিজেই হেল্প করেছে ওদের প্রেমে! অথচ এখন কিনা শেষ মুহুর্তে এসে এরকম হবে? নিশীথকে বুঝাতে না পেরে তূর্য অন্য ফন্দি আটলো। ও চলে গেলো দোলার কাছে। দরজা খুলে তূর্যকে দেখে দোলা অবাক হলো। তূর্য বললো,
---একটু বাইরে আসবেন প্লিজ? অনেক জরুরি কথা আছে আপনার সাথে।
দোলনচাঁপা অবাক হলো। তূর্য কখনো আসেনি এভাবে ওর সাথে কথা বলতে। আজ এসেছে যখন তার মানে নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলতেই এসেছে! নিশীথের কিছু হয়নি তো? দোলা মা-কে বলে তূর্যর সাথে বাইরে গেলো। বাসার বাইরে আসতেই তূর্য দোলাকে সব বলে দিলো। নিশীথ কিভাবে রাগের বশে লিরার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছে, কারও কথা শুনছেনা সবটাই ওকে বলে দিলো। সব শুনে দোলনচাঁপা আকাশ থেকে পড়লো! এ কোন নিশীথের কথা শুনছে সে? নিশীথ এমনটাও করতে পারে? অতি শোকে দোলা কথা বলতে ভুলে গেলো। চুপচাপ হতবিহ্বলের ন্যায় চেয়ে থাকার মাঝেই তূর্য আবারো বললো,
---ভাবি, এখন আপনিই কিছু করেন। আমরা ভাইয়ের বউ হিসেবে আপনাকেই মেনে নিয়েছি। আপনি ছাড়া আমরা আর কাউকেই ভাবি হিসেবে মানতে পারবোনা। প্লিজ ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যান! আমরা সবাই আপনাদের বিয়েতে সাক্ষী হবো। আয়মান আংকেলও জলদিই মেনে নিবে। তবু প্লিজ এ অঘটন ঘটতে দেবেন না!
দোলা পাথরের ন্যায় চেয়ে রইলো। ও কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারলোনা। শুধু বুঝলো, নিশীথ ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এতটাই দূরে যে এখন আর চাইলেও ও আগের নিশীথকে ফিরে পাবেনা! স্তব্ধপায়ে হেটে বাসার বাইরে বেরোতেই দোলা নিশীথকে দেখলো। তবে নিশীথের ওর দিকে ধ্যান নেই আজ! সে তো ব্যস্ত হাসিমুখে ফোনে অন্য কারও সাথে কথা বলতে। দোলার মনে প্রশ্ন এলো, আচ্ছা! ও কি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলছে? নাম কি যেন মেয়েটার? ওই লিরার সাথে! কষ্টে, হিংসায় দোলার রন্ধ্রে আ'গুন লাগলো। তনুমন জ্ব'লে গেলো! বারবার শুধু মনে হলো, এতদিন যে নিশীথ শুধু ওর ছিলো, যে ওকে এক পলক দেখার জন্য এতটা পাগলামি করতো, কাল থেকে সেই নিশীথ অন্য কারও হয়ে যাবে! জীবন এত স্বার্থপর কেন? যদি ক্ষণিকের মোহ হয়েই আসার ছিলো তবে কেন সবকিছু এত করে ওকে টানতো? দুঃখে, ক্রোধে দোলার চিৎকার করতে কান্না পেলো। মাথার মধ্যে ভীষণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে সবকিছু। চোখে ঘোলা দেখছে ও। আর কিছু বুঝবার আগেই দোলা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো!
_____________________
মুখমণ্ডল ঘেমে-নেয়ে একাকার দোলার। কপালের রগগুলোও ইষত ব্যাথায় দপদপ করছে যেন! বিছানা থেকে উঠে বসে আশেপাশে তাকাতেই সে উপলব্ধি করলো যে, এতক্ষণ ও যা দেখলো তার সবটুকুই একটা স্বপ্ন ছিলো! মায়ের সাথে কথা শেষে আরও কিছুক্ষণ ঘুমানোর উদ্দেশ্যে একটু শুয়েছিলো মেয়েটা অথচ এই চোখ লাগার বিনিময়ে ও কি দেখলো? সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে যেটা শুধুমাত্র একটি দুঃস্বপ্ন! কিন্তু দোলার কাছে যেন এ দুঃস্বপ্নই ছিলো ওর জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অনুভূতি।
সবকিছু এতটা বাস্তব, এতটা কল্পনাতীত লেগেছে যে দোলা এখনো একপ্রকার ঘোরে আছে যে কি থেকে কি হয়ে গেলো একটু আগেই! ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙেছিলো। নয়তো নিশীথের বিয়ে হওয়াটা কিভাবে সহ্য করতো ও? হোক স্বপ্ন৷ তবুও আর দশটা প্রেয়সীর মতোন অন্য কারও সাথে প্রিয়তমের বিয়ের কথা দোলা কখনোই ভাবতে চায়না, এমনকি সেটা ওর দুঃস্বপ্নেও না! একিসাথে মেয়েটা উপলব্ধি করলো, এই স্বল্পক্ষণেই নিশীথের প্রতি ওর অনুভূতিগুলো কতটা গাঢ় হয়ে গেছে! ফলে দোলার মন গললো। ও নিশীথের সাথে কথা বলতে চাইলো। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে নিশীথের নাম্বারে ডায়াল করলো। দোলার মনে এখন একটাই ভয়, নিশীথ যদি আসলেই রাগ ও জিদের বশে লিরাকে বিয়ে করতে রাজি হয়?
নিশীথ ফোন ধরলোনা। উল্টো কিছুক্ষণ রিং হতেই কেটে দিলো কল। দোলা বিস্মিত হলোনা, ও বুঝে নিশীথ রেগে আছে। কিন্তু ও যে রাগ ভাঙানোর জন্যই নিশীথকে ফোন দিয়েছিলো এ কথা ওকে বুঝাবে কে? দোলা মনে মনে হতাশ হয়! আরও কিছুক্ষণ কল দেওয়ার চেষ্টা করতেই এক পর্যায়ে নিশীথ ফোন অফ করে দেয়। দোলার মন খারাপ হয়। এবার কিভাবে যোগাযোগ করবে নিশীথের সাথে বসে বসে ভাবতে থাকে। ও যে নিশীথকে বিয়ে করতে রাজি তা ছেলেটাকে কিভাবে বুঝাবে?
____________________
পরদিন তালুকদার বাড়িতে গোল টেবিল বৈঠক বসেছে। নিশীথ সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছে, বাসায় আসেনি এখনো। ডাইনিং টেবিলে বসা সদস্যদের মাঝে আজকের আলোচনার বিষয় নিশীথের বিয়ে। বাড়ির প্রৌঢ় ব্যক্তি হিসেবে ইউনুস সাহেব নিজের মত প্রকাশ করলেন ছেলেদের সামনে। সোজাসাপটা কণ্ঠে বললেন,
---এ বাড়ির বউ ও আমার নাতবৌ হিসেবে দোলনচাঁপাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার মনে হয় আয়মান বাদে বাকি সবারও একি মতামত, কি বলিস তোরা?
আরেফিন সাহেব মাথা নাড়লেন। সায় দিয়ে বললেন,
---হ্যাঁ আব্বা। ঠিক বলেছেন আপনি। আমারও মেয়েটাকে এক দেখাতেই ভালো লেগেছে। নিশীথের পছন্দের তারিফ করতে হয়!
ছোটছেলের কথায় ইউনুস সাহেব হাসলেন। আসমা বেগমের দিকে চেয়ে বল্লেন,
---বৌমা, নিশীথের মা হিসেবে তোমার মতামতও অতি প্রয়োজন। তোমার কি মনে হয় নিশীথের বউ হিসেবে দোলনচাঁপা কেমন? তোমার ভালো লেগেছে মেয়েটাকে?
হঠাৎ নিজের নাম শুনে আসমা বেগম চারদিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ান। নিচু গলায় বললেন,
---আমার মতামত শুনে আর কি হবে, আব্বা? ছেলে আমার তার জন্য পছন্দ করে রেখেছে। শেষ মুহুর্তে এসে আমাদের জানালো। এবার আমাদের পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে কি করবো? নিশীথকে আপনি চেনেন না? ওর পছন্দ হয়েছে মানে এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও ওর যায় আসবেনা।
আসমা বেগমের ঘুরানো প্যাচানো উত্তরে ইউনুস সাহেব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। ভ্রু কুচকে বললেন,
---কি বলতে চাইছো তুমি? দোলনচাঁপাকে তোমার পছন্দ হয়নি?
আসমা বেগম মাথা নেড়ে বললেন,
---মেয়েটার মাঝে অপছন্দ হওয়ার মতো কিছুই নেই। অন্তত প্রথম দেখায় তো যেকারোই ভালো লাগবে ওকে। আমারও ভালো লেগেছে। তবে ছেলে আগে থেকে কোনোকিছু না জানিয়ে হুট করে এভাবে বিয়ের কথা বলে মেয়ে দেখালো তাই একটু কষ্ট পেয়েছি, এই আর কি! অন্য কিছু না!
এবার ইউনুস সাহেব বুঝলেন তার মনোভাব। এজন্য নিশীথের মুখে দোলনচাঁপার কথা শুনার পর থেকে এমন চুপচাপ আছেন! মায়ের এ মনোভাবের ব্যাপারে নিশীথকে জানাতে হবে, উনি মনে মনে ভাবলেন। এর মাঝে আয়মান সাহেব মুখ খুললেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন,
---মেয়েটার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই গলে হেছে নিশীথ। এই ছেলেটা আমার সারাজীবন এমন বোকামি করে গেলো। ভেবেছিলাম অন্তত বিজনেসে জয়েন দেওয়ার পর থেকে একটু লাভ-লসের ব্যাপারে চিন্তা করতে শিখবে অথচ এখনো আগের মতোই রয়ে গেলো!
---বিয়ে কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়, আয়মান। না এটা কোনো বিজনেস ডিল যে এখানে মানুষ লাভ-লস দেখবে। সারাজীবন ব্যবসা করতে করতে তুই যান্ত্রিক হয়ে গেছিস। তোর অনুভূতি মরে গেছে। এজন্যই তুই নিশীথের দিকটা বুঝতে পারছিস না! একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর যাই হোক, বিয়ের মতো সম্পর্ক টিকেনা। এ দিকটা তোর ভাবার দরকার আছে!
এতক্ষণ গম্ভীর মুখে থাকলেও বাবার কথা শুনে এবার আয়মান সাহেবের মুখে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাসি। চোখেমুখে ছেয়ে গেলো অদ্ভুত তিক্ততা। যেন অতীতের কিছু মনে করছেন সেভাবে মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্য করলেন! কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,
---তুমি এ কথা বলছো, আব্বা? আজ নাতির প্রতি ভালোবাসায় তুমি অন্ধ হয়ে গেছো বলে নিজের...
---অনেক বলেছিস তুই। চুপ কর এখন। সব জায়গায় সবকিছু বলতে হয়না তোর মাথায় রাখা উচিত ব্যাপারটা!
ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে কঠোরভাবে বলে উঠলেন ইউনুস সাহেব। আয়মান সাহেব ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। বড় এক শ্বাস ছাড়লেন ইউনুস সাহেব নিজেও। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
---যেহেতু আয়মান বাদে আমাদের সবারই দোলনচাঁপাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে পছন্দ, সুতরাং আমাদের এ ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ, নিশীথকে আমরা সবাই চিনি। ও নিজের ইচ্ছার বাইরে কোনোকিছু করেনা এটা জানা কথা। ও যখন বলেছে ও শুধু দোলনচাঁপাকেই বিয়ে করবে, তার মানে যেভাবেই হোক না কেন নিশীথ ওকেই বিয়ে করবে! ছেলেমেয়ে দুজনই এডাল্ট, এখন মাঝখান থেকে আমরা রাজি না হলে ওরা যদি আলাদা ভাবে নিজেরা বিয়ে করে নেয় তবে খামোখাই দু'পরিবারের বদনাম হবে! তাই আমার মনে হয় কাল-বিলম্ব না করে আমাদের দোলনচাঁপার মায়ের সাথে এ বিষয়ে বসে কথা বলা উচিত! যত দ্রুত ওদের বিয়ে দেওয়া যায় তত ভালো হবে! আয়মান, আমার মনে হয় এ ব্যাপারে তোর কোনো আপত্তি নেই। কি বলিস?
উনার কথায় ডাইনিং এ বসা সকলেই মাথা নেড়ে সায় দিলো। আয়মান সাহেব সব দেখে টেবিল থেকে উঠে দাড়ালেন। চেয়ার ছেড়ে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
---যা মন চায় করো!
ইউনুস সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যাক, এবার বেপরোয়া তার নাতিকে ঘরে টেনে আনার ব্যবস্থা করা যাবে!


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৪২ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন