গীতিকবিতা : তোমাকে চাই
কবি : কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়)
অ্যালবাম : তোমাকে চাই
প্রকাশকাল : ১৯৯১ ইং
![]() |
তোমাকে চাই || কবীর সুমন |
তোমাকে চাই || কবীর সুমন
কবীর সুমনের এই কালজয়ী গানটি প্রথমে কলকাতার শিশির মঞ্চে আয়োজিত এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে প্রথমবার প্রকাশিত হয়। এর পরে আসে ক্যাসেটে। সেসময় বেশিরভাগ অ্যালবাম বের হতো গ্রামোফোন ডিস্কে। কিন্তু স্রোতের উল্টো হেটে আধুনিকতার সঙ্গী হয়েছিলেন কবীর। তিনি গ্রামোফোন ডিস্কের বদলে অডিও ক্যাসেটে ফ্রকাশ করেছিলেন পুরো অ্যালবাম।
প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধ্যের অবকাশে তোমাকে চাই
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই
কবেকার কলকাতা শহরের পথে
পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে
অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই
চৌরাস্তার মোড়ে, পার্কে, দোকানে
শহরে, গঞ্জে-গ্রামে, এখানে-ওখানে
স্টেশন, টার্মিনাস, ঘাটে-বন্দরে
অচেনা ড্রয়িং রুমে, চেনা অন্দরে
বালিশ, তোশক, কাঁথা, পুরোনো চাদরে
ঠাণ্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে, চৌকাঠে, মাদুরে, পাপোশে
হাসি, রাগ-অভিমানে, ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই
শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে
হঠাৎ পড়তে বসা আবোলতাবোলে
অবোধ্য কবিতায় ঠুংরি খেয়ালে
স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে
সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে
ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্ত'র সুরে
সেই কবেকার অনুরোধের আসরে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
অনুরোধে-মিনতিতে তোমাকে চাই
বেদনার আর্তিতে তোমাকে চাই
দাবীদাওয়া-চাহিদায় তোমাকে চাই
লজ্জা-দ্বিধায় আমি তোমাকে চাই
অধিকার বুঝে নেয়া প্রখর দাবীতে
সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে
ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়
গদ্যের যুক্তিতে বাঁচার আশায়
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়
দ্বিধাদ্বন্দের দিন ঘোচার স্বপ্নে
সাম্যবাদের গান ঘুমে জাগরণে
বিক্ষোভে-বিপ্লবে তোমাকে চাই
ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই
শান্তি-অশান্তিতে তোমাকে চাই
এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই
প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই
এই গীতিকবিতার অ্যালবাম প্রসঙ্গে কবির কথা :
‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামটি কিন্তু গানের বাজারে নাম করতে কয়েক মাস সময় লেগে গিয়েছিল। শুনেছি, প্রথম দিকে অ্যালবামটি মোটেও বিক্রি হয়নি। পরে হতে শুরু করেছিল। অ্যালবামটি প্রকাশ করার সময় এইচ.এম.ভি একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তারপর আর নয়। ‘তোমাকে চাই’ কে কেন্দ্র করে নানান নাটক হয়েছে সে সময়। কিন্তু সব চেয়ে নাটকীয় যে ঘটনা সেটি ওই অ্যালবামটি মানুষের কাছে পৌঁছানর ক্ষেত্রে। গান বাজনার রেকর্ড সারা পৃথিবীতেই সর্বযুগে জনগণের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে বেতারের মাধ্যমে। আমাদের দেশ তার ব্যাতিক্রম নয়। বরাবর রীতিটি ছিলঃ রেকর্ড বেরবে, তারপর তা বেতার থেকে প্রচারিত হবে। বেতারে না বাজলে কোনও গানের রেকর্ড বৃহত্তর সমাজে প্রচারিত হওয়ার কোনও উপায়ই বলতে গেলে ছিল না। ‘তোমাকে চাই’ যখন বেরল, আকাশবানীর এফ.এম. বেতারপ্রচার তখনও শুরু হয়নি। আকাশবাণী মিডিয়াম ওয়েভ অনুষ্ঠানে মিউজিক ক্যাসেট বাজানোর নিয়ম ছিল না, রীতি ছিল শুধু গ্রামোফোন ডিস্ক বাজানোর। ‘তোমাকে চাই’ বেরিয়েছিল ডিস্ক হিসাবে নয়, ক্যাসেট হিসাবে। সুতরাং প্রকাশের সময় বা তার কয়েক বছরের মধ্যে এই অ্যালবামের কোনও গান আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়নি। এত বড় একটা বাধা সত্ত্বেও গানগুলি সাধারণ শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল শুধু মানুষে-মানুষে মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়া কথার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘তোমাকে চাই’ এর একমাত্র বিজ্ঞাপন। তাদের উৎসাহই এই অ্যালবামটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল দিকে দিকে।
কবি সংক্ষেপ : ১৯৪৯ সালের ১৬ মার্চ ভারতের ওড়িশায় জন্মগ্রহন করেন গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার ও সাবেক সংসদ সদস্য কবীর সুমন। অবশ্য তখন তিনি ছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। ২০০০ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় পূর্ব নাম ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৯২ সালে তোমাকে চাই শিরোনামের অ্যালবামের মাধ্যমে বাংলা সংগীতজগতে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। এরপর এক এক করে ১৫টি স্বরচিত গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেন কবীর সুমন। ২০০৯ সালে বহুল জনপ্রিয়তার কারণে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন এই কিংবদন্তী।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন